তৃতীয় অধ্যায়: ময়দানে প্রত্যাবর্তন-তৃতীয় পরিচ্ছেদ: মিশরের অভিযান সমূহ
(পুর্ব প্রকাশের পর)
দ্বিতীয় ভাগ: এ সংঘাত থেকে অর্জিত শিক্ষা:
১- জিহাদের সংকল্প অটুট রাখা এবং সরকারি নিরাশকরণ অভিযান ব্যর্থ করা:
আনওয়ার সাদাত হত্যাকাণ্ডের পর থেকে মিশরীয় সরকারের পরিচালিত আক্রমণগুলোর লক্ষ্য ছিল ইসলামী আন্দোলন ও তার শক্ত আঁটি জিহাদী আন্দোলনের মনোবল ভেঙ্গে দেওয়া। আর যাকি বদর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এ রাজনীতি ভয়াবহতার শীর্ষ চূড়ায় পৌঁছে। এমনিক যাকি বদর প্রকাশ্যে দম্ভভরে বলে: ইসলামী দলগুলোর চিকিৎসা হল: “হৃদপিণ্ডের মূল বিন্দুতে আঘাত করা।”
আগ্রাসী আক্রমণগুলোর টার্গেট স্পষ্ট ছিল। তা হল: মুসলিম যুবকদের অন্তরে হতাশা সৃষ্টি করা এবং তাদের মাঝে এই ধারণা সৃষ্টি করা যে, কোন প্রতিরোধে কাজ হবে না। এগুলো তার কর্তাদের বিপদ ও দুর্ভোগই ডেকে আনবে। এখন একমাত্র পথ হল আত্মসমর্পণ করা।
এ হামলার জবাব না দিয়ে চুপ থাকার অনিবার্য ফলাফল হল ইসলামী আন্দোলনের আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাওয়া, পশ্চাদপসরণ করা, হাত গুটিয়ে নেওয়া, নিরব হয়ে যাওয়া এবং নাসিরী শাসনামলের অবস্থার দিকে ফিরে যাওয়া। এ হতাশা সৃষ্টি করাই প্রতিটি আক্রমণের মূল উদ্দেশ্য ছিল, যা উক্ত অঞ্চলে ইহুদীবাদ সম্প্রসারণের মূল হাতিয়ার। কারণ ইহুদিরা অনুধাবন করেছিল, যদি মুসলমানদের অন্তরে হতাশার বীজ বপন করা না যায়, তাহলে তাদের বিরোধী প্রতিরোধগুলো কিছুতেই দমন করা যাবে না।
আর জিহাদী অভিযানের মাধ্যমে এ আগ্রাসী হামলার জবাব প্রদান মুসলিম যুবকদেরকে শুধু হতাশা থেকেই রক্ষা করবে না, বরং তাদের অন্তরকে মহান আল্লাহর উপর আস্থার পর আত্মবিশ্বাস ও আশায় ভরে দিবে। কারণ ইতিমধ্যেই মুজাহিদ যুবকদের সামনে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তাদের শত্রু কোন অপরাজেয় কিংবদন্তী নয়। বরং তারা দুনিয়ার প্রতি কুকুরের মত লালায়িত কতগুলো মানুষ এবং তাদেরকে আঘাত করা কোন কঠিন বিষয় নয়।
এমনকি জিহাদী অভিযানের ফলাফল শুধু মুসলিম যুবকদের অন্তরে আশা জাগ্রত করার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং একই অস্র সরকারের সহযোগীদের দিকে ফিরে যাবে। ফলে মুসলিম যুবকগণ তাদের বিরুদ্ধে মনস্তাত্তিক দৃঢ়তা অনুভব করবে। আর তাদের (অর্থাৎ অপরপক্ষের) মনোবল ভেঙ্গে যাবে। তারা দেখবে, তাদের চারপাশে তাদের সহকর্মীরা একের পর এক পড়ে যাচ্ছে।
এমনিভাবে আমেরিকান ও ইহুদী টার্গেটগুলোতে আঘাত হানার জন্য জিহাদী হামলার ক্রমোন্নতি জনগণের মাঝে যুদ্ধের প্রাণ সৃষ্টি করবে, যারা ইহুদী ও আমেরিকাকে অহংকার ও সীমালঙ্ঘনের নিকৃষ্ট প্রতীক মনে করে। এ সকল কারণে লড়াইয়ের বিকল্প নেই। বরং লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
যেকোন নিরপেক্ষ বিশ্লেষকই বুঝতে পারবেন যে, যদি আনওয়ার সাদাতকে হত্যা করা না হত এবং যদি আজ পর্যন্ত মিশরীয় সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অব্যাহত না থাকত, তাহলে কতটা দুর্যোগ সৃষ্টি হওয়া সম্ভব ছিল।
আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, যদি আনওয়ার সাদাতকে হত্যা করা না হত এবং যদি ইসলামী প্রতিরোধ অব্যাহত না থাকত, তাহলে মিশর ও এ অঞ্চলের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো এখন আমেরিকান প্রভাব ও জায়নবাদি সম্প্রসারণের অধীনে বিভক্ত হয়ে যেত।
শুধু তাই নয়, যে বাকস্বাধীনতা দ্বারা মিশরের আত্মসমর্পণকারী ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদিরা নিজেরা নিজেরা প্রতিারিত হচ্ছে এবং বলছে যে, মিশর প্রতিনিয়ত গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে.. এজাতীয় আরো যত প্রবঞ্চনা আছে.., যদি আনওয়ার সাদাতকে হত্যা করা না হত এবং মুজাহিদগণ দালাল সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করতেন, তাহলে সরকার ও তার পশ্চাতে আমেরিকা ক্রোধের স্ফুলিঙ্গ ঠাণ্ডা রাখার প্রচেষ্টা হিসাবে প্রদত্ত এই প্রতারণাময় স্বাধীনতাটুকুও দিত না। যদি প্রতিরোধ অভিযান না হত, তাহলে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীগণ, আত্মসমর্পণকারী ইসলামী আন্দোলনগুলো, এমনকি কারাগারে অবস্থানকারী কিবতীদের প্রধানদের অবস্থা যা হওয়ার, তা ই হত। তোরা অভ্যর্থনা কারাগারে সাদাত কি তাদেরকে ‘সুরক্ষা আইনে’ একত্রিত করেছিল না? তাদেরকে সেখান থেকে বের করেছিলেন একমাত্র খালিদ আল ইসলামবুলি রহ. ও তার পুণ্যবান সাথীগণ। আল্লাহ তাদের উপর এবং মুসলমানদের সকল শহীদানের উপর রহমত বর্ষণ করুন!
তারপর ইখওয়ানুল মুসলিমীন কারাগার থেকে বের হল। কিন্তু যারা তাদেরকে মুক্তি দিল তাদের কৃতজ্ঞতা আদায়ের পরিবর্তে তেলেসমানি বললেন: প্রকৃতপক্ষে সাদাত হত্যা ওসমান ইবনে আফ্ফান রাযি. এর হত্যার মত। তারপর এতটুকুতেই ক্ষান্ত থাকেননি, বরং কপটতার মিছিলে বের হন। যা গণপরিষদ থেকে বের হয়ে গণভবনের দিকে যায়। অতঃপর কামাল আস-সানানিরি রহ. এর হত্যাকারী দ্বিতীয় টার্মের প্রেসিডেন্ট হুসনি মোবারকের হাতে বায়আত গ্রহণ করে। তারপর বলল: কট্টরপন্থী দলগুলো ইখওয়ানের নীতির দিকে পশ্চাদপসরণ করেছে।
আমি মনে করি, যাদের দ্বিতীয় গুরু প্রথম গুরুর হত্যাকারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বের হয়ে বলে: “সম্মানিত বাদশার সঙ্গে মর্যাদাময় মতবিনিময়” এবং যাদের নতুন নীতিনির্ধারণী অফিস তাদের গুরুর হত্যাকারী আবিদীনের সঙ্গে বন্ধুত্বের ঘোষণা দিয়ে আবিদীন প্রাসাদের সম্মানজনক রেকর্ডে স্বাক্ষর করে, তাদের কোন অধিকার নেই পশ্চাদপসরণ নিয়ে কথা বলার।
মিশরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে প্রকাশ পায় যে, মিশরের ব্যাপারে দু’টি বিবাদমান প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি প্রতিযোগীতা করছে: একটি হল সরকারী শক্তি, আর অপরটি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশ্রিত জনশক্তি, তথা সকল ইসলামী আন্দোলন ও বিশেষভাবে তার শক্ত জিহাদী আঁটি।
প্রথম শক্তিটিকে সাহায্য করছে আমেরিকা, পশ্চিমা বিশ্ব, ইসরাঈল এবং অধিকাংশ আরব রাষ্ট্রগুলো। আর দ্বিতীয় শক্তিটি প্রথমত: একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করে, তারপর তাদের ব্যাপক জনসমর্থন আর উত্তরে চেচনিয়া থেকে শুরু করে দক্ষিণে সোমালিয়া পর্যন্ত এবং পূর্বে পূর্ব-তুর্কিস্তান থেকে শুরু করে পশ্চিমে ইসলামিক মাগরিব পর্যন্ত গোটা মুসলিম বিশে^র জিহাদী আন্দোলনের সাথে মিত্রতা।
আর দুই শক্তির মাঝে শত্রুতার কারণ দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট: তা হল: প্রথম শক্তির কতগুলো বিষয়ের উপর অনড় অবস্থান:
ক. ইসলামকে শাসনব্যবস্থা থেকে উৎখাত করা এবং তাকে শক্তি, আগ্রাসন, মিথ্যা নির্বাচন ও বিকৃত মিডিয়ার মাধ্যমে জীবনের বিভিন্ন অঙ্গন থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া।
খ. বিভিন্ন আত্মসমর্পণমূলক চুক্তির মাধ্যমে ইসলামের শত্রু আমেরিকা ও ইহুদীদের জন্য আমাদের দেশকে বৈধ করে দেওয়া, শুধু আমাদের উপর বিধ্বংসী অস্ত্র নিষিদ্ধ করা, সিনাইকে অস্রমুক্ত করার চুক্তি, আমাদের দেশে আমেরিকার প্রত্যক্ষ দখলদারি এবং বিভিন্ন যৌথ মহড়া।
এজন্য ইসলামী আন্দোলন ও তার অগ্রপথিক জিহাদি আন্দোলনের জন্য লড়াই ও জিহাদ ব্যতিত কোন অপশনই বাকি রইল না। এটা হল বিশ্বাসের যুদ্ধ, অস্তিত্বের লড়াই এবং এমন যুদ্ধ, যাতে সন্ধির কোন অবকাশ নেই।
২- প্রসারতা:
কোন সন্দেহ নেই যে, এ সময়ের মধ্যে ইসলামী জিহাদী আন্দোলন ব্যাপক প্রসারতা ও ক্রমবর্ধমান উর্ধ্বগতি লাভ করেছে। বিশেষ করে মিশরের যুবক শ্রেণীর মাঝে। শুধু তাই নয়, আমেরিকা ও ইসরাঈলকে আঘাত করা এবং ইরাক ও আফগানিস্তানের দু’টি যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার দ্বারা জিহাদী আন্দোলন মুসলিম উম্মাহর বিশাল জনগোষ্ঠীর ভালোবাসা, সমর্থন ও সহানুভূতি লাভ করেছে এবং মুসলিম উম্মাহর উপর ক্রুসেডার ও জায়নবাদি হামলার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধের প্রতীক হয়ে গেছে।
৩- আক্রমণাত্মক চরিত্র:
ইসলামী জিহাদী আন্দোলন শেষ নি:শ্বাস পর্যন্ত ইসলামের শত্রুদের উপর আক্রমণ ও প্রতিরোধের চরিত্র লাভ করেছে। ১৯৭৪ সালের সামিরক কলেজের ঘটনা থেকে শুরু করে ২০০৬ এর দাহব-বোমা হামলা পর্যন্ত বড় বড় ঘটনাগুলো তারই প্রমাণ বহন করে। ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে এই আক্রমণাত্মক প্রাণ সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে যায় নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন ও বেনিসালফানিয়ার মোবারক হামলাসমূহের মাধ্যমে।
৪- অব্যাহত বিশাল ত্যাগ:
ইসলামী জিহাদী আন্দোলন তাগুত সরকার ও তার ব্যবহৃত ইসলাম বিরোধী শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে তার অব্যাহত লড়াইয়ে এ পর্যন্ত কয়েক দশক হাজার বন্দি, নির্যাতিত, আক্রান্ত ও হাজার হাজার নিহতের নযরানা পেশ করেছে। এর মাধ্যমে তারা দু’টি বিষয় প্রমাণ করেছে:
এক. তারা গভীর শিকড় সম্পন্ন ও উর্বর মাটি বিশিষ্ট একটি শক্তি। তাই এত আঘাত ও কুরবানীর মাঝে, যেখানে মিশরের অন্য কোন রাজনৈতিক শক্তি টিকে থাকতে পারে না, সেখানে ইসলামী জিহাদী আন্দোল এখনো পর্যন্ত আল্লাহর পথে ময়দানে কাজ ও প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে।
দুই. তারা সর্বদাই এই শাসনব্যবস্থার প্রথম বিপদ হিসাবে বিবেচিত। এর প্রমাণ হল, এখনো পর্যন্ত জরুরী আইন, সামরিক আদালত ও সন্ত্রাস নির্মূল আইনগুলো অব্যাহত থাকা। আর নিকট ভবিষ্যতেও এগুলোর কাজ শেষ হওয়ার কোন সম্ভাবনা না থাকা। এছাড়া প্রায় ৬০ হাজার মুসলিম যুবকে কারাগারগুলো ভরে থাকার কথা তো বলাই বাহুল্য। যাদের কারো কারো কারাগারে বিশ বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে, কিন্তু এখানো পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ উত্থাপন করা হয়নি। বরং এ সবের চেয়ে বড় বিষয় হল, মিশরীয় সরকার সন্ত্রাসবাদের নামে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ক্রুসেডার জোটের মধ্যে প্রবেশ করেছে এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নির্যাতন ও তদন্ত ঘাটিসমূহের মধ্যে মিশর অন্যতম একটি ঘাটিতে পরিণত হয়েছে, যেখানে ইসলামের বিরুদ্ধে আমেরিকার ক্রুসেড যুদ্ধের হিসাব চুকানোর জন্য বিশ্বের সর্বস্থান থেকে বন্দিদেরকে নিয়ে আশা হয়।
Comment