তৃতীয় অধ্যায়: ময়দানে প্রত্যাবর্তন-তৃতীয় পরিচ্ছেদ: মিশরের অভিযান সমূহ
(পুর্ব প্রকাশের পর)
৫- আন্তর্জাতিক মিত্রতা ও আন্তর্জাতিক উচ্ছেদ অভিযান: সরকার ইসলামী জিহাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে আন্তর্জাতিক যুদ্ধে পরিণত করা ছাড়া উপায় দেখল না। কারণ সরকার ক্রমবর্ধমান জিহাদী সম্প্রসারণ মোকাবেলায় অক্ষম হয়ে গিয়েছিল। যা তার অস্তিত্বকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল এবং তার ভিত্তিসমূহের উপর একের পর এক আঘাত হানছিল।
মিশরের সরকার গঠিত হয় একজন ফেরাউন এবং বেতন ও স্বার্থপূজারি একদল সুবিধাবাদি মুনাফিক দ্বারা, যারা তারই নির্ধারিত কক্ষপথে ঘুরে। এই ফেরাউনের আত্মম্ভরিতা ও চেয়ার আঁকড়ে থাকার নেশা এ পর্যায়ে পৌঁছল যে, সে তার মিশর শাসনে কাটানো দীর্ঘ ২৮ বছরে একজন সহকারীও গ্রহণ করেনি। আর এখন আপ্রাণ চেষ্টা করছে তার পুত্রকে ক্ষমতার উত্তরাধিকার বানিয়ে যেতে, যে আমেরিকার সন্তুষ্টভাজন এবং গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার রক্ষক।
মুজাহিদগণ এই ফেরাউন ও তার সরকারের সাথে লড়াইয়ে নিজেদের পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা দ্বারা উপকৃত হয়েছেন। ফলে পূর্বে যত জিহাদী গ্রুপ ছিল, তাদের সকল সদস্যকে দেশের ভিতরেই পাওয়া যেত। ফলে নিরাপত্তা বাহিনী তাদের কোন একজন সদস্য পর্যন্ত পৌঁছতে পারলে তাকে নির্মম শাস্তি দিতে থাকত, যাতে তার মাধ্যমে নেতৃত্ব পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। অতঃপর নেতৃত্ব পর্যন্ত পৌঁছতে পারলে তাকে নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে চিপে ফেলত, যাতে সকল তথ্য পেয়ে যায়। এজন্য এখন মুজাহিদগণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, নেতৃবৃন্দ ও তার সহযোগী শাখাসমূহ দেশের বাইরে থাকবে। এভাবে সংগঠনের মাথা, বিবেক ও তা পরিচালনার কেন্দ্রটি সরকারের থাবা থেকে দূরে থাকবে। কিন্তু তার হাতগুলো দেশের ভিতর ছড়িয়ে থাকবে। ফলে যখন নিরাপত্তা বাহিনী কোন একটি গ্রুপকে ধরে ফেলবে, তখন অন্য আরেকটি গ্রুপ জেগে উঠবে। এভাবে জিহাদ অব্যাহতভাবে চলতে থাকবে। এ কৌশলের ফলে আল্লাহর অনুগ্রহে মুজাহিদগণের হামলা বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি সরকারের মাথায় একাধিক আঘাত করা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। একমাত্র আল্লাহর কুদরতই যা থেকে তাকে রক্ষা করতে পারে।
এছাড়া যেহেতু সরকার ক্রমবর্ধমান জিহাদী সম্প্রসারণ মোকাবেলায় নিজের অক্ষমতার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে, একারণেই ওয়াশিংটনের নতুন কায়সারের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেছে এবং তাদেরকে এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে যে, তার পতনের অর্থই হল মধ্যপ্রাচ্যে তাদের স্বার্থ ধ্বংস হওয়া এবং সমগ্র ইসলামী বিশ্বে তা হুমকির মুখে পড়া।
আমেরিকা যখন বুঝতে পারল যে, এই জিহাদী হামলার সামনে সরকার টিকে থাকতে পারবে না এবং খুব সম্ভাবনা আছে যে, এই জিহাদি প্রাণ উক্ত অঞ্চলের সব বিষয়ই উলট পালট করে দিবে এবং সেখান থেকে আমেরিকাকে তাড়িয়ে দিবে আর তখনই সেই ভূমিকম্প সৃষ্টি হবে, যা সহ্য করতে পশ্চিমা বিশ্ব কেঁপে উঠবে। অর্থাৎ মিশরে একটি ইসলামী খিলাফাহ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। সেই রাষ্ট্র, যা প্রতিষ্ঠিত হওয়া আল্লাহ ভাগ্যে রাখলে মিশরই (ইসলামী বিশ্বের হৃদয়ে তার যে ভারত্ব আছে তার মাধ্যমে) পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে জিহাদে ইসলামী বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে এবং গোটা মুসলিম বিশ্ব তার পাশে একত্রিত হওয়ার উপযুক্ত হবে ইনশআল্লাহ। আর তখন ইতিহাস আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ ও আন্তর্জাতিক ইহুদীবাদী রাজত্যের বিরুদ্ধে নতুন দিকে মোড় নিবে ইনশআল্লাহ।
আমেরিকার এ বিশ্বাস হওয়ার পর থেকেই মিশরে ও ইসলামী বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে মুজাহিদগণকে নির্মূল করতে লাগল। যেহেতু ইতিমধ্যেই মিশর সরকার তাদের মোকাবেলা করতে এবং তাদের ক্রমবর্ধমান সম্প্রসারণ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে।
ফলে মুজাহিদগণকে সমর্পণ ও উচ্ছেদ করার জন্য অধিকাংশ দেশের উপর আমেরিকান চাপ শুরু হল। মুজাহিদগণের উপর দিয়ে এক ঝঞ্ঝাময় সময় অতিবাহিত হল। কিন্তু এ ছিল কষ্টের মোড়কে উপহার। কারণ মুজাহিদগণ কুফরি বিশ্বের প্রধান ও বড় শয়তান আমেরিকার উপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলেন। ক্রুসেডার ও জায়নিষ্টদের বিরুদ্ধে মুসলিম উম্মাহর জিহাদি প্রভাত উদ্ভাসিত হল। এটা ছিল মহা বিজয়, মহান রব নিজ হিকমতে মুজাহিদগণকে যে দিকে পরিচালিত করেছিলেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন:
﴿كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهٌ لَّكُمْ وَعَسَى أَن تَكْرَهُواْ شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ وَعَسَى أَن تُحِبُّواْ شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَّكُمْ وَاللّهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لاَ تَعْلَمُونَ﴾
“তোমাদের উপর যুদ্ধ ফরজ করা হয়েছে, যদিও তা তোমাদের নিকট অপছন্দনীয়। হতে পারে তোমরা কোন বস্তু অপছন্দ কর, কিন্তু তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর আর হতে পারে তোমরা কোন বস্তু ভালোবাস, কিন্তু তা তোমাদের জন্য মন্দ। বস্তুত: আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না।”
একারণে একথা বলা যে, মিশর সরকার মিশরে জিহাদী আন্দোলন নির্মূল করতে সক্ষম হয়েছে, এটা বাস্তবতা পরিপন্থি। বরং বাস্তবতা হল, মিশর সরকার মুজাহিদগণের পক্ষ থেকে ক্রমবর্ধমান আঘাতের শিকার হচ্ছে, যা সরকারের মাথা পর্যন্ত পৌঁছে তাকে পরাজিত করার উপক্রম করেছে। ফলে সে মুজাহিদগণকে বিতাড়নের জন্য আমেরিকার কাছে সাহায্য প্রার্থী হয়েছে। ফলে মুজাহিদগণও তাদের ভাইদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছে এবং ইহুদি ও ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে জিহাদের জন্য আন্তর্জাতিক ইসলামী সংগঠন তৈরী করেছে, অতঃপর জামাআতু কায়িদাতুল জিহাদ গঠন করেছে এবং কুফরের মাথা আমেরিকার উপর আন্তর্জাতিক হামলা করেছে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ছড়িয়ে দিয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে ইরাকে ও আফগানিস্তানে দু’টি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। তারপর পুনরায় মিশরে জিহাদি অভিযানে ফিরে এসেছে। এটাই বাস্তবতা, যার সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে আমেরিকা ও মিশর সরকার।
এরা জিহাদি আন্দোলন দমনে মিশর সরকারের দক্ষতা নিয়ে গর্ব করে, কিন্তু এর জন্য মিশরকে যে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে তা ভুলে যায়, তা থেকে দৃষ্টি নত রাখে। নির্যাতন, ইজ্জতের উপর আক্রমণ, এমনকি সকল প্রকার মূল্যবোধ ও নৈতিকতা জলাঞ্জলি দেওয়ার মত বর্ববর হামলার কথা ভুলে যায়। পাতানো সামরিক আদালত, প্রায় ১৩০ জনের ব্যাপারে মৃত্যুদণ্ডাদেশ, দীর্ঘ মেয়াদি কারাদণ্ড, এমনকি কোন ধরণের অভিযোগ পেশ করা ব্যতিত গ্রেফতার করণ- ইত্যাদি বিষয়গুলো থেকে দৃষ্টি নত করে রাখে, যা আমেরিকার প্রত্যক্ষ তত্ববধানে সম্পন্ন হয়েছে ও হচ্ছে।
তারা আরো ভুলে যায় যে, তারা ও আমেরিকা সেভিয়েত ইউনিয়ন ও ওয়ার্সো জোটের দেশগুলোর জনগণকে দমন করার জন্য একই পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল।
পরিশেষে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করব, যা এ সময়টিতে আমাদের অর্জন করা আবশ্যক, তা হল: ইসলাম ও কুফরের মধ্যকার লড়াই কোন অঞ্চল বা ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ থাকা সম্ভব নয়। কারণ ইসলামের শত্রুরা সকল স্থান থেকে ও সকল স্থানে ইসলামের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হচ্ছে।
আমি এখানে সেই দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে আশ্চর্য বোধ করছি, যারা জোর দিয়ে বলতে চাচ্ছে, ফিলিস্তীনের জিহাদ ফিলিস্তীনের ভৌগলিক সীমান্তে ও শুধু ইহুদিদের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। তারা এই শরয়ী বাস্তবতা ভুলে যায় যে, সমস্ত মুসলিম জাতি এক জাতি। সমস্ত মুসলিম দেশগুলো এক দেশের সমতুল্য। আর এই বাস্তবতাও ভুলে যায় যে, ক্রুসেডার পাশ্চাত্য ও কমিউনিষ্ট প্রাচ্যের সহযোগীতার কারণেই ইসরাঈল প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে।
আমি এই দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারীদের জন্য ইসলামের শহীদ শায়খ আব্দুল্লাহ আয্যাম রহ. এর কিছু আলোকিত বাণী উল্লেখ করছি। তিনি বলেন:
“হক ভৌগলিক সীমারেখা মানতে অস্বীকার করে। তা ভূগোলবিদদের আবিস্কৃত সংকীর্ণ সীমান্তে সীমাবদ্ধ হতে চায় না। হক নির্ভেজাল মানবমস্তিস্ককে চ্যালেঞ্জ করে বলে: তোমাদের কী হল, তোমরা বল, অমুক ব্যাপারটি পাহাড়ের বা এই নদীর এই পাড়ে ঠিক, কিন্তু তা যখন এই উপকূল অতিক্রম করে ওই উপকূলে যাবে, তখন বেঠিক।”
“নিশ্চয়ই আফগানিস্তানই ফিলিস্তীন এবং ফিলিস্তীনই আফগানিস্তান। এক দুঃখ আরেক দুঃখকে জাগিয়ে তুলে। কিন্তু আমরা চাই না, আমাদের অন্তর থেকে জিহাদের স্ফুলিঙ্গ মরে যাক। আমরা চাই না এই দ্বীনের ব্যাপারে, নিপিড়ীতদেরকে উদ্ধার করার ব্যাপারে এবং আমাদের শিরা ও ধমনির ভেতরকার মুসলিম ভূমিগুলোকে রক্ষা করার ব্যাপারে আমাদের তীব্র চেতনা নিভে যাক।”
“এখানে আমাদের উপর ইহুদিবাদী চাপ, আমেরিকা ও পশ্চিমাদের উপর ইহুদিবাদী চাপ- যেন তারা আমাদেরকে পাকিস্তানের ভেতর থেকে বের করে দেয়, আরবদেরকে এবং বিশেষ করে ফিলিস্তীনীদেরকে ভিসা প্রদান নিষিদ্ধ করার জন্য ইহুদিবাদী চাপ... ইত্যাদির মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হয় যে, তারা বুঝতে পেরেছিল, হিন্দুকুশ পর্বতমালায় যে ভূমিকম্প শুরু হয়েছে তা অবশ্যই আল কুদসের মিনারেও প্রতিধ্বনিত হবে।”
৬- যুদ্ধ অব্যাহত থাকা: ইসলামী জিহাদী আন্দোলনের ক্রমবিকাশ পর্যবেক্ষণকারী যে কেউ লক্ষ্য করবে যে, সরকারের বিরুদ্ধে তার জিহাদ এখনো অব্যাহত আছে। বিগত ৪০ বছরেও (১৯৬৬ থেকে ২০০৬) এ যুদ্ধ থামেনি। বরং ইসলামী জিহাদী আন্দোলন সর্বদাই আক্রমণ বা আক্রমণের প্রস্তুতির মধ্যেই ছিল।
সরকার ও তার মিডিয়া দেশ-বিদেশের মানুষকে একথা বিশ্বাস করানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে যে, যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। অথচ এখনো জরুরী অবস্থা অব্যাহত আছে এবং উচ্চনিরাপত্তা ব্যবস্থাগুলো কার্যকর আছে, যা প্রমাণ করে, যুদ্ধ চলমান হওয়ার কারণে সরকার এখনো ভয়, অপেক্ষা ও সর্বোচ্চ সতর্কতার মধ্যে আছে। আর অবস্থা যেকোন সময় বিস্ফোরিত হতে পারে। সরকার এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে, ইসলামী জিহাদী আন্দোলন এমন নতুন প্রজন্ম তৈরী করছে, যাদেরকে নির্মূল করা সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য কঠিন হবে।
হুসনি মোবারকের সরকার এ পর্যন্ত ৬ জন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী পরিবর্তন করেছে, যাদের প্রত্যেকেই ঘোষণা দিয়েছে: সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করবে। তারপর সে পদচ্যুত হয়ে যায়, তারপর আরেকজন আসে। সেও একই ঘোষণা দেয়!!
৭- জিহাদী সংগঠনের শক্তিবৃদ্ধি: ষাটের দশকে সায়্যিদ কুতুব শহিদ রহ. এর ছোট্ট গ্রুপ কর্তৃক আব্দুন নাসেরের আগ্রাসী হামলার জবাব দেওয়ার জন্য একটি শক্তি প্রস্তুত করার প্রচেষ্টার মাঝে আর বর্তমানে জিহাদী সংগঠন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তার মাঝে তুলনা করলেই জিহাদী সংগঠনের ক্রমোন্নতির উচ্চ মাত্রা প্রকাশ পায়। আর জিহাদী সংগঠনের এমন উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া, যা তাকে সমকালীন ক্রুসেডার ও ইহুদিবাদী হামলার সম্মুখে মুসলিম উম্মাহর অগ্রবাহিনীর মর্যাদায় নিয়ে গেছে- এটা পশ্চাদপসরণ, পিছু হটা, শাসকদের লেজুরবৃত্তি করা, ইসলামের বিধি-বিধান ও তার মৌলিক আকিদাহসমূহ থেকে সরে আসা এবং সংলাপ ও সরকারি অনুমোদনপত্র সমূহের মাধ্যমে হয়নি। কিংবা শরীয়তের শাসনকর্তৃত্ব থেকে সরে পড়ে আইন সভার কয়েকটি আসন দখলের প্রচেষ্টার মাধ্যমেও এ পর্যায়ে পৌঁছেনি। বরং এ পর্যায়ে পৌঁছেছে তাওহীদের মূলনীতি ও শরীয়তের বিধানাবলীর উপর অটল থেকে, জান-মালের লাগাতার কুরবানী ও ত্যাগের মাধ্যমে এবং শত শত শহীদ, হাজার হাজার বন্দি, আহত, অচল, বিধবা ও ইয়াতিমদের মাধ্যমে। এ পর্যায়ে পৌঁছতে পেরেছে হিজরত ও নির্বাসনের মাধ্যমে এবং পরিবার, দেশ, নিরাপদ জীবন, স্বস্তি, পদবি, চাকুরি, লাভ, ব্যবসা ও সুবর্ণ সুযোগসমূহ বিসর্জনের মাধ্যমে। আল্লাহ তা’আলা বলেন:
﴿أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُواْ الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُم مَّثَلُ الَّذِينَ خَلَوْاْ مِن قَبْلِكُم مَّسَّتْهُمُ الْبَأْسَاء وَالضَّرَّاء وَزُلْزِلُواْ حَتَّى يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُواْ مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللّهِ أَلا إِنَّ نَصْرَ اللّهِ قَرِيبٌ﴾.
“তোমরা কি মনে করেছ তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করে ফেলবে, অথচ এখনো তোমাদের উপর সেই রকম অবস্থা আসেনি, যা তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর এসেছিল। তাদেরকে অভাব-অনটন ও দুঃখ-বেদনা স্পর্শ করেছে এবং তারা প্রকম্পিত হয়েছে। এমনকি রাসূল ও তার ঈমানদারগণ সাথীগণ বলে উঠল: কখন আল্লাহর সাহায্য আসবে?? জেনে রেখ, আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে।”
৮- চিন্তা ও আদর্শ সুস্পষ্ট করা: ইসলামী জিহাদী আন্দোলন- কুরআন, সুন্নাহ ও উম্মাহর গ্রহণযোগ্য ফুকাহায়ে কেরামের ইজমার দলিল সমূহ থেকে উৎসারিত শক্তিশালী মূলনীতি সমূহের আলোকে তাদের আদর্শের মৌলিক উপসর্গগুলো অনেক দূর পর্যন্ত সুস্পষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। যা তাকে একটি শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করেছে, যার উপর ইসলামী আন্দোলন তার পতাকা উঁচু করে আছে, যে পতাকা আল্লাহর অনুগ্রহে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সহযোগী আকৃষ্ট করছে।
৯- গণমুখী সম্বোধন: জিহাদি সংগঠনের বক্তব্যগুলো শুধু বিশেষ নির্বাচিত লোকদের লক্ষ্য করে হওয়া উচিত নয়। বরং এমন বক্তব্য হওয়া উচিত, যা সকল সাধারণ মানুষের নিকট বোধগম্য। জিহাদী সংগঠনকে এ ছিদ্রপথ বন্ধের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন ও বেনিসালফানিয়ার বরকতময় হামলাসমূহের পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত জিহাদী সংগঠনের বক্তব্যগুলো কেউ লক্ষ্য করলে বুঝতে পারবে যে, এখন জিহাদী সংগঠনের বক্তব্যগুলো সাধারণ মুলমানদেরকে সম্বোধন করা এবং আধুনিক ক্রুসেড হামলা প্রতিরোধে তাদেরকে একীভূত করার ক্ষেত্রে স্পষ্ট সৌন্দর্য লাভ করেছে। যেমন মাইকেল শাভির বলেন:
“তিনি ও তার সহযোগীগণ বিরাট পরিমাণ সম্পদ, সময় ও চিন্তা ব্যয় করে একটি আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও প্রচারমাধ্যম গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। এই প্রচারমাধ্যম তার সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে এবং ইবনে লাদেন ও জাওয়াহিরীর সহযোগীতা করছে। তারা যখনই চায়, আন্তর্জাতিক মিডিয়া দখল করে নিতে পারে। একইভাবে ইন্টারনেটের বিবিধ সাইটে আল কায়েদার উপস্থিতি অব্যাহতভাবে তাদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ব্যাখ্যাগুলোকে এবং তথ্যমূলক বিবৃতিগুলোকে তাদের সহযোগীদের সামনে পেশ করছে। তথা ইসলামী বিশ্বের মধ্যবর্তী শ্রেণী এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারী উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সামনে।”
তবে এর অর্থ এই নয় যে, জিহাদি সংগঠন গভীর শরয়ী বক্তব্যের ব্যাপারে উদাসিনতা প্রদর্শন করবে। বরং এটারও প্রয়োজন আছে, যার কোন বিকল্প নেই। এটা প্রয়োজন নিজেদের সদস্যদেরকে সঠিক আকিদা ও বুঝের উপর গড়ে তোলার জন্য, উলামা, মুদাররিস ও তালিবুল ইলমদের সাথে কথা বলার জন্য এবং সংগঠন যে সকল গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি স্পর্শকাতর শরয়ী সমস্যার সম্মুখীন হয়, তা গবেষণা করার জন্য। এটা প্রয়োজন সংগঠনের পক্ষ থেকে দাওয়াত, ইফতা (ফাতওয়া প্রদান) ও কাযা (বিচার করা)এ নিজস্ব বিশেষজ্ঞ শাখা গঠন করার জন্য।
তবে সুস্থির শরয়ী মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত গণমুখী বক্তব্য ও সম্বোধনের ব্যাপারেই জিহাদি সংগঠনকে সবচেয়ে কঠিন পরিশ্রমটি করতে হবে দুই কারণে:
এক. গভীর ইলমী সম্বোধন ও বক্তব্যের দায়িত্বটি অনেক দূর পর্যন্ত একনিষ্ঠ আলেম ও মুদাররিসগণ পালন করেছেন। জিহাদী সংগঠন যেসকল গভীর ইলমী প্রকাশনাসমূহ প্রকাশ করে, তা সাধারণত: তাদের পূর্ববর্তীদের থেকে সংগৃহিত। তাদের শুধু পরিবেশন করা, প্রকাশ করা এবং গুরুত্বানুসারে বিন্যাস করার অবদানটি থাকে।
দুই. সাধারণ মুসলিমগণ, এমনকি অনেক শিক্ষার্থী ও বিশেষজ্ঞগণ গভীর শরয়ী বক্তব্য বুঝেন না। কারণ সিংহভাগ শিক্ষার্থী ও বিশেষজ্ঞগণও হয়ত শরীয় ইলমে একেবারে সাধারণ থাকেন, অথবা ইতিপূর্বে বুঝেছেন ভুল। আর মানুষ স্বভাবগতভাবে অজানা জিনিসের শত্রু।
দায়ীগণ এ দিকটিতে বিরাট কমতি করেছেন। তারা হয়ত এটা ছেড়েই দিয়েছেন অথবা এক্ষেত্রে নিজেদের সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করেছেন, কিন্তু শুধুমাত্র যে বিষয়গুলো প্রবৃত্তির সাথে সাংঘর্ষিক নয় এবং তাগুত ও ক্রুসেডারদের বাসনার সাথে সাংঘর্ষিক নয়, সেগুলো। ফলে মুসলমানদের বিরাট অংশ আকিদা ও শরীয়ার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে অজ্ঞ ও ধারণাহীন থাকছে, ক্রুসেডার ও জায়নবাদী হামলার সময় যে বিষয়গুলো মুসলমানদের প্রয়োজন ছিল।
তাই জিহাদী সংগঠনকে এ বিষয়গুলো সহজ ও পরিস্কার উপস্থাপনায় পেশ করার মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থে এবং মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি পালন করতে হবে। যা মুসলিম উম্মাহর সর্বাধিক স্পর্শকাতর আকিদা ও শরীয়ার বিষয়গুলোকে সর্বাধিক স্পর্শকাতর লড়াই ও বাস্তবতার সাথে সম্পর্কযুক্ত করবে।
এখন যদি উপরোক্ত অবস্থার সাথে জিহাদী সংগঠনের বক্তব্যসমূহের উপর আরোপিত মিডিয়া অবরোধ, অতঃপর সরকারি মিডিয়ার বিভ্রান্তকরণ অভিযানকে যুক্ত করেন, তাহলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, জিহাদী সংগঠনকে মুসলিম উম্মাহর সর্বমহলে, তথা নিরক্ষর থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী পর্যন্ত পৌঁছতে কতটা পরিশ্রম করতে হবে।
Comment