তৃতীয় অধ্যায়: ময়দানে প্রত্যাবর্তন
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
ইসলামাবাদে ইহুদিদের দালালদের প্রতি বার্তা
ইসলামাবাদে ইহুদিদের দালালদের প্রতি বার্তা
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ لاَ تَتَّخِذُواْ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاء بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاء بَعْضٍ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللّهَ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্য থেকে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই দলভূক্ত। নিশ্চয়ই আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে পথপদর্শন করেন না।”
১৯৯৫ সাল আগমনের সাথে সাথেই পূর্বাকাশে নির্মূলাভিযানের নতুন ঝড়ের পূর্বাভাস শুরু হল। জনৈক সম্মানিত বন্দি ভাইয়ের পক্ষ থেকে আমাদের নিকট উপদেশ আসল: আপনারা যদি থেমে যেতে বাধ্য হন, তাহলে সর্বশেষ ধাপ যেন হয় বড় ধরণের অভিযান।
এভাবে আমরা কাছাকাছি সময়ে দু’টি আক্রমণ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিলাম। একটি পাকিস্তানে আমেরিকান দূতাবাসের উপর, অপরটি মিশরে ইহুদিদের উপর। পাকিস্তানের অপারেশনটির দায়িত্ব দেওয়া হল বাহাদুর ভাই শহিদ আবু খালিদ তারিক আনওয়ার রহ.কে। আমি যাদের সঙ্গে উঠাবসা করেছি, তাদের মধ্যে সর্বাধিক একনিষ্ঠ লোক ছিলেন তারিক আনওয়ার। দ্বীনকে যথাযথভাবে আঁকড়ে থাকার দিক থেকে সবচেয়ে কট্টর এবং সর্বাধিক ত্যাগ, কুরবানি ও আত্মবিসর্জনকারী। দুঃখ, বেদনা ও বিপদে সর্বাধিক ধৈর্যশীল। দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্ত, দুনিয়া থেকে পবিত্রতা অবলম্বনকারী। আমি দু’বছর নিকটে থেকে তার সঙ্গে জীবন কাটিয়েছি। আমি কোনদিন তাকে সাথীদের খেদমত করে ক্লান্ত হতে দেখিনি। তিনি আমার ছোট সহোদরের মত ছিলেন। আমি অনেক সময় আমার অনুপস্থিতিতে আমার পরিবারবর্গের দেখাশোনার জন্য তাকে দায়িত্বশীল বানাতাম। আর তাদের সাথেই গার্দেজে সংঘটিত দু’টি বিমান হামলায় শাহাদত বরণ করেন, যে হামলাগুলোর একমাত্র টার্গেট ছিল তাদেরকে আশ্রয় দানকারী বাড়িটি। ফলে আমেরিকানরা ১৮ জন মুসলমান পুরুষ, নারী ও শিশুকে হত্যা করে। আল্লাহ তাদের (১৮ জন মুসলিমের) প্রতি প্রশস্ত রহমত নাযিল করুন।
আমি কোন কাজে তাকে দায়িত্ব দিলে মনে করতাম, উপযুক্ত লোককেই দায়িত্ব দিয়েছি। আমার ভূমিকা ছিল শুধু তাকে আর্থিক সাহায্য সরবরাহ করা। অবশিষ্ট কার্যাবলী শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিন্যাস করার ব্যাপারে এই ভরসায় থাকতাম যে, বিশ্বস্ত নির্ভরযোগ্য লোকের হাতেই দায়িত্ব সুপর্দ করেছি।
তিনি এই জিহাদী হামলায় তার সাথে অংশগ্রহণের জন্য একদল শ্রেষ্ঠ ভাইকে বাছাই করে নিলেন এবং প্রায় এক বছর পর্যন্ত ধৈর্য, অধ্যাবসা ও হাত দ্বারা পাথরে খুদাই করার মত পরিশ্রম করে প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। হতাশার দ্বারাপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। যখন ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন, তখন আল্লাহ তা’আলা তার জন্য এমনভাবে পথ খুলে দিলেন, যা তিনি জানতেনও না এবং ধারণাও করেননি। আল্লাহ তা’আলা বলেন:
﴿وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللَّهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ﴾
“যারা আমার পথে সাধনা করবে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথসমূহ দেখিয়ে দিব। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সঙ্গে আছেন।”
এবার কার্যকরকারী দুই ভাইয়ের কথা, তারা ছিলেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে আল্লাহ ভীরু ও গোপনীয়তা অবলম্বনকারী ভাই। প্রথম কার্যকরকারী ভাই, যিনি নিজের সাথে বহন করা বিস্ফোরক ব্যাগ দিয়ে দূতাবাসের লোহার দরজা উড়িয়ে দিয়েছিলেন, তার অবস্থা হল, তিনি চূড়ান্ত বিনয় ও কঠিন পরিস্থিতিতে ধৈর্যের গুণে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিলেন। তিনি সর্বদা নিজ সাথী ভাইদের খেদমত করতেন। অন্য কাউকে খাবার-পানি প্রস্তুত করার সুযোগ দিতেন না। রান্নাঘর যেন ছাড়তেই চাইতেন না, কাউকে সেখানে প্রবেশ করার সুযোগ দিতেন না।
আর দ্বিতীয় ভাই, আমাদের উপর যত কঠিন পরিস্থিতি এসেছে, তিনি তাতে ধৈর্যশীল ছিলেন। আল্লাহর পথে শাহাদাতের জন্য ব্যাকুল ছিলেন। তিনি শাহাদাতের আগ্রহে কাঁদতেনও। আমার একদিনের কথা মনে পড়ে, তিনি খুব পেরেশানি নিয়ে আমার নিকট আসলেন এই আবেদন করতে যে, আমি যেন তার জন্য একটি ইস্তেশহাদি হামলার ব্যবস্থা করে দেই। আমি তাকে বললাম: আপনি আমার নিকট চাচ্ছেন কেন? আমি তো কোন কিছুর মালিক না। আপনি রাজাধিরাজ আল্লাহর স্মরণাপন্ন হোন। তার নিকট চান, তিনি আপনাকে দিবেন। কিছুকাল পরে বাস্তবেই আল্লাহ তার জন্য সহজ করে দিলেন।
ইসলামাবাদে আমাদের প্রধান টার্গেট ছিল আমেরিকান দূতাবাসে আঘাত হানা। যদি সেটা সম্ভব না হয়, তাহলে পাকিস্তানে অবস্থিত কোন একটি আমেরিকান টার্গেটে আঘাত হানা। যদি সেটাও সম্ভব না হয়, তাহলে এমন কোন পশ্চিমা রাষ্ট্রের দূতাবাসে আঘাত হানা, যাদের মুসলমানদের সাথে শত্রুতার প্রসিদ্ধ ইতিহাস আছে। যদি এটাও সম্ভব না হয়, তাহলে মিশরীয় দূতাবাস গুড়িয়ে দেওয়া।
এ কারণে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, এমন টার্গেট নির্ধারণ করে জবাব দেওয়া হবে, যা এই নিকৃষ্ট জোটের জন্য বেদনাদায়ক হবে।
গভীর ও বিস্তারিত তথ্য নেওয়ার পর জানা গেল যে, আমেরিকান টার্গেটের উপর হামলা করা দায়িত্বপ্রাপ্ত টিমটির সক্ষমতার বাইরে। অতঃপর ইসলামাবাদস্ত কোন একটি আমেরিকান টার্গেটের ব্যাপারে তথ্য নিয়ে জানা গেল, সেখানে অল্পকিছু আমেরিকান কর্মচারী আছে মাত্র, তাতে বেশি আক্রান্ত হবে পাকিস্তান।
এভাবেই আরো জানা গেল যে, অন্য কোন পশ্চিমা রাষ্ট্রের দূতাবাসে হামলা করাও দায়িত্বপ্রাপ্ত টিমটির সক্ষমতার বাইরে।
সবশেষে ইসলামাবাদস্ত মিশরীয় দূতাবাসে হামলা করাই চূড়ান্ত হল, যারা শুধু পাকিস্তানে অবস্থানকারী আরব মুজাহিদগণকে উচ্ছেদই করেনি, বরং আরব মুজাহিদগণের বিরুদ্ধে ভয়ংকর গুপ্তচরবৃত্তি করত। এছাড়া পাকিস্তানী নিরাপত্তা বাহিনী ধ্বংসপ্রাপ্ত দূতাবাস ভবনগুলো থেকে যে সকল নথিপত্র পেয়েছে- যা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত-মিশর সহযোগীতামূলক গুপ্তচরবৃত্তি ফাঁস করে দিয়েছে, তা হল অতিরিক্ত সংযোজন।
পূর্বমতে পাকিস্তানে অবস্থানকারী আরব মুজাহিদগণকে উচ্ছেদ ও বিচ্ছিন্নকরণ অভিযানের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব পাকিস্তানকে যে সহযোগীতা দিয়ে থাকে এবং তার কারণে পাকিস্তান সরকারের উপর তাদের যে শক্তিশালী প্রভাব ছেয়ে আছে তার উপর ভর করে মিশরীয় সরকার পাকিস্তানের উপর দৌড়াত্ম প্রদর্শন শুরু করে। যেহেতু পঞ্চাশের দশক থেকে কাশ্মীর ইস্যুতে মিশর সরকারের ভারত সমর্থনমূলক অবস্থান এবং কাশ্মীরকে ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যা মনে করার কারণে পাকিস্তান সরকারের সাথে তাদের সরাসরি সম্পর্ক খারাপ ছিল।
মিশর সরকার আরব মুজাহিদগণের, বিশেষত মিশরীয় মুজাহিদগণের মধ্যে যারা পাকিস্তানে অবশিষ্ট আছে তাদের পশ্চাদ্ধাবন শুরু করল। তা এ পর্যায়ে পৌঁছল যে, পাকিস্তান ইসলামাবাদে আইনীভাবে অবস্থানকারী জামিয়া ইসলামিয়ার একজন ছাত্রকে পর্যন্ত অব্যাহতি দিয়ে দিল। তারপর এমন দু’জন মিশরীয়কে গ্রেফতার করল, যাদের পাকিস্তানে বিয়ে করার কারণে পাকিস্তানের জাতীয়তাও ছিল। পাকিস্তান সরকারের আত্মসমর্পণ এ পর্যায়ে পৌঁছল যে, পাকিস্তানের জাতীয়তা ধারণকারী দু’জন লোককে তাদের অভিযোগ বিচার প্রক্রিয়াধীন থাকাবস্থায়ই পাকিস্তানের সংবিধান বা আইনের প্রতিও সামান্য লক্ষ্য না করে মিশর সরকারের হাতে তুলে দেয়।
এমনিভাবে মিশর সরকার কর্তৃক ইসলামের সাথে শত্রুতামূলক হামলার পরিধি বৃদ্ধি করা, এছাড়া আমেরিকার সাথে লজ্জাজনক মিত্রতা এবং মিশরের বাইরে পর্যন্ত যুদ্ধকে স্থানান্তর করারও একটি জবাব দেওয়া আবশ্যক ছিল।
বিস্ফোরণ ঘটানোর পূর্বে কার্যকরকারী টিমটি আমাদেরকে সংবাদ পাঠাল, আরো কিছু অস্র ও সরঞ্জামের ব্যবস্থা করে দিলে এক সাথে আমেরিকা-মিশর উভয় দেশের দূতাবাস ধ্বংস করা সম্ভব। কিন্তু আমরা আমাদের নিকট যা ছিল তা দিয়ে দিয়েছিলাম, অতিরিক্ত ব্যবস্থা করতে পারছিলাম না। এভাবে উক্ত টিমটি মিশরীয় দূতাবাস ধ্বংস করার প্রতিই মনোযোগ দিলেন আর দূতাবাসের ধ্বংসাবশেষের মাঝে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ও সুস্পষ্ট বক্তব্য সংবলিত একটি চিঠি রেখে আসলেন।
Comment