কিছু পদ্ধতি এমন যা দাওয়াতের জন্য ক্ষতিকর
পর্ব - ২
পর্ব - ২
জি'হা/দের পথে আহবানকারী দাঈগণের জন্য জরুরি হল, আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দাওয়াতের পদ্ধতি বোঝা এবং সে অনুযায়ী আমল করা। আল্লাহর মনোনীত পদ্ধতিতেই জি'হা/দের খেদমত হতে হবে। অতএব দাওয়াতের ওই পদ্ধতি থেকে বেঁচে থাকতে হবে যা দাওয়াতের কোন পদ্ধতিই নয় এবং যার দ্বারা জি'হা/দের খেদমতের চাইতে ক্ষতিই বেশি হয়।
.
দাওয়াতের সঠিক পদ্ধতি
আল্লাহ তা’আলা যেখানেই দাওয়াতের আদেশ করেছেন (ادع الى سبيل ربك) অর্থাৎ দ্বীন ও দ্বীনের কাজের প্রতি দাওয়াতের কথা বলেছেন, সেখানে তার পদ্ধতিও বলে দিয়েছেন। এ পদ্ধতি হলো হেকমত, উত্তম ওয়াজ নসিহত এবং আকর্ষণীয় পদ্ধতিতে মুনাযারা করা।
আল্লাহ তা’আলার ঘোষণা,
ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ
অর্থ: “তুমি তোমার রবের পথের দিকে আহ্বান কর হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা, আর (যদি কখনো বিতর্কের প্রয়োজন হয় তবে) তাদের সাথে বিতর্ক কর সর্বোত্তম পন্থায়। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক যারা তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে তাদের ব্যাপারে সম্যক অবগত, আর যারা সৎ পথে প্রতিষ্ঠিত তাদের ব্যাপারেও সম্যক অবগত”। -সুরা নাহল-১২৫
.
আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানী রহিমাহুল্লাহ এই আয়াতের তাফসীরে বলেন:
এই আয়াতে স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, কীভাবে আল্লাহর পথে মানুষকে দাওয়াত দিতে হবে। এখানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তিনটি পদ্ধতির কথা বলেছেন –
১. হেকমত
২. মাওয়ায়েযে হাসানা
৩. জিদালে হাসানা।
প্রত্যেকটির বিবরণ নিম্মে উল্লেখ করা হল:
১. হেকমত:
হেকমত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, খুব মজবুত বিষয়ও অকাট্য প্রমাণের মাধ্যমে, প্রজ্ঞার সাথে উপস্থাপন করা। যা শুনে বিবেক-বুদ্ধির অধিকারী জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ ও ইলম পিপাসু আলেমগণ মাথা ঝুঁকিয়ে দেয়। জাগতিক দর্শন তার সামনে ম্লান হয়ে যায়। হেকমত দ্বারা ওহী থেকে প্রাপ্ত কোন বিষয়কে এমনভাবে উপস্থাপন করা বোঝায়, যেন জ্ঞানগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে কোন ধরনের খুঁত কেউ ধরতে না পারে।
.
২. মাওয়ায়েযে হাসানা:
অন্তর নরমকারী ও প্রভাব বিস্তারকারী নসিহতকে মাওয়ায়েযে হাসানা বলে। এর মধ্যে ভাষা মাধুর্য থাকবে, সেই সাথে অন্তর বিগলিত করার মতো প্রাণও থাকতে হবে। ইখলাস, সহমর্মিতা, দয়া ও উত্তম আখলাকের সাথে সুন্দরভাবে কৃত নসিহত দ্বারা পাথরের মতো শক্ত অন্তরও মোমের মতো গলে যায়। মৃতও প্রাণ ফিরে পায়, নিরাশাগ্রস্ত জাতি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। উৎসাহ ও ভীতিপ্রদর্শনমূলক ওয়াজ শুনে জান্নাতের দিকে অস্থির চিত্তে দৌড়ানো শুরু করে। বিশেষ করে যাদের অন্তর হক্কের জযবায় ভরপুর, কিন্তু উঁচু চিন্তা-চেতনা ও বেশি মেধার অধিকারী নয়, তাদের মধ্যে প্রভাব বিস্তারকারী ওয়াজ নসিহত দ্বারা আমলের জন্য এমন এক আগ্রহ তৈরি করা যায় যা উঁচু স্তরের গবেষণালব্ধ ইলমী তাহকিকের মাধ্যমে সম্ভব নয়।
তবে, দুনিয়াতে একশ্রেণির মানুষ আছে যারা সবসময় সব বিষয়ে নাক গলায়। এরা প্রত্যেক কথায় প্যাঁচ ধরে আর অযথা তর্ক করে। এসমস্ত লোকেরা হেকমতপূর্ণ কথা শোনে না, ওয়াজ নসিহতও কবুল করে না। তারা চায় সব বিষয়েই তর্ক-বিতর্ক চলতে থাকুক।
.
৩. জিদালে হাসানা:
অনেক সময় বুঝমান, সত্যানুসন্ধানী ব্যক্তিকেও সন্দেহ ঘিরে ধরে। আলোচনা ছাড়া তারও এতমিনান হয় না। তাদের জন্য হল জিদালে হাসান। বিষয়টিকে আয়াতে এভাবে বলা হয়েছে وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ অর্থাৎ যদি এমন পরিস্থিতি হয় তাহলে সর্বোত্তম পদ্ধতিতে ভদ্রতা, সঠিক দিকনির্দেশনা ও ইনসাফের সাথে মুনাযারা করবে। প্রতিপক্ষকে কোন অভিযোগ দিলে উত্তম পদ্ধতিতে দিবে। অযথা অন্তরে আঘাতকারী কথাবার্তা বলে ঝগড়ার পরিবেশ তৈরি করবে না। বিষয়টি এমনভাবে পেশ করতে হবে যেন অনেক দূর পর্যন্ত না গড়ায়। লোকদেরকে বোঝানো ও সত্য প্রতিষ্ঠা আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ। কঠোরতা, খারাপ ব্যবহার, চাপাবাজি ও গোয়ার্তুমি দ্বারা কোন ফায়দা হয় না।
.
মুফতি শফি রহিমাহুল্লাহ দাওয়াতের পদ্ধতির ক্ষেত্রে আম্বিয়ায়ে কেরামের তরিকার বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন: আল্লাহর পথে আহবান মূলত নবীগণের কাজ। ওলামায়ে কেরাম এ দায়িত্ব পালন করেন নবীদের নায়েব বা প্রতিনিধি হিসেবে। এজন্য জরুরি হলো, দাওয়াতের পদ্ধতি ও আদবও নবীদের থেকে শিখে নেওয়া। যে দাওয়াত তাদের তরিকার ওপর থাকবে না, তা দাওয়াতই নয়; বরং তা লড়াই বা ঝগড়ার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। নববী দাওয়াতের মূলনীতি কেমন তা আমরা মুসা ও হারুন আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তাআলা যে নির্দেশ দিয়েছেন তা থেকে শিখতে পারি। আল্লাহ তা’আলা বলেন:
فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَيِّنًا لَعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَى
অর্থাৎ ফেরাউনের সাথে নরম কথা বল, হয়ত সে বুঝবে অথবা ভীত হবে। [সুরা ত্বা-হা ২০:৪৪]
.
প্রত্যেক দাঈর সর্বদা এ বিষয়টি মাথায় রাখা উচিৎ যে, ফেরাউনের মত অহংকারী কাফের, যার মৃত্যুও আল্লাহর ইলম অনুযায়ী কুফর অবস্থায়ই হবে, তার ক্ষেত্রেও আল্লাহ তাআলা নিজের দাঈকে নরম ভাষায় কথা বলার নির্দেশ দিয়েছেন।
বর্তমানে আমরা যাদেরকে দাওয়াত দেই, তারা কেউ ফেরাউনের চেয়ে বড় গোমরাহ নয়। আর আমাদের কেউ মূসা ও হারুন আলাইহিমাস সালামের মতো দাঈও নই। অতএব যেই অধিকার আল্লাহ তা’আলা তাঁর দুই নবীকে দেননি যে, “মাদউর সাথে শক্ত ব্যবহার করবে, তাকে অপমান করবে” - সে অধিকার আমাদের কোথা থেকে অর্জন হয়ে গেলো?!
.
.
চলমান...
.
টীকা–
.
[১] সুরা নাহল, ১৬:১২৫
.
[২] সুরা ত্বা-হা ২০:৪৪
.
দাওয়াতের পদ্ধতি ও জি@হা/দি মানহাজের হেফাযত
উস্তাদ উ@স]ম। ম]হ-মুদ হাফিজাহুল্লাহ
Comment