তৃতীয় অধ্যায়: ময়দানে প্রত্যাবর্তন- পঞ্চম পরিচ্ছেদ:দাগিস্তান: উপায় শেষ হওয়ার পর সাহায্য- প্রথম বিষয়: ককেশাসের পরিস্থিতি নিয়ে কিছু ভাবনা
চতুর্থ ভাগ
রাশিয়া ও ককেশাশি মুসলিমদের মধ্যকার লড়াই যে রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক তাৎপর্যগুলো প্রকাশ করেছে
রাশিয়া ও ককেশাশি মুসলিমদের মধ্যকার লড়াই যে রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক তাৎপর্যগুলো প্রকাশ করেছে
মুসলমানদের জন্য কি একথা প্রমাণের জন্য অন্য কোন দলিলের প্রয়োজন আছে যে, রাশিয়ান আগ্রাসন শয়তানি ক্রুসেড হামলার একটি অংশ এবং তাদেরকে ব্যর্থ করার জন্য যুদ্ধ করা সর্বার্থেই জিহাদ? এটাই প্রকৃত জিহাদ। কারণ এটা শুধু চেচনিয়া স্বাধীন করার জিহাদ নয়, রবং মুসলিম জাতির প্রতিরক্ষার জিহাদ। (১)
চেচেন জিহাদ অতীতে ও বর্তমানে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সুউচ্চ তাৎপর্য প্রকাশ করেছে, যার কয়েকটি আমি নিম্নোক্ত শিরোনামগুলোর অধীনে সংক্ষেপে আলোচনার করার চেষ্টা করব:
১- চেচনিয়া ইসলামের বিরুদ্ধে ক্রুসেড যুদ্ধের রণাঙ্গনসমূহ হতে একটি রণাঙ্গন।
ক- মুসলিম ককেশাশের সাথে লড়াইয়ে রাশিয়াকে পশ্চিমা ক্রুসেডার বিশ্বের সহায়তা।
খ- মানবাধিকার ইস্যূ ব্যবহারে সমস্ত খৃষ্ট জগতের ঐক্যমত্য।
২- চেচেন জনগণের শ্রেষ্ঠত্ব
ক- ইসলামের খেদমতে এবং ককেশাশি মুসলিমদের খেদমতে নিজেদের ভূমিকার ব্যাপারে চেচেনদের ভাবনা।
১. রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে নিজেদের জিহাদের ব্যাপারে চেচেনদের উপলব্ধি।
২. শরয়ী আইনের প্রবেশ ঘটানো।
৩. এটিই একমাত্র স্বাধীনতা আন্দোলন, যা ক্ষমতাসীন রাশিয়ান প্রজাতন্ত্রের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল।
খ- আত্মত্যাগ ও আত্মসম্মান
গ- প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কট্টরতা:
***
১- চেচনিয়া হল ইসলামের বিরুদ্ধে ক্রুসেড যুদ্ধের রণাঙ্গনসমূহ হতে একটি রণাঙ্গন:
ক- মুসলিম ককেশাশের সাথে লড়াইয়ে রাশিয়াকে পশ্চিমা ক্রুসেডার বিশ্বের সহায়তা
শায়খ সেলিম খান ইয়ানদারবি রহ. বর্ণনা করেন: পশ্চিমারা মনে করে, ১৯৯৬ সালে চেচনিয়ায় ইসলামী বিশ্বের বিজয় এমন একটি বিষয়, যার জন্য ইসলামী বিশ্বকে শাস্তি দেওয়া জরুরী। একারণেই তারা দ্বিতীয় যুদ্ধে চেচনিয়াকে ধ্বংসের ক্ষেত্রে রাশিয়ার হাত উম্মুক্ত করে দেয়। তিনি বলেন:
“তাই ক্রুসেডার শিবিরের অভ্যন্তরে প্রধান সমস্যা হল, রাশিয়া পশ্চিমাদের পেশকৃত শর্তগুলো মেনেই নতুন সাম্রাজ্যবাদি ব্যবস্থায় প্রবেশ করতে আগ্রহি।
...............
কারণ শোভেনিয়া এমন একটি রাষ্ট্র, যারা নিজেদেরকে মহা শক্তিধর মনে করে এবং তাদের নগ্ন ফ্যাসিবাদি ব্যবস্থা তাদেরকে পশ্চিমা বিশ্বের এক শক্ত অংশীদারে পরিণত করে। এছাড়াও যেহেতু তাদের বাস্তব প্ল্যানগুলো সবসময়ই সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দু। কারণ তারা কোন যৌথ লক্ষ্য নিয়ে কোন সংগঠনের সাথে যুক্ত হওয়া কঠিন। উপরন্তু পশ্চিমারা এই পরিস্থিতিতে নেই যে, তারা খুব সহজেই রাশিয়াকে ভুলে যাবে।
.................
তাই যখন পশ্চিমারা রাশিয়াকে সন্তুষ্ট করবে না, তখন যদি রাশিয়া নিজ ইচ্ছেমত নিজের পথে চলতে চায়, তখন রাশিয়ার পক্ষ থেকে আশঙ্কা থেকে যায়। এর ফলে সেই বাস্তব আশঙ্কা তৈরী হয়, যা খৃষ্টান শিবিরের মাঝে আরেকটি অনর্থক সংঘর্ষে পরিণত হতে পারে, যা তাদেরকে ভিতর থেকে দুর্বল করে দিবে।
.............
এজন্য পশ্চিমা বিশ্ব বলকানে রাশিয়ার প্রত্যক্ষ অনুপ্রবেশ ব্যতিত নিজেদের একক কর্তৃত্ব চর্চা করার জন্য যে মূল্য দিতে বাধ্য হয়েছে, তা কী ছিল? উত্তর স্বাভাবিক: তা হল চেচনিয়া। তাই রাশিয়াকে ককেশাশে হস্ত সম্প্রসারিত করার জন্য পরিপূর্ণ সুযোগ দিয়েছে। এর বিনিময়ে রাশিয়া পশ্চিমা বিশ্বকে বলকানে নিজেদের অব্যাহত টার্গেট বাস্তবায়নের সুযোগ দিবে। এর মাঝে ইসলামী বিশ্বকে শাস্তি দেওয়াও উদ্দেশ্য ছিল, যারা দাবি করেছিল, ১৯৯৬ সালের বিজয় তাদেরই বিজয়। অপরদিকে এ বিজয়ের মধ্যে খৃষ্টীয় মতাদর্শগুলো এক অবিস্মরণীয় পরাজয় দেখতে পেল। তাই অবশ্যই এটাকে ইসলামী বিশ্বের বিরুদ্ধে রূপান্তরিত করতে হবে।
.............
অন্য কথায়, খৃষ্ট ধর্মের দ্বিতীয় সহস্রাব্দের পূর্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সমাবেশে তাদের জন্য কোন বাধা বা নিয়ন্ত্রণ ব্যতিত নিজেদের ইচ্ছেমত চেচনিয়াকে ধ্বংস করা এবং ব্যাপকভাবে পুরো ইসলামী বিশ্বকে পরাজিত করার কাজ শুরু করার অনুমতি লাভ হয়েছিল।”
পশ্চিমারা কিভাবে সমস্ত ইসলামী বিশ্বের উপর এবং বিশেষ করে চেচনিয়ার উপর নিজেদের কর্তৃত্ব চাপিয়ে দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে খেলছে, তা পরিস্কার করতে গিয়ে তিনি বলেন:
“উদাহরণ স্বরূপ- এই আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী প্রতিটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার ও ইচ্ছার স্বাধীনতা আছে। অন্যকথায়, তার জন্য নিজ দেশে নিজের বিশেষ ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া ও উন্নতি করার অধিকার আছে।
কিন্তু কার্যক্ষেত্রে আমরা কী দেখি? প্রতিটি জাতিই কি কার্যকরীভাবে এই অধিকার লাভ করতে পারে? কেউ কেউ পারে। যেমন কার্যক্ষেত্রে দেখি যে, ইহুদী জাতি এ অধিকার পরিপূর্ণভাবে ভোগ করছে, অথচ এটা তাদের দেশ নয়। জাতিসঙ্ঘের তত্ত্ববধানে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এমনিভাবে কমিউনিষ্ট ব্লকের পতনের পর ক্রোয়েশিয়া, ম্যাসেডোনিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, স্লোভাকিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশ, মোল্দাভিয়া, জর্জিয়া প্রভৃতি রাজ্যসমূহকে কোন বাধা ছাড়া আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা হয়েছে। পক্ষান্তরে আযারবাইযান, কাজাখস্তান, কিরগিজিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, চেচনিয়া প্রভৃতি রাজ্যের জনগণের জন্য এটা গুরুতরভাবে নিষিদ্ধ। অথচ তাদের খুব উত্তমভাবেই আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের নির্দিষ্ট কিছু রূপ চর্চা করা সম্ভব ছিল।
এখানে এটা লক্ষ্য না করলেই নয় যে, প্রথম গ্রুপটি এমন কতগুলো রাষ্ট্র, যারা খৃষ্টান। অন্য কথায়, তাদের ইতিহাস খৃষ্টীয় আইন ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা যখন স্বাধীনতা লাভ করল, তখন এর জন্য কোন ধরনের সংঘাতের সম্মুখীন হতে হয়নি। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় গ্রুপটি, যাদের ব্যাপারে এটা লক্ষ্য না করলেই নয় যে, তার প্রত্যেকটিই ইসলামী রাষ্ট্র- তাদেরকে মৌলিকভাবে খৃষ্টীয় মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত আইনের উপরেই থাকতে বাধ্য করা হয়। এটাই (অর্থাৎ খৃষ্টীয় মূল্যবোধের আইন) তো সেই উত্তরাধিকার স্বত্ব, যা বহন করার জন্য পূর্বে সেভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকেও বাধ্য করা হয়েছিল।
এ পর্যন্ত শুধুমাত্র তাজিক ও চেচেন জনগণই তাদের পরিপূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার এবং এমন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অধিকার বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা করেছে, যা তাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জীবনধারা অনুযাযী চলবে। এর ফলে তাজিকিস্তান তাৎক্ষণিকভাবে রাশিয়ান আক্রমণের শিকর হয় এবং গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়, যার বলি হয় এক মিলিয়নের অধিক মুসলিমের প্রাণ। আর এই আগ্রাসন বিক্ষিপ্ত বিভক্ত তাজিক জনগণের উপর ভিনদেশি আইন ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়। এটাই তো হুবহু সেই ফলাফল, যা জাতিসঙ্ঘ আফগানিস্তানে ও কাশ্মীরে বাস্তবায়ন করতে চেষ্টা করেছে। হয়ত অচিরেই আমরা এর ন্যায্যতার কারণগুলোও ভুলে যাব। ফলে তখন আর কথিত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলমান থাকবে না।
এর বিপরীতে স্বয়ং জাতিসঙ্ঘ এবং যারা তাতে কর্তৃত্ব করছে, তারা নিজেরাই সর্বাধিক ভয়ংকর সন্ত্রাসী সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব করছে এবং আরো ভয়ংকর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত।
চেচনিয়ার কী অবস্থা হয়েছে? চেচেনগণ ইসলামী ইতিহাস ও ইসলামী সংস্কৃতির প্রকৃত নীতি ও আদর্শ অনুযায়ী তাদের প্রকৃত আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের জন্য লড়াই করার কারণে কত প্রকার ভয় ও আতঙ্কের মাঝে জীবন যাপন করছে, গভীরভাবে চিন্তা করুন!
আরেকটি বিষয় বলা আবশ্যক যে, রাশিয়া আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে নতুন কোন আইনের বিরোধিতা করেনি। আমরা গণহত্যা ও সন্ত্রাসবাদকে যুদ্ধের অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করার বিষয়গুলো দেখে দেখে পরিপূর্ণ অভ্যস্ত। তাই রাশিয়া কথিত আন্তর্জাতিক সমাজের ব্যবহৃত উপায়গুলোর বিপরীত কিছুই করেনি, তবে কখনো আংশিকভাবে করতে পারে। কারণ তারাও নিজেদেরকে কথিত পশ্চিমা গণতন্ত্রের মাধ্যমেই পরিচিত করে, যে গণতন্ত্র রাশিয়ান অপরাধের ব্যাপারে নিরব থাকে, এমনকি সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন পথ খুঁজতে থাকে। বিষয়টিকে অন্যভাবে বুঝানোর জন্য বলব: পশ্চিমা কাকগুলো কখনো অন্য কাকের চক্ষু উপড়াতে বের হবে না। বরং তারা প্রত্যেকেই সর্বদা একে অপরকে বাঁচাতে চিৎকার চেচামেচি করবে।
যখন সাবেক সেভিয়েত প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য জাতিগুলো অত্যন্ত দৃঢ়তা, সংকল্প ও উদ্যমতার সাথে নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা করল- যেমন সেভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তাজিকিস্তান ও চেচনিয়া করেছে - তখনই তারা একই পরিণতির সম্মুখীন হল। বসনিয়া ধ্বংস করা হল। কুরসুবাকে আংশিক ধ্বংস করা হল। কারণ সাম্রাজ্যবাদি খৃষ্টান রাষ্ট্রগুলো জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে তাদেরকে যে অপশনগুলো দিয়েছিল, তারা তার থেকে নিজেদের স্বার্থ নিয়ন্ত্রণ করার অধিকারটি গ্রহণ করেছিল।
এটাকে সেই অমানবিক হামলাসমূহের সাথে তুলনা করুন, যার কোন শেষ নেই, যা কাশ্মীর ও ফিলিস্তীনে সংঘটিত হয়েছে, যেখানে একটি স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চলছে। এটাকে সেই ত্রাসের সাথেও তুলনা করুন, যা আফ্রিকা ও এশিয়ার অন্যান্য অংশে মুসলিম অধিবাসীদের উপর চলছে। তাদের অপরাধও এটাই যে, তারা জাতিসঙ্ঘেরই দেওয়া শর্ত মোতাবেক নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে। এ উদাহরণগুলোর মাধ্যমেই নমুনা স্পষ্ট হয়ে গেছে।
(১) শায়খ সেলিম খান ইয়ানদারিব
Comment