তৃতীয় অধ্যায়: ময়দানে প্রত্যাবর্তন- পঞ্চম পরিচ্ছেদ:দাগিস্তান: উপায় শেষ হওয়ার পর সাহায্য- প্রথম বিষয়: ককেশাসের পরিস্থিতি নিয়ে কিছু ভাবনা- চতুর্থ ভাগ:রাশিয়া ও ককেশাশি মুসলিমদের মধ্যকার লড়াই যে রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক তাৎপর্যগুলো প্রকাশ করেছে
(পূর্ব প্রকাশের পর)
চেচনিয়ার জিহাদ কোন নতুন বিষয় নয়। বরং এটা জিহাদের ধাপসমূহ হতে একটি ধাপ। যার ইতিহাস নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে সংঘটিত বদর যুদ্ধের দিকে ফিরে যায়, অথবা কখনো তার থেকেও দূরে জালুতের সাথে নবী দাউদ আলাইহিস সালামের যুদ্ধের দিকে ফিরে যায়। চেচনিয়ার জিহাদ আল্লাহর নামে প্রকৃত ইনসাফ বাস্তবায়নের জন্য চিরন্তন জিহাদের ইতিহাসের আরেকটি অধ্যায়।
ইসলাম ও জিহাদের এই উন্নত উপলব্ধির কারণেই- যা উক্ত অনন্য নেতা সেলিম খান ইয়ানদারবি রহ. তার জাতির প্রতিনিধি হিসাবে গুরুত্বের সঙ্গে বললেন- চেচেনগণ আজও পর্যন্ত ক্রুসেডার ও কমিউনিষ্ট রাশিয়ার আক্রমণসমূহের মোকাবেলা করতে পারছেন এবং মুসলিম ককেশাশের পর্বতচূড়ায় সম্মানের পতাকা সুউচ্চ করেছেন। শুধু তাই নয়, তাদের অন্তরে তরঙ্গায়িত মর্যাদার চেতনা ইসলামী বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের মুসলিম যুবকদের মাঝে বিস্তার করতে পেরেছেন।
তবে এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আছে। তা হল: চেচনিয়ার জনগণ পর্যাপ্ত পরিমাণে এমন নেতা পেয়েছেন, যারা অবিচলতা, দৃঢ়তা, উচ্চ মনোবল এবং নিজ ধর্ম, ইতিহাস ও জাতির ব্যাপারে আত্মমর্যাদাবোধের উন্নত স্তরে ছিলেন। আমরা যে সময়কালের আলোচনায় আছি, কেউ যদি এ সময়গুলোতে বিদ্যমান চেচেন জাতির নেতৃবৃন্দের প্রতি দৃষ্টি দেয়, তাহলে দেখতে পাবে, জাওহার দুদায়েভ, সেলিম খান ইয়ানদারবি, আসলান মাসখাদুভ ও শামিল বাসিফের মত সুপুরুষদেরকে। (আল্লাহ তাদের সকলের প্রতি রহমত নাযিল করুন) আল্লাহ তাদের প্রত্যেককে শহিদ হিসাবে মনোনীত করেছেন। এমন জালিম অহংকারী তাগুতী বাহিনীর বিরুদ্ধে (,যাদের মাঝে আর তাদের মাঝে শক্তি, সংখ্যা ও সরঞ্জামের দিক থেকে কোন তুলনাই হয় না) চেচেন জনগণের সাহসী জিহাদী মোকাবেলার রহস্যগুলোর মধ্যে এ সকল মহান নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বও একটি রহস্য।
আরেকটি প্রশ্নও উঠতে পারে: মুসলিম ককেশাশের অন্যান্য অঞ্চলগুলো কি চেচনিয়ার সাথে তাদের বীরত্বময় জিহাদি যাত্রায় অংশগ্রহণ করেছিল?
এখানে স্পষ্টভাবে জনগণের অবস্থান আর সরকারের অবস্থানের মাঝে পার্থক্য করতে হবে। ককেশাশের অন্যান্য অঞ্চলের জনগণ এমন সরকারসমূহের অধীনে ছিল, যারা মস্কোর অনুগত ছিল। তাদের সেরকম উন্নত নেতৃত্ব জোটেনি, যেমনটা জুটেছে চেচনিয়ার জনগণের। একারণেই আমরা সেসকল জনগণের ভূমিকা আর তাদের সকারের ভূমিকার মাঝে স্পুষ্ট পার্থক্য দেখতে পাই।
এই জনসহানুভূতি সম্পর্কেই শায়খ সেলিম খান ইয়ানদারবি রহ. বলেন:
“এ যুদ্ধে ককেশাশের অন্যান্য মুসলিমদের অংশগ্রহণের ব্যাপারে বলব: এটা কোন গোপনীয় বিষয় নয় যে, দাগিস্তানের মুসলিমগণ এবং এর আরো অনেক অঞ্চলের মুসলিমগণ হিম্মত ও সাহসিকতার সাথে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। যুদ্ধের শুরুতে প্রায় এক হাজার এ ধরণের মুজাহিদ ছিলেন, যাদের মধ্যে কিছু সংখক সাবেক সেভিয়েত ইউনিয়নের নাগরিক ছিলেন। এতদসত্ত্বেও এটা উল্লেখ করা সঙ্গত যে, এ সকল যোদ্ধাদের সিংহভাগই এসেছিলেন দাগিস্তান থেকে। ১৯৯৯ সালের গ্রীস্মে যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় আমাদের যোদ্ধা বাহিনীর ১০% মুজাহিদ চেচনিয়ার বাইরের ছিলেন। যা এ যুদ্ধে তাদের অবদানকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে। এছাড়া শুধু তাদের উপস্থিতিই সাধারণভাবে সকল জিহাদের প্রতি এবং বিশেষভাবে চেচনিয়ার জিহাদের প্রতি উক্ত অঞ্চলের মুসলিমদের অবস্থান প্রকাশ করে।”
এখানে আমরা যা উল্লেখ করলাম, তার আলোকে এ প্রশ্ন করা অতিরিক্ত হবে যে, ককেশাশের লোকেরা তাদের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ব্যাকুল কি না?
আসলে এই প্রশ্ন একমাত্র এমন কারো পক্ষেই করা সম্ভব, যার ককেশাশের ব্যাপারে জানাশোনা নেই। যারাই ককেশাশের ইতিহাস অনুসন্ধান করবে, তারাই জানবে যে, ককেশাশ হল যুগ যুগ ধরে স্বাধীনতা-জিহাদের বাতিঘর। এ কারণেই ককেশাশের সমস্ত জনগণ পূর্ণ আশা নিয়ে চেচনিয়ার জিহাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তবে স্বাভাবিকভাবেই এটা কোন দুরূহ ব্যাপার নয় যে, আমরা সব স্থানেই কিছু বিশ্বাসঘাতক ও তেলবাজ লোক পাই, যারা শুধু নিজের স্বার্থের জন্য কাজ করে। তবে এদের কারণে প্রকৃত রূপ ঘোলাটে করা ফেলা যাবে না।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকষর্ণ করতে চাই। যদিও তা আমাদের আলোচ্য সময়কালের পরে সংঘটিত হয়েছে। তা হল, কেন ইমারাতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানই আশকিরীয়া চেচনিয়া প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃতি প্রদানকারী একমাত্র রাষ্ট্র? এ প্রশ্নের উত্তরে এখানে শায়খ সরদার সেলিম খান ইয়ানদারবি রহ. যা বলেছেন, তা উল্লেখ করব। কারণ তিনি আশকিরীয়া চেচনিয়া প্রজাতন্ত্রের উচ্চ পদের নেতৃত্বে থাকার পাশাপাশি কান্দাহার চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী চেচেন প্রতিনিধি সরদার ছিলেন।
শায়খ সেলিম খান ইয়ানদারবি রহ. বলেন:
“আশকিরীয়ার চেচনিয়া প্রজাতন্ত্রের ব্যাপারে আফগানিস্তানের স্বীকৃতি পশ্চিমা জগতে বিরাট অস্থিরতা সৃষ্টি করে। যৌথ স্বার্থ ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে দু’টি ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে সম্প্রীতি ও প্রথাগত সম্পর্ক পুন:প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে রাশিয়া ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর কর্মকাণ্ড ছিল সাদৃশ্যপূর্ণ।
এটি কেবল একথা মেনে নিতেই সমর্থন যোগায় যে, খৃষ্টান রাষ্ট্রগুলো চেচনিয়ার স্বাধীনতার বিষয়ে একটি যৌথ কৌশলের অংশীদার। তাই সুনিশ্চিতভাবে এটা আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সাপোর্ট করে যে, যেকোন পশ্চিমা শক্তি ও রাশিয়া ইসলামী বিশ্বের ব্যাপারে সাধারণভাবে এক নীতির অধিকারী। আমরা এটা দেখতে পারি, যখন কোন যৌথ বিষয়ে ইসলামী ঐক্যের যেকোন সম্পর্কের প্রতি বা পশ্চিমা বিশ্ব ও তাদের নীতি বিরোধী সরকারি জোটগুলোর প্রতি তাদের প্রত্যক্ষ শত্রুতা প্রকাশ পায়। এটাই ঘটেছে চেচনিয়া-আফগানিস্তান চুক্তির মধ্যে। আর খুব দ্রুতই তাতে ব্যাপক সাড়াও পড়বে। শুধুমাত্র চেচনিয়া প্রজাতন্ত্র ও আফগানিস্তান জোট গঠন করার কারণে এই জোটের বিরুদ্ধে অনেকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্পন্ন হয়ে গেছে। এমনিভাবে যারাই এই পন্থায় কাজ করার চিন্তা করবে, তাদের বিরুদ্ধেই এটা ঘটবে। ওয়াশিংটন সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে, যে রাষ্ট্রই চেচনিয়া প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃতি দিবে, তারাই মন্দ পরিণতির সম্মুখীন হবে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো ও জাতিসঙ্ঘের পক্ষ থেকে ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর কাছে প্রতিনিধি প্রেরণ করে একথা স্পষ্ট করে দেওয়া হয় যে, আফগান আন্দোলন গ্রহণযোগ্য নয়। এটাকে পূর্ববর্তী নীতি হিসাবে বিবেচনা করা উচিত নয়।
তাই উপরোল্লেখিত উদাহরণটি প্রাসঙ্গিকভাবে এটা স্পষ্ট করে যে, বিশ্ব পরিচালনাকারী নতুন সাম্রাজ্যবাদি খৃষ্টান রাষ্ট্রগুলো কোন পন্থায় কাজ করছে। তারা সর্বদাই এমন যেকোন ব্যক্তির পথে বাধা দিতে বা তাকে দুর্বল করতে সচেষ্ট, যার ব্যাপারে তারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে, সে তাদের প্রতিপক্ষ ও শক্তিমান। যেমন আমরা দেখেছি, কথিত আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়ন করাই হয়েছে এই নীতির সেবা করার উদ্দেশ্যে। তাই তার কাজই হল শক্তিশালীরা নিজেদের স্বার্থে যেকোন কাজ করতে চাইলে তাকে মিথ্যা প্রত্যয়ন করা এবং অন্যায়ভাবে বৈধতা প্রদান করা। তাই চূড়ান্ত লক্ষ্য হল এমন একটি বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যা বাধাহীনভাবে এ সমস্ত স্বার্থগুলোর সেবা করবে। আর স্বভাবতই এ ব্যবস্থাটি এই গ্রহে বসবাসকারী সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের হিসাবে হবে, যারা নিজেদেরকে কথিত পশ্চিমা গণতান্ত্রিক আদর্শের কাছে অনুগত ও নত করবে। এ প্রক্রিয়াটি এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে খুব শীঘ্রই পৃথিবী আরো বেশি খৃষ্টান-অখৃষ্টান দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়বে।”
(৪) আত্মমর্যাদা ও সম্মানবোধ:
চেচেন জাতির সুপরিচিত বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে আরেকটি হল, তীব্র আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মান। এর একটি উদাহরণ হল, ১৯৯৬ সালের মে মাসে রাশিয়ান রাষ্ট্রপতি বরিস ইয়ালতাসিনের সাথে সংলাপের সময় রাষ্ট্রপতির সামনে শায়খ সেলিম খান ইয়ানদারবি রহ. এর বিখ্যাত অবস্থান। যখন চেচেন প্রতিনিধি উপস্থিত হল, তখন ইয়ালতাসিন অহংকারের সাথে শায়খ সেলিম খান ইয়ানদারবিকে তার এক পাশে বসতে আদেশ করল। শায়খ সেলিম দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করে জবাব দিলেন, তিনি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের প্রধান। তাই সামনা সামনি ছাড়া কখনো বসবেন না। অন্যথায় সংলাপের কোন আগ্রহ নেই। কয়েক মিনিট দ্বিধায় থাকার পর ইয়ালতাসিন গণমাধ্যমে ফিরে আসে এবং সেলিম খানের শর্ত মেনে নেয়।
(৫) প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সীমাহীন জেদ:
এই জেদ সম্পর্কে আনাতুল লেভিন বলেন:
“শামিলের যুদ্ধগুলোর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি হল, যা আমাদের সময়ও পুনরাবৃত্তি ঘটেছে: প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সেই সীমাহীন জেদ এবং সর্বোপরি পরাজয় থেকে পুনরুত্থানের সেই আশ্চর্যজনক ক্ষমতা, যা কখনো অসম্ভব মনে হতে পারে।
তাই দুই বার রাশিয়া ধারণা করেছিল, তারা চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে ফেলেছে। ১৮৩২ সালে রাশিয়া দাগিস্তানের জিমিরিতে ব্যাপক হামলা করল, মোল্লা গাজীকে হত্যা করল, কিন্তু গভীর ক্ষত হওয়া সত্ত্বেও আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যাওয়া শামিলই ১৮৩৪ সালে ইমাম নিযুক্ত হলেন। তারপর ১৮৩৯ সালে রাশিয়া উখলুজে তার ঘাটিতে ঢুকে পড়ল। তার নিকটতম অনুসারীদের মধ্যে অনেককে ঘিরে ফেলল। কিন্তু শামিল দ্বিতীয়বার আহত অবস্থায় পলায়ন করলেন। তখন তার পিঠে ছিল তার ছোট পুত্র। যেহেতু বড় ছেলেকে জিম্মি হিসাবে রাশিয়ার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। অতঃপর পুনরায় তার অনুসারীরা একত্রিত হয়ে নতুন করে যুদ্ধ চালিয়ে গেল।”
এ তো এই মহান ইমামের বীরত্বের দীর্ঘ সিরিজের একটি উদাহরণ মাত্র। যার ব্যাপারে আমি মনে করি: তিনি জীবনের শেষ নি:শ্বাস পর্যন্ত আল্লাহর পথে জিহাদ, রিবাত ও অবিচলতার প্রতীক হয়ে যতদিন আল্লাহ চান মসুলমনাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন ইনশাআল্লাহ।
Comment