বিপ্লবের রূপরেখা
বিপ্লবের পরিচয়
যেকোনও কাজের জন্য একটি রূপরেখা তৈরি করতে হয়। কাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধাপে-ধাপে অগ্রসর হওয়ার জন্য সামগ্রিক কাজের একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়। কাজটি শুরু করে এক লাফেই কাজের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছা সম্ভব নয়। যে ব্যক্তি এমনটা আশা করে সে নির্বোধ।
তদ্রুপ, বিপ্লব তথা আমূল পরিবর্তনের জন্যও প্রয়োজন বাস্তবসম্মত ও বিশদ বিবরণ-সমৃদ্ধ রূপরেখা তৈরি করা। উক্ত রূপরেখায় পৃথিবীতে অতীত-বর্তমানে ঘটিত প্রতিটি বিল্পবের মৌলিক উপাদান, প্রেক্ষাপট ও বিপ্লবের স্তরভিত্তিক বর্ণনা থাকবে।
রাষ্ট্র বা সমাজব্যবস্থার কাঠামোগত আমূল পরিবর্তনকে বিপ্লব বলে। যেমন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইসলামি বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব।
মূলত প্রতিটি বিপ্লবেই তার পূর্বে ঘটিত বিপ্লবের উপাদানগুলো বিদ্যমান ছিল। তবে প্রতিটি বিপ্লবের প্রেক্ষাপট এক ছিল না। পক্ষান্তরে বিপ্লবের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মাঝেও ভিন্নতা ছিল। তাই, বিপ্লবের উপাদান, প্রেক্ষাপট ও স্তর-সমৃদ্ধ রূপরেখা ভালোভাবে অনুধাবন করা আমাদের জন্য আবশ্যক।
বিল্পবের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য
বিল্পব যেমন ধর্মভিত্তিক আদর্শের অনুসারীদের দ্বারা সংগঠিত হতে পারে, তদ্রুপ ধর্ম অস্বীকারকারী সেক্যুলারদের দ্বারাও হতে পারে। মূলত যেকোনও চিন্তাধারার মানুষই তার চিন্তাধারার লোকদের নিয়ে বিল্পবের সূচনা করতে চায়। কিন্তু, বিপ্লবের সূচনা করা বা সূচনা করেও ব্যর্থ হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, বিপ্লবের মৌলিক উপাদান বিদ্যমান না থাকা, প্রেক্ষাপট না বোঝা এবং বিপ্লবকে স্তরে-স্তরে না সাজানো।
ব্যক্তি, গোত্র, দল বা ধর্মের চিন্তাধারা প্রতিষ্ঠা করাই বিল্পবের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। ধার্মিক হলে স্বীয় ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা, সেক্যুলার হলে নিজের নাস্তিকতা ও ধর্ম-নিরপেক্ষ মতবাদ প্রতিষ্ঠা করা বিপ্লবের উদ্দেশ্য হয়। প্রাচীন পারস্য সম্রাটদের লক্ষ্য ছিল পৌত্তলিক ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা, রোম সম্রাটদের উদ্দেশ্য ছিল খৃস্টধর্ম প্রতিষ্ঠা করা, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহ-প্রদত্ত দ্বীন ইসলাম কায়েম করা, ইউরোপের বিজ্ঞান-মনস্ক সেক্যুলারদের ফরাসি বিপ্লবের উদ্দেশ্য ছিল সেক্যুলার রাষ্ট্র জন্ম দেওয়া।
বিপ্লবের মৌলিক উপাদান
যে বস্তুগুলোর সাহায্যে কোনও কিছু গঠিত হয় সে বস্তুগুলোকে উপাদান বলে। যেমন, টেবিল তৈরির জন্য কাঠ হচ্ছে মৌলিক উপাদান। তদ্রুপ বিপ্লবের জন্যও কিছু বিষয় আবশ্যক; যেগুলোকে বিপ্লবের মৌলিক উপাদান বলে। নিম্নে বিপ্লবের মৌলিক উপাদানগুলো পয়েন্ট আকারে তুলে ধরা হলো।
১। রিজাল: রিজাল বা কর্মী ছাড়া বিপ্লব সংগঠিত হওয়া অসম্ভব।
২। আমওয়াল: বিপ্লব চলমান রাখতে আমওয়াল বা সম্পদের প্রয়োজনীয়তা দেহের জন্য রক্তের মতো।
৩। আসলিহা: আসলিহা বা অস্ত্র হচ্ছে বিপ্লবের প্রধান হাতিয়ার। অস্ত্র দিয়ে শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করা, নিজেদের সুরক্ষিত রাখা এবং শত্রুকে ভীত-সন্ত্রস্ত করা হয়।
বিপ্লবের প্রেক্ষাপট
সাধারণত দেশে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হলে বিপ্লবের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। শাসকের জুলম-অত্যাচার, জনস্বার্থ লঙ্ঘন, অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, বহিঃরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ও আগ্রাসন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, শত্রুপক্ষের ষড়যন্ত্র ইত্যাদির ফলে দেশে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
বিপ্লবের পরিবেশ ইসলাম ও ইনসাফ কায়েমের জন্য মুসলিমদের পক্ষ থেকেও তৈরি হতে পারে, আবার ইসলামি রাষ্ট্রে কুফর ও জুলম প্রতিষ্ঠার জন্য কাফের ও জালেমের পক্ষ থেকেও হতে পারে।
বিপ্লবের স্তরসমূহ
চাইলেই একদিনে বিপ্লব বা আমূল পরিবর্তন সম্ভব নয়। বিপ্লবের জন্য ধাপে-ধাপে অগ্রসর হয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে হয়। নিম্নে বিপ্লবের স্তরগুলো পয়েন্ট আকারে উল্যেখ করা হলো।
১। দাওয়াহ: দাওয়াতের মাধ্যমে বিপ্লবের মৌলিক উপাদানগুলো প্রস্তুত করতে হয়। রিজাল আসবে দাওয়াতের মাধ্যমে, আমওয়ালের বন্দোবস্ত হবে দাওয়াতের মাধ্যমে, আসলিহার যোগানও হবে দাওয়াতের মাধ্যমে। সবগুলোর সাথেই সরাসরি দাওয়াতের সম্পর্ক রয়েছে।
২। ইদাদ: উপাদানগুলো প্রস্তুত করার পাশাপাশি নিজেদেরকে সামগ্রিকভাবে বিপ্লবের উপযোগী করে তুলতে কর্মীদের ইদাদ বা প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হয়।
৩। রিবাত: দাওয়াত ও ইদাদের স্তরে এসে কিছু কিছু খন্ডযুদ্ধের সূচনা করতে হয়। এতে নিজেদের শক্তিমত্তা, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য জানান দেওয়ার পাশাপাশি জনসমর্থনও আদায় হয়।
৪। কিতাল: কর্মীদের প্রশিক্ষণ পূর্ণ হলে চূড়ান্ত ও মিমাংসাকারী যুদ্ধে নামতে হয়। চূড়ান্ত যুদ্ধে হয় বিজয়, নয় শাহাদাত-এমন মানসিকতা রাখতে হয়।