ইসালাম কতই না মহান। আর দুনিয়াতে ইসলাম ফিরিয়ে আনতে মহান ব্যক্তিদের কতই না প্রয়োজন।
আর এই মহান ব্যাক্তিদের কাছে আমাদের নূন্যতম কিছু চাহিদা রয়েছে-
১) পরিশুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন ফিকর
২) উদাসীনতা ত্যাগ ও উদ্যমী মানসিকতা
৩) ইলম ও নেতৃত্বের ভারসাম্যপূর্ণ সহাবস্থান
৪) হিম্মত
(১)
যখন কোন মুমিন এই মহান দ্বীনের জন্য নিজ প্রবৃত্তির চাহিদা থেকে শুরু করে স্বীয় জীবনকে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হয়, তখন তার জন্য অত্যাবশ্যক হল সঠিক ফিকর ও পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনে সচেষ্ট হওয়া। কেননা, আল্লাহ্ তা'আলার সুন্নাহ বা সৃষ্টিগত ব্যবস্থাপনা কারো পক্ষপাতিত্ব করে না।
ইলাহি রীতি অনুযায়ী মুমিন-কাফির সকলেই সমানভাবে বিচার্য হয় এক্ষেত্রে।
যেমন মুমিন বা কাফের উভয়ের জন্যই পানি ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফুটতে শুরু করবে; মুমিনের জন্য তা ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফুটতে শুরু করবে না। আল্লাহ্ তা'আলার বিশেষ তাওফিকের কথা ভিন্ন বিষয়।
বিষয়টি অত্যন্ত চমৎকারভাবে বোঝা যায়, ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রাহঃ এর বক্তব্য থেকে
"আল্লাহ্ তা'আলা ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত কাফির রাষ্ট্রকে সাহায্য করেন ও টিকিয়ে রাখেন। আর অত্যাচারী জালিম রাষ্ট্র তা মুসলিমদের হলেও পরাজিত করেন ও ধ্বংস করেন।"
অর্থাৎ, সন্দেহাতীতভাবে যে কোনও রাষ্ট্র, তানজীম বা ব্যবস্থাপনার ভিত্তি হল আদল ও ইনসাফ। আমরা এও বুঝলাম যে, আল্লাহ তা'আলার রীতিনীতি সকলের উপর সমানভাবে ক্রিয়াশীল।
মানুষের উপর ইলাহি রীতির যে স্রোত আছড়ে পড়ে, তা একজন মুলিমকেও প্রভাবিত ও ব্যথিত করে। নিয়তের বিশুদ্ধতা, উত্তম গন্তব্য বা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা ইলাহি রীতির পরিবর্তন ঘটায় না, যদিও এসবই নেক আমল কবুল হওয়ার অন্যতম শর্ত।
আল্লাহ্ তা'আলা স্বীয় শরীয়তে যত আদেশ নিষেধ পছন্দ অপছন্দনীয় বিষয় সাব্যস্ত করেছেন; তার প্রতিটিতেই জাগতিক কোন না কোন সমাধান আছে। আল্লাহর রাসূল (সা) এর প্রতিটি সুন্নাহর অনুসরণে আখিরাতের সফলতার পাশাপাশি দুনিয়াবী কোন না কোন উপকারিতা ও সমাধান নিয়ে আসে।
তাই কোন ব্যক্তি যদি আল্লাহ্ তা'আলার শরীয়তের বিধিবিধান সুন্নাহ অনুযায়ী পরিপূর্ণভাবে মেনে চলে, তাহলে সে অবশ্যই দুনিয়াতে ইলাহী ওয়াদার বাস্তবায়ন দেখতে পাবে। ফলে সে দুনিয়াতে ও আখিরাতে হবে সৌভাগ্যবান।
যখন কোনো বান্দা বা জামাত দুনিয়াতে আগত বালা-মুসিবতের ফলে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে, ব্যর্থতার পর ব্যর্থতা ছাড়া কোনো কিছুই দেখতে পায়না; তখন বুঝে নিতে হবে আল্লাহ্ তা'আলার হুকুম পালনে অথবা আল্লাহর রাসূল সাঃ এর সুন্নাহ বোঝা ও অনুসরণে ঘাটতি রয়ে গেছে।
একজন মানুষ যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন; নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ইলাহী রীতি না তার পক্ষপাতিত্ব করে, আর না বিরুদ্ধাচরণ করে। আর এমন হওয়াটা রবের পক্ষ হতে তার বান্দার প্রতি তার নিয়ামতের পূর্ণতার নিদর্শন।
একেক মানুষের জন্য আগুন আর পানির উত্তাপ একেক রকম হওয়া নিঃসন্দেহেই পরিস্থিতি জটিল করে তুলতো। আল্লাহ্ তা'আলার বিশেষ বান্দাদের জন্য বরাদ্দ তাউফিকের বিষয়টি বিশেষ ক্ষেত্র, সাধারণ বাস্তবতা না।
আল্লাহ্ তা'আলা দুনিয়াকে স্বীয় সুব্যবস্থাপনা দ্বারা কায়দা কানুনের আবাস বানিয়েছেন। এসকল কায়দা পরিত্যাগ করা বা এর বিপরীতে চলা সঠিক নয়। তাই ইসলাম ফিরিয়ে আনার পথে যারা কাজ করবেন তাদের সর্বাগ্রে প্রয়োজন ফিকর ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচ্ছন্নতা অর্জন।
(২)
অতঃপর আমরা দেখতে পাচ্ছি 'উদাসীনতা' নামক ভয়াবহ ব্যাধিটি কীভাবে উম্মাহকে গ্রাস করেছে। ব্যক্তি, দল নির্বিশেষে বিক্ষিপ্ত ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্যহীন কর্মকাণ্ডসমূহ উম্মতের বোঝা লাঘবের পরিবর্তে বিপরীত ফলাফলই বয়ে আনছে। এই উদাসীনতা আজ উম্মতের অসংখ্য উত্তম আত্মাগুলোকে আক্রান্ত করে ফেলেছে।
অথচ, পূর্ববর্তী প্রজন্মের মুসলিমদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই ইসলাম আমাদের পর্যন্ত বিশুদ্ধ অবস্থায় পৌঁছেছে। মুহাদ্দিসগণ উম্মাহর কাছে সহীহ হাদীস পৌঁছাতে হাদীস বর্ণনাকারীগণ ও প্রেক্ষাপটের পূর্বাপরের চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে বিন্দুমাত্র ছাড় দেননি। যার ফলাফল আমাদের সামনেই রয়েছে। ইসলামের ইমামগণ ইল্ম, জিহাদ বা দাওয়াতের ক্ষেত্রগুলোতে ছিলেন সমহিমায় উজ্জ্বল।
ইমাম মালিক রাহঃ উদাসীন ব্যক্তির ডাকে সাড়া দিতেন না। তিনি এমন ব্যক্তির আহ্বানেই কেবল সাড়া দিতেন যে কি না অধিক যিকর ও ইবাদতের মাধ্যমে নিজেকে কর্মচঞ্চল রাখতেন।
দুঃখজনক বাস্তবতা তো এই যে আমরা নিজেরা তো উদাসীন, তার উপর কেউ আমাদের কল্যাণকামী হয়ে উদ্যমের দিকে আহ্বান করলে তাকেও আমরা শত্রু ভাবতে শুরু করি।
(৩)
তো, ইসলামের পুনরুত্থানে অগ্রগামী ভূমিকা রাখতে আগ্রহী জামাত ও সচেষ্ট ব্যক্তিবর্গের পরিচ্ছন্ন ফিকর, বাস্তবতা ও শরয়ী ইলমের উপলব্ধি এবং উদাসীনতা পরিত্যাগের পাশাপাশি আরও প্রয়োজন- নেতৃবৃন্দ ও উলামায়ে কেরামের ভারসাম্যপূর্ণ সহাবস্থান।
ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহঃ সুন্দর বলেছেন, আমির-উমারাদের উচিৎ শরয়ী অভিভাবকদের থেকে উপকৃত হওয়া । তবে দ্বীনী অভিভাবকেরা যেন আমির উমারাদের আজ্ঞাবাহি না হয়ে ওঠেন তা নিশ্চিত করতে হবে। কেননা, তা কোনোভাবেই উত্তম ফলাফল আনবে না।
মানুষের মাঝে দুইপ্রকার সম্পর্ক হয়ে থাকে দ্বীনী সম্পর্ক ও জাগতিক সম্পর্ক। আর মানুষের স্বভাবজাত দুর্বলতা এই যে, তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্পর্কের ব্যাপারে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেনা।
তাই নেতৃবৃন্দ ও উলামাদের মাঝে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়া জরুরী। কেননা, নেতৃবৃন্দ ও উলামায়ে কেরামের মাঝে যথাযথ সমন্বয় ঘটলেই ইসলামের উত্থান সম্ভব হবে।
বিশেষত, বিগত কয়েক শতকের ক্রমাগত অবনতির ফলাফল হিসেবে এই বাস্তবতা উম্মত প্রত্যক্ষ করছে যে, একই ব্যক্তির মাঝে নেতৃত্ব ও ইল্মের গভীরতার উপস্থিতি এ জামানায় প্রায় অসম্ভব বা বিরল। এর কারন হিসেবে বলা যায়, হিজরি ১৩তম শতকের শুরু থেকে ইলমি কেন্দ্রগুলোতে- সমসাময়িক বাস্তবতা, পরিবর্তিত দুনিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞান, নতুন প্রজন্মের চাহিদার ব্যাপারে দক্ষতা অর্জন করা দূরে থাক, এবিষয়ে ফিকির করাই ছিল অবিশ্বাস্য কল্পনা।
ইলম চর্চার এমন এক ধারা সে সময় থেকে চলমান আছে, যার স্রোতে ভেসে আসা মস্তিষ্কে শরয়ী ইলম ও রাজনীতি চর্চা ধারন করা সম্ভব হচ্ছে না।
অবক্ষয়যুগের মুসলিম বিশ্বের ব্যাপারে আলোচনার এক পর্যায়ে শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী রাহঃ বলেন, "মাদ্রাসা ও শিক্ষাকেন্দ্রগুলো চরম স্থবিরতা, নির্জীবতা ও বন্ধাত্তের শিকার হয়ে পড়েছিলো।
সেখানেও ছিল (বাস্তব) জ্ঞান ও চিন্তাগত অবক্ষয়ের ছাপ। মুসলিম বিশ্বের উপর তখন জ্ঞান-বন্ধাত্ত ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্থবিরতা কেমন কঠিনভাবে চেপে বসেছিলো, যা থেকে জীবনের কোনো অংন মুক্ত ছিল না।"
(মা যা খসিরাল 'আলাম পৃষ্ঠাঃ ২৭৮ দারুল কলম)
আর একথা সর্বজনবিদিত যে, আমাদের সমাজে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা যা 'দরসে নিজামী' হিসেবে সমধিক পরিচিত সেই অবক্ষয়যুগেরই ফসল।
যার ফলে দরসে নিজামির ছাত্র হিসেবে জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়ে দেয়ার পর, উম্মাহর এই ক্রান্তিলগ্নে নেতৃত্বের দায়িত্ব নেয়ার সক্ষমতা গড়ে তোলা কঠিন থেকে কঠিনতরই হয়ে উঠছে।
বস্তুত, কোনো কওমের মাঝে যত ভালো গুণ ও যোগ্যতাই থাকুক, যদি ফিকরের পরিচ্ছন্নতা ও সচেতনতা না থাকে, তাহলে যে কোনো কপটের কপটতাই তাকে সহজে বিভ্রান্ত করতে পারে। ইলমের কিছু শাখায় পারদর্শিতা বা নফল আমলের আধিক্য এ বিষয়টিকে পরিবর্তন বা প্রভাবিত কোনটাই করে না।
কুখ্যাত প্রাচ্যবিদ বার্নারড লুইস তার ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত 'The return of Islam' প্রবন্ধে বলেন, "আধুনিক বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের অনুপস্থিতি কিংবা সময়ের প্রয়োজনীয় জ্ঞান দ্বারা ইসলামকে সুসজ্জিত করে না এমন নেতৃত্বই বিজয়ী শক্তি হিসেবে ইসলামের গতিকে আটকে রেখেছে।
এমন নেতৃত্বের অনুপস্থিতিই ইসলামী আন্দোলনগুলোকেও দমন করে রেখেছে। আর এমন নেতৃত্বই ইসলামী আন্দোলনকে এক বিশাল রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করতে পারে।"
যাই হোক, উপর্যুপরি ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ, স্থবির চিন্তাধারা এবং প্রায়োগিক বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ না থাকায়, উলামায়ে কেরাম ও নেতৃবর্গের সমন্বিত সম্পর্ক অত্যাবশ্যক।
(৪)
অতঃপর প্রয়োজন হিম্মত। যা হচ্ছে ইচ্ছাশক্তি ও কাজের বাস্তবায়ন সমন্বিত রূপ। আর পরিষ্কার উদ্দেশ্য, কর্মপন্থা ও ফিকর ব্যতীত কেবল হিম্মত কোনো ফলাফল নিয়ে আসতে পারে না। আমাদের সমসাময়িক ও পূর্ববর্তী বিভিন্ন ইসলামী জামাত আমাদের জন্য এর সপক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছে।
তবে যদি কোনো মহান উদ্দেশ্য হাসিলের হিম্মত বা বৈপ্লবিক মানসিকতা না থাকে তবে আমাদের জন্য তাত্ত্বিক কিছু অর্জনের বাইরে ভিন্ন ভিন্ন অর্জন সম্ভব হবে না। বছরের পর বছর একই বৃত্তে, একই সমস্যার দুষ্টচক্রে ঘুরপাক খাওয়ার কোনো বিকল্প থাকবে না।
আর মুসলিমদের জন্য হিম্মতের মূল চালিকাশক্তি হবে তার ইমান, তাকওয়া ও গন্তব্যের সঠিকতা। আমাদের এই পথ আসহাবুল উখদুদের পথ। জমীনে তামকিন লাভ আমাদের অনেকের বা কারো পক্ষেই দেখে না যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তাই শাহাদাত অর্জনের আগ পর্যন্ত আমাদের পূর্বসূরীদের পথের উপর অটল-অবিচল থাকার মাধ্যমে আমরা দুনিয়া আখিরাতের সফলতা অর্জন করতে পারব।
কাপুরুষতা আমাদের মোটাতাজাও করবে না, হায়াতও বৃদ্ধি করবে না। তাই সাহসিকতা ও সুউচ্চ হিমত অর্জনে অগ্রগামী হওয়া উম্মাহর মহান ব্যক্তিদের জন্য আবশ্যক । জীবনমানের আগ পর্যন্ত নিজের মেধা, শক্তি, সময় ও প্রচেষ্টার যতটুকু ব্যয় করার মাধ্যমেই আমরা নিজেদের কাঙ্খিত মর্যাদা হাসিল করতে পারব এবং এবং পারব পরবর্তী প্রজন্মের নির্বিঘ্নে ইসলাম পালনের রাস্তা সহজ করতে।
পরিশেষে একথা মনে রাখা প্রয়োজন - যুদ্ধ মানেই শুধুমাত্র অস্ত্রের ঝংকার নয়। যুদ্ধ বিবাদমান দুটি পক্ষের চূড়ান্ত ফয়সালা করে দেয়। যুদ্ধ মূলত একটি প্রতিষ্ঠানের ন্যায়। এর মাঝে রয়েছে সুদৃঢ় ও সূক্ষ্ম ব্যবস্থাপনা, রব্বানী নেতৃত্ব, মজলুৃম ও সালেহিনদের দুয়া, ঘাত-প্রতিঘাত কিংবা উড়ন্ত খুলি ও রক্তাক্ত দেহের সমারোহ।
আর তাই বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত চিন্তাধারা বা কর্মকান্ডকে আকড়ে ধরে অগ্রসর হওয়াটা আমাদের মোটেও কাম্য নয়।
শায়খ আবু কাতাদা (হাফি) বলেন, "বীরত্ব বা আল্লাহর ওয়াদা বাস্তবায়নের উপায়ের উপর অনেকেই লিখেছেন। কিন্তু পরিচ্ছন্ন ফিকর, ইলাহি রীতিনীতি ও সচেতন নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য নিয়ে খুব কম লোকই কলম ধরেছেন।"
শায়খের এবক্তব্যের আবেদন রক্ষার উদ্দেশ্যে, আল্লাহ্ তা'আলার অনুগ্রহে স্বীয় জ্ঞান, আকল, অভিজ্ঞতা ও উপস্থাপনার যোগ্যতার দুর্বলতা সত্ত্বেও- পূর্ববর্তীদের লেখা ও বক্তব্যের আলোকে অত্র প্রবন্ধটি পেশ করা হলো।
যদিও, এখানে বলা কথার চেয়ে না বলা কথার পরিমাণই বেশী। আর আল্লাহ্ তা'আলাই সকল বিষয়ে সর্বজ্ঞ ও সম্যক অবগত।
আর এই মহান ব্যাক্তিদের কাছে আমাদের নূন্যতম কিছু চাহিদা রয়েছে-
১) পরিশুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন ফিকর
২) উদাসীনতা ত্যাগ ও উদ্যমী মানসিকতা
৩) ইলম ও নেতৃত্বের ভারসাম্যপূর্ণ সহাবস্থান
৪) হিম্মত
(১)
যখন কোন মুমিন এই মহান দ্বীনের জন্য নিজ প্রবৃত্তির চাহিদা থেকে শুরু করে স্বীয় জীবনকে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হয়, তখন তার জন্য অত্যাবশ্যক হল সঠিক ফিকর ও পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনে সচেষ্ট হওয়া। কেননা, আল্লাহ্ তা'আলার সুন্নাহ বা সৃষ্টিগত ব্যবস্থাপনা কারো পক্ষপাতিত্ব করে না।
ইলাহি রীতি অনুযায়ী মুমিন-কাফির সকলেই সমানভাবে বিচার্য হয় এক্ষেত্রে।
যেমন মুমিন বা কাফের উভয়ের জন্যই পানি ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফুটতে শুরু করবে; মুমিনের জন্য তা ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফুটতে শুরু করবে না। আল্লাহ্ তা'আলার বিশেষ তাওফিকের কথা ভিন্ন বিষয়।
বিষয়টি অত্যন্ত চমৎকারভাবে বোঝা যায়, ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রাহঃ এর বক্তব্য থেকে
"আল্লাহ্ তা'আলা ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত কাফির রাষ্ট্রকে সাহায্য করেন ও টিকিয়ে রাখেন। আর অত্যাচারী জালিম রাষ্ট্র তা মুসলিমদের হলেও পরাজিত করেন ও ধ্বংস করেন।"
অর্থাৎ, সন্দেহাতীতভাবে যে কোনও রাষ্ট্র, তানজীম বা ব্যবস্থাপনার ভিত্তি হল আদল ও ইনসাফ। আমরা এও বুঝলাম যে, আল্লাহ তা'আলার রীতিনীতি সকলের উপর সমানভাবে ক্রিয়াশীল।
মানুষের উপর ইলাহি রীতির যে স্রোত আছড়ে পড়ে, তা একজন মুলিমকেও প্রভাবিত ও ব্যথিত করে। নিয়তের বিশুদ্ধতা, উত্তম গন্তব্য বা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা ইলাহি রীতির পরিবর্তন ঘটায় না, যদিও এসবই নেক আমল কবুল হওয়ার অন্যতম শর্ত।
আল্লাহ্ তা'আলা স্বীয় শরীয়তে যত আদেশ নিষেধ পছন্দ অপছন্দনীয় বিষয় সাব্যস্ত করেছেন; তার প্রতিটিতেই জাগতিক কোন না কোন সমাধান আছে। আল্লাহর রাসূল (সা) এর প্রতিটি সুন্নাহর অনুসরণে আখিরাতের সফলতার পাশাপাশি দুনিয়াবী কোন না কোন উপকারিতা ও সমাধান নিয়ে আসে।
তাই কোন ব্যক্তি যদি আল্লাহ্ তা'আলার শরীয়তের বিধিবিধান সুন্নাহ অনুযায়ী পরিপূর্ণভাবে মেনে চলে, তাহলে সে অবশ্যই দুনিয়াতে ইলাহী ওয়াদার বাস্তবায়ন দেখতে পাবে। ফলে সে দুনিয়াতে ও আখিরাতে হবে সৌভাগ্যবান।
যখন কোনো বান্দা বা জামাত দুনিয়াতে আগত বালা-মুসিবতের ফলে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে, ব্যর্থতার পর ব্যর্থতা ছাড়া কোনো কিছুই দেখতে পায়না; তখন বুঝে নিতে হবে আল্লাহ্ তা'আলার হুকুম পালনে অথবা আল্লাহর রাসূল সাঃ এর সুন্নাহ বোঝা ও অনুসরণে ঘাটতি রয়ে গেছে।
একজন মানুষ যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন; নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ইলাহী রীতি না তার পক্ষপাতিত্ব করে, আর না বিরুদ্ধাচরণ করে। আর এমন হওয়াটা রবের পক্ষ হতে তার বান্দার প্রতি তার নিয়ামতের পূর্ণতার নিদর্শন।
একেক মানুষের জন্য আগুন আর পানির উত্তাপ একেক রকম হওয়া নিঃসন্দেহেই পরিস্থিতি জটিল করে তুলতো। আল্লাহ্ তা'আলার বিশেষ বান্দাদের জন্য বরাদ্দ তাউফিকের বিষয়টি বিশেষ ক্ষেত্র, সাধারণ বাস্তবতা না।
আল্লাহ্ তা'আলা দুনিয়াকে স্বীয় সুব্যবস্থাপনা দ্বারা কায়দা কানুনের আবাস বানিয়েছেন। এসকল কায়দা পরিত্যাগ করা বা এর বিপরীতে চলা সঠিক নয়। তাই ইসলাম ফিরিয়ে আনার পথে যারা কাজ করবেন তাদের সর্বাগ্রে প্রয়োজন ফিকর ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচ্ছন্নতা অর্জন।
(২)
অতঃপর আমরা দেখতে পাচ্ছি 'উদাসীনতা' নামক ভয়াবহ ব্যাধিটি কীভাবে উম্মাহকে গ্রাস করেছে। ব্যক্তি, দল নির্বিশেষে বিক্ষিপ্ত ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্যহীন কর্মকাণ্ডসমূহ উম্মতের বোঝা লাঘবের পরিবর্তে বিপরীত ফলাফলই বয়ে আনছে। এই উদাসীনতা আজ উম্মতের অসংখ্য উত্তম আত্মাগুলোকে আক্রান্ত করে ফেলেছে।
অথচ, পূর্ববর্তী প্রজন্মের মুসলিমদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই ইসলাম আমাদের পর্যন্ত বিশুদ্ধ অবস্থায় পৌঁছেছে। মুহাদ্দিসগণ উম্মাহর কাছে সহীহ হাদীস পৌঁছাতে হাদীস বর্ণনাকারীগণ ও প্রেক্ষাপটের পূর্বাপরের চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে বিন্দুমাত্র ছাড় দেননি। যার ফলাফল আমাদের সামনেই রয়েছে। ইসলামের ইমামগণ ইল্ম, জিহাদ বা দাওয়াতের ক্ষেত্রগুলোতে ছিলেন সমহিমায় উজ্জ্বল।
ইমাম মালিক রাহঃ উদাসীন ব্যক্তির ডাকে সাড়া দিতেন না। তিনি এমন ব্যক্তির আহ্বানেই কেবল সাড়া দিতেন যে কি না অধিক যিকর ও ইবাদতের মাধ্যমে নিজেকে কর্মচঞ্চল রাখতেন।
দুঃখজনক বাস্তবতা তো এই যে আমরা নিজেরা তো উদাসীন, তার উপর কেউ আমাদের কল্যাণকামী হয়ে উদ্যমের দিকে আহ্বান করলে তাকেও আমরা শত্রু ভাবতে শুরু করি।
(৩)
তো, ইসলামের পুনরুত্থানে অগ্রগামী ভূমিকা রাখতে আগ্রহী জামাত ও সচেষ্ট ব্যক্তিবর্গের পরিচ্ছন্ন ফিকর, বাস্তবতা ও শরয়ী ইলমের উপলব্ধি এবং উদাসীনতা পরিত্যাগের পাশাপাশি আরও প্রয়োজন- নেতৃবৃন্দ ও উলামায়ে কেরামের ভারসাম্যপূর্ণ সহাবস্থান।
ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহঃ সুন্দর বলেছেন, আমির-উমারাদের উচিৎ শরয়ী অভিভাবকদের থেকে উপকৃত হওয়া । তবে দ্বীনী অভিভাবকেরা যেন আমির উমারাদের আজ্ঞাবাহি না হয়ে ওঠেন তা নিশ্চিত করতে হবে। কেননা, তা কোনোভাবেই উত্তম ফলাফল আনবে না।
মানুষের মাঝে দুইপ্রকার সম্পর্ক হয়ে থাকে দ্বীনী সম্পর্ক ও জাগতিক সম্পর্ক। আর মানুষের স্বভাবজাত দুর্বলতা এই যে, তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্পর্কের ব্যাপারে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেনা।
তাই নেতৃবৃন্দ ও উলামাদের মাঝে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়া জরুরী। কেননা, নেতৃবৃন্দ ও উলামায়ে কেরামের মাঝে যথাযথ সমন্বয় ঘটলেই ইসলামের উত্থান সম্ভব হবে।
বিশেষত, বিগত কয়েক শতকের ক্রমাগত অবনতির ফলাফল হিসেবে এই বাস্তবতা উম্মত প্রত্যক্ষ করছে যে, একই ব্যক্তির মাঝে নেতৃত্ব ও ইল্মের গভীরতার উপস্থিতি এ জামানায় প্রায় অসম্ভব বা বিরল। এর কারন হিসেবে বলা যায়, হিজরি ১৩তম শতকের শুরু থেকে ইলমি কেন্দ্রগুলোতে- সমসাময়িক বাস্তবতা, পরিবর্তিত দুনিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞান, নতুন প্রজন্মের চাহিদার ব্যাপারে দক্ষতা অর্জন করা দূরে থাক, এবিষয়ে ফিকির করাই ছিল অবিশ্বাস্য কল্পনা।
ইলম চর্চার এমন এক ধারা সে সময় থেকে চলমান আছে, যার স্রোতে ভেসে আসা মস্তিষ্কে শরয়ী ইলম ও রাজনীতি চর্চা ধারন করা সম্ভব হচ্ছে না।
অবক্ষয়যুগের মুসলিম বিশ্বের ব্যাপারে আলোচনার এক পর্যায়ে শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী রাহঃ বলেন, "মাদ্রাসা ও শিক্ষাকেন্দ্রগুলো চরম স্থবিরতা, নির্জীবতা ও বন্ধাত্তের শিকার হয়ে পড়েছিলো।
সেখানেও ছিল (বাস্তব) জ্ঞান ও চিন্তাগত অবক্ষয়ের ছাপ। মুসলিম বিশ্বের উপর তখন জ্ঞান-বন্ধাত্ত ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্থবিরতা কেমন কঠিনভাবে চেপে বসেছিলো, যা থেকে জীবনের কোনো অংন মুক্ত ছিল না।"
(মা যা খসিরাল 'আলাম পৃষ্ঠাঃ ২৭৮ দারুল কলম)
আর একথা সর্বজনবিদিত যে, আমাদের সমাজে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা যা 'দরসে নিজামী' হিসেবে সমধিক পরিচিত সেই অবক্ষয়যুগেরই ফসল।
যার ফলে দরসে নিজামির ছাত্র হিসেবে জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়ে দেয়ার পর, উম্মাহর এই ক্রান্তিলগ্নে নেতৃত্বের দায়িত্ব নেয়ার সক্ষমতা গড়ে তোলা কঠিন থেকে কঠিনতরই হয়ে উঠছে।
বস্তুত, কোনো কওমের মাঝে যত ভালো গুণ ও যোগ্যতাই থাকুক, যদি ফিকরের পরিচ্ছন্নতা ও সচেতনতা না থাকে, তাহলে যে কোনো কপটের কপটতাই তাকে সহজে বিভ্রান্ত করতে পারে। ইলমের কিছু শাখায় পারদর্শিতা বা নফল আমলের আধিক্য এ বিষয়টিকে পরিবর্তন বা প্রভাবিত কোনটাই করে না।
কুখ্যাত প্রাচ্যবিদ বার্নারড লুইস তার ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত 'The return of Islam' প্রবন্ধে বলেন, "আধুনিক বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের অনুপস্থিতি কিংবা সময়ের প্রয়োজনীয় জ্ঞান দ্বারা ইসলামকে সুসজ্জিত করে না এমন নেতৃত্বই বিজয়ী শক্তি হিসেবে ইসলামের গতিকে আটকে রেখেছে।
এমন নেতৃত্বের অনুপস্থিতিই ইসলামী আন্দোলনগুলোকেও দমন করে রেখেছে। আর এমন নেতৃত্বই ইসলামী আন্দোলনকে এক বিশাল রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করতে পারে।"
যাই হোক, উপর্যুপরি ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ, স্থবির চিন্তাধারা এবং প্রায়োগিক বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ না থাকায়, উলামায়ে কেরাম ও নেতৃবর্গের সমন্বিত সম্পর্ক অত্যাবশ্যক।
(৪)
অতঃপর প্রয়োজন হিম্মত। যা হচ্ছে ইচ্ছাশক্তি ও কাজের বাস্তবায়ন সমন্বিত রূপ। আর পরিষ্কার উদ্দেশ্য, কর্মপন্থা ও ফিকর ব্যতীত কেবল হিম্মত কোনো ফলাফল নিয়ে আসতে পারে না। আমাদের সমসাময়িক ও পূর্ববর্তী বিভিন্ন ইসলামী জামাত আমাদের জন্য এর সপক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছে।
তবে যদি কোনো মহান উদ্দেশ্য হাসিলের হিম্মত বা বৈপ্লবিক মানসিকতা না থাকে তবে আমাদের জন্য তাত্ত্বিক কিছু অর্জনের বাইরে ভিন্ন ভিন্ন অর্জন সম্ভব হবে না। বছরের পর বছর একই বৃত্তে, একই সমস্যার দুষ্টচক্রে ঘুরপাক খাওয়ার কোনো বিকল্প থাকবে না।
আর মুসলিমদের জন্য হিম্মতের মূল চালিকাশক্তি হবে তার ইমান, তাকওয়া ও গন্তব্যের সঠিকতা। আমাদের এই পথ আসহাবুল উখদুদের পথ। জমীনে তামকিন লাভ আমাদের অনেকের বা কারো পক্ষেই দেখে না যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তাই শাহাদাত অর্জনের আগ পর্যন্ত আমাদের পূর্বসূরীদের পথের উপর অটল-অবিচল থাকার মাধ্যমে আমরা দুনিয়া আখিরাতের সফলতা অর্জন করতে পারব।
কাপুরুষতা আমাদের মোটাতাজাও করবে না, হায়াতও বৃদ্ধি করবে না। তাই সাহসিকতা ও সুউচ্চ হিমত অর্জনে অগ্রগামী হওয়া উম্মাহর মহান ব্যক্তিদের জন্য আবশ্যক । জীবনমানের আগ পর্যন্ত নিজের মেধা, শক্তি, সময় ও প্রচেষ্টার যতটুকু ব্যয় করার মাধ্যমেই আমরা নিজেদের কাঙ্খিত মর্যাদা হাসিল করতে পারব এবং এবং পারব পরবর্তী প্রজন্মের নির্বিঘ্নে ইসলাম পালনের রাস্তা সহজ করতে।
পরিশেষে একথা মনে রাখা প্রয়োজন - যুদ্ধ মানেই শুধুমাত্র অস্ত্রের ঝংকার নয়। যুদ্ধ বিবাদমান দুটি পক্ষের চূড়ান্ত ফয়সালা করে দেয়। যুদ্ধ মূলত একটি প্রতিষ্ঠানের ন্যায়। এর মাঝে রয়েছে সুদৃঢ় ও সূক্ষ্ম ব্যবস্থাপনা, রব্বানী নেতৃত্ব, মজলুৃম ও সালেহিনদের দুয়া, ঘাত-প্রতিঘাত কিংবা উড়ন্ত খুলি ও রক্তাক্ত দেহের সমারোহ।
আর তাই বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত চিন্তাধারা বা কর্মকান্ডকে আকড়ে ধরে অগ্রসর হওয়াটা আমাদের মোটেও কাম্য নয়।
শায়খ আবু কাতাদা (হাফি) বলেন, "বীরত্ব বা আল্লাহর ওয়াদা বাস্তবায়নের উপায়ের উপর অনেকেই লিখেছেন। কিন্তু পরিচ্ছন্ন ফিকর, ইলাহি রীতিনীতি ও সচেতন নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য নিয়ে খুব কম লোকই কলম ধরেছেন।"
শায়খের এবক্তব্যের আবেদন রক্ষার উদ্দেশ্যে, আল্লাহ্ তা'আলার অনুগ্রহে স্বীয় জ্ঞান, আকল, অভিজ্ঞতা ও উপস্থাপনার যোগ্যতার দুর্বলতা সত্ত্বেও- পূর্ববর্তীদের লেখা ও বক্তব্যের আলোকে অত্র প্রবন্ধটি পেশ করা হলো।
যদিও, এখানে বলা কথার চেয়ে না বলা কথার পরিমাণই বেশী। আর আল্লাহ্ তা'আলাই সকল বিষয়ে সর্বজ্ঞ ও সম্যক অবগত।
Comment