Islam knows only two kinds of societies, the Islamic and the Jahili.
- Sayyed Qutub (Rahimahullah)
শহীদ সাইয়্যিদ কুতুব (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ معالم في الطريق (Milestones)-এ যে দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন, তা কোনো আকস্মিক আবেগের ফসল বা অস্পষ্ট চিন্তার প্রতিফলন নয়। এটি একটি সুচিন্তিত, গভীরভাবে পরিকল্পিত এবং আদর্শিক বিপ্লবের আহ্বান। তিনি এই গ্রন্থে এমন একটি দ্বিমাত্রিক (binary) দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন, যা আধুনিক সভ্যতার মুখোশ উন্মোচন করে এবং স্পষ্ট করে দেখায় যে, মানুষের তৈরি জীবনব্যবস্থা আসলে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে একটি ঘোষিত বিদ্রোহ। তিনি অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে বলেছেন—মানবসভ্যতা হয় আল্লাহর বিধানের আলোকে পরিচালিত হবে, নয়তো জাহিলিয়াতের অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে হাবুডুবু খাবে। এই দুইয়ের মাঝে কোনো মধ্যপন্থা নেই, কোনো আপস নেই, কোনো ধূসর এলাকা নেই। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি কেবল তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি জীবন্ত বাস্তবতা—একটি চেতনাগত সংগ্রাম, যা ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় স্তরে বিরাজমান।
সাইয়্যিদ কুতুব (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর এই গ্রন্থে ইসলাম ও জাহিলিয়াত, হক ও বাতিল, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও মানুষের তৈরি শাসনব্যবস্থার মধ্যে একটি সুস্পষ্ট বিভাজনরেখা টেনেছেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, কেবল ইসলামী জীবনব্যবস্থাই মানুষের জন্য মুক্তির একমাত্র পথ। অন্য সব ব্যবস্থা, যদিও বাহ্যিকভাবে উন্নত, সুসজ্জিত বা প্রগতিশীল বলে প্রতীয়মান হতে পারে, শেষ পর্যন্ত মানুষকে অন্ধকারের দিকে টেনে নিয়ে যায়। তিনি আধুনিক যুগের আপসকামী ও বহুমতের সহাবস্থানের ধারণাকে তীব্রভাবে চ্যালেঞ্জ করেছেন। তাঁর মতে, ইসলাম কোনো সংস্কার আন্দোলন বা ধর্মীয় আবেগের নাম নয়; বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ ও সার্বজনীন বিপ্লবী আদর্শ, যা জাহিলিয়াতের ভিত্তি ভেঙে ফেলে একটি নতুন সভ্যতা গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি বলেছেন, বর্তমান বিশ্বে ইসলামের মুখোমুখি একমাত্র প্রতিপক্ষ হলো সেই জাহিলি সভ্যতা, যা মানুষকে আল্লাহর দাসত্ব থেকে মুক্ত করে অন্য মানুষের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে।
তাঁর মা'আলিম ফিত্ ত্বারীক গ্রন্থে তিনি একটি অতি মৌলিক ও যুগান্তকারী প্রশ্ন তুলেছেন: "সভ্যতার প্রকৃত মানদণ্ড কী?"
এই প্রশ্ন কেবল একটি তাত্ত্বিক আলোচনা নয়, বরং এটি একটি গভীর আত্মসমালোচনার আহ্বান, যা আজকের বিশ্বকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে মূল্যায়ন করতে বাধ্য করে। যখন কোনো ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্র এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়ায়, তখন তাদের চিন্তাভাবনা পুনর্বিবেচনা করতে হয়, জীবন ও সভ্যতাকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝতে হয় এবং জীবনযাত্রার মানদণ্ড নির্ধারণে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পুনঃমূল্যায়ন করতে হয়।
পশ্চিমা সভ্যতার প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বা তথাকথিত ব্যক্তি স্বাধীনতা কখনোই সভ্যতার প্রকৃত মানদণ্ড হতে পারে না। এগুলো কেবল বাহ্যিক শক্তি ও উপকরণের প্রতিফলন। প্রকৃত সভ্যতা তখনই পূর্ণতা লাভ করে, যখন তা মানুষের অন্তর্নিহিত নৈতিকতা, আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়।
তিনি প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক প্রাচুর্যকে সভ্যতার মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করতে সম্পূর্ণ অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। যদি সভ্যতার পরিমাপ শুধু এই বস্তুগত উপাদানের ওপর নির্ভর করে, তবে তা একপেশে ও অসম্পূর্ণ থেকে যায়। একদিকে যখন প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ অর্জিত হয়, অন্যদিকে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক অবক্ষয় মানবসভ্যতার অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলে। আজকের তথাকথিত উন্নত সমাজে প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির পাশাপাশি মানুষের নৈতিক পতনও একই গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আত্মহত্যা, মানসিক রোগ, পারিবারিক বিচ্ছেদ, সামাজিক নিঃসঙ্গতা—এগুলো সবই আধুনিক সমাজের অন্ধকার দিকগুলোর প্রতিচ্ছবি। এই আধুনিকতা বাহ্যিক উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও মানবিক সমস্যা ও আত্মিক সংকটকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে। তাই তিনি বলেন, যে সভ্যতা মানুষের নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার প্রতি দৃষ্টি দেয় না, তা কখনো প্রকৃত সভ্যতা হতে পারে না।
পশ্চিমা সভ্যতা ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মানবিক মর্যাদাকে তাদের সভ্যতার মূল স্তম্ভ হিসেবে উপস্থাপন করে। এই ধরনের স্বাধীনতা ও মর্যাদার ধারণা একটি ভ্রান্ত ব্যাখ্যার ফল। যে সমাজে কিছু মানুষ ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে আইন প্রণয়ন করে এবং বাকিরা সেই আইনের অধীনে বাধ্য থাকে, সেখানে সত্যিকারের স্বাধীনতা বা মর্যাদা কোথায়? পশ্চিমা সমাজে এই ধারণাগুলো প্রায়শই রাজনৈতিক হাতিয়ার বা কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যেখানে ক্ষমতাশীল শ্রেণির স্বার্থে সাধারণ মানুষের অধিকার চাপা পড়ে যায়। এই তথাকথিত স্বাধীনতা ও মর্যাদা কেবল স্লোগানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, কিন্তু বাস্তবে মানুষের জীবন ও মর্যাদাকে উন্নত করার পরিবর্তে তা সীমিত করে ফেলে।
সাইয়্যিদ কুতুব (রাহিমাহুল্লাহ) সভ্যতার প্রকৃত মানদণ্ড হিসেবে তিনটি মৌলিক ভিত্তির কথা উল্লেখ করেছেন—
- আধ্যাত্মিকতা (Spirituality),
- বৌদ্ধিকতা (Intellectuality)
- নৈতিকতা(Ethics)।
তিনি বলেন, এই তিনটি উপাদান যদি একত্রে কোনো সভ্যতায় প্রতিষ্ঠিত হয়, তবেই তা একটি সুশৃঙ্খল, স্থিতিশীল ও উন্নত সমাজ গড়ে তুলতে পারে।
আধ্যাত্মিকতা মানুষকে নৈতিক পথে পরিচালিত করে, বৌদ্ধিকতা তাদের চিন্তা ও কর্মকে সুগঠিত করে, আর নৈতিকতা সমাজের অভ্যন্তরীণ শক্তি ও অনুপ্রেরণা যোগায়। এই তিনটি উপাদান একে অপরের পরিপূরক। তাঁর মতে, সভ্যতার সত্যিকারের উন্নতি তখনই সম্ভব, যখন এই তিনটি ভিত্তির ওপর এটি দাঁড়ায়। এর মাধ্যমে সভ্যতা কেবল বাহ্যিক উন্নতির দিকে না গিয়ে তার অন্তর্নিহিত প্রকৃতির বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়, যা তার দীর্ঘস্থায়িত্ব নিশ্চিত করে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, যদি কোনো সভ্যতা এই তিনটি গুণ—আধ্যাত্মিকতা, বৌদ্ধিকতা ও নৈতিকতা—ধারণ করে, তবে তা কি বিকাশিত হতে পারবে, বিশেষ করে যদি সেই সভ্যতা ইসলামী না হয়ে কাফের সমাজের হয়?
এই প্রশ্নের উত্তর সহজভাবে হ্যাঁ বা না দিয়ে বলা যায় না। একটি সভ্যতা এই তিনটি গুণ ধারণ করলে তা অবশ্যই কিছুটা বিকাশের সম্ভাবনা রাখে, কিন্তু এই গুণগুলোকে একত্রে ধরে রাখা এবং বাস্তবায়ন করা নির্ভর করে সেই সভ্যতার মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, খ্রিস্টান সমাজ একসময় বাইবেল ও চার্চের নির্দেশনায় পরিচালিত হতো। তখন চার্চ সমাজের নিয়ম-নীতি, পারিবারিক বিধান এবং রাষ্ট্র পরিচালনার কেন্দ্রে ছিল। উদাহরণস্বরূপ, তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদের কোন নিয়মই ছিল না; সবকিছু চার্চের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, বিশেষ করে ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা যখন বুঝতে পারল যে তাদের ধর্মীয় নীতি সমাজের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং এর ফলে তাদের আধিপত্য বজায় রাখা কঠিন হচ্ছে, তখন তারা ধর্মনিরপেক্ষতার পথ বেছে নিল। এর ফলে ধর্মীয় নীতির পরিবর্তে রাজনীতিবিদদের হাতে সমাজের নিয়ম-নীতি নির্ধারণের দায়িত্ব চলে গেল। এরপর তালাকের অনুমতি দেওয়া হলো, এবং ধীরে ধীরে তাদের নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আরও বড় পরিবর্তন দেখা দিতে শুরু করল। সমকামিতার অধিকারের মতো বিষয়, যা একসময় অকল্পনীয় ছিল, আজ তাদের সমাজে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। এই পরিবর্তন এসেছে কারণ তারা তাদের ধর্মীয় নীতির সঙ্গে আপস করেছে, এবং ফলে তাদের নৈতিক ভিত্তি ভেঙে পড়েছে।
ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো সভ্যতার পক্ষে আধ্যাত্মিকতা, বৌদ্ধিকতা ও নৈতিকতাকে একত্রে ধরে রাখা সম্ভব নয়। অন্যান্য সভ্যতার ক্ষেত্রে দেখা যায়, একসময় তাদের কাছে ধর্মগ্রন্থ বা নীতি ছিল এই তিনটি উপাদানের উৎস। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যখন তারা এই উপাদানগুলোকে একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল এবং তাদের মূল উৎস থেকে দূরে সরে গেল, তখন তাদের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ল। এর মূল কারণ হলো, তাদের গ্রন্থ বা নীতি ঐশ্বরিক উৎস থেকে আসেনি; বরং তা মানুষের হাতে তৈরি ও পরিবর্তিত হয়েছে। এই বিচ্ছিন্নতা ও ঐশ্বরিক সংযোগের অভাবই তাদের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু মুসলিমদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদের আধ্যাত্মিকতা, বৌদ্ধিকতা ও নৈতিকতা একটি অভিন্ন উৎস থেকে আসে—আল-কুরআনুল কারীম এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা ও জীবনাদর্শ। কুরআন আমাদেরকে আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা দেয়, নৈতিকতার মানদণ্ড নির্ধারণ করে এবং বৌদ্ধিক চিন্তাধারাকে উৎসাহিত করে। রাসূলুল্লাহর জীবন আমাদের সামনে একটি জীবন্ত উদাহরণ হিসেবে রয়েছে, যিনি এই তিনটি উপাদানকে পূর্ণাঙ্গভাবে প্রতিফলিত করেছেন। আমাদের নৈতিকতার সঙ্গে আপস করলে তা আমাদের আধ্যাত্মিকতার ওপর প্রভাব ফেলে। বৌদ্ধিকতার সঙ্গে আপস করলে আমরা নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতা থেকে দূরে সরে যাই। এই তিনটি উপাদান একে অপরের সঙ্গে এতটাই গভীরভাবে জড়িত যে, একটির ক্ষতি হলে অন্য দুটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই এগুলোকে একত্রে ধরে রাখতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে আমাদের মূল উৎস—কুরআন ও সুন্নাহর কাছে।
এই কারণেই বলা যায়, একমাত্র ইসলামী সভ্যতাই এই তিনটি উপাদানকে একত্রে ধরে রাখতে সক্ষম। ইসলাম শুধু ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বর্তমান সময়ে আমাদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং ভবিষ্যতের জন্য আশার আলো। এই তিনটি উপাদানের সমন্বয়ের মাধ্যমে ইসলাম এমন একটি জীবনব্যবস্থা প্রদান করে, যা কেবল ব্যক্তিকে উন্নত করে না, বরং সমাজ ও সভ্যতাকে সুসংহত ও শক্তিশালী করে। তাই ইসলামী সভ্যতাই একমাত্র সেই সভ্যতা, যা মানবজাতির জন্য একটি সুন্দর ও স্থায়ী ভবিষ্যতের সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।
Comment