আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
আমরা এমন এক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে প্রতিদিন আমাদের অন্তর বিদীর্ণ হয় গাযার খবর শুনে। শিশুরা রক্তাক্ত, মায়েরা সন্তান হারায়, আর বাতাসে যেন প্রতিধ্বনিত হয়—“উম্মাহ কোথায়?” এই আর্তনাদ শুধু ফিলিস্তিনের মানুষের নয়, বরং গোটা মুসলিম জাহানের ব্যর্থতার নিঃশব্দ স্বীকৃতি। ঠিক এমন এক সময়েই আমাদের সামনে এসেছে একটি সুযোগ—‘March for Gaza’। অনেকের চোখে হয়তো এটি একটি প্রতিবাদ, একদিনের আবেগ, কিংবা কেবল স্লোগানে সীমাবদ্ধ কোনো কর্মসূচি। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে, এই পদযাত্রা কেবল রাস্তায় হাঁটার নাম নয়; বরং এটি একটি বার্তা—আমরা এখনো জেগে আছি, আমরা এখনো উম্মাহর অংশ হতে চাই, আমরা এখনো “আল্লাহু আকবার” বলতে লজ্জা পাই না।
তবে, কেবল হেঁটে গেলে চলবে না। আমাদের ভাবতে হবে, আমরা কেন হাঁটছি, কার জন্য হাঁটছি, আর তার পরিণতি কী? আমাদের মাথায় গেঁথে নিতে হবে—এই আয়োজন যদি চেতনায় রূপ না নেয়, যদি এটায় নেতৃত্ব না জন্মায়, যদি এই পদযাত্রা আমাদের জীবনের মোড় না ঘোরায়, তাহলে এটি কেবল একটি আবেগপূর্ণ ছবি হয়ে থাকবে। গাযার মানুষ আমাদের একদিনের সংহতি চায় না, তারা আমাদের সত্যিকার দায়িত্ববোধ দেখতে চায়।
এই আলোচনা তাই শুধু মার্চকে ঘিরে নয়, বরং আমাদের সেই আত্মসমালোচনার দরজাও খুলে দিতে চায়, যেটা আমরা বহুদিন ধরে বন্ধ রেখেছি। এখন সময় এসেছে ভেঙে পড়ার নয়—ভেঙে দাঁড়াবার।
প্রথম যে বিষয়টি আমাদের ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে, তা হলো—এই পদযাত্রার মূল উদ্দেশ্য শুধুমাত্র রাস্তায় বের হওয়া নয়, বরং এর মাধ্যমে একটি সলিড বার্তা দেওয়া। গাযার মজলুমদের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা যেমন, তেমনি ইহুদি ও নাসারাদের—বিশ্বব্যাপী যেসব শক্তি এই জুলুমকে সমর্থন বা প্রশ্রয় দিচ্ছে—তাদেরকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া যে আমরা উম্মাহ হিসেবে এক আছি, তাদের ষড়যন্ত্র আমরা বুঝি এবং এ বর্বরতার বিরুদ্ধে আমরা নীরব থাকব না।
এই পদযাত্রা কেবল ইসলামপন্থীদের কোনো পৃথক কর্মসূচি নয়। এখানে নানা মত, পথ, চিন্তাধারার মানুষ থাকবেন—কারণ গাযার রক্ত শুধু মুসলমানদের নয়, মানবতার বিবেককেও কাঁদায়। তাই এখানে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে আমাদের ইসলামী পরিচয় বজায় রেখে ঐক্যের সৌন্দর্য তুলে ধরা। আমাদের আচরণ, কথা-বার্তা, পোশাক, এবং অংশগ্রহণে এমন পরিণতিবোধ থাকতে হবে যেন কেউ আমাদের দেখে বিভ্রান্ত না হয় বরং অনুপ্রাণিত হয়। যেন বোঝা যায়, ইসলামী চিন্তাধারার মানুষরা কীভাবে ধৈর্য, শালীনতা ও নেতৃত্বের পরিচয় দেয়।
এখানে কেউ হয়তো ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি জানে না, কেউ হয়তো দ্বীন মানে না—তবু তারা গাযার ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এটা তাদের জন্য দাওয়াহর একটা ক্ষেত্র হতে পারে, যদি আমরা তাদের প্রতি অহংকার নয়, সদাচরণ দেখাই। এখানে আত্মমর্যাদা ও আদর্শের ভারসাম্য খুব গুরুত্বপূর্ণ—আমরা যেন নিজেদের হারিয়ে না ফেলি, আবার কাউকে দূরে ঠেলে না দিই।
এই পদযাত্রা যেন একটি চলমান চেতনার সূচনা হয়, যেখানে বিভাজনের দেয়াল নয় বরং উম্মাহর ঐক্যের সেতু গড়ে ওঠে। আমাদের ভিন্নতা থাকবে, মতের পার্থক্য থাকবে, কিন্তু যদি আমাদের লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি হয় এবং জুলুমের বিরুদ্ধে এক কণ্ঠে কথা বলার অভ্যাস গড়ে তুলি—তবে এই ‘March for Gaza’ একদিন ইতিহাসে লেখা হবে জাগরণের শুরু হিসেবে।
দ্বিতীয় যে ব্যাপারটি আমাদের গভীরভাবে উপলব্ধি করা দরকার, তা হলো—এই মার্চের একটি নির্দিষ্ট, স্পষ্ট লক্ষ্য রয়েছে: গাযা ও ফিলিস্তিনের জন্য মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ও জাগরণ তৈরি করা। এটি এমন এক মুহূর্ত, যেখানে আমরা মানুষকে তাদের ঘুমন্ত বিবেকের দিকে আহ্বান জানাতে চাই। যারা আজ হয়তো রাজনীতি, মতবাদ, এমনকি দ্বীনের সঙ্গে তেমন সম্পৃক্ত নন, তারাও যেন গাযার শিশুদের আহাজারিতে কেঁদে উঠেন—এটাই তো আমাদের এই পদযাত্রার তাৎপর্য।
তবে এখানেই আসে সংবেদনশীলতা ও ভারসাম্যের বিষয়। আমরা যারা ইসলামী চিন্তাধারায় বিশ্বাস করি, আমাদের নি:সন্দেহে আকীদাগত দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে—আমরা বিশ্বাস করি, খিলাফতের প্রতিষ্ঠা ছাড়া প্রকৃত অর্থে উম্মাহর নেতৃত্ব সম্ভব নয়, ইসলামী রাষ্ট্র ছাড়া আল্লাহর পূর্ণ দীন বাস্তবায়ন হয় না। কিন্তু এই মার্চের ময়দান সেই তত্ত্ব প্রচারের মঞ্চ নয়। যদি আমরা এখানে সেই দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক আদর্শ সামনে নিয়ে আসি—যেমন খিলাফতের আহ্বান বা রাষ্ট্রবিপ্লবের কথা—তবে অনেকে এটিকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করবে। এতে এই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপটি রাজনৈতিক বিতর্কে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে পারে, বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে, এমনকি গণজাগরণে ভাটা পড়ে যেতে পারে।
আমাদের কৌশলী হতে হবে। এখন দরকার—হৃদয়ে আলো জ্বালানো, বিবেককে নাড়া দেওয়া, গাযার প্রতি সংহতির আবহ তৈরি করা। যাদের কাছে আমরা খিলাফতের কথা পৌঁছাতে চাই, তারা যদি এখনই আমাদের ভাষা বুঝতে না পারে, তাহলে দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। বরং এই মার্চে আমরা যদি উদারতা, ধৈর্য, সৌন্দর্য ও দায়িত্বশীল আচরণ দেখাতে পারি, তাহলে আগামীদিনে খিলাফতের আহ্বান তাদের মনে গ্রহণযোগ্যতার জায়গা তৈরি করবে ইনশাআল্লাহ।
কাজেই, লক্ষ্য যেন লক্ষ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে—গাযার জন্য জাগরণ সৃষ্টি করা। দীর্ঘমেয়াদি দাওয়াহর ভাষা একরকম হয়, আর তাৎক্ষণিক মুহূর্তে হিকমাহর ভাষা আরেকরকম। আমরা যেন পরিস্থিতি বুঝে ভাষা বেছে নিই, যেন সত্যি করে উম্মাহর অন্তরে আলো জ্বালাতে পারি।
তৃতীয় যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আমাদের মনে রাখতে হবে, তা হলো—এই 'March for Gaza' শুধুমাত্র সংহতির বার্তা নয়, বরং এটি একটি দাওয়াতি সুযোগ। এটিকে আমরা এমন এক মঞ্চে রূপ দিতে পারি, যেখানে শুধু ফিলিস্তিনের প্রসঙ্গ নয়, বরং তার পেছনের কারণগুলোও মানুষের সামনে তুলে ধরা যায়। মানুষ যখন আবেগতাড়িত থাকে, তখন তাদের অন্তর নরম হয়, চিন্তার দরজা খোলে—সেই মুহূর্তেই সত্যের দাওয়াত দিলে তা গভীরে প্রভাব ফেলে। এই দাওয়াত হবে এমন—not aggressive but awakening.
আমরা বলতে পারি, আজ শুধু গাযা নয়, মুসলিম উম্মাহর সর্বত্র একই চিত্র—দুর্বলতা, অপমান, রক্তপাত, বিভক্তি। এবং এর মূল কারণ রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক ব্যর্থতা নয়—মূল কারণ হচ্ছে, আমরা আল্লাহর দেওয়া দীন থেকে দূরে সরে গেছি, আর ইসলাম আজ পৃথিবীর কোথাও শাসক নয়। যদি পৃথিবীতে আল্লাহর বিধান থাকত, তবে আজ গাযায় শিশুদের লাশ পড়ে থাকত না, ইয়েমেন-সিরিয়ায় মানবিক বিপর্যয় চলত না, উম্মাহ বিভক্ত হয়ে জাতিগুলোর হাতে খেলনা হয়ে থাকত না।
তবে আমাদের এ কথাগুলো বলার ভঙ্গি হবে দাওয়াতি, আলো ছড়ানোর মতো—অভিযোগের মতো নয়। আমাদের লক্ষ্য হবে হৃদয়ে ভাবনার বীজ বপন করা, কোনো ঝড় তুলা নয়। কারণ এই মার্চ রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শনের জায়গা নয়। কেউ যেন এটিকে রাজনৈতিক শক্তির মহড়া বা ইসলামপন্থীদের মিটিং বলে ভুল না করে। এখানকার প্রতিটি কথা, প্রতিটি ব্যানার, এমনকি আমাদের আচরণও হবে এমন—যেন মানুষ দেখে, “এই লোকগুলো ভিন্ন... এদের কথা, আচরণ, চোখের ভাষায়ও কেমন যেন এক গভীর শান্তি আর দায়িত্ববোধ।”
‘March for Gaza’ হলো দাওয়াতের দরজা খোলার একটি ক্ষণিকের সুযোগ। যদি আমরা এখানে কৌশলী, ভারসাম্যপূর্ণ, এবং হিকমাহপূর্ণ দাওয়াত দিতে পারি—তাহলে হয়তো একজন মানুষ শুধু গাযার জন্য নয়, ইসলামের জন্যও ভাবতে শুরু করবে।
চতুর্থ ও সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—আমরা যেন ভুলে না যাই, আগ্রাসন তৈরি করা বা গৃহযুদ্ধ উসকে দেওয়া কখনোই আমাদের লক্ষ্য নয়। একটি দেশের ভেতরে অস্থিরতা সৃষ্টি করা, রাষ্ট্রকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেওয়া বা রাস্তায় ভাঙচুর করে আলোচনাকে সহিংসতায় রূপ দেওয়া—এসব কখনোই প্রকৃত মুজাহিদদের পথ নয়। কেউ যদি ভাবে 'March for Gaza' একটি অজুহাত, যেখান থেকে সহিংস বিপ্লব বা গৃহযুদ্ধের সূচনা করা যাবে—তবে সে শুধু এই পদযাত্রার মর্যাদাকেই অপমান করছে না, বরং পুরো দাওয়াতি প্রচেষ্টাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
আমরা যারা জিহাদের ধারণাকে ভালোবাসি, যারা ইসলামী শাসন চাই, তাদের জন্য এই বিষয়টা পরিষ্কার হওয়া জরুরি—আল-কায়েদা, তালেবান বা অন্যান্য প্রতিরোধ আন্দোলন কখনোই নিজেরাই গৃহযুদ্ধ তৈরি করেনি। তারা বরং সেইসব স্থানে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, যেখানে জুলুম এতটাই প্রবল হয়ে গিয়েছিল যে প্রতিরোধ ছাড়া বিকল্প ছিল না। তারা পরিবেশকে ফিতনার দিকে ঠেলে দেয়নি, বরং যখন রাষ্ট্র ও কাঠামো নিজের দমননীতি দিয়ে জনসাধারণের উপর চড়াও হয়েছে, তখন তারা ইসলামের ছায়া দেওয়ার জন্য সামনে এসেছে।
আমাদেরও সেই পরিণত দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে। 'March for Gaza' এমন কোনো আয়োজন নয় যেখানে উত্তেজনা ছড়াতে হবে, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াতে হবে, রাস্তা ভাঙচুর করতে হবে, বা এমন কিছু করতে হবে যাতে সমাজে ভীতি সৃষ্টি হয়। না, বরং এই মুহূর্তে আমাদের প্রয়োজন ধৈর্য, সংযম, এবং কৌশলী অবস্থান।
আমরা যেন এমন এক পরিবেশ তৈরি করি, যেখানে সাধারণ মানুষ আমাদের মধ্যে ভারসাম্য, শালীনতা, চিন্তাশীলতা ও নেতৃত্ব দেখতে পায়। যেন তারা ভাবে—“এরা যদি কখনো নেতৃত্বে আসে, তাহলে হয়তো সত্যিই পরিবর্তন আসবে।”
তাই আমাদের জিহাদপ্রেমী ভাইদের কাছে আবেদন থাকবে—যুদ্ধের জন্য আগ্রহ নয়, বরং নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুতি নিন। যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে আমরা দমে যাব না, তবে যুদ্ধ তৈরি করা আমাদের দায়িত্ব নয়। 'March for Gaza' আমাদের প্রতিরোধের নয়, বরং চেতনার মিছিল। আমাদের কাজ হলো আগুন জ্বালানো নয়, বরং আলো জ্বালানো।
সব দিক বিবেচনায় 'March for Gaza' কেবল একটি পদযাত্রা নয়—এটি একটি পরীক্ষা, একটি সুযোগ এবং একইসাথে একটি দায়িত্ব। আমরা যারা উম্মাহর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি, যারা ফিলিস্তিনের রক্তে কাঁদি, আমাদের জন্য এটি শুধু হাঁটার বিষয় নয়; বরং চিন্তা, চেতনা ও চরিত্র প্রকাশের মুহূর্ত।
এই আয়োজন আমাদের সামনে কিছু কঠিন প্রশ্ন ফেলে দেয়—আমরা কী শুধুই স্লোগানের মানুষ, না কি আমরা সেই হিকমাহ ও দাওয়াতের প্রতিনিধি, যারা জুলুমের মধ্যেও আদর্শকে তুলে ধরে? আমরা কী বিভ্রান্তি ছড়াতে এসেছি, না কি বিভ্রান্তদের আলোর পথে ডাকার জন্য প্রস্তুত?
এই পদযাত্রা যেন উগ্রতা নয়, সংযম শেখায়। যেন তা অহংকার নয়, দায়িত্ব জাগায়। যেন আমরা দেখাতে পারি—আমাদের হাতে শুধু ব্যানার নয়, আমাদের হৃদয়ে দাওয়াত, আচরণে পরিপক্বতা, আর চিন্তায় উম্মাহর ভবিষ্যৎ আছে।
আমরা আগ্রাসন চাই না, আমরা নেতৃত্ব চাই। আমরা বিশৃঙ্খলা চাই না, আমরা ঐক্য চাই। আর আমরা ক্ষণিকের উত্তেজনা চাই না, আমরা চিরন্তন এক পরিবর্তনের বীজ বপন করতে চাই—যার ফল একদিন ইনশাআল্লাহ ইসলামি নেতৃত্ব, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ এবং উম্মাহর সম্মান ফিরে পাওয়ায় রূপ নেবে।
তাই আসুন, এই 'March for Gaza' কে কেবল একটি দিনে সীমাবদ্ধ না রেখে, একটি দিকনির্দেশনায় পরিণত করি—যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ হয় বিবেকের ডাক, প্রতিটি কণ্ঠ হয় সত্যের সাক্ষী, আর প্রতিটি চোখে জ্বলুক পরিবর্তনের আগুন।
আমরা এমন এক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে প্রতিদিন আমাদের অন্তর বিদীর্ণ হয় গাযার খবর শুনে। শিশুরা রক্তাক্ত, মায়েরা সন্তান হারায়, আর বাতাসে যেন প্রতিধ্বনিত হয়—“উম্মাহ কোথায়?” এই আর্তনাদ শুধু ফিলিস্তিনের মানুষের নয়, বরং গোটা মুসলিম জাহানের ব্যর্থতার নিঃশব্দ স্বীকৃতি। ঠিক এমন এক সময়েই আমাদের সামনে এসেছে একটি সুযোগ—‘March for Gaza’। অনেকের চোখে হয়তো এটি একটি প্রতিবাদ, একদিনের আবেগ, কিংবা কেবল স্লোগানে সীমাবদ্ধ কোনো কর্মসূচি। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে, এই পদযাত্রা কেবল রাস্তায় হাঁটার নাম নয়; বরং এটি একটি বার্তা—আমরা এখনো জেগে আছি, আমরা এখনো উম্মাহর অংশ হতে চাই, আমরা এখনো “আল্লাহু আকবার” বলতে লজ্জা পাই না।
তবে, কেবল হেঁটে গেলে চলবে না। আমাদের ভাবতে হবে, আমরা কেন হাঁটছি, কার জন্য হাঁটছি, আর তার পরিণতি কী? আমাদের মাথায় গেঁথে নিতে হবে—এই আয়োজন যদি চেতনায় রূপ না নেয়, যদি এটায় নেতৃত্ব না জন্মায়, যদি এই পদযাত্রা আমাদের জীবনের মোড় না ঘোরায়, তাহলে এটি কেবল একটি আবেগপূর্ণ ছবি হয়ে থাকবে। গাযার মানুষ আমাদের একদিনের সংহতি চায় না, তারা আমাদের সত্যিকার দায়িত্ববোধ দেখতে চায়।
এই আলোচনা তাই শুধু মার্চকে ঘিরে নয়, বরং আমাদের সেই আত্মসমালোচনার দরজাও খুলে দিতে চায়, যেটা আমরা বহুদিন ধরে বন্ধ রেখেছি। এখন সময় এসেছে ভেঙে পড়ার নয়—ভেঙে দাঁড়াবার।
প্রথম যে বিষয়টি আমাদের ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে, তা হলো—এই পদযাত্রার মূল উদ্দেশ্য শুধুমাত্র রাস্তায় বের হওয়া নয়, বরং এর মাধ্যমে একটি সলিড বার্তা দেওয়া। গাযার মজলুমদের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা যেমন, তেমনি ইহুদি ও নাসারাদের—বিশ্বব্যাপী যেসব শক্তি এই জুলুমকে সমর্থন বা প্রশ্রয় দিচ্ছে—তাদেরকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া যে আমরা উম্মাহ হিসেবে এক আছি, তাদের ষড়যন্ত্র আমরা বুঝি এবং এ বর্বরতার বিরুদ্ধে আমরা নীরব থাকব না।
এই পদযাত্রা কেবল ইসলামপন্থীদের কোনো পৃথক কর্মসূচি নয়। এখানে নানা মত, পথ, চিন্তাধারার মানুষ থাকবেন—কারণ গাযার রক্ত শুধু মুসলমানদের নয়, মানবতার বিবেককেও কাঁদায়। তাই এখানে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে আমাদের ইসলামী পরিচয় বজায় রেখে ঐক্যের সৌন্দর্য তুলে ধরা। আমাদের আচরণ, কথা-বার্তা, পোশাক, এবং অংশগ্রহণে এমন পরিণতিবোধ থাকতে হবে যেন কেউ আমাদের দেখে বিভ্রান্ত না হয় বরং অনুপ্রাণিত হয়। যেন বোঝা যায়, ইসলামী চিন্তাধারার মানুষরা কীভাবে ধৈর্য, শালীনতা ও নেতৃত্বের পরিচয় দেয়।
এখানে কেউ হয়তো ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি জানে না, কেউ হয়তো দ্বীন মানে না—তবু তারা গাযার ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এটা তাদের জন্য দাওয়াহর একটা ক্ষেত্র হতে পারে, যদি আমরা তাদের প্রতি অহংকার নয়, সদাচরণ দেখাই। এখানে আত্মমর্যাদা ও আদর্শের ভারসাম্য খুব গুরুত্বপূর্ণ—আমরা যেন নিজেদের হারিয়ে না ফেলি, আবার কাউকে দূরে ঠেলে না দিই।
এই পদযাত্রা যেন একটি চলমান চেতনার সূচনা হয়, যেখানে বিভাজনের দেয়াল নয় বরং উম্মাহর ঐক্যের সেতু গড়ে ওঠে। আমাদের ভিন্নতা থাকবে, মতের পার্থক্য থাকবে, কিন্তু যদি আমাদের লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি হয় এবং জুলুমের বিরুদ্ধে এক কণ্ঠে কথা বলার অভ্যাস গড়ে তুলি—তবে এই ‘March for Gaza’ একদিন ইতিহাসে লেখা হবে জাগরণের শুরু হিসেবে।
দ্বিতীয় যে ব্যাপারটি আমাদের গভীরভাবে উপলব্ধি করা দরকার, তা হলো—এই মার্চের একটি নির্দিষ্ট, স্পষ্ট লক্ষ্য রয়েছে: গাযা ও ফিলিস্তিনের জন্য মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ও জাগরণ তৈরি করা। এটি এমন এক মুহূর্ত, যেখানে আমরা মানুষকে তাদের ঘুমন্ত বিবেকের দিকে আহ্বান জানাতে চাই। যারা আজ হয়তো রাজনীতি, মতবাদ, এমনকি দ্বীনের সঙ্গে তেমন সম্পৃক্ত নন, তারাও যেন গাযার শিশুদের আহাজারিতে কেঁদে উঠেন—এটাই তো আমাদের এই পদযাত্রার তাৎপর্য।
তবে এখানেই আসে সংবেদনশীলতা ও ভারসাম্যের বিষয়। আমরা যারা ইসলামী চিন্তাধারায় বিশ্বাস করি, আমাদের নি:সন্দেহে আকীদাগত দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে—আমরা বিশ্বাস করি, খিলাফতের প্রতিষ্ঠা ছাড়া প্রকৃত অর্থে উম্মাহর নেতৃত্ব সম্ভব নয়, ইসলামী রাষ্ট্র ছাড়া আল্লাহর পূর্ণ দীন বাস্তবায়ন হয় না। কিন্তু এই মার্চের ময়দান সেই তত্ত্ব প্রচারের মঞ্চ নয়। যদি আমরা এখানে সেই দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক আদর্শ সামনে নিয়ে আসি—যেমন খিলাফতের আহ্বান বা রাষ্ট্রবিপ্লবের কথা—তবে অনেকে এটিকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করবে। এতে এই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপটি রাজনৈতিক বিতর্কে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে পারে, বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে, এমনকি গণজাগরণে ভাটা পড়ে যেতে পারে।
আমাদের কৌশলী হতে হবে। এখন দরকার—হৃদয়ে আলো জ্বালানো, বিবেককে নাড়া দেওয়া, গাযার প্রতি সংহতির আবহ তৈরি করা। যাদের কাছে আমরা খিলাফতের কথা পৌঁছাতে চাই, তারা যদি এখনই আমাদের ভাষা বুঝতে না পারে, তাহলে দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। বরং এই মার্চে আমরা যদি উদারতা, ধৈর্য, সৌন্দর্য ও দায়িত্বশীল আচরণ দেখাতে পারি, তাহলে আগামীদিনে খিলাফতের আহ্বান তাদের মনে গ্রহণযোগ্যতার জায়গা তৈরি করবে ইনশাআল্লাহ।
কাজেই, লক্ষ্য যেন লক্ষ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে—গাযার জন্য জাগরণ সৃষ্টি করা। দীর্ঘমেয়াদি দাওয়াহর ভাষা একরকম হয়, আর তাৎক্ষণিক মুহূর্তে হিকমাহর ভাষা আরেকরকম। আমরা যেন পরিস্থিতি বুঝে ভাষা বেছে নিই, যেন সত্যি করে উম্মাহর অন্তরে আলো জ্বালাতে পারি।
তৃতীয় যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আমাদের মনে রাখতে হবে, তা হলো—এই 'March for Gaza' শুধুমাত্র সংহতির বার্তা নয়, বরং এটি একটি দাওয়াতি সুযোগ। এটিকে আমরা এমন এক মঞ্চে রূপ দিতে পারি, যেখানে শুধু ফিলিস্তিনের প্রসঙ্গ নয়, বরং তার পেছনের কারণগুলোও মানুষের সামনে তুলে ধরা যায়। মানুষ যখন আবেগতাড়িত থাকে, তখন তাদের অন্তর নরম হয়, চিন্তার দরজা খোলে—সেই মুহূর্তেই সত্যের দাওয়াত দিলে তা গভীরে প্রভাব ফেলে। এই দাওয়াত হবে এমন—not aggressive but awakening.
আমরা বলতে পারি, আজ শুধু গাযা নয়, মুসলিম উম্মাহর সর্বত্র একই চিত্র—দুর্বলতা, অপমান, রক্তপাত, বিভক্তি। এবং এর মূল কারণ রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক ব্যর্থতা নয়—মূল কারণ হচ্ছে, আমরা আল্লাহর দেওয়া দীন থেকে দূরে সরে গেছি, আর ইসলাম আজ পৃথিবীর কোথাও শাসক নয়। যদি পৃথিবীতে আল্লাহর বিধান থাকত, তবে আজ গাযায় শিশুদের লাশ পড়ে থাকত না, ইয়েমেন-সিরিয়ায় মানবিক বিপর্যয় চলত না, উম্মাহ বিভক্ত হয়ে জাতিগুলোর হাতে খেলনা হয়ে থাকত না।
তবে আমাদের এ কথাগুলো বলার ভঙ্গি হবে দাওয়াতি, আলো ছড়ানোর মতো—অভিযোগের মতো নয়। আমাদের লক্ষ্য হবে হৃদয়ে ভাবনার বীজ বপন করা, কোনো ঝড় তুলা নয়। কারণ এই মার্চ রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শনের জায়গা নয়। কেউ যেন এটিকে রাজনৈতিক শক্তির মহড়া বা ইসলামপন্থীদের মিটিং বলে ভুল না করে। এখানকার প্রতিটি কথা, প্রতিটি ব্যানার, এমনকি আমাদের আচরণও হবে এমন—যেন মানুষ দেখে, “এই লোকগুলো ভিন্ন... এদের কথা, আচরণ, চোখের ভাষায়ও কেমন যেন এক গভীর শান্তি আর দায়িত্ববোধ।”
‘March for Gaza’ হলো দাওয়াতের দরজা খোলার একটি ক্ষণিকের সুযোগ। যদি আমরা এখানে কৌশলী, ভারসাম্যপূর্ণ, এবং হিকমাহপূর্ণ দাওয়াত দিতে পারি—তাহলে হয়তো একজন মানুষ শুধু গাযার জন্য নয়, ইসলামের জন্যও ভাবতে শুরু করবে।
চতুর্থ ও সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—আমরা যেন ভুলে না যাই, আগ্রাসন তৈরি করা বা গৃহযুদ্ধ উসকে দেওয়া কখনোই আমাদের লক্ষ্য নয়। একটি দেশের ভেতরে অস্থিরতা সৃষ্টি করা, রাষ্ট্রকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেওয়া বা রাস্তায় ভাঙচুর করে আলোচনাকে সহিংসতায় রূপ দেওয়া—এসব কখনোই প্রকৃত মুজাহিদদের পথ নয়। কেউ যদি ভাবে 'March for Gaza' একটি অজুহাত, যেখান থেকে সহিংস বিপ্লব বা গৃহযুদ্ধের সূচনা করা যাবে—তবে সে শুধু এই পদযাত্রার মর্যাদাকেই অপমান করছে না, বরং পুরো দাওয়াতি প্রচেষ্টাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
আমরা যারা জিহাদের ধারণাকে ভালোবাসি, যারা ইসলামী শাসন চাই, তাদের জন্য এই বিষয়টা পরিষ্কার হওয়া জরুরি—আল-কায়েদা, তালেবান বা অন্যান্য প্রতিরোধ আন্দোলন কখনোই নিজেরাই গৃহযুদ্ধ তৈরি করেনি। তারা বরং সেইসব স্থানে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, যেখানে জুলুম এতটাই প্রবল হয়ে গিয়েছিল যে প্রতিরোধ ছাড়া বিকল্প ছিল না। তারা পরিবেশকে ফিতনার দিকে ঠেলে দেয়নি, বরং যখন রাষ্ট্র ও কাঠামো নিজের দমননীতি দিয়ে জনসাধারণের উপর চড়াও হয়েছে, তখন তারা ইসলামের ছায়া দেওয়ার জন্য সামনে এসেছে।
আমাদেরও সেই পরিণত দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে। 'March for Gaza' এমন কোনো আয়োজন নয় যেখানে উত্তেজনা ছড়াতে হবে, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াতে হবে, রাস্তা ভাঙচুর করতে হবে, বা এমন কিছু করতে হবে যাতে সমাজে ভীতি সৃষ্টি হয়। না, বরং এই মুহূর্তে আমাদের প্রয়োজন ধৈর্য, সংযম, এবং কৌশলী অবস্থান।
আমরা যেন এমন এক পরিবেশ তৈরি করি, যেখানে সাধারণ মানুষ আমাদের মধ্যে ভারসাম্য, শালীনতা, চিন্তাশীলতা ও নেতৃত্ব দেখতে পায়। যেন তারা ভাবে—“এরা যদি কখনো নেতৃত্বে আসে, তাহলে হয়তো সত্যিই পরিবর্তন আসবে।”
তাই আমাদের জিহাদপ্রেমী ভাইদের কাছে আবেদন থাকবে—যুদ্ধের জন্য আগ্রহ নয়, বরং নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুতি নিন। যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে আমরা দমে যাব না, তবে যুদ্ধ তৈরি করা আমাদের দায়িত্ব নয়। 'March for Gaza' আমাদের প্রতিরোধের নয়, বরং চেতনার মিছিল। আমাদের কাজ হলো আগুন জ্বালানো নয়, বরং আলো জ্বালানো।
সব দিক বিবেচনায় 'March for Gaza' কেবল একটি পদযাত্রা নয়—এটি একটি পরীক্ষা, একটি সুযোগ এবং একইসাথে একটি দায়িত্ব। আমরা যারা উম্মাহর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি, যারা ফিলিস্তিনের রক্তে কাঁদি, আমাদের জন্য এটি শুধু হাঁটার বিষয় নয়; বরং চিন্তা, চেতনা ও চরিত্র প্রকাশের মুহূর্ত।
এই আয়োজন আমাদের সামনে কিছু কঠিন প্রশ্ন ফেলে দেয়—আমরা কী শুধুই স্লোগানের মানুষ, না কি আমরা সেই হিকমাহ ও দাওয়াতের প্রতিনিধি, যারা জুলুমের মধ্যেও আদর্শকে তুলে ধরে? আমরা কী বিভ্রান্তি ছড়াতে এসেছি, না কি বিভ্রান্তদের আলোর পথে ডাকার জন্য প্রস্তুত?
এই পদযাত্রা যেন উগ্রতা নয়, সংযম শেখায়। যেন তা অহংকার নয়, দায়িত্ব জাগায়। যেন আমরা দেখাতে পারি—আমাদের হাতে শুধু ব্যানার নয়, আমাদের হৃদয়ে দাওয়াত, আচরণে পরিপক্বতা, আর চিন্তায় উম্মাহর ভবিষ্যৎ আছে।
আমরা আগ্রাসন চাই না, আমরা নেতৃত্ব চাই। আমরা বিশৃঙ্খলা চাই না, আমরা ঐক্য চাই। আর আমরা ক্ষণিকের উত্তেজনা চাই না, আমরা চিরন্তন এক পরিবর্তনের বীজ বপন করতে চাই—যার ফল একদিন ইনশাআল্লাহ ইসলামি নেতৃত্ব, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ এবং উম্মাহর সম্মান ফিরে পাওয়ায় রূপ নেবে।
তাই আসুন, এই 'March for Gaza' কে কেবল একটি দিনে সীমাবদ্ধ না রেখে, একটি দিকনির্দেশনায় পরিণত করি—যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ হয় বিবেকের ডাক, প্রতিটি কণ্ঠ হয় সত্যের সাক্ষী, আর প্রতিটি চোখে জ্বলুক পরিবর্তনের আগুন।
Comment