Announcement

Collapse
No announcement yet.

শাসনব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের দুইটি ধারা - শায়খ আবু বকর আন নাজি (রাহিমাহুল্লাহ)

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • শাসনব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের দুইটি ধারা - শায়খ আবু বকর আন নাজি (রাহিমাহুল্লাহ)

    দুনিয়ার স্বাভাবিক নিয়মানুসারে, শাসনব্যবস্থা পুনরুদ্ধার হয় দুইভাবে।

    এক, যখন তা আকিদাহর ভিত্তিতে, বিশ্বাস ও চিন্তার এক পূর্ণাঙ্গ জাগরণ থেকে উৎসারিত হয়। মানুষ তাদের অন্তরের গভীরতা থেকে সত্যকে গ্রহণ করে, ন্যায়ের ধারণায় নিজেদের সমর্পণ করে, এবং একটি সঠিক পথে চলার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়। এই পুনরুজ্জীবন এক ধরনের ঈমানদীপ্ত বিপ্লব—যেখানে নেতৃত্ব, আইন, বিচার এবং আদর্শ সবকিছুই সত্যের আলোকে বিন্যস্ত হয়।

    অন্যটি, যখন শাসনব্যবস্থা শুধুমাত্র যুলুম প্রতিহত করার তাগিদ থেকে পরিবর্তিত হয়। এতে আদর্শের ভিত্তি দুর্বল বা অনুপস্থিত হলেও, মানুষের মাঝে যুলুম, দুর্নীতি ও অবিচারের বিরুদ্ধে স্বাভাবিক এক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তারা বিদ্রোহ করে, কারণ সহ্য করার সীমা পেরিয়ে যায়। এই প্রতিরোধে সত্যের ছায়া না-ও থাকতে পারে, তবে ন্যায়ের আকাঙ্ক্ষা প্রবল থাকে। আর এই আকাঙ্ক্ষা এমন এক শক্তি, যা মুমিন-কাফের নির্বিশেষে সকলেই ধারণ করে, কারণ ন্যায়বিচার সকল বিবেকবান মানুষের হৃদয়ে পবিত্র এক চাহিদা।

    এই দুই পথই, যদিও ভিন্ন, ইতিহাসে বহুবার পরিবর্তনের অনুঘটক হয়েছে। প্রথমটি গড়ায় একটি দীর্ঘমেয়াদি, মৌলিক রূপান্তরের দিকে—যেখানে মানুষ নিজেকে বদলায়। দ্বিতীয়টি অনেক সময় তাৎক্ষণিক উত্তরণ ঘটায়—যেখানে পরিস্থিতির চাপ থেকে উত্তরণের জন্য একটি অস্থায়ী, কার্যকর ব্যবস্থার প্রয়োজন দেখা দেয়। তবে, যুলুম বিরোধী আন্দোলন যদি সত্য ও আকিদাহহীন হয়, তবে তা হয়তো নতুন এক যুলুমের জন্ম দিতে পারে, যেখানে কেবল মুখ বদলায়, কিন্তু মুখোশ একই থাকে।

    শাসনব্যবস্থার প্রকৃত পুনরুদ্ধার তখনই সম্ভব, যখন এই দুটি ধারা—সত্যভিত্তিক আদর্শ ও যুলুম প্রতিরোধের সাহস—একত্রিত হয়। যেখানে নেতৃত্ব কেবল প্রতিশোধ নয়, বরং পথনির্দেশ দেয়। যেখানে জনতা কেবল রক্ত নয়, বরং ন্যায় ও কল্যাণ চায়। এই একতাই পারে একটি শাসনব্যবস্থাকে শুধু টিকিয়ে রাখা নয়, বরং তাকে প্রকৃত অর্থে ন্যায়ের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করতে।

    শাসনব্যবস্থা আপনি যেভাবেই পরিবর্তন বা পুনরুদ্ধার করতে চান না কেন—চাই তা আকিদাহভিত্তিক আদর্শিক আন্দোলন হোক, অথবা যুলুম প্রতিরোধের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া—দুটি স্তম্ভ আপনাকে যেকোনো পরিস্থিতিতে সম্যক বুঝতে হবে:

    প্রথমত, জনগণের শক্তি।
    এটি কেবল সংখ্যার খেলা নয়—এটি চেতনার, ঐক্যের, এবং আত্মত্যাগের শক্তি। যখন জনগণ বিভক্ত থাকে, বিভ্রান্ত থাকে বা ভীত থাকে, তখন তাদের সংখ্যা থাকলেও শক্তি থাকে না। কিন্তু যখন তারা একটি অভিন্ন স্বপ্ন, অভিন্ন ক্ষোভ বা অভিন্ন আদর্শের চারপাশে ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন তারা এক ভয়ংকর পরিবর্তনের শক্তিতে রূপ নেয়। ইতিহাসে এর অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে—যেখানে অনাহারী, নিরস্ত্র জনগণও শাসকের মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছে কেবল ঐক্য ও আত্মোৎসর্গের মাধ্যমে। তবে এই শক্তিকে সংগঠিত করা, নেতৃত্ব দেওয়া এবং যথাযথ দিকনির্দেশনা দেওয়া ছাড়া এটি কাঁচা আগুনের মতো—আলো যেমন দিতে পারে, তেমনি পুড়িয়ে ছারখারও করতে পারে।

    দ্বিতীয়ত, প্রতিরক্ষা বাহিনীর শক্তি।
    শুধু জনগণ নয়, একটি রাষ্ট্রযন্ত্রের মৌলিক নিয়ন্ত্রণ থাকে সেই যন্ত্রের প্রতিরক্ষাকেন্দ্রিক শাখাগুলোর হাতে। আপনি যতই জনস্রোত গড়ে তুলুন না কেন, যদি রাষ্ট্রের সেনা, পুলিশ, র‍্যাব, গোয়েন্দা বাহিনী—এই স্তম্ভগুলো শাসকের অনুগত থাকে, তবে সেই শাসক দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় টিকে যেতে পারে। বিপরীতভাবে, যখন এই বাহিনীর মধ্যে ফাটল ধরে, আদর্শিক চেতনার সঞ্চার হয়, বা নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে—তখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার রূপরেখা মুহূর্তেই বদলে যায়। তবে প্রতিরক্ষা বাহিনী কেবল শক্তির জায়গা নয়—এটি অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার প্রশ্নেও নিয়ামক। এই বাহিনীর সম্মতি, নিরপেক্ষতা বা বিপ্লবী অবস্থান—এগুলো সবই রাজনৈতিক পরিবর্তনের গতিপথ নির্ধারণ করে।

    এই দুই শক্তিকে অস্বীকার করে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনের কথা কল্পনা করাও বাতুলতা। আদর্শ, চিন্তা, ও বিশ্বাস—এসবই প্রয়োজন, কিন্তু বাস্তবতা বিবর্জিত ভাবনা মাঠে নামলে তা দুঃস্বপ্নে রূপ নেয়। তাই কেউ যদি সত্য, ইনসাফ বা মুক্তির পথে এগোতে চায়, তাকে অবশ্যই এই দুই জায়গায় সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করতে হবে—জনগণকে জাগাতে হবে হৃদয়ের ভাষায়, আর প্রতিরক্ষা বাহিনীকে অন্তরের ভাষায় বুঝাতে হবে: তারা কিসের পক্ষে, এবং কাদের হয়ে ইতিহাসে দাঁড়াবে।

    আপনি শাসনব্যবস্থার পুনরুদ্ধারে যে পদ্ধতিই গ্রহণ করুন না কেন—তা আকিদাভিত্তিক হোক কিংবা যুলুম প্রতিরোধমূলক—দুইটি বিষয় সাধারণভাবে সামনে আসে: এক, জনগণের শক্তি; দুই, প্রতিরক্ষা বাহিনীর অবস্থান। তবে আমাদের আলোচ্য ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টি, অর্থাৎ প্রতিরক্ষা বাহিনীর শক্তি, প্রাসঙ্গিক নয়।

    এর প্রধান কারণ, আমরা এমন কোনো কৌশল বা পন্থাকে গ্রহণ করছি না, যা আল কায়দা সেন্ট্রাল কিংবা আল কায়দা উপমহাদেশ শাখার মতো সংঘাতমুখী, সেনাশক্তি নির্ভর বা যুদ্ধপ্রসূত কাঠামোতে গঠিত। বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে, প্রতিরক্ষা বাহিনীকে কৌশলের কেন্দ্রে আনবার সময় এখনো আসেনি—বরং একে বাইরের স্তরে রেখেই চিন্তা-পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে।

    এই মুহূর্তে আমাদের ফোকাস হলো আদর্শের ভূমি তৈরি করা এবং জনগণের চেতনায় পরিবর্তন আনা। এটি এমন এক প্রস্তুতি, যেখানে অন্তর প্রথমে জাগে, চিন্তা স্পষ্ট হয়, ঐক্য গড়ে ওঠে, এবং একটি শুদ্ধ চেতনার ভিত্তিতে জনগণ একত্রিত হয়। এই কাজ বাহ্যিক সংঘর্ষের চেয়ে বহুগুণ কঠিন, কারণ এটি সমাজের মনস্তত্ত্ব ও নৈতিক ভিত নির্মাণের সংগ্রাম।

    যারা বাস্তবতার মাটিতে দাঁড়িয়ে দীর্ঘমেয়াদি একটি রূপান্তরের কথা ভাবেন, তারা জানেন—প্রতিরক্ষা বাহিনীর শক্তি ব্যবহার বা তাদের সঙ্গে সংঘাতে যাওয়া কেবল আগে সময় নয়, বরং আপাতত অপ্রয়োজনীয় এবং কৌশলগত ভুলও হতে পারে।

    বর্তমানে যে অবস্থান গ্রহণ করা হয়েছে, তা মূলত একটি আদর্শিক ও চিন্তাধারাগত প্রস্তুতির পর্যায়ে রয়েছে, যা ধৈর্য, প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতা দাবি করে। প্রতিরক্ষা বাহিনীর ভূমিকা সেখানে নিরপেক্ষ থাকুক—এটাই শ্রেয়, এবং সময় এলে ইতিহাস তাদের নিজের জায়গা থেকে কথা বলার সুযোগ দিবে।

    আমাদের আলোচ্য বিষয় হলো প্রথম শক্তি—অর্থাৎ জনগণের শক্তি—এবং এই বাস্তবতা ঘিরেই আমরা বুঝতে চাই, কেন এই অপরিসীম শক্তি আমাদের সামনে উপস্থিত থাকলেও আমরা তা কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারছি না। কেন একটি সম্ভাবনাময় জনশক্তি, যার দ্বারা যেকোনো যুলুম প্রতিরোধ, ন্যায় প্রতিষ্ঠা কিংবা শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন সম্ভব, তা আজ নিষ্ক্রিয়, নিঃশব্দ, ও ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পড়ে আছে—এই প্রশ্নের গভীরে যাওয়াই আমাদের মূল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।

    প্রথম কারণ, এই শক্তিকে—অর্থাৎ জনগণের শক্তিকে—আজ অত্যন্ত কৌশলপূর্ণভাবে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। চতুর সামাজিক প্রকৌশল, মনস্তাত্ত্বিক ছলচাতুরি ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জনগণকে এমন এক দিশাহীন ব্যস্ততায় নিপতিত করা হয়েছে, যেখানে তারা নিজেদের প্রকৃত শক্তির কথা ভাবার সময়ই পাচ্ছে না।

    জীবিকা নির্বাহের বাধ্যবাধকতা, জীবনের নিরাপত্তাহীনতা এবং সফলতার মোহ—এসবকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে জনগণকে পুরোপুরি দুনিয়াবী সংগ্রামে নিমজ্জিত করে ফেলা হয়েছে। একদিকে সমাজে এমন একটি চিন্তা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, ‘সফলতা মানেই বিত্ত, পদ, খ্যাতি’, অন্যদিকে প্রতিনিয়ত তাদের সামনে এমন সব লক্ষ্য হাজির করা হয়েছে, যেগুলো প্রকৃত অর্থে অধরা এবং শাসনব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মতো বোধশক্তিকে স্তিমিত করে দেয়।

    এর পাশাপাশি, মানুষের পেট ও যৌনাঙ্গ—এই দুই প্রবৃত্তিকে উসকে দিয়ে, তাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণাকে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিকভাবে এমনভাবে ব্যবস্থাপনায় রাখা হয়েছে, যাতে মানুষ সারাক্ষণ নিজের চাহিদা পূরণের পেছনে দৌড়ায়, কিন্তু সমাজের অধিকারের প্রশ্নে দাঁড়াতে শেখে না।

    অপর দিকে, সম্পদের প্রতি অতৃপ্ত লোভ ও বিত্তবিলাসের মোহও চেতনার এই বিচ্যুতির অন্যতম নিয়ামক। একবার কেউ এই ঘূর্ণিতে ঢুকে পড়লে, সে আর ইনসাফ, ন্যায় বা আদর্শ নিয়ে ভাবার সময় পায় না।

    ফলে দেখা যায়, যে শক্তি একসময় যুলুম প্রতিহত করতে পারত, সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে পারত, তা আজ নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত, বিভ্রান্ত, এবং পেছনে ঠেলে দেওয়া এক অসহায় সত্তায় পরিণত হয়েছে।

    দ্বিতীয় কারণ, মিডিয়ার প্রতারণাপূর্ণ মগজধোলাই এবং সমাজে সুচতুরভাবে ছড়িয়ে দেওয়া নির্জীব ও আত্মবিস্মৃত চিন্তাধারার প্রভাবও জনগণের শক্তিকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার অন্যতম হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণমাধ্যমের মাধ্যমে একদিকে তথ্য বিকৃতি, পক্ষপাতদুষ্ট বয়ান ও বিকৃত বাস্তবতা উপস্থাপন করে জনগণের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে সত্যের দিক থেকে, অন্যদিকে তাদের মনে এমন একটি ভাবমূর্তি গড়ে তোলা হয়েছে যে—প্রতিবাদ মানেই বিশৃঙ্খলা, এবং ন্যায়ের জন্য লড়াই মানেই অশান্তি সৃষ্টি।

    এই মিডিয়াগুলো দিনে-রাতে এমন এক পর্দা টেনে রেখেছে জনগণের চোখে, যা তাদের নিজ শক্তির অস্তিত্ব ও দায়িত্ববোধ ভুলিয়ে দিচ্ছে। ফলত, তারা নিজেদের অসহায় ভাবে, অথচ তারা জানেই না—আসলে তারাই সবচেয়ে বড় শক্তি।

    এছাড়াও সমাজে সুফিবাদী নিস্ক্রিয়তা, মুরজিয়া ধাঁচের "সব ঠিক আছে" মনোভাব এবং জাবারি চিন্তার "যা হচ্ছে, আল্লাহই করাচ্ছেন—আমাদের কিছু করার নেই" জাতীয় আত্মসমর্পণমূলক দর্শনের বিস্তার জনগণের ভেতরের শক্তিকে একেবারে ভোঁতা করে দিয়েছে। এই চিন্তাধারাগুলো কৌশলে মানুষের দায়বোধকে মুছে ফেলে, তাদের চেতনায় একপ্রকার নিষ্ক্রিয়তা ও নির্লিপ্তির বোধ তৈরি করে—যার ফলে জনগণ তাদের নিজের ভেতরকার পরিবর্তন-ক্ষমতা, প্রতিরোধ-সাহস কিংবা দায়িত্বশীলতা উপলব্ধিই করতে পারে না।

    এইভাবে জনগণের যে অন্তর্নিহিত এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি রয়েছে—যা যুগে যুগে তাগুতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে—সেই শক্তিকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, কেবল যেন তা আর কখনো মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে না পারে।

    তৃতীয় কারণ, মাঝেমধ্যে যখন কিছু মানুষ গাফেলতি ও উদাসীনতার ঘোর থেকে জেগে উঠে, সত্য উপলব্ধি করে, প্রতিবাদে অংশ নিতে চায় কিংবা অন্যদের সচেতন করার চেষ্টা করে—তখনই রাষ্ট্র তার দমনযন্ত্র চালু করে দেয়। পুলিশ, সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাসহ আধুনিক রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীগুলোকে ব্যবহার করে এসব সজাগ মানুষদের কঠোরভাবে দমন করা হয়। যেন এই চেতনার স্ফুলিঙ্গ সমাজে ছড়িয়ে না পড়ে, এবং ঘুমন্ত জনতা আর জেগে না ওঠে।

    আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সশস্ত্র বাহিনীগুলোর একটি মৌলিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে—জনগণের প্রকৃত আকাঙ্ক্ষা, চেতনা ও শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা, প্রয়োজনে নির্মমভাবে দমন করা। এই দমনমূলক ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়েই তারা রাজনৈতিক ক্ষমতার আনুকূল্য পায়, পজিশন, প্রমোশন, আর্থিক সুবিধা ও উপঢৌকনে লাভবান হয়।

    এর ফলে এসব বাহিনীগুলো আর জনগণের রক্ষক থাকে না, হয়ে ওঠে ক্ষমতাসীনদের রক্ষী। তারা এমন এক প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়, যা সাধারণ মানুষের শক্তিকে কখনো শাসকের দরবার পর্যন্ত পৌঁছাতে দেয় না। ক্ষমতাসীনরা এই ব্যবস্থার মাধ্যমে নিজেদের নিরাপদ রাখে, আর তাদের পছন্দসই পরাশক্তি বা বিদেশি শক্তিবলয়ের ঘূর্ণিতে নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব ধরে রাখে।

    ফলে দেখা যায়, জনগণের মাঝে যদি সাময়িক জাগরণও ঘটে, তা টিকে থাকতে পারে না। তা দমন হয়, নিঃশেষ হয়, এবং বাকিদের জন্য হয়ে ওঠে এক প্রকার ভয়ভীতির নিদর্শন—যা বাকিদেরও আবার নিঃশব্দ করে দেয়।

    উপর্যুক্ত আলোচনায় স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয় যে, শাসনব্যবস্থা পুনরুদ্ধারে জনগণের শক্তিই সবচেয়ে মৌলিক, প্রকৃত ও দীর্ঘস্থায়ী শক্তি—যা যুলুম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি জাতিকে জাগিয়ে তুলতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই শক্তিকে নানা কৌশলে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। প্রথমত, জনগণকে জীবিকা, কামনা-বাসনা ও ভোগ-বাসনার অসীম দৌড়ে এমনভাবে ব্যস্ত করে তোলা হয়েছে যে তারা নিজের শক্তি, দায়িত্ব কিংবা অধিকার নিয়ে ভাবার সুযোগই পাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, মিডিয়া ও বিভ্রান্তিকর চিন্তাধারার মাধ্যমে মানুষের চিন্তাজগৎ এমনভাবে প্রভাবিত করা হয়েছে যে, তারা নিজেদের শক্তিকে অপ্রাসঙ্গিক ও অব্যবহারযোগ্য মনে করে। আর তৃতীয়ত, যখনই কেউ এই ঘুমন্ত অবস্থা থেকে জেগে উঠতে চায়, তখনই তাকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কঠোর দমন নীতির মাধ্যমে থামিয়ে দেওয়া হয়—যাতে বাকিরাও ভয় পেয়ে আবার নীরব হয়ে যায়।

    ফলে একটি জাতির অন্তর্নিহিত শক্তি থাকলেও, তা আজ চেতনাহীন, লক্ষ্যহীন ও দিকনির্দেশনাহীন অবস্থায় পড়ে আছে। যতদিন পর্যন্ত এই শক্তিকে জাগিয়ে তোলা, সংগঠিত করা এবং সত্যের পথে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত করার সাহসী প্রচেষ্টা শুরু না হবে, ততদিন এই জাতি কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে গিয়েও তা অর্জন করতে পারবে না। অতএব, এখন সময়—এই ঘুমন্ত শক্তিকে জাগানোর, বিভ্রান্তির চাদর সরিয়ে সত্যকে সামনে আনার, এবং জনগণকে তাদের প্রকৃত ভূমিকা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার। ইতিহাস কখনো শাসকের সম্পত্তি ছিল না—তা সবসময় জাগ্রত জনতার দ্বারা লেখা হয়েছে।



    মূল বক্তব্য:
    - কিতাব: إدارة التوحش (The Management of Savagery)
    লেখক: শাইখ আবু বকর নাজী
    অধ্যায়: শক্তি বা ক্ষমতার দুটি ধরণ
    (বাংলা অনুবাদ, পৃষ্ঠা-১২-১৪)
    ​নোট: উক্ত বইয়ের ইংলিশ টেক্সট এর লিংক।
    Last edited by Munshi Abdur Rahman; 4 days ago.
    فَاَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ وَ انۡتَظِرۡ اِنَّهُمۡ مُّنۡتَظِرُوۡنَ

  • #2
    শাসনব্যবস্থার প্রকৃত পুনরুদ্ধার তখনই সম্ভব, যখন এই দুটি ধারা—সত্যভিত্তিক আদর্শ ও যুলুম প্রতিরোধের সাহস—একত্রিত হয়। যেখানে নেতৃত্ব কেবল প্রতিশোধ নয়, বরং পথনির্দেশ দেয়। যেখানে জনতা কেবল রক্ত নয়, বরং ন্যায় ও কল্যাণ চায়। এই একতাই পারে একটি শাসনব্যবস্থাকে শুধু টিকিয়ে রাখা নয়, বরং তাকে প্রকৃত অর্থে ন্যায়ের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করতে।
    জাজাকুমুল্লাহ

    Comment

    Working...
    X