Announcement

Collapse
No announcement yet.

বিপ্লবের আদর্শ না আদর্শবাদী বিপ্লবী ???

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • বিপ্লবের আদর্শ না আদর্শবাদী বিপ্লবী ???

    সাইয়্যিদ কুতুব (রাহিমাহুল্লাহ) সভ্যতার ধারণাকে শুধুমাত্র ইট-পাথরের অট্টালিকা, প্রযুক্তির উৎকর্ষ কিংবা সাম্রাজ্য বিস্তারের সীমানায় সীমাবদ্ধ রাখেননি; বরং তিনি সভ্যতার মূল ভিত্তিকে দেখেছেন মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা ও মর্যাদায়। তাঁর দৃষ্টিতে একটি সমাজ তখনই সভ্য বলা যাবে, যখন তার নাগরিকরা অন্য মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে শুধুমাত্র আল্লাহর দাসত্বে নিজেদের সমর্পণ করবে। এই দাসত্ব মানে অন্ধ আনুগত্য নয়; বরং ন্যায়ের শাসন, নৈতিকতার পথ এবং অন্তর্গত মুক্তির নামই প্রকৃত আল্লাহর দাসত্ব।

    এই দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি মানব সমাজের এক গভীর অসঙ্গতি তুলে ধরেন—যেখানে মানুষ নামধারী কিছু শক্তিশালী গোষ্ঠী অন্য মানুষদের ওপর নিজেদের আধিপত্য চাপিয়ে দেয়। তারা বিধান নির্ধারণ করে, সামাজিক রীতিনীতি ও নৈতিকতা নির্ধারণ করে এবং জনগণের স্বাধীন চিন্তা-চেতনার সমস্ত পথ রুদ্ধ করে দেয়। এ এক আধুনিক দাসত্ব—যা দেহকে শৃঙ্খলবদ্ধ না করেও মন, বিবেক ও আত্মাকে বন্দী করে রাখে। এ অবস্থায় মানুষ সম্মানহীন, স্বাধীনতাহীন এক নিষ্প্রাণ যন্ত্রে পরিণত হয়।

    ঐতিহাসিকভাবে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের সময় পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর ও তথাকথিত "সভ্য" দুটি সাম্রাজ্য ছিল—রোমান ও পারসিক সাম্রাজ্য। এরা ছিল শক্তিতে পরিপূর্ণ, প্রাসাদগাত্রে অলংকৃত, প্রযুক্তি ও সামরিক কৌশলে অগ্রসর। কিন্তু সাইয়্যিদ কুতুবের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এগুলো সভ্যতা নয়, বরং মানুষের উপর মানুষের দাসত্ব চাপিয়ে দেওয়া এক অবমাননাকর ব্যবস্থা মাত্র। শাসকগোষ্ঠী ছিল প্রভু, আর জনগণ ছিল নিঃস্ব ও পরাধীন।

    এই বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ইসলামের সূচনালগ্নে যখন সাহাবি রিব’ঈ ইবনে আমির (রাযি.) পারস্য সেনাপতি রুস্তমের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন:
    "আল্লাহ আমাদের পাঠিয়েছেন যাতে আমরা মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে একমাত্র আল্লাহর দাসত্বে নিয়ে আসি, দুনিয়ার সংকীর্ণতা থেকে এনে তাকে প্রশস্ততায় নিয়ে যাই, এবং অন্যায় জীবনব্যবস্থা থেকে বের করে ন্যায়ের ছায়াতলে নিয়ে আসি।"

    এই বাণী ছিল কেবল বক্তৃতা নয়, বরং একটি সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন। একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে কোনো রাজা নয়, কোনো যাজক নয়, বরং সর্বশক্তিমান আল্লাহর বিধানই হবে মানব সমাজ পরিচালনার মূল নীতিমালা। আর এভাবেই রোম ও পারস্যের মতো সাম্রাজ্যিক শক্তির শিকড় কেঁপে উঠেছিল। ইসলাম একটি বিকল্প সভ্যতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল—যার মৌলিক ভিত্তি ছিল মানবিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার, এবং ব্যক্তির প্রকৃত স্বাধীনতা।

    অবশ্যই সভ্যতা বিষয়টা এখন এমন এক ধারণায় পরিণত হয়েছে, যা প্রত্যেকে নিজের প্রয়োজন ও সুবিধা অনুযায়ী ব্যাখ্যা করে। সভ্যতা, যা একসময় মানুষের নৈতিক উন্নয়ন, সামষ্টিক কল্যাণ ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাকে বোঝাতো—আজ তা হয়ে উঠেছে কেবল বাহ্যিক উন্নয়ন, ভোগবাদিতা আর শক্তির আধিপত্য প্রদর্শনের একটি মুখোশ।

    পশ্চিমা বিশ্ব আজ যে "সভ্যতা"র ধ্বজা তুলে ধরেছে, তার ভিত্তি হিসেবে তারা জোর দিয়ে বলে "ব্যক্তি স্বাধীনতা" ও "মতপ্রকাশের স্বাধীনতা"। এই শব্দগুলো শুনতে যেমন আকর্ষণীয়, বাস্তবে তেমনি জটিল ও আত্মবিরোধী। কারণ ব্যক্তি স্বাধীনতা যদি হয় সভ্যতার মাপকাঠি, তবে কেন একজনের বিশ্বাস ও জীবনাচার প্রকাশের অধিকার আরেকজনের মনঃপীড়ার অজুহাতে খর্ব হয়?

    ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯) এর মাধ্যমে ইউরোপে যে ব্যক্তি স্বাধীনতার জয়গান শুরু হয়, তা মূলত চার্চের জুলুমের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নেয়। মানুষের চিন্তার ওপর থেকে গির্জার একচেটিয়া অধিকার সরিয়ে দেওয়ার দাবি ছিল ন্যায়সঙ্গত। কিন্তু কালের বিবর্তনে এই মুক্তির ধারণা হয়ে গেলো একপাক্ষিক ও স্ববিরোধী। ধর্মকে পুরোপুরি ব্যক্তিগত পরিসরে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হলো, যেন তা সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় জীবনে কোনো অবস্থানে না আসতে পারে। এর ফলেই আজ পশ্চিমা বিশ্বে ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর চলতে থাকা নানা রকম সাংস্কৃতিক নিপীড়নকে "সভ্যতার রক্ষা" বলা হয়।

    উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একজন খ্রিস্টান যদি সমকামিতার বিরোধিতা করেন, তাকে বলা হয় "হেট স্পিচ"-এর কারিগর। একজন মুসলিম নারী যদি হিজাব পরে স্কুলে যেতে চান, তাকে "মুক্তি" দেওয়ার নামে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়। অথচ একই সময়ে একজন অন্য ধর্মাবলম্বী তার আচার-অনুষ্ঠান বা পোষাক নিয়ে কোনো বাধা পান না। এই দ্বৈতনীতি কি আদৌ স্বাধীনতা?

    আরও গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও সেখানে সীমিত—নির্দিষ্ট চিন্তাচেতনার গণ্ডিতে। কেউ যদি তথাকথিত মূলধারার রাজনীতি, সমাজনীতি বা মূল্যবোধের বাইরে কিছু বলে, তাকে ‘চরমপন্থী’, ‘সন্ত্রাসী’ বা ‘কনস্পিরেসি থিওরিস্ট’ বলে লেবেল দেওয়া হয়। অথচ সভ্যতা তখনই পরিপূর্ণ হয়, যখন সকল ভিন্নমত সহ্য করার নৈতিক দৃঢ়তা সমাজে থাকে।

    ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে—প্রকৃত স্বাধীনতা কখনোই কেবল মানুষের তৈরি আইন দিয়ে নিশ্চিত হয় না। রোমান ও পারসিক সভ্যতার পতনের অন্যতম কারণ ছিল, তারা শক্তির কাঠামো দাঁড় করালেও ন্যায়ের কাঠামো তৈরি করতে পারেনি। ইসলাম সেই শূন্যতাকেই পূরণ করেছিল একটি ঈশ্বরপ্রদত্ত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে, যেখানে মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও সম্মানকে রক্ষা করা হয় আল্লাহর বিধানের আলোকে। এই দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের স্বাধীনতাকে কেবল বাহ্যিক নয়, অন্তর্গত দাসত্ব থেকেও মুক্তি দেয়।

    তাই আজকের তথাকথিত উন্নত সভ্যতা, যদি তার ভেতরের বৈপরীত্য, দুঃসহ নির্যাতন আর পক্ষপাতদুষ্ট নীতিকে পাশ কাটিয়ে নিজেকে সভ্য বলে দাবি করে, তবে তা প্রকৃত সভ্যতার সংজ্ঞায় টিকতে পারে না। বরং তা হয় এক সাজানো মুখোশ, যার পেছনে লুকিয়ে থাকে আধিপত্য, নিয়ন্ত্রণ এবং কৃত্রিম মুক্তির প্রতারণা।

    নিঃসন্দেহে, সভ্যতা কোনো কাকতালীয় প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠে না; এর পেছনে থাকে একটি গভীর আদর্শিক ভিত্তি। কথিত আধুনিক সভ্যতা হোক, মধ্যযুগীয় সভ্যতা হোক বা প্রাচীন কোনো সমাজব্যবস্থা—সবই কোনো না কোনো আদর্শের রূপরেখায় গঠিত হয়। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা হলো, আদর্শ নিজে নিজে সমাজে প্রভাব বিস্তার করে না; বরং সেই আদর্শকে অন্তরে ধারণ করা, লালন করা ও বাস্তব রূপ দেওয়ার দায়িত্ব নেয় কিছু নিবেদিত মানুষ।

    আদর্শ—তা হক হোক কিংবা বাতিল—প্রথমে জন্ম নেয় চিন্তার জগতে, তারপর ছড়িয়ে পড়ে শব্দে, এবং অবশেষে শরীর পায় আচরণে, আন্দোলনে ও সাংগঠনিক প্রয়াসে। তবে কোন আদর্শ সমাজে কতটা প্রভাব ফেলবে বা কতটা প্রতিষ্ঠিত হবে, তা নির্ভর করে না কেবল সেই আদর্শ কতটা সত্য, যৌক্তিক কিংবা কেতাবিভাবে উৎকৃষ্ট তার উপর। ইতিহাস এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছে—সত্যকে অনেক সময় মঞ্চে ঠাঁই পেতে শতাব্দী লাগে, আর বাতিল আদর্শ কখনও কখনও এক প্রজন্মেই বিশাল সাম্রাজ্যের জন্ম দেয়।

    এই বাস্তবতার পেছনে মূল কারণ হলো আদর্শের বাহকদের অটলতা ও সংগ্রামী মানসিকতা। যারা তাদের আদর্শকে কেবল এক মতবাদ নয়, বরং জীবনের উদ্দেশ্য হিসেবে দেখেছে, তারা ত্যাগের মাধ্যমে সেই আদর্শকে মাটিতে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাদের মাঝে ছিল এক ধরণের ‘তাওহিদি সত্ত্বা’—যেখানে বিশ্বাস ও কর্ম একাকার হয়ে যায়।

    উদাহরণস্বরূপ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রেরিত সাহাবায়ে কেরাম সংখ্যায় অল্প ছিলেন, বাহ্যিক সম্পদেও দুর্বল ছিলেন, কিন্তু আদর্শিকভাবে ছিলেন দুর্ভেদ্য। তাদের এই অনমনীয় ঈমান ও আত্মত্যাগী মানসিকতাই ইসলামের আদর্শকে তৎকালীন দুই সুপারপাওয়ার—রোম ও পারস্যের—বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। তারা ‘হক’ আদর্শের বাহক ছিলেন, এবং তা প্রতিষ্ঠায় ছিল তাঁদের জীবন ও মরণের অঙ্গীকার।

    অন্যদিকে, ইতিহাসে অনেক বাতিল আদর্শ, যেমন ফ্যাসিবাদ বা উপনিবেশবাদ—কিছু মানুষ যদি একে আঁকড়ে না ধরত, তবে তা কেবল বইয়ের পাতায় একটি তত্ত্ব হিসেবেই থেকে যেত। এই আদর্শগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাদের অনুরাগীদের একনিষ্ঠতা, সংঘবদ্ধতা, এবং সংগঠিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে।

    আদর্শের তাত্ত্বিক শ্রেষ্ঠত্বই কোনো সমাজে তার বাস্তব প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা নয়। ইতিহাস জুড়ে আমরা দেখতে পাই—অনেক সময় সবচেয়ে পরিশুদ্ধ, সর্বোচ্চ নৈতিকতা সম্পন্ন এবং আধ্যাত্মিকভাবে শুদ্ধতম আদর্শও সমাজে স্থান পায়নি, কেবল তার বাহকরা সংখ্যায় অল্প ছিল, কিংবা যথেষ্ট দৃঢ়তা ও সংগঠন ছাড়া তারা একা হয়ে পড়েছিল।

    এই বাস্তবতার সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ হলো—তাওহীদ। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা যুগে যুগে পৃথিবীতে তাঁর পয়গাম পৌঁছে দেওয়ার জন্য নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন। সকল নবীর দাওয়াতের মূল ছিল এক ও অভিন্ন—তাওহীদের আহ্বান, আল্লাহর একত্বের প্রতি মানুষের আনুগত্য প্রতিষ্ঠা। এ দাওয়াত ছিল সর্বোচ্চ সত্য, সর্বোচ্চ ন্যায়ের প্রতিনিধিত্বকারী একটি আদর্শ।

    তবুও, আমরা দেখি যে আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় নবীদের সবাইকে এই তাওহীদের উপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দেননি, সমাজে প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা দান করেননি। কেউ কেউ ছিলেন শুধুই দাঈ—যারা তাদের সমাজে বার্তা পৌঁছিয়েছেন, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের বিরোধিতার কারণে আদর্শ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যেমন নূহ (আ.) নবী ছিলেন দীর্ঘ ৯৫০ বছর, কিন্তু তাঁর অনুসারী ছিল মাত্র কিছু লোক। তাঁর আদর্শের তাত্ত্বিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রশ্নাতীত হলেও সমাজে তা গড়ে উঠতে পারেনি, কারণ সেই সমাজ ছিল নৈতিকভাবে ভঙ্গুর, আর তাওহীদের প্রতি ছিল প্রবল বিরোধিতা।

    অন্যদিকে কিছু নবী যেমন দাঊদ (আ.) এবং সুলায়মান (আ.), তাদের হাতে আল্লাহ রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দিয়েছেন, আদর্শিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবনে আমরা এই প্রতিষ্ঠার পূর্ণতা দেখতে পাই—যেখানে তাওহীদ শুধু তাত্ত্বিক বক্তব্য ছিল না, বরং বাস্তব সমাজব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়েছিল।

    এ থেকেই আমরা বুঝতে পারি—তাত্ত্বিক শ্রেষ্ঠতা যথেষ্ট নয়। কোনো আদর্শ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে কিনা, তা নির্ভর করে তিনটি মূল ভিত্তির উপর:

    প্রথমত, সে আদর্শ ধারণকারী মানুষের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রের দৃঢ়তা—যাঁরা নিজ জীবনে সেই আদর্শকে প্রতিফলিত করেন। আদর্শ যখন ব্যক্তি চরিত্রে মিশে যায়, তখন তা ভাষণ নয়, আচরণে দৃশ্যমান হয়। এবং মানুষ তখনই প্রভাবিত হয়, যখন তারা আদর্শকে জীবন্ত রূপে দেখে।

    দ্বিতীয়ত, দৃঢ়তা ও একাগ্রতা—আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কষ্ট, নিপীড়ন, উপহাস, এমনকি পরাজয়ের মধ্যেও তা আঁকড়ে ধরার মানসিকতা প্রয়োজন। ইতিহাসে সকল সফল আদর্শিক বিপ্লবই এসেছে আত্মত্যাগ ও অবিচলতার মাধ্যমে, বাগ্মিতার মাধ্যমে নয়।

    তৃতীয়ত, সংকল্প ও কৌশলপূর্ণ সংগ্রাম—আদর্শ প্রতিষ্ঠা একটি দীর্ঘ ও কৌশলগত প্রক্রিয়া। শুধু সৎ হওয়া যথেষ্ট নয়, দরকার দুরদর্শিতা, সংগঠন, সময়ানুগ পদক্ষেপ ও কঠোর পরিশ্রম। আদর্শিক প্রতিযোগিতায় তারাই টিকে থাকে যারা স্বপ্ন দেখে, পরিকল্পনা করে এবং দিনরাত শ্রম দেয়।

    সুতরাং, আদর্শের সত্যতা তার শক্তি নয়—মানুষই আদর্শকে শক্তি দেন। যদি সেই মানুষরা আদর্শের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা না করে, তাহলে সে আদর্শ সময়ের ব্যবধানে সমাজে বাস্তব রূপ পায়, নতুবা তা হারিয়ে যায় কিতাবের পাতায়।

    সভ্যতা গড়ে ওঠে আদর্শ থেকে, কিন্তু আদর্শ গড়ে ওঠে মানুষ দিয়ে। এই চক্রটাই নির্ধারণ করে কোন আদর্শ কেবল আলোচনার বিষয় হবে, আর কোনটি ইতিহাস রচনার শক্তি হয়ে উঠবে।

    প্রথম যুগের সাহাবাদের ঈমান ও সংগ্রামী চরিত্রের ইতিহাস মানবসভ্যতার অন্যতম উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যখন তারা ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং একটি সামাজিক বিপ্লবী আদর্শে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছিলেন। তাদের জীবনের উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর জন্য সমস্ত কিছু ত্যাগ করা, এমন এক বিশ্বাস এবং সংকল্প নিয়ে তারা এগিয়ে গিয়েছিলেন, যা বিশ্বকে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং নতুন সভ্যতার দিকে পরিচালিত করেছিল। তারা নিশ্চিত ছিলেন যে, ইসলামের বিজয় অবশ্যম্ভাবী, এবং তারা নিজেরাই সেই বিজয়ের অগ্রসেনানী হিসেবে নিজেদের প্রস্তুত করেছিলেন।

    এই সাহাবিরা বিপ্লবী চরিত্র ধারণ করেছিলেন, যা তাদের জীবনকে শুধুমাত্র ধর্মীয় সীমারেখা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখেনি, বরং সমাজে আদর্শগত পরিবর্তন আনার জন্য তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল সুনির্দিষ্ট ও অটল। তারা ইসলামের মূলনীতি শুধুমাত্র তাত্ত্বিকভাবে জানতেন না, বরং সেই আদর্শকে নিজেদের জীবনে পুরোপুরি ধারণ করেছিলেন, এবং সেই আদর্শের ভিত্তিতেই সমাজে পরিবর্তন আনার জন্য তাদের মনোবল ছিল অটুট।

    এখানে সাইয়্যিদ কুতুব (রাহি.)-এর উল্লেখযোগ্য আলোচনা আসে। তিনি তার "মাইলস্টোন" বইতে ইসলামের আদর্শিক পুনর্জাগরণের কথা উল্লেখ করেছেন এবং বার বার বলে গেছেন যে, সভ্যতার পুনর্জাগরণ শুধুমাত্র কৌশলগত পরিকল্পনার মাধ্যমে সম্ভব নয়; এর জন্য প্রয়োজন একজন বিপ্লবী চরিত্রধারী অগ্রবর্তী বাহিনী। তাঁর মতে, ইসলামকে কেবল তাত্ত্বিক আলোচনার বিষয় হিসেবে না দেখে, তাকে আদর্শিকভাবে ধারণ করে, সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কর্মপন্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

    ইতিহাসের আলোকে, ইসলামি সভ্যতার প্রতিষ্ঠা যেভাবে হয়েছিল, তা এ কথাকেই প্রমাণ করে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবিরা একে একে বিপ্লবী চরিত্র ধারণ করে ইসলামকে শুধু আধ্যাত্মিক তত্ত্ব হিসেবে নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তাদের জন্য ইসলাম ছিল একটি চলমান বাস্তবতা—এটি ছিল তাদের জীবনদর্শন, যা তারা তাদের প্রতিটি কর্মে, প্রতিটি পদক্ষেপে বাস্তবায়িত করেছিলেন।

    ওহুদের যুদ্ধের মতো ঐতিহাসিক ঘটনার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে, সাহাবিরা কখনোই তাদের ঈমানের সাথে妥 নিজেকে বিচ্যুত হতে দেননি। যদিও তারা কৌশলগতভাবে কিছু ভুল করেছেন, কিন্তু তাদের ঈমান, চরিত্র এবং দৃঢ়তার কারণে সেসব ভুলের মধ্যে থেকেও তারা আল্লাহর সাহায্য পেয়েছিলেন এবং তাদের ত্যাগ, পরিশ্রম ও দৃঢ়সংকল্পের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত সফলতার দিকে এগিয়েছেন। এটি প্রমাণ করে যে, কৌশলগত ভুল বা যুদ্ধে পরাজয় এমন কোনো বাধা নয়, যখন ব্যক্তি ও দল একনিষ্ঠভাবে ঈমান এবং আদর্শের প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে।

    সাইয়্যিদ কুতুব (রাহি.) যখন ইসলামের আদর্শিক পুনর্জাগরণ এবং সভ্যতার প্রতিষ্ঠা নিয়ে আলোচনা করেন, তখন তিনি এই অগ্রবর্তী বাহিনীটির গুরুত্ব বার বার উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, একে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে, যারা এ আদর্শের বাহক হবেন তাদের শতভাগ আদর্শবাদী, ত্যাগী এবং বিপ্লবী চরিত্রে গড়ে উঠতে হবে। যে কোনো সভ্যতার পুনর্জাগরণ যদি সত্যিকার অর্থে সম্ভব হয়, তা তখনই সম্ভব যখন সেই সমাজে এমন মানুষরা জন্মগ্রহণ করেন, যারা শুধুমাত্র আদর্শের প্রতি নয়, বরং সেই আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে আত্মত্যাগে প্রস্তুত থাকে।

    এভাবে, সাইয়্যিদ কুতুব (রাহি.) তার লেখনিতে আদর্শিক প্রেক্ষাপটে তার দৃঢ় বিশ্বাস ও সংকল্পের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন, এবং তিনি যে কথা বলেছেন তা হচ্ছে, শুধু পরিকল্পনা বা কৌশল নয়, বরং সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে অপরিহার্য এক অগ্রবর্তী বাহিনী, যারা সেই আদর্শকে শুধু চিন্তা বা আলোচনার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করবে না, বরং বাস্তবে তা বাস্তবায়ন করবে। আজকের দিনে ইসলামি সভ্যতা ও আদর্শ পুনর্জাগরণের জন্য এই বিপ্লবী চরিত্রের, সেই অগ্রবর্তী বাহিনীর প্রয়োজন রয়েছে, যারা সমাজকে তার প্রকৃত স্বাধীনতা ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে দৃঢ় সংকল্পে লিপ্ত থাকবে।

    فَاَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ وَ انۡتَظِرۡ اِنَّهُمۡ مُّنۡتَظِرُوۡنَ
Working...
X