Announcement

Collapse
No announcement yet.

প্রকৃতির স্বাভাবিক নীতি যা মুমিন ও কাফের- উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য (পর্ব-১)

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • প্রকৃতির স্বাভাবিক নীতি যা মুমিন ও কাফের- উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য (পর্ব-১)

    আমাদের দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে স্পষ্টভাবে দুটি পৃথক ধারা পরিলক্ষিত হয়। এই ধারাগুলোর মধ্যে একটি হলো তথাকথিত গণতান্ত্রিক ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচেষ্টা, যারা মূলত পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্রকে ইসলামী রাজনীতির কাঠামোর সঙ্গে মেলাতে চেয়েছে। তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ধাপে ধাপে ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এগিয়ে যায়। তাদের কৌশল সাধারণত নির্বাচন, সংবিধান পরিবর্তন এবং সাংবিধানিক উপায়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার দাবি-দাওয়ায় সীমাবদ্ধ। তারা গণআন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের মনোভাব পরিবর্তনের কথা বলে থাকলেও, তাদের পন্থা মূলত শান্তিপূর্ণ বা অহিংস বলে প্রচারিত হয়।

    এই ধারার অনুসারীরা প্রায়শই একটি 'soft' ইসলামী রাজনীতির ধারা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যেখানে আপসহীন ইসলামি আদর্শের পরিবর্তে একটি সংস্কারকৃত, আধুনিক এবং পশ্চিমা ধাঁচের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ইসলামী দর্শন উপস্থাপন করা হয়। তারা অনেক সময় ইসলামি আন্দোলনের মৌলিক ধারণাসমূহ—যেমন জিহাদ, খিলাফাহ, শরিয়া—এসব শব্দ ও ধারণা প্রকাশে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। যেন তারা এই শব্দগুলো উচ্চারণ করলেই সমাজে ‘চরমপন্থী’ হিসেবে চিহ্নিত হবার ভয়ে থাকে। এর ফলে, তারা মূল ইসলামি সংগ্রামের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও প্রাসঙ্গিকতা থেকে সরে এসে একটি ধোঁয়াটে ও আপসকামীতায় ভরা রাজনৈতিক চর্চায় নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখে।

    আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ও উজ্জ্বলভাবে আলাদা করে চিহ্নিতযোগ্য ধারা হলো সশস্ত্র আন্দোলনের ধারা, যারা ইসলামের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শক্তি ও বলপ্রয়োগের পথকেই ইতিহাসসিদ্ধ ও প্রকৃতিপ্রসূত পন্থা হিসেবে গ্রহণ করে। এই ধারার ভিত্তি হচ্ছে, আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধান কায়েম করতে হলে শুধুমাত্র আদর্শ প্রচার বা সাংবিধানিক অনুরোধ যথেষ্ট নয়—বরং প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ, আত্মত্যাগ এবং কাফের কর্তৃত্বকে উৎখাত করাই প্রকৃত ইসলামি সংগ্রামের অনিবার্য রূপ।

    তবে এ ধারা যে একেবারেই নিখুঁত, এমন বলা যায় না। একদিকে যেমন তারা ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আপসহীন অবস্থানে অবিচল থেকেছে ঠিকই, কিন্তু অন্যদিকে তারা অনেক সময় নিজেদের আন্দোলনকে সাধারণ জনগণের চেতনায় প্রোথিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতা আংশিকভাবে ঔপনিবেশিক মানসিকতায় বন্দী জনগণের চিন্তাগত পশ্চাৎপদতার কারণে, আবার আংশিকভাবে এই ধারার কৌশলগত বিচ্ছিন্নতা ও কখনো কখনো অতিমাত্রায় গোপনীয়তার কারণে।

    ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতার ফলে গঠিত যে পরাজিত মানসিকতা, যেখানে জনগণ শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোকে ‘অপরাধ’ হিসেবে দেখে, সেখানে এই ধারা নিজেদের বার্তা যথাযথভাবে পৌঁছে দিতে না পারায় সমাজে একধরনের বিচ্ছিন্নতার আবরণ তৈরি হয়েছে। ফলে গণতান্ত্রিক ধারার দলগুলো অনেক সময় এই সশস্ত্র আন্দোলনকারীদের আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি (IRA) বা অন্যান্য সশস্ত্র সংগঠনের সাথে তুলনা করে, যেন তারা এদের ‘চরমপন্থী’ আখ্যা দিয়ে মূলধারার রাজনৈতিক পরিসর থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে পারে।

    সমাজ ও রাষ্ট্রে বিপ্লব, অর্থাৎ একটি মৌলিক ও আমূল পরিবর্তন, ইতিহাসের কোন পর্যায়েই রক্তপাত ছাড়া সম্ভব হয়েছে—এমন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। একটি শক্তিশালী, প্রতিষ্ঠিত সিস্টেমকে উপড়ে ফেলে নতুন একটি আদর্শিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে গেলে, তা স্বভাবতই বিদ্যমান ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এই সংঘর্ষের ফলেই সংঘটিত হয় রক্তপাত, যার মাধ্যমেই পুরাতন শক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং নতুন শক্তি আত্মপ্রকাশের সুযোগ পায়।

    কেবলমাত্র রক্তপাতই নয়, বিপ্লব সফল করতে জনসংযোগ, জনসচেতনতা এবং জনসম্পৃক্ততাও অপরিহার্য। জনগণের মনের গভীরে যদি পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা না থাকে, তবে একটি বিপ্লব কখনোই স্থায়ী রূপ পায় না। কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষা থাকলেও, যদি তা শক্তিশালী প্রতিরোধের মুখে পড়ে এবং প্রতিপক্ষ ক্ষমতা ব্যবহার করে তা দমন করতে চায়, তখন বিপ্লবকারীদের সামনে দুটি পথ থাকে—হয় আত্মসমর্পণ, নয়তো সশস্ত্র প্রতিরোধ। যারা ইতিহাসে পরিবর্তন এনেছে, তারা দ্বিতীয় পথকেই বেছে নিয়েছে।

    একটি রাষ্ট্রে যখন কোনো একটি রাজনৈতিক পক্ষ শক্তি ও কর্তৃত্বের কেন্দ্রে অবস্থান করে, তখন সেই পক্ষের আদর্শ, ভাষ্য (narrative), এবং নীতি-নীতিমালাই রাষ্ট্র পরিচালনার মানদণ্ডে পরিণত হয়। রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো, শিক্ষা ব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, এমনকি সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের প্রকাশও সেই পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন হিসেবে গড়ে ওঠে। ফলে, অন্য কোনো আদর্শ যদি রাষ্ট্রে প্রবেশ করতে চায় বা বিকল্প দর্শন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তাহলে সেটি সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে ক্ষমতাসীন আদর্শের সঙ্গে।

    রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনী এই ন্যাচারাল পলিটিক্যাল প্রসেসের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। মক্কায় অবস্থানকালে নবীজির (সা.) নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আদর্শিক কাঠামো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সত্তা না হয়েও এক বিপ্লবী, ঈমানদীপ্ত শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। সাহাবায়ে কেরাম (রা.), বিশেষ করে মাক্কান সাহাবাগণ, ছিলেন সেই আদর্শিক বীজ যারা ধৈর্য, ত্যাগ এবং দ্ব্যর্থহীন একনিষ্ঠতার মাধ্যমে সমাজে পরিবর্তনের সূচনা ঘটান। কিন্তু আদর্শিক শক্তির রাজনৈতিক রূপায়ণ তখনো সম্ভব হয়নি—কারণ রাষ্ট্রক্ষমতা ছিল কুরাইশের হাতে।

    পরিস্থিতির মোড় ঘোরে যখন ইয়াসরিবের (বর্তমান মদিনা) আওস ও খাজরাজ গোত্রের প্রতিনিধিরা ইসলামের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাই'আতের মাধ্যমে নিজেদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নেতৃত্বে সম্পূর্ণভাবে সঁপে দেন। এখানেই সামাজিক শক্তির সঙ্গে সামরিক ও রাজনৈতিক সংহতির এক ঐতিহাসিক মেলবন্ধন ঘটে—যার মাধ্যমে ইসলামের আদর্শিক কাঠামো রূপ পায় রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে।

    মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর এই শক্তি ও সংগ্রামের ধারাবাহিকতা গড়ে তোলে এমন এক ভিত্তি, যার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে।

    বাংলাদেশের তথাকথিত নির্বাচনী গণতান্ত্রিক ইসলামী দলগুলো প্রায়ই দাবি করে যে তারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মাক্কী জীবনের অনুকরণে ইসলামী দাওয়াহর পথ অনুসরণ করছে। তারা বলে থাকে, রাসূল (সা.) যেভাবে শুরুতে প্রতিকূল পরিবেশেও অহিংস দাওয়াহর মাধ্যমে ইসলামের বীজ বপন করেছিলেন, তারাও তেমনিভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা ছাড়াই সমাজে ইসলামী চেতনাবোধ জাগ্রত করতে চায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই দাবি একদিকে যেমন ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভ্রান্ত, অন্যদিকে বর্তমানে তাদের কার্যক্রম ইসলামী আদর্শের প্রতি দায়িত্বশীলতার চরম ব্যত্যয় বলেই পরিগণিত হচ্ছে।

    রাসূল (সা.)-এর মাক্কী জীবনের বৈশিষ্ট্য ছিল আদর্শিক uncompromising অবস্থা, আত্মত্যাগ, ত্যাগ-তিতিক্ষা, এবং সর্বোপরি তাগুতি শক্তির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান। তিনি কুরাইশ নেতাদের কোনো রাজনৈতিক আপসের প্রস্তাব গ্রহণ করেননি—বরং কাবা গৃহের চাবি, রাজত্ব কিংবা অর্থ-বিত্তের প্রতিশ্রুতি থাকলেও একটিই উত্তর দিয়েছেন: “এক হাতে সূর্য, আর এক হাতে চন্দ্র দিলেও আমি এই দাওয়াত থেকে সরে আসব না।” কিন্তু আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক ইসলামী দলগুলোর দাওয়াহ প্রক্রিয়া এমনভাবে পরিচালিত হচ্ছে, যা কার্যত তাগুতের স্বীকৃতি দিয়েই শুরু হয়। তারা ইসলামী আদর্শ কায়েমের নামে এমন এক পদ্ধতিতে প্রবেশ করেছে, যার মূল কাঠামোই ইসলামবিরোধী, তাগুতি ও উপনিবেশিক।

    নির্বাচনমুখী দাওয়াহর এই প্রকল্প ইসলামী সমাজে আদর্শিক ভিত্তি গড়ার পরিবর্তে বরং একটি ভ্রান্ত ধারণা প্রতিষ্ঠা করেছে—যেখানে মানুষ মনে করে ইসলাম কেবল এক ধরনের 'নৈতিক বিকল্প', কিন্তু বাস্তব রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য নয়। ফলে তারা আদর্শিকভাবে সমাজে ইসলামী মূল্যবোধ ছড়াতে তো ব্যর্থই হয়েছে, বরং নিজেদের অস্তিত্বই ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। আজকে তাদের অবস্থান এমন হয়েছে যে, তারা ইসলামি রাজনীতির নামে নির্বাচনের বৈঠকখানায়, তাগুতি সংবিধান ও কাঠামোর মধ্যে নিজেদের আদর্শকে মানিয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এর ফলে ইসলামী রাজনৈতিক চেতনার স্বরূপই বিকৃত হয়ে গেছে।

    এই সংকটকে আরও পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় তিউনিশিয়ার আন-নাহদা পার্টির উদাহরণে। প্রথমে যে আদর্শিক দৃঢ়তা ও ইসলামি আদর্শের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আন-নাহদা এগিয়েছিল, সে দলই পরে "প্রজাতন্ত্র রক্ষার জন্য" ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সঙ্গে আপস করে, এমনকি ইসলামি শরিয়াহর কথা বলাও প্রায় বন্ধ করে দেয়। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার নামে তারা যে আত্মসমর্পণমূলক অবস্থানে চলে গিয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত ইসলামপন্থীদের জন্য এক ট্র্যাজিক পরিণতির উদাহরণ হয়ে ওঠে। সেই একই পথেই বাংলাদেশের ইসলামি দলগুলো হাঁটছে, যদিও তারা মুখে বলছে মাক্কী মডেল, বাস্তবে কিন্তু তারা এগিয়ে চলেছে এক প্রকার লিবারেল গণতান্ত্রিক ঘূর্ণিপাকে গৃহপালিত বিরোধী শক্তিতে পরিণত হবার দিকে।

    তাদের দাওয়াতি কাজের ফলাফল হচ্ছে এমন একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে ইসলাম নিজেই কোণঠাসা। তারা যেন তাগুতি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ইসলামের জন্য একটি 'খোপ' তৈরি করতে ব্যস্ত—যাতে করে ইসলাম আর পূর্ণাঙ্গ আদর্শ হিসেবে নয়, বরং সিস্টেমের একটি আনুষঙ্গিক উপাদান হিসেবে স্থান পায়। এই পন্থা আদতে ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণাকে দুর্বল করে এবং ইসলামকে একটি 'সহনীয় ধর্মীয় সংস্কৃতি' হিসেবে চিত্রিত করে—যে সংস্কৃতি কখনোই বিদ্যমান ক্ষমতার কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে না।

    ইসলামী রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার শরীয়াহ-সম্মত পথ কী হওয়া উচিত—এ প্রশ্নটি খিলাফতের পতনের পর থেকেই মুসলিম উম্মাহর চিন্তাশীল ও ইখলাছপূর্ণ মুজাহিদদের সামনে এক গুরুত্বপূর্ণ ও বাস্তবিক সংকট হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। বিশেষ করে যখন উসমানীয় খেলাফত ব্যবস্থার অবসানের মধ্য দিয়ে ইসলামের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সর্বজনীন রূপ বিলুপ্ত হয়ে যায়, তখন থেকে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুসলমানরা এই শূন্যতা পূরণের জন্য বিভিন্ন পন্থা অনুসন্ধান করতে শুরু করে।

    এই অনুসন্ধান একেবারেই কেবল তাত্ত্বিক ছিল না; বরং তা ছিল রক্তমাখা, বাস্তব অভিজ্ঞতায় পরিপুষ্ট, এবং নানা ব্যর্থতা, অর্জন ও শিক্ষা দিয়ে গঠিত একটি চলমান প্রক্রিয়া। ইসলামী আন্দোলনগুলো বুঝতে পেরেছিল যে, শুধু ধর্মীয় আচার বা ব্যক্তিগত নৈতিকতা দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়—বরং রাষ্ট্রের স্তরে একটি আদর্শিক কাঠামো প্রয়োজন, যেখানে কেবল শরিয়াহই হবে আইন, নীতিনির্ধারণ ও শাসনের একমাত্র মানদণ্ড।

    এই প্রেক্ষাপটে যারা গভীরভাবে চিন্তা করেছেন, তারা স্পষ্টতই উপলব্ধি করতে পেরেছেন—খিলাফাহর পতন এবং ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থার উত্থান, এই উভয় প্রক্রিয়ার মূলে একটি অভিন্ন বাস্তবতা ছিল: জনগণের এক বৃহৎ অংশের মানসিক ও আদর্শিক বিচ্ছিন্নতা। খিলাফাহর পতনের সময়, মুসলিম জনগণ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণে খিলাফাহর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিল। পশ্চিমা জ্ঞানতাত্ত্বিক আগ্রাসন এবং সাংস্কৃতিক উপনিবেশীকরণে তারা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে আধুনিক জাতিরাষ্ট্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে উন্নতির একমাত্র পথ। ফলে খেলাফত ভেঙে পড়লেও মুসলিম সমাজে কোনো বাস্তব প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি।

    অপরদিকে, যখন ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো মুসলিম ভূমিতে নিজেদের শাসন কায়েম করে, তখন এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সুদৃঢ় ও আত্মোৎসর্গমূলক প্রতিক্রিয়া এসেছিল ইসলামী আন্দোলনগুলোর পক্ষ থেকে। মুজাহিদিন, আলেম সমাজ, সুফি তরীকার অনুসারী এবং সাধারণ ঈমানদার জনগণ, সবাই এই বহিরাগত দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে জান ও মাল নিয়ে প্রতিরোধে নেমেছিল। এ থেকেই বোঝা যায়, রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে মুসলিম উম্মাহ তখনো একটি অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত ছিল—যেখানে ‘নিজের শাসক’ হলেও আদর্শচ্যুত খেলাফাহকে তারা মেনে নেয়নি, কিন্তু ‘পরাধীন দখলদার’ হলে তার বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে লড়েছে।

    কিন্তু আমাদের জন্য গভীর দুঃখ ও আফসোসের বিষয় হলো—এখনও ইসলামী আন্দোলনগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে সঠিক ও সুস্পষ্ট জবাব দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এটি কেবল একটি কৌশলগত ব্যর্থতা নয়, বরং আদর্শিক ও শরয়ী পরিপক্বতার অভাব থেকেও উৎসারিত। ইসলামী রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে মৌলিক প্রশ্নগুলো সামনে আসে—শরীয়াহ-সম্মত ক্ষমতা দখলের পথ কী? তাগুতি ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ততার সীমা কোথায়? উম্মাহর বাস্তবতা ও ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে কোন পর্যায়ে কোন কৌশল বৈধ?—এসব প্রশ্নে বহু আন্দোলন অস্পষ্ট, দ্বিধাগ্রস্ত এবং অনেক সময় আবেগনির্ভর সিদ্ধান্তে পতিত হয়েছে।

    খেলাফতের পতনের পর মুসলিম উম্মাহর এক বিশাল অংশ যখন একটি ঐতিহাসিক ও আদর্শিক শূন্যতার মধ্যে পতিত হলো, তখন সমাজে প্রভাব বিস্তারকারী অন্য আদর্শিক শক্তিগুলো—বিশেষ করে বামপন্থী ও প্রগতিশীল ধারা—তাদের মতাদর্শ ও কৌশলকে বিস্তার দিতে শুরু করে। আমাদের সমাজেও একই চিত্র পরিলক্ষিত হয়েছে। খেলাফতের পতনের ফলে ইসলামী চিন্তা ও রাজনীতির ধারা যখন নানান বিভ্রান্তি, মতপার্থক্য ও কৌশলগত দ্বিধায় বিপর্যস্ত, তখন ঠিক সেই সময়েই বামপন্থী দলগুলো তাদের কার্যক্রমকে ক্রমাগত সংগঠিত, আদর্শিকভাবে একনিষ্ঠ এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে সুপরিকল্পিতভাবে এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়।

    তারা কেবল চিন্তাগত একটি বিকল্প প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেনি, বরং তারা বাস্তবিক রাজনৈতিক কাঠামো নির্মাণ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি পুনর্গঠন, অর্থনীতি ও প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সমাজকে একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শের দিকে প্রবাহিত করেছে। এই আদর্শিক প্রবাহ রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে এবং তারা এক পর্যায়ে রাষ্ট্রক্ষমতা, প্রশাসন ও সম্পদের উপর সুদৃঢ় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এই প্রক্রিয়াটি যে কেবল একটি রাজনৈতিক উত্তরণের ফল ছিল তা নয়, বরং এটি ছিল এক নিরব, দীর্ঘমেয়াদী আদর্শিক ও সাংগঠনিক সংগ্রামের ফল।

    অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলনের অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। তারা একটি মহত্তম লক্ষ্যের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল—ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই পথের সূচনাতেই তারা একটি কেন্দ্রীয় প্রশ্নে বিভক্ত হয়ে পড়ে: নববী তরীকা কোনটি? কীভাবে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে শরীয়াহর আলোকে? এই প্রশ্নটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সমস্যা হলো—এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয় তা কেবল মতবিনিময় বা ইজতিহাদি পার্থক্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা পরিণত হয় দলাদলি, দোষারোপ, এমনকি পরস্পরের তাকফিরে।

    আরও হতাশাজনক হলো এই যে, ইসলামপন্থীদের কাছে আদর্শিক ভিত্তি ও জনগণের আবেগগত সমর্থনের বিপুল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও তারা তার সদ্ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের দেশেই ৯০% মানুষ অন্তত আবেগ ও আত্মিক অনুভূতির দিক থেকে ইসলামকে ভালোবাসে, ইসলামকে নিজেদের পরিচয়ের মূল অংশ মনে করে—তবুও রাষ্ট্র ক্ষমতায় বারবার দেখা যায় সেই সেক্যুলার, সমাজতান্ত্রিক বা পশ্চিমা ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী দলগুলোই অধিষ্ঠিত। কারণ, তারা সংঘবদ্ধ, কৌশলগত এবং আদর্শিক বাস্তবতা বুঝে কাজ করেছে, যেখানে ইসলামপন্থীরা নিজেদের মধ্যেই দ্বিধান্বিত, পরস্পর বিরোধী এবং কখনো কখনো রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থেকেছে।

    আজকের বাস্তবতা এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে কিছু লোক এখনো বলে—"না, এখনও আদর্শিক কাঠামো পরিষ্কার না। আরও গবেষণা দরকার।"

    কেন আমরা আজও নিজেদের কাছে এই কঠিন কিন্তু প্রয়োজনীয় প্রশ্নটি করছি না—কীভাবে কমিউনিস্ট বামপন্থীরা, যাদের দর্শনের শিকড় ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে, তারা নিজেদের মতাদর্শের ভিত্তিতে একের পর এক রাষ্ট্র গঠন করে ফেললো? কোথাও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, কোথাও শ্রমিক শ্রেণির নামে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল, কোথাও আবার বিশৃঙ্খলা আর বিশাল ত্যাগের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র কাঠামো নির্মাণ—তাদের ইতিহাস আমাদের চোখের সামনেই। অথচ আমরা, যারা নিজেদের শেষ নবীর উম্মত বলে দাবি করি, যারা একটি পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা নিয়ে গর্ব করি, আমরা আজ পর্যন্ত নিজেদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল, একটি আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থাও গড়ে তুলতে পারিনি।

    এমন পরিস্থিতিতে প্রত্যেক বিবেকবান, চিন্তাশীল মুসলমানের উচিৎ ছিল এই প্রশ্নে গভীরভাবে চিন্তা করা—আমরা কোথায় ভুল করেছি? কীসের কারণে আমরা লক্ষ্যের দিকে এগোতে পারিনি? আমাদের আন্দোলনগুলো কোথায় পথ হারিয়েছে?

    আজ আমাদের একথা স্বীকার করে নিতেই হয়, কষ্ট হলেও সত্য যে—আমরা নববী মানহাজ নিয়ে যে চিন্তা করেছি, যে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলেছি, তা এককথায় বললে ‘ভুল’ ছিল। এই ভুল শুধু একটি চিন্তার ত্রুটি নয়, এটি ছিল এক আদর্শিক মোহ—যেখানে আমরা ধরে নিয়েছিলাম নববী তরীকাহ মানেই নিঃক্রিয়তা, অপেক্ষা, অব্যবস্থা এবং কেবল কষ্ট সহ্য করার নাম। অথচ বাস্তবতা হলো, নবী (স)-এর জীবনধারা ছিল গভীর কৌশল, সমাজ বাস্তবতার সূক্ষ্ম উপলব্ধি, এবং লক্ষ্য অর্জনে অবিচল সংগঠন ও নেতৃত্বের মিশ্রণে গঠিত এক পরিপূর্ণ পদ্ধতি।

    রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা—এটা কেবল একটি ধর্মীয় আবেগের বিষয় নয়; এটি একটি বাস্তব রাজনৈতিক, সামাজিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া। নববী মানহাজ আসলে একটি ‘বিশ্বজনীন রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার পদ্ধতি’, যার উপাদানগুলো স্বতন্ত্র হলেও বিশ্ব বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটি কেবল মক্কী পর্বের ত্যাগ-তিতিক্ষায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা মদীনায় রাষ্ট্রীয় কাঠামো গঠনের, যুদ্ধ-শান্তির কূটনীতি পরিচালনার, সমাজ পুনর্গঠনের, এমনকি আইনি ও প্রশাসনিক সংস্কারের এক পূর্ণাঙ্গ রূপরেখাও বটে। নববী তরীকা মানেই ধৈর্য নয়, তাওয়াক্কুল নয়—বরং এই ধৈর্য ও তাওয়াক্কুলের পাশাপাশি সর্বোচ্চ কৌশলী ও সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ, সর্বোচ্চ প্রজ্ঞার সাথে জাতি গঠনের উপযোগী কাঠামো নির্মাণ।

    তবে এখানে একটি স্পষ্ট পার্থক্য করা জরুরি—শুধু কার্যকারিতা, অর্থাৎ একটি পদ্ধতি কার্যকর বা ফলদায়ী হলেই তা শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ বা গ্রহণযোগ্য হয়ে যায় না। ইসলামী আদর্শ কেবল ফলের ওপর ভিত্তি করে পথ নির্ধারণ করে না, বরং পথ ও ফল উভয়ের মাঝে একটি শরয়ী সামঞ্জস্য থাকা চাই। অন্যথায়, ইসলামপন্থীরা তাগুতি শক্তির মতোই আচরণ করতে পারে—শুধু ভিন্ন নামে। নববী তরীকার মর্যাদা এখানে—যে এটি শরীয়াহর দলিল দ্বারা প্রমাণিত, এবং একইসাথে কার্যকর ও ফলপ্রসূও।

    আমরা যদি সত্যিই নিজেদের ভুল স্বীকার করি, তবে আমাদেরকে পুনরায় নববী তরীকার মূল স্পিরিট এবং কাঠামো অনুধাবন করে, বর্তমান বাস্তবতায় তার বাস্তবায়নের রূপরেখা নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের সমাজে, যেখানে ইসলামপন্থীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং আবেগগত সমর্থন রয়েছে, সেখানে প্রয়োজন সেই সাংগঠনিক কাঠামো, যে কাঠামো আদর্শিক স্বচ্ছতা, কৌশলগত প্রজ্ঞা, এবং বাস্তবতাভিত্তিক পদক্ষেপের সমন্বয়ে গঠিত।

    তর্ক নয়, তাওয়াক্কুল—এখন সময় আত্মসমীক্ষা ও বাস্তব পদক্ষেপের। নববী তরীকা শুধুমাত্র স্মরণ করার জন্য নয়, তা বাস্তবায়নের জন্য। আর সেটি যদি সঠিকভাবে অনুধাবন ও প্রয়োগ করা যায়, তবে একদিন ইন শা আল্লাহ, সেই হারিয়ে যাওয়া আশ্রয়স্থল আমরা গড়ে তুলতেই পারবো।​
    فَاَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ وَ انۡتَظِرۡ اِنَّهُمۡ مُّنۡتَظِرُوۡنَ
Working...
X