বিগত আড়াই শতাব্দী থেকে কিছু মৌলিক প্রশ্ন মানবসভ্যতার চিন্তাজগতে, বিশেষ করে মুসলিম উম্মাহর বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে বারংবার ফিরে এসেছে। সময় বদলেছে, প্রেক্ষাপট রূপান্তরিত হয়েছে, কিন্তু এই প্রশ্নগুলো যেন সময়ের সাথে আরও গভীরতর রূপে আবির্ভূত হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি প্রশ্ন বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক, যা আজও বুদ্ধিজীবী সমাজে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে।
প্রথমত, ইসলাম ও মডার্নিটির মধ্যে সম্পর্ক কি চিরকালই বিরোধপূর্ণ?
দ্বিতীয়ত, ইসলাম যদি মডার্নিটিকে গ্রহণ করে, তাহলে ইসলামের মৌলিক আকিদা—আখিরাত, নবুওত, তাকদীর, তাওহীদ—এগুলোর সার্বিকতা ও মৌলিকত্ব ধরে রাখা কি সম্ভব?
তৃতীয়ত, এই দ্বন্দ্বের, এই টানাপোড়েনের, এই বিশ্বাস বনাম বাস্তবতার সমস্যার সমাধান কোথায়?
সময়ের ব্যবধানে আলোচিত প্রশ্নগুলোর কিছু কিছু উত্তর আমাদের জন্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, কিন্তু কিছু কিছু এখনো ধোঁয়াশার আড়ালে রয়ে গেছে। তবে এই ধোঁয়াশা থাকা মানে এই নয় যে প্রশ্নগুলোর সমাধান কুরআন বা সুন্নাহতে অনুপস্থিত। বরং এর প্রকৃত কারণ হলো—এই প্রশ্নগুলোর অন্তর্নিহিত গভীরতা ও প্রেক্ষাপটকে সঠিকভাবে অনুধাবন করার ক্ষেত্রে আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতা, এবং কখনো কখনো চিন্তার দার্শনিক কাঠামোর দুর্বলতা।
ইসলামিক ফিকহ ঐতিহাসিকভাবেই প্রমাণ করেছে যে, সময়ের প্রয়োজনে নতুন বাস্তবতা মোকাবিলায় এটি এক অনন্য দিকনির্দেশক। ফিকহের ইজতিহাদ, মাসলাহা ও উরফ-এর মতো নীতিমালাগুলো যুগোপযোগী প্রেক্ষাপটে শরীয়াহর মূল উদ্দেশ্য অক্ষুণ্ণ রেখে আধুনিকায়নের পথ উন্মুক্ত রেখেছে।
তাই কোনো প্রযুক্তিগত, শিল্প-সাংস্কৃতিক, বা স্থাপত্যগত মডার্নিটি যদি মানবকল্যাণে নিয়োজিত হয় এবং তা শরীয়াহর মৌলনীতি লঙ্ঘন না করে, তাহলে ইসলামের পক্ষে তা গ্রহণে আপত্তির কোনো অবকাশ নেই। তাই আধুনিক টেকনোলজি বা উন্নত স্থাপত্য ইসলামবিরোধী—এমন ধারণার কোনো ভিত্তি নেই।
কিন্তু বিষয়টা ঠিক এখানেই জটিল হয়, যখন আমরা দেখি—পশ্চিমা দৃষ্টিকোণে মডার্নিটি বলতে কেবল প্রযুক্তি বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ মতাদর্শ বোঝানো হয়। এটি এমন এক চিন্তাধারা, যেখানে ধর্মকে ব্যক্তিগত পরিসরে সীমাবদ্ধ রাখা হয়, আর সামষ্টিক জীবনের সব কিছু চালিত হয় ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, লিবারেলিজম, মানবতাবাদ, নারীবাদ ইত্যাদি নানা ‘তন্ত্র-মন্ত্র’ দ্বারা। এইসব ধারণা একসাথে মিলে একধরনের নতুন ‘ধর্ম’ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, নৈতিকতা, এমনকি ‘পাপ ও পুণ্য’-এর সংজ্ঞাও আছে।
এবং ঠিক এখানেই ইসলামের সাথে সংঘর্ষ শুরু হয়। কারণ দ্বীন আল-ইসলাম কোনো আপসের ধর্ম নয়। ইসলাম তার অনুসারীদের কখনোই এই অনুমতি দেয় না যে, তারা আল্লাহ্র নাযিলকৃত দ্বীন ব্যতীত অন্য কোনো মতাদর্শকে ‘জীবনের পথ’ হিসেবে গ্রহণ করবে। ইসলামের মৌলিক আকীদা হলো—আল্লাহর আইনই একমাত্র সত্য ও চূড়ান্ত, এবং এর বাইরে কোনো আদর্শ মানুষের জন্য পথনির্দেশ হতে পারে না।
সুতরাং, মডার্নিটি যদি শুধু আধুনিকায়ন হয়, তাহলে দ্বন্দ্ব নেই। কিন্তু যখন এটি ইসলাম-বহির্ভূত আদর্শিক কাঠামো রূপে হাজির হয়—তখনই দ্বীন আল-ইসলামের সঙ্গে তার সরাসরি দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। আর এখানেই আমাদের দ্বিতীয় প্রশ্নের মূল জবাব নিহিত।
আমাদের আলোচনার ধারাবাহিকতায় এখন আমরা সেই কেন্দ্রীয় প্রশ্নে পৌঁছেছি—এই সমস্যার সমাধান কোথায়? তবে এখানেই স্পষ্ট করতে হবে, সমাধানটি কোনো সরল বাইনারি সিদ্ধান্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি এমন নয় যে, হয় আগ্রাসন, নয় আত্মসমর্পণ—এ দুটি পথের একটিই বেছে নিতে হবে। বাস্তবতা এতটা দ্বিমাত্রিক নয়, বরং অনেক বেশি জটিল ও বহুস্তরবিশিষ্ট।
এখানে এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এই বাইনারি ধারণাটিও অনেকাংশে পশ্চিমা মতাদর্শের তৈরি। যেমন, তারা শুধু মডার্নিটির সংজ্ঞাই নির্ধারণ করে দিচ্ছে না, বরং 'আগ্রাসন' ও 'আত্মসমর্পণ'-এর সংজ্ঞাও নিজের মতো করে চাপিয়ে দিচ্ছে। তাদের চোখে আত্মসমর্পণ মানে হলো—নিজের ধর্ম ও বিশ্বাস থেকে সরে এসে তাদের আদর্শকে নিঃশর্তভাবে গ্রহণ করা। অন্যদিকে, যদি কেউ নিজেদের বিশ্বাসকে ধরে রাখে, ইসলামী আদর্শের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয় বা অন্যায় প্রতিরোধ করে—তখনই সেটাকে তারা 'আগ্রাসন' বলে চিহ্নিত করে।
ফলে, এই পুরো আলোচনাটি এমন এক পরিসরে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে খেলাধুলার নিয়মও নির্ধারিত হচ্ছে এক পক্ষের দ্বারা, এবং বিচারকও সেই পক্ষই। এ অবস্থায় প্রকৃত সমাধান খুঁজতে হলে আমাদেরকে আগে এই একচেটিয়া সংজ্ঞাগুলোর দখল থেকে নিজেদের চিন্তা মুক্ত করতে হবে। আমাদেরকে বুঝতে হবে—কোথায় আপস নয়, আবার কোথায় অনর্থক সংঘাতে না গিয়েও, স্বকীয় অবস্থানে থেকে, বিশ্ববাস্তবতার জবাব দেয়া যায়। আর সেই উত্তর আমরা এখানে দেওয়ার চেষ্টা করব।
যেমন ধরুন, শায়খ ওসামা (রাহি.) কর্তৃক পরিচালিত টুইন টাওয়ার হামলাকে পশ্চিমারা তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে আগ্রাসনের চরম রূপ বলে আখ্যা দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, শায়খ ওসামা (রাহি.) এই হামলা শুধুমাত্র প্রতিক্রিয়াশীল ক্ষোভ থেকে করেননি। এর পেছনে ছিল সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য ও চিন্তাভাবনা।
প্রথমত, এটি ছিল মুসলিমদের উপর পশ্চিমাদের দীর্ঘদিনের নির্যাতন ও আগ্রাসনের জবাব। আফ্রিকা, ইরাক, ফিলিস্তিনসহ বহু মুসলিম ভূমিতে তারা যে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়েছে, সে অন্যায়ের প্রতিশোধ ছিল এর প্রেরণা।
দ্বিতীয়ত, এর মাধ্যমে পশ্চিমাদের সামরিক ও অর্থনৈতিক পরাক্রমকে দুর্বল করার চেষ্টা ছিল। তারা নিজেদের যে 'অজেয়', 'মানবিকভাবে সভ্য', 'শান্তির রক্ষক' রূপে বিশ্বে উপস্থাপন করে—শায়খ ওসামা সেই ভুয়া মুখোশটা খুলে সবাইকে দেখাতে চেয়েছেন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তিনি স্পষ্ট করে দিতে চেয়েছেন—তাদের মধ্যে যে ঐক্য আমরা দেখি, তা কোনো নৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে নয়। বরং তারা একত্র হয়েছে মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ, ভয় ও দমননীতিকে কেন্দ্র করে। এই বাস্তবতাটাই তিনি সামনে তুলে ধরতে চেয়েছেন, যেন উম্মাহ বুঝতে পারে কারা আসল শত্রু এবং কারা তাদের বিরুদ্ধে সত্যিকারের একজোট।
এখানে আমাদের কিছু ঐতিহাসিক বাস্তবতা স্পষ্টভাবে জানা জরুরি। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপীয় শক্তিগুলো—বিশেষ করে ঐতিহাসিক ক্রুসেডার রাষ্ট্রগুলো—প্রায় সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। তাদের অর্থনীতি, রাজনীতি, এবং বৈশ্বিক প্রভাব চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই শূন্যতার মাঝেই আমেরিকা নিজেকে নতুন শক্তি হিসেবে তুলে ধরে—শুধু একটি পরাশক্তি নয়, বরং নতুন যুগের ‘ক্রুসেডার নেতৃত্ব’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
এটা আমাদের অনুমান নয়। স্বয়ং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ২০০১ সালের ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ ঘোষণা করার সময় একে “ক্রুসেড” বলে আখ্যায়িত করেছিলেন—এ কথা তো কারও অজানা নয়। অর্থাৎ এটি কোনো কূটনৈতিক যুদ্ধ নয়, বরং আদর্শিক ও বিশ্বাসভিত্তিক সংঘাত হিসেবেই তারা এটিকে উপস্থাপন করেছে।
এই সময়েই আমেরিকান শক্তি ও তার পিছুপড়া পশ্চিমা গোষ্ঠী বুঝতে পারে—
বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ব ধরে রাখতে হলে তাদের দরকার এমন একটি আদর্শ, যা ধর্মকে সমাজ থেকে দূরে রাখবে, মানুষকে বিশ্বাসহীনতার দিকে ঠেলে দেবে, এবং একই সঙ্গে তাদের অন্যায়, ভোগবাদী, নীতিহীন কর্মকাণ্ডকে আইনগত ও নৈতিক বৈধতা দেবে।
এই ইতিহাস জানা জরুরি, কারণ এটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে—আজকের মতাদর্শিক সংঘাত কোনো হঠাৎ গড়ে ওঠা বিষয় নয়। বরং এটি একটি সচেতন, পরিকল্পিত, এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টার ফল, যার মূল লক্ষ্য হলো মুসলিম উম্মাহর চেতনা, ঐক্য এবং স্বকীয়তা ধ্বংস করা।
যদিও আমরা অনেক সময় আমেরিকাকে শুধুমাত্র একটি যুদ্ধবাজ রাষ্ট্র হিসেবে দেখি, প্রকৃতপক্ষে তাদের যুদ্ধ ও আগ্রাসনের পেছনে রয়েছে আরও গভীর, আদর্শিক একটি লক্ষ্য। সেটা হলো—তাদের নিজস্ব মতাদর্শ, বিশেষ করে সেকুলারিজম, লিবারেলিজম ও তথাকথিত গণতন্ত্র, এসবকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়ে গোটা মানবজাতির চিন্তাভাবনা ও জীবনব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যখন ইউরোপ বিধ্বস্ত এবং প্রায় নির্বাক, তখন আমেরিকা বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে বসে পড়ে। সে সময় তাদের একমাত্র আদর্শিক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল কমিউনিজম। স্নায়ুযুদ্ধ ছিল মূলত এই দুই মতবাদের আধিপত্য কায়েমের লড়াই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই লড়াই শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতার নয়—এটি ছিল বিশ্বব্যাপী চিন্তার নেতৃত্ব কে দেবে, সেই প্রশ্নে এক দীর্ঘমেয়াদি সংঘর্ষ।
এই আদর্শিক আধিপত্য বজায় রাখতে গিয়ে আমেরিকা কেবল যুদ্ধ করেছে তা নয়, গণতন্ত্রের নামে তারা পরিচালনা করেছে একের পর এক সামরিক আগ্রাসন। আফ্রিকার দিকে তাকালেই দেখা যায়, সেখানে খনিজ, তেল, স্বর্ণ—সবই আছে। কিন্তু সেই ভূখণ্ডই আজ বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চলগুলোর একটি। কেন? কারণ তারা "আমেরিকান শৈলীর গণতন্ত্র" মেনে নেয়নি। তাই সেখানে বারবার সামরিক হস্তক্ষেপ, অস্থিতিশীলতা, এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা হয়েছে।
ইরাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা, কুয়েত ইস্যুকে কেন্দ্র করে সামরিক হামলা, কিংবা আফগানিস্তানে দুই দশকের যুদ্ধ—সবই মূলত সেই একই দর্শনের ধারাবাহিকতা। যে দর্শন বলে, “আমাদের মত না হলে, তোমার অস্তিত্বও অবৈধ।” আর এই দর্শনের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এক আধিপত্যবাদী জ্ঞানতন্ত্র, যা নিজেদেরকে মুক্তির পথ বলে প্রচার করে, কিন্তু বাস্তবে তা এক ভয়ঙ্কর মানসিক উপনিবেশের রূপ নেয়।
শায়খ উসামা (রাহিমাহুল্লাহ) যে জিহাদের আহ্বান জানিয়েছিলেন, তা ছিল এক গভীর কৌশলী প্রতিরোধ—পশ্চিমাদের একচেটিয়া আধিপত্য, তাদের রাজনৈতিক ও আদর্শিক হেজেমনিকে ভেঙে দেওয়ার সংগ্রাম। তিনি বুঝেছিলেন, সরাসরি সামরিক শক্তির দাপট দিয়ে নয়, বরং এক দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের ফাঁদ তৈরি করে পশ্চিমাদের মুখোশ খুলে ফেলা যাবে। সেই যুদ্ধের মধ্যেই তাদের “মানবতা”, “গণতন্ত্র”, “নৈতিকতা”—এসব শব্দের আসল অর্থ কী, তা দুনিয়ার সামনে উন্মোচিত হয়ে যাবে।
আজ আমরা যখন ফিলিস্তিনে আগ্রাসন দেখি কিংবা আফগানিস্তান-ইরাকের ইতিহাসের দিকে তাকাই, তখন স্পষ্ট হয়—তাদের তথাকথিত মানবতা সবসময়ই ছিল একটি মুখোশ, যার পেছনে লুকিয়ে ছিল নিছক স্বার্থপরতা।
২০ বছর আগেও আমেরিকা যখন কোনো দেশকে নিষেধাজ্ঞা দিত, তখন বলত: “এটি গণতন্ত্রের জন্য দরকার।” আবার যখন সামরিক হামলা চালাত, বলত: “এটি মানবতার নামে।” কিন্তু আজ? তারা আর সেই কথা বলে না। কেন? কারণ, শায়খ উসামার (রাহি.) আহ্বানে সাড়া দিয়ে শুরু হওয়া সেই জিহাদ আমেরিকাকে এমন এক যুদ্ধের জালে ফেলেছে, যেখানে তারা শুধু সৈন্য নয়—পূর্বের একক নেতৃত্ব, আদর্শগত আস্থা, এমনকি বিশ্বজুড়ে “নৈতিক পুলিশ” হওয়ার মুখোশও হারিয়েছে।
আজ আমেরিকা তার আগের মতো আর প্রকাশ্যে আগ্রাসন চালায় না। বরং এখন তারা মনজয় করার এক নতুন কৌশলে নেমেছে—“সুশীল” লেবাসধারী এজেন্ট তৈরির মাধ্যমে। যারা পশ্চিমাদের ভাষা নিজের মুখে বলছে, তাদের আদর্শকে আমাদের সমাজে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা করছে। ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, লিবারেলিজম, মানবতা, নারীবাদ—এসব এখন শুধুই মতবাদ নয়, বরং এক একেকটি 'নতুন ধর্ম' হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেগুলো মুসলিমদের চিন্তা ও সংস্কৃতিকে গিলে খেতে চায়।
আর যারা এই ঢেউয়ের বিপরীতে দাঁড়ায়, যারা সত্য বলার সাহস করে, যারা ইসলামের মৌলিকত্বকে রক্ষা করতে চায়—তাদেরকে ‘উগ্রপন্থী’, ‘জঙ্গি’ কিংবা ‘চরমপন্থী’ ট্যাগ দিয়ে সমাজে কোণঠাসা করা হচ্ছে।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা দিয়েছেন—তিনি বলেন, "তোমরা যুদ্ধ কামনা করো না, কিন্তু যদি তোমাদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে দৃঢ়তার সাথে অবস্থান করো।" (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ১৭৪২)।
এই নির্দেশনা অনুসারে, আমাদের শায়খগণ মুসলিম ভূখণ্ডের বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে এক গভীর রাজনৈতিক উপলব্ধি গড়ে তুলেছেন। তাঁরা সমগ্র মুসলিম ভূভাগকে দুটি ভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করেছেন—যা শুধুই ভৌগোলিক নয়, বরং একটি আদর্শিক ও বাস্তবতার নিরিখে গঠিত বিশ্লেষণ।
প্রথম শ্রেণির ভূখণ্ড হল 'প্রাথমিক ভূমি' বা প্রাইমারি অঞ্চল—যেখানে পশ্চিমা শক্তিগুলো সরাসরি আগ্রাসন চালাচ্ছে। আফগানিস্তান, ইরাক, ফিলিস্তিন ইত্যাদি অঞ্চল এই শ্রেণির উদাহরণ। এসব জায়গায় মুসলিম জনগণ দিনের পর দিন বোমা বর্ষণ, সামরিক দখলদারিত্ব ও দমন-পীড়নের শিকার। এসব অঞ্চলে জিহাদ কেবল একটি তাত্ত্বিক ধারণা নয়, বরং বাস্তবিক প্রতিরোধ—একটি মুক্তিসংগ্রাম। এখানে মুসলমানদের কর্তব্য হলো দখলদার বাহিনীকে রুখে দেওয়া এবং নিজেদের ভূমিকে ফিরিয়ে আনা, যেন সেই ভূমিতে আবার শান্তি, ন্যায় ও ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
দ্বিতীয় শ্রেণির ভূখণ্ড হলো 'সেকেন্ডারি ভূমি'—যেখানে সরাসরি কোনো সামরিক আগ্রাসন নেই, কিন্তু পাশ্চাত্য মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিদ্যমান। এ ধরনের অঞ্চলগুলোতে হয়তো যুদ্ধের গর্জন নেই, কিন্তু আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক উপনিবেশ বিদ্যমান। এখানে যুদ্ধের রূপ পাল্টে গেছে—এটি এখন অস্ত্রের নয়, বরং চিন্তার, বিশ্বাসের ও দৃষ্টিভঙ্গির লড়াই।
এই সেকেন্ডারি ভূখণ্ডে জিহাদ মানে হলো প্রস্তুতি। একদিকে, এটি বাহ্যিক অর্থে শারীরিক শক্তি অর্জনের প্রস্তুতি—যাতে ভবিষ্যতে যদি পরিস্থিতি চরমে পৌঁছে, তখন আত্মরক্ষার সক্ষমতা অর্জিত থাকে। অন্যদিকে, এটি মানসিক ও আদর্শিক প্রস্তুতি—যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণা থেকে বের করে এনে ইসলামের প্রকৃত দিশা দেখানো হয়। তাদেরকে বোঝানো হয়, ইসলাম কেবল একটি ধর্ম নয়—এটি একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যা মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে সামষ্টিক ব্যবস্থাপনার প্রতিটি স্তরে ন্যায়, শান্তি ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার কথা বলে।
এই আদর্শিক প্রক্রিয়া কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক জয় নয়, এটি আত্মিক ও সামাজিক পরিবর্তনের পথও বটে। কারণ, যখন একটি জাতি নিজেদের চিন্তা ও বিশ্বাসে স্বনির্ভর হয়, তখন তারা বাইরের আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। এই ভাবনা থেকেই শায়খদের এই কৌশলগত শ্রেণীবিন্যাস—যা কেবল যুদ্ধের ময়দানেই নয়, বরং মন-মানসিকতার জগতে বিজয়ের পথ রচনা করে।
মনে রাখুন, বারবার মনে রাখুন—আরব বসন্তের সময় মানুষ যখন রাস্তায় নেমেছিল, তখন তাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছিল তাকবীর: "আল্লাহু আকবার!" এই তাকবীর ছিল কেবল আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং ছিল এক গভীর প্রত্যয়—জুলুম ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে একটি অব্যক্ত প্রত্যাবর্তনের আহ্বান। কিন্তু আফসোস, সেই আল্লাহু আকবার ধ্বনি আজ আরবের বুকে কোনো রাষ্ট্র কায়েম করতে পারেনি। কেন?
এর একটি বড় কারণ হলো—আমরা শাসকদের কুফরী চরিত্র জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হলেও, তাদের গড়ে তোলা শাসনব্যবস্থার মূলে যে কুফর নিহিত, তা জনমনে প্রোথিত করতে পারিনি। আমরা বলতে পেরেছি, "এই নেতা ফাসেক", "এই সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত", কিন্তু আমরা বোঝাতে পারিনি—এই তথাকথিত গণতান্ত্রিক কাঠামোই আসলে তাদের দাসত্বের জাল। কাফের শাসকরা বরং উল্টোভাবে জনগণকে বুঝিয়েছে—"দেখো, এই শাসনব্যবস্থা তোমাদের জীবনে সুযোগ এনেছে, স্বাধীনতা দিয়েছে, রাস্তাঘাট, চাকরি, উন্নয়ন দিয়েছে।" ফলে, মানুষ যে সিস্টেমের ভেতরে শিকলবন্দি, সেটাকেই তারা মুক্তি ভেবে গ্রহণ করেছে।
একই চিত্র আমরা দেখেছি জুলাই বিপ্লব–এর সময়ও। সে সময় কৃষকেরা ট্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে, হাতে কাস্তে নিয়ে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে যে দৃঢ়তা দেখিয়েছে—তা কোনো সিনেমার দৃশ্য নয়, ছিল বাস্তব সাহস ও আত্মত্যাগের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু দিনশেষে দেখা গেল, সেই কৃষকরাই আবার ফিরে যাচ্ছে সেই একই গণতন্ত্রের জালিম ঘূর্ণিপাকে—নতুন কোনো রাজনৈতিক দলের ছায়ায় আশ্রয় খুঁজছে। কারণ কী? কারণ, আমরা তাদের বোঝাতে পেরেছি শেখ হাসিনার অন্যায়, তার পরিবারতন্ত্র, তার স্বৈরতন্ত্র। কিন্তু বোঝাতে পারিনি যে, শুধু একজন নেতার পতন সমাধান নয়—সমাধান হলো সেই কাফেরী ভিত্তিক শাসনব্যবস্থার উচ্ছেদ এবং আল্লাহর শাসনের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা।
আমরা বলতে ভুলে গেছি—হাসিনার পতন একা কোনো বিজয় নয়। সেই কাস্তে যেটা তিনি হাতে ধরেছিলেন, সেটি শুধু জমি চাষের জন্য নয়—তা হতে পারে আল্লাহর জমিনে তাঁর দীন কায়েমের প্রতীক। আর সেই তাকবীর কেবল একটি স্লোগান নয়, সেটি একটি দায়—একটি চূড়ান্ত দায়িত্ব, যা কেবল স্বৈরাচার হটিয়ে নয়, বরং ইসলামী শাসনব্যবস্থা ফিরিয়ে এনে পূর্ণ হয়।
বাংলাদেশ—এটি এখনো প্রস্তুতির ভূমি। এখানে আমরা মুজাহিদ তৈরি করব, মুহাজির গড়ে তুলব, আনসার তৈরি করব। কিন্তু তার চেয়েও বড় কাজটি হলো এমন এক সমাজ নির্মাণ, যেখানে মানুষ বুঝবে—রাষ্ট্রব্যবস্থা যতই চাকরি দিক, উন্নত রাস্তা বানাক, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা দিক—এটি কখনোই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলার সান্নিধ্য দিতে পারে না।
এই উপলব্ধি মানুষকে দিতে পারা কোনো সাধারণ কাজ নয়। কিন্তু ইতিহাস আমাদের সামনে উদাহরণ রেখেছে—আফগানিস্তানের মুজাহিদিনরা এটি পেরেছিলেন। তারা মানুষের অন্তরে এমন বিশ্বাস জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, যদি আমেরিকার দখলদার সরকার বা তাদের পোষা শাসকের পতন ঘটে এবং মুজাহিদরা ক্ষমতায় আসে, তাহলে হয়তো কিছুকাল মানুষদের জীবনে দারিদ্র্য থাকবে, খাবারে অভাব হবে, ঘরে আরাম আসবে না—তবুও তারা যে শান্তি পাবে, তা হবে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রশান্তি, রহমত এবং অফুরন্ত বরকত।
তারা জাতিকে বোঝাতে পেরেছিল যে, একটি ইসলামিক রাষ্ট্র মানে কেবল রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়—এটি হৃদয়ের পরিবর্তন, চিন্তার বিপ্লব, এবং আখিরাতমুখী জীবনের দিকে প্রত্যাবর্তন। ঠিক সেইভাবেই আমাদেরকেও বাংলাদেশে এমন এক চিন্তার বীজ বপন করতে হবে, যাতে মানুষ বুঝে—এখানে যেকোনো কাফের শাসনব্যবস্থার ছায়ায় সাময়িক স্বস্তি থাকতে পারে, কিন্তু তা কখনোই আল্লাহর সন্তুষ্টি এনে দিতে পারে না। আমাদের কাজ হলো—এমন এক সমাজ গড়া, যারা শুধু ক্ষণিক উন্নয়নের মোহে বিভোর না হয়ে, চায় চিরন্তন কল্যাণ, পরকালীন মুক্তি, এবং আল্লাহর বিধানে জীবন যাপন।
Comment