আল-কায়েদা নিয়ে কিছু প্রচলিত আপত্তি: একটি নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ
মুনশি আব্দুর রহমান
মুনশি আব্দুর রহমান

সম্প্রতি ফেসবুকে Ysul Zulkarnain নামে এক ভাই আল-কায়েদা বিষয়ে কয়েকটি গুরুতর আপত্তি তুলেছেন। একজন ছাত্র হিসেবে আমি বহু বছর ধরে আল-কায়েদার আন্দোলনের ইতিহাস, দর্শন ও কৌশলগত বিবর্তন নিয়ে পড়াশোনা করেছি। বিভিন্ন অভিযোগের গভীরে গিয়ে দেখলে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়—সেগুলো হয় অতিরঞ্জিত, কিংবা কিছু বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে গঠিত, কিংবা কখনো আল-কায়েদার প্রকৃত সাহিত্য ও বক্তব্য সম্পর্কে অজ্ঞতার ফল। [১]
এই আলোচনায় ভাইয়ের উত্থাপিত আপত্তিগুলো পর্যালোচনা করে সুনির্দিষ্ট যুক্তির মাধ্যমে তাদের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব—আবেগ নয়, বরং নিরপেক্ষতা ও তথ্যই এখানে মাপকাঠি হবে ইনশাআল্লাহ।
১. “সারা বিশ্বের বিরুদ্ধে একযোগে যুদ্ধ করার চিন্তা ভুল”
তিনি বলছেন- সারা বিশ্বে একই সাথে সবাইকে শত্রু ঘোষণা করে সবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা... এই চিন্তা টা অতীতেও ভুল ছিল, এখনো ভুল আছে
জবাবঃ এ ধরনের অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়—যে আল-কায়েদা নাকি গোটা বিশ্বের বিরুদ্ধে একসাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
আল-কায়েদার জিহাদের ভিত্তি সর্বদা প্রতিরক্ষামূলক এবং অগ্রাধিকারভিত্তিক (priority-based)। তাদের নীতিমালায় “সবার বিরুদ্ধে একযোগে যুদ্ধ” করার কোনো সার্বজনীন নির্দেশনা নেই।
শায়খ আইমান আয-যাওয়াহিরি তার বহু বক্তব্য ও রচনায়—বিশেষ করে “At-Tabri’ah” (التبرئة) গ্রন্থে—এই নীতিকে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, আল-কায়েদা কেবল তাদের বিরুদ্ধেই লড়াই করে, যারা সরাসরি উম্মাহর বিরুদ্ধে সামরিক আগ্রাসন চালায়—যেমন আমেরিকা, ইসরাইল, রাশিয়া এবং তাদের মদদপুষ্ট মুসলিম ভূমির স্বৈরশাসকরা। [২]
শায়খ উসামা বিন লাদেন (রহ.)-এর ১৯৯৮ সালের ঐতিহাসিক ফতোয়া “Declaration of War Against the Americans”-এ স্পষ্ট বলা হয়েছে, এই যুদ্ধ মূলত মুসলিম ভূমিতে পশ্চিমা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়া। [৩]
অতএব, “আল-কায়েদা গোটা বিশ্বের বিরুদ্ধে একযোগে যুদ্ধ করছে”—এমন ধারণা তথ্যগতভাবে ভুল এবং একটি প্রচলিত ভুল ব্যাখ্যার ফসল। এটি তাদের প্রকৃত অবস্থান নয়।
২. “সাময়িকভাবে হলেও কিছু শত্রুর সাথে সন্ধি করা জরুরি”
তিনি বলছেন- কোন কোন শত্রুর সাথে সাময়িক সন্ধি করতে হবে, যেন সব শত্রু একসাথে ঝাপিয়ে না পড়ে। একিউ এর অনেক বড় সমস্যা হলো তারা কারো সাথেই সন্ধি করতে চায় না। অথচ খোদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ততকালীন দুনিয়ার সবচাইতে নিকৃষ্ট কাফের তৎকালীন কুরাইশদের সাথে সন্ধি করেছিলেন। তারপর অন্যান্য শত্রুদের একে একে সাইজ করেছিলেন।
জবাবঃ ইসলামী শরিয়তে কৌশলগত সন্ধির অনুমতি রয়েছে, এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ হুদায়বিয়ার সন্ধির মাধ্যমে এর একটি নিখুঁত উদাহরণ স্থাপন করেছেন। আল-কায়েদা কখনো এই শরঈ নীতিকে অস্বীকার করেনি। বরং তাদের অবস্থান হচ্ছে—সন্ধি তখনই গ্রহণযোগ্য, যখন তা মুসলিমদের স্বার্থ রক্ষা করে এবং আকীদা ও শরিয়াহর মৌলিক নীতিকে জলাঞ্জলি না দেয়।
বাস্তবতার নিরিখে দেখলে স্পষ্ট হয়, ভাইয়ের এই আপত্তি আল-কায়েদার বাস্তব কর্মকৌশল ও ইতিহাসের সাথে সাংঘর্ষিক। কয়েকটি দৃষ্টান্ত এখানে তুলে ধরা যায়—
আফগানিস্তান প্রসঙ্গে: তালিবান সরকারের প্রতি শুরু থেকেই আল-কায়েদা আনুগত্য প্রকাশ করেছে এবং তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও কূটনৈতিক নীতিকে সম্মান জানিয়েছে। এমনকি ২০২০ সালের তালিবান-আমেরিকা শান্তিচুক্তিকে কেন্দ্র করে আল-কায়েদার পক্ষ থেকে প্রকাশিত “নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে সুস্পষ্ট বিজয় দিয়েছি” শীর্ষক বিবৃতি এ সাক্ষ্যই দেয় যে, তারা বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রস্তুত, শর্ত একটাই—তা যেন ইসলামের মৌলিক নীতির পরিপন্থী না হয়। [৪]
ইরাক প্রসঙ্গে: আল-কায়েদা ইন ইরাক (AQI) সময়বিশেষে স্থানীয় উপজাতি ও অন্যান্য প্রতিরোধ গোষ্ঠীর সঙ্গে সন্ধি করেছে। যদিও কোথাও কোথাও মতবিরোধ ও সংঘাতও দেখা গেছে, তবে তা কৌশলগত ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত—নীতিগত অনমনীয়তা হিসেবে নয়।
সুতরাং, আল-কায়েদা যে “কারো সাথেই সন্ধি চায় না”—এই অভিযোগ বাস্তবতার প্রতিফলন নয়। বরং তারা এমন সন্ধির বিরুদ্ধে, যা মুসলিম ভূমিতে দখলদার শক্তির আধিপত্যকে বৈধতা দেয় কিংবা ইসলামী আকীদা ও শরীয়াহর মৌলিক স্বার্থকে বিসর্জন দেয়। এটি একটি নীতিনির্ভর অবস্থান, অবাস্তব জেদ নয়।
৩. “ইরাকে দুর্বল ইজতিহাদ ও সাংগঠনিক ব্যর্থতা তাদের পতনের কারণ”
তিনি বলছেন- একিউ এর সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং দুর্বল ইজতেহাদ ইরাক এ দুর্ধর্ষ যুদ্ধের পর ও পরাজয়ের অন্যতম কারণ। তারা যদি তাদের এই নীতি "সবার সাথে শত্রুতা কারো সাথে সন্ধি নয়.." থেকে সরে না আসে তবে আমার আশঙ্কা পাকিস্তানেও আরেকটা ইরাক টাইপ সিচুয়েশন হতে পারে, যেখানে পাকিস্তান টুকরা টুকরা হলেও সেকুলার শক্তিদের হাতে মূল ক্ষমতা থেকে যাবে।
জবাবঃ ইরাকে আল-কায়েদার শাখা আল-কায়েদা ইন ইরাক (AQI)-এর কিছু কৌশলগত ভুল নিঃসন্দেহে ছিল, যা পরবর্তীতে তাদের জন্য মারাত্মক প্রতিকূলতা তৈরি করে। বিশেষ করে আবু মুসআব আল-যারকাওয়ির (রহ.) কিছু পদক্ষেপ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব—যেমন শাইখ ওসামা বিন লাদেন (রহ.) ও শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরি—এর সঙ্গে মতপার্থক্যের জন্ম দেয়।
এই মতপার্থক্যগুলোর অন্যতম ছিল—অতিরিক্ত সহিংসতা ও শিয়াদের প্রতি মারমুখী আচরণ। শাইখ জাওয়াহিরি তার একটি বিখ্যাত চিঠিতে যারকাওয়িকে স্মরণ করিয়ে দেন: “যদি জনগণের সমর্থন হারিয়ে ফেল, তবে জিহাদ কখনো দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।” [৫]
যারকাওয়ির শাহাদাতের পর ইরাকি শাখার নেতৃত্ব আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তারা কেন্দ্রীয় নির্দেশনা উপেক্ষা করে নিজেরাই একতরফাভাবে "দাওলা" ঘোষণা করে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাদেরকে নির্বিচারে শিয়াদের হত্যা এবং খ্রিস্টান সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ থেকে বিরত থাকতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছিল। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা তারা মান্য করেনি।
শাইখ আদম ইয়াহইয়া গাদ্দান (রহ.) “Resurgence” ম্যাগাজিনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই ঘটনাগুলোর বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন। এসব ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়—ইরাকে আল-কায়েদার দুর্দশার জন্য দায়ী ছিল মূলত স্থানীয় নেতৃত্বের একচেটিয়া সিদ্ধান্ত ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অমান্যতা—not the central command itself. [৬]
তবে এটাও সত্য যে, ইরাকের অভিজ্ঞতা আল-কায়েদাকে ভবিষ্যতের জন্য অনেক কিছু শিখিয়েছে। আর সে শিক্ষা বাস্তবায়িত হয়েছে উত্তর আফ্রিকার AQIM, ইয়েমেনের AQAP, ও উপমহাদেশের AQIS-এর সংগঠনী ও কৌশলগত ভারসাম্যে।
এই শাখাগুলো রাজনৈতিক বাস্তবতা, জনসমর্থন ও শত্রু-সমীকরণের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সংবেদনশীল ও কৌশলী হয়েছে—যা ইরাকের অভিজ্ঞতার এক বাস্তব প্রতিফলন।
৪. “আল-কায়েদার সমর্থকরা পাকিস্তানে অহেতুক বহু ফ্রন্ট খুলে রাখছে”
তিনি বলছেন- আর একিউ এর অনেক সমর্থক এর বক্তব্য এরকম বালুচ লিবারেশন আর্মি, পাক মুরতাদ আর্মি, পশতুন জাতীয়তাবাদী। সবার সাথে তারা একই সময়ে যুদ্ধ করতে চায়। গাছেরটাও খাবে তলারটাও কুড়াবে। বাস্তবতা বিবর্জিত ইজতেহাদ। এটা থেকে সরে না আসলে সামগ্রিকভাবে পাকিস্তানের জিহাদের ব্যাপক ক্ষতি হবে।
জবাবঃ এই আপত্তির একটি আংশিক বাস্তব ভিত্তি থাকতে পারে—বিশেষ করে যদি কিছু ব্যক্তির অতিরিক্ত উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্যকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। তবে এটাকে আল-কায়েদার প্রাতিষ্ঠানিক নীতি হিসেবে তুলে ধরা ন্যায্য হবে না।
প্রথমত, কারো আকীদাগত বিচ্যুতি বা জাতীয়তাবাদী মনোভাবের সমালোচনা করা এবং একযোগে তাদের সবার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করা এক বিষয় নয়। বাস্তবতা হলো, আল-কায়েদা একইসাথে সকল "মুরতাদ" বা জাতীয়তাবাদীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে নেমে পড়েনি।
দ্বিতীয়ত, কোনো দল / বাহিনী যদি জোরপূর্বক শরিয়ার বিধান বাস্তবায়ন করতে না দেয়, কাফেরদের পক্ষ হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাহলে উম্মাহর সর্বসম্মতি ক্রমে ঐ বাহিনীর বিরুদ্ধে কিতাল করা ফরজ। পাক আর্মি শরিয়া আইন বাস্তবায়নে বাঁধা দিয়ে সেক্যুলারিজম-গণতন্ত্র কায়েম করে রাখার কারণে, এবং তালিবান দের বিরুদ্ধে আমেরিকাকে যুদ্ধে সাহায্য করার কারণে টিটিপি আলকায়েদা সহ সবার কাছেই কিতালযোগ্য।
তদপুরি তারাই আগে যুদ্ধিও শুরু করেছে কাবায়েলে মুজাহিদ ও মুসলমানদের উপর আক্রমণ করার মাধ্যমে, সুতরাং এখন তো মুজাহিদিনদের জন্য প্রতিরোধ ও প্রতিরক্ষা করা ফরজ।
তবে আল-কায়েদা দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষ কৌশলগত বাস্তবতা বিবেচনায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য সম্মুখযুদ্ধে এই মুহূর্তে নেই। বরং তারা ধৈর্য ও হিকমাহর মাধ্যমে উপমহাদেশকে এক ফ্রন্ট ধরে সেই লড়াইয়ের প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে।
তৃতীয়ত, যখন তারা প্রকাশ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক লড়াই চালাচ্ছে না, তখন তাদের উপস্থিতি কীভাবে পাকিস্তানের জিহাদে ক্ষতির কারণ হতে পারে—এই প্রশ্নটিই বাস্তবতাকে সামনে আনে।
চতুর্থত, কোনো সংগঠনের সাধারণ সমর্থকের বক্তব্য দিয়ে কি ঐ সংগঠন কে বিচার করা যায়? এখানে আলকায়েদার প্রতিপক্ষ হিসাবে পশতুন জাতীয়তাবাদীদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। প্রশ্ন হল- এই সব পার্শ্ব লড়াইয়ে আল কায়েদা কবে জড়িয়েছে?
সুতরাং, একে “বাস্তবতা বিবর্জিত ইজতিহাদ” বলা যৌক্তিক নয়। বরং এটি আল-কায়েদার একটি পরিপক্ব, কৌশলনির্ভর এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত, যা স্থানীয় জটিল বাস্তবতার প্রতি সচেতন প্রতিক্রিয়া হিসেবেই বিবেচ্য।
আল-কায়েদার মূল টার্গেট কারা? — এক নিরীক্ষণভিত্তিক আলোচনা
আল-কায়েদা কি গোটা দুনিয়ার বিরুদ্ধে নির্বিচারে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, নাকি তাদের নির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্যবস্তু রয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে সরাসরি তাদের শীর্ষ নেতৃত্বের বক্তব্যে।
এই প্রসঙ্গে আল-কায়েদার প্রাক্তন আমির, শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরীর লেখা “জিহাদের সাধারণ দিকনির্দেশনা” শিরোনামের নীতিমালার দিকে তাকানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
◾ সামরিক কর্মকাণ্ডের স্তর ও অগ্রাধিকার
শাইখ যাওয়াহিরী স্পষ্ট ভাষায় বলেন—
“সামরিক কর্মকাণ্ডের প্রথম লক্ষ্যবস্তু হলো আন্তর্জাতিক কুফরি শক্তির নেতৃত্বদানকারী দেশ আমেরিকা ও তার ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েল। দ্বিতীয়ত, এসব শক্তির স্থানীয় দোসর বা মিত্র, যারা মুসলিম দেশগুলোর শাসক হিসেবে বসে আছে।”
ক. আমেরিকাকে মূল লক্ষ্য বানানোর যুক্তি কী?
আমেরিকাকে প্রথম টার্গেট করার পেছনে মূল যুক্তি হলো—
তাকে সামরিক, অর্থনৈতিক ও জনশক্তির দিক থেকে এমনভাবে নিঃশেষ করে দেওয়া, যেন তার পরিণতি হয় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো। উদ্দেশ্য, বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহর ওপর চালানো অন্যায়-অবিচার, দখল ও আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায় এক প্রতিরোধমূলক জিহাদ।
খ. স্থানীয় আমেরিকাপন্থী সরকারগুলোর ক্ষেত্রে কী নীতি?
এই বিষয়ে আল-কায়েদার অবস্থান আরো কৌশলভিত্তিক।
তারা বলে, এসব সরকারের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়ানোই মূলনীতি, যতক্ষণ না তারা এমন অবস্থান নেয় যেখানে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকে না। অর্থাৎ, ‘উসূল’ হলো সংঘর্ষ এড়ানো, কিন্তু ‘ইস্তিসনা’ বা ব্যতিক্রমও বাস্তবতা বিবেচনায় রাখা হয়। [৭]
আল-কায়েদা উপমহাদেশ শাখা (AQIS) ও পাকিস্তান প্রসঙ্গে অবস্থান
আল-কায়েদা ইন দ্য ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট (AQIS) তাদের আচরণবিধির দ্বিতীয় অধ্যায়ে “পাকিস্তানে আমাদের সামরিক লক্ষ্যবস্তু” শিরোনামে স্পষ্টভাবে তাদের কৌশলিক রূপরেখা তুলে ধরেছে।
শাইখ উসামা বিন লাদেন (রহ.) থেকে শুরু করে সমগ্র জামা’আতের অবস্থান কুরআনের এই আয়াতের ভিত্তিতে গঠিত:
"فقاتلوا أئمة الكفر" — “কুফরের নেতৃস্থানীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর।”
শাইখ উসামা একে ব্যাখ্যা করেন “সাপের মাথা” হিসেবে—অর্থাৎ, কুফরি শক্তির মূল নেতৃত্ব যারা পরিকল্পনা করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে।
সাপের মাথা অর্থাৎ প্রধান শত্রুদের চিহ্নিতকরণ:
১. পাকিস্তানে অবস্থানরত আমেরিকান কাফের ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কেন্দ্রসমূহ
এরা সরাসরি মুসলিমদের বিরুদ্ধে অন্যায়-অবিচার, দখল ও আক্রমণে সহায়তা করে।
বায়তুল মুকাদ্দাস মুক্তির পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়।
ইসলামী জাগরণ ও জিহাদবিরোধী বিশ্ব কুফরি শক্তির কেন্দ্রীয় ঘাঁটি।
২. পাকিস্তানে নিযুক্ত অন্যান্য কাফের রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো
যারা পাকিস্তানের জনগণকে শোষণ করে, অর্থনৈতিকভাবে দাস বানিয়ে রাখে এবং মুসলিম উম্মাহর ওপর হামলায় সরাসরি জড়িত।
যেমন: ভারত, আমেরিকার মিত্র পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহ ইত্যাদি।
৩. পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার অবশিষ্টাংশ
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কাঠামো এখনো পাকিস্তানের আইন, শিক্ষা ও প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার করে চলছে।
ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার পথে এটি বড় অন্তরায়। [৮]
সুতরাং আল-কায়েদার সামরিক কৌশল ও লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ একেবারে নির্বিচার বা আবেগনির্ভর নয়—বরং তা নির্দিষ্ট শরঈ ভিত্তি ও কৌশলগত বাস্তবতার উপর গড়ে উঠেছে।
তাদের কাছে ‘শত্রু’ মানেই সবাই নয়, বরং সেই সব শক্তি যারা ইসলামের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ও কাঠামোগত যুদ্ধ ঘোষণা করেছে—তা সরাসরি হোক কিংবা পরোক্ষভাবে।
তাদের সাহিত্য ও নীতিমালায় বারবার এ কথাই স্পষ্ট করা হয়েছে যে, মূল লক্ষ্য হলো "সাপের মাথা" ধ্বংস করে গোটা উম্মাহকে মুক্তি ও শরীয়াহর পথে পরিচালিত করা।
উপসংহার
আল-কায়েদা একটি বৈশ্বিক আন্দোলন। এর কিছু কৌশল সফল, কিছুতে ভুল—এ কথা মানা যায়। কিন্তু তাদের প্রতিটি সিদ্ধান্তকে অজ্ঞতার আলোকে সমালোচনা করা, কিংবা তাদের মূলনীতিকে বিকৃতভাবে তুলে ধরা—এটি গবেষণা ও ইনসাফপ্রসূত আলোচনা নয়।
আমাদের উচিত—একটি আন্দোলনের সঠিক অবস্থান বোঝা, তার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া এবং সত্য-মিথ্যার সীমারেখা স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা। তবেই আমরা একজন ছাত্র বা গবেষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারব, ইনশাআল্লাহ।
সংশ্লিষ্ট লিংকসমূহ:
[১] ভাই Ysul Zulkarnain এই কমেন্ট করেছিলেন টিটিপির সাথে সংশ্লিষ্ট দাবীকারী ভাই Imran Haider এর একটি পোস্টে। ইমরান ভাই সম্ভবত মাসলাহাত বিবেচনায় পোস্টটি ডিলিট করেছেন।
[২] আত-তাবরিয়াহ - https://archive.org/details/altabr2a001
[৩] Declaration of Jihad against the Americans Occupying the Land of the Two Holiest Sites- https://ctc.westpoint.edu/harmony-pr...al-language-2/
[৪] কায়িদাতুল জিহাদ – কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এর পক্ষ থেকে তালিবান মুজাহিদীন ও ক্রুসেডার আমেরিকার মাঝে সংগঠিত চুক্তি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা “নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে সুস্পষ্ট বিজয় দিয়েছি” - https://gazwah.net/?p=26801
[৫]Zawahiri Letter to Zarqawi,” 2005- https://ctc.westpoint.edu/harmony-pr...al-language-2/
[৬] Resurgence Special Issue Summer 2015- https://www.yumpu.com/en/document/vi...ue-summer-2015
[৭] জিহাদের সাধারণ দিক-নির্দেশনা – শাইখ আইমান আল-জাওয়াহিরী - https://gazwah.net/?p=1233
[৮] মুজাহিদিন ও উমারাদের আচরণবিধি - উপমহাদেশে জিহাদের নির্দেশিকা - https://gazwah.net/?p=10727
Comment