আল-কায়েদা কি কেবল ‘সাপের মাথা’র বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করে? — একটি বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ
মুনশি আব্দুর রহমান

ভূমিকা
ভাই Ysul Zulkarnain আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আপত্তি তুলেছেন। তাঁর একটি বক্তব্যের সারকথা এই যে, যদিও আল-কায়েদার ঘোষিত নীতিমালায় ‘সবাইকে’ শত্রু বলা হয়নি, তবুও তাদের বাস্তব কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয় যেন তারা গোটা দুনিয়াকেই শত্রু বানিয়ে বসেছে। এই প্রবন্ধে আমরা তাঁর সেই আপত্তি সম্পর্কে কিঞ্চিত আলোচনা করছি। সময় হলে আমি পর্যায়ক্রমে তার সবগুলো আপত্তির জবাব দিবো ইনশা আল্লাহ। আজকে প্রথম আপত্তি নিয়ে আলোচনা করছি-
প্রথম আপত্তি:
তিনি বলছেন “একিউ এর সবার বিরুদ্ধে একযোগে যুদ্ধ করার কোন সার্বজনীন নির্দেশনা নাই। নির্দেশনা না থাকলেও তাদের কাজ মূলত এটাই নির্দেশ করে। এখানে যেই আমেরিকা, ইসরাইল, রাশিয়া, এবং তাদের মদদপুষ্ট মুসলিম ভূমির স্বৈরশাসকেরা... এদেরকে যদি বাদ দেন তাহলে আর বাকি থাকে কে শত্রু হিসেবে? ”
উত্তর:
এই আপত্তির জবাব দিতে গিয়ে আমাদের প্রথমে নীতিগত ঘোষণার সাথে বাস্তব সংঘর্ষের বাস্তবতা—এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট করতে হবে।
🔸 আল-কায়েদার নীতি কী বলে?
আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ও পরবর্তীকালের নেতৃবৃন্দ বারবার ঘোষণা দিয়েছেন যে, তাদের প্রধান যুদ্ধ ‘সাপের মাথা’, অর্থাৎ—আগ্রাসী আন্তর্জাতিক কাফির শক্তির বিরুদ্ধে, বিশেষ করে আমেরিকা, ইসরাইল ও তাদের সামরিক উপস্থিতি এবং রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে আগ্রহী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে।
শাইখ আয়মান আয যাওয়াহিরি এ সম্পর্কে বলেন:
"৩। স্থানীয় শাসনের সাথে সামরিক সংঘর্ষ এড়িয়ে চলা, যদি না বাধ্য করা হয়। উদাহরণ হলো, যখন স্থানীয় শাসন আমেরিকান বাহিনীর অংশ হিসেবে কাজ করে যেমনটি হচ্ছে আফগানিস্তানে; অথবা যেখানে এটি আমেরিকার পক্ষ হয়ে মুজাহিদদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে যেমনটি সোমালিয়া ও জাজিরাতুল আরবে হচ্ছে, অথবা মুজাহিদদের উপস্থিতিই সহ্য করতে পারেনা যেমনটি হচ্ছে ইসলামি মাগরিব, সিরিয়া এবং ইরাকে।
এমনকি, যতটুকু সম্ভব এদের সাথে সামরিক সংঘর্ষে জড়ানো অবশ্যই এড়ানো উচিত ।
যদি আমাদের লড়াই করতে বাধ্য করতে হয়, তখন অবশ্যই আমাদের উচিত এ ব্যাপারে পরিষ্কার হওয়া যে, তাদের বিরূদ্ধে আমাদের যে জিহাদ তা যেন ক্রুসেডারদের বিরূদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনের অংশ হয় আর তা হবে মুসলমানদের বিরূদ্ধে প্রচন্ড আক্রমণের জবাব।
যেখানেই যে কোন জায়গায় ঘরোয়া শাসকদের সাথে সংঘর্ষ প্রশমনের সম্ভাবনা যদি আমাদের সামর্থ্যে থাকে তবে সেই সাথে দাওয়াহ, আমাদের মতামত প্রকাশ, মুমিনদের উদ্দীপ্ত করা, রিক্রুটমেন্ট, তহবিল উঠানো ও সমর্থক প্রাপ্তি সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে। আমাদের অবশ্যই উচিত এর সর্বোচ্চ সুবিধা নেয়া; এটা আমাদের এই দীর্ঘ জিহাদের জন্য, আর জিহাদের প্রয়োজন নিরাপদ ঘাঁটি এবং মানুষ, অর্থ ও বিশেষজ্ঞতাপূর্ণ সঙ্গতিময় অব্যাহত সমর্থন।" [১]
অর্থাৎ, আল-কায়েদার মূল স্ট্র্যাটেজি হলো প্রতিরোধের জিহাদ, যা শত্রুর আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায় সংগঠিত হয়, আগ্রাসনের সূচনায় নয়।
কিন্তু বাস্তবে সংঘর্ষ কেন বাড়ছে?
এখানেই আসে বাস্তবতার প্রশ্ন। যখন কোনো দেশ ‘সাপের মাথা’র প্রক্সি বা দোসর হিসেবে কাজ করে, তখন সংঘর্ষ স্বাভাবিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ:
- পাকিস্তান তার আকাশপথ ও ঘাঁটি ব্যবহার করতে দিয়েছে আমেরিকাকে, যার ফলে ইমারাতে ইসলামীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২০ বছরের যুদ্ধ সম্ভব হয়েছে। তাই আল-কায়েদা পাকিস্তানে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। পাকিস্তানে আল কায়েদার হামলা শুরু করার কারণ ছিল ইমারাতে ইসলামীকে রক্ষা করা। দুনিয়ার কে না জানে যে, পাকিস্তানের আকাশ ও ভূমি ব্যবহার করেই আমেরিকা আফগানিস্তানে আক্রমণ করেছিল এবং দীর্ঘ দুই দশক এই লড়াই জারি রেখেছিল। এখন যেহেতু আমেরিকা চলে গেছে, তাই পাকিস্তানে স্বনামে আল কায়েদার হামলার বন্ধ আছে।
- সিরিয়ায়, আল-কায়েদার শাখা (জাবহাতুন নুসরাহ/হুররাসুদ্দিন) প্রথমদিকে শুধুই বাশার আল-আসাদের বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছিল। কিন্তু যখন শিয়া মিলিশিয়ারা, রাশিয়া, ইরান ও তাদের মদদপুষ্ট দলগুলো এসে আহলুস সুন্নাহদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন তাদের প্রতিহত করাও জিহাদের অপরিহার্য অংশ হয়ে দাঁড়ায়।
এভাবে ইয়েমেন, সোমালিয়া, ইসলামিক মাগরিব, মালি ইত্যাদি অঞ্চলে আল কায়েদা মূল শত্রু আমেরিকা-ইসরাইলের বাইরে লোকাল শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অন্যতম কারণ হল পশ্চিমা বিশ্ব লোকাল দোসরদের আল কায়েদার বিরুদ্ধে নামিয়ে দিয়েছে। আল কায়েদা তো বলে দিছে যে, আমরা অমুকের বিরুদ্ধে লড়াই করছি, তোমাদের সাথে নয়। এরপরও কেউ পায়ে পাড়া দিয়ে লড়াই বাঁধাতে চাইলে, তার বিরুদ্ধে তো লড়াই করবেই। তো এটাই হল আসলে বাস্তবতা।
এই বাস্তবতাকে নীতিগত রূপ দিতে গিয়ে শাইখ আইমান বলেন:
"এই অধম বলেছিলো, এই ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারনা থাকা উচিত যে, কুফর প্রধানের (আমেরিকা) উপর দৃষ্টি রাখার নীতি সাধারণ মুসলিমের অধিকারের সাথে বিরোধ সৃষ্টি করেনা, তা সাংঘর্ষিক নয় তাদের পক্ষে মৌখিক জিহাদ পরিচালনা করা অথবা যারা তাদের নির্যাতন করছে তাদের বিরুদ্ধে হাতে অস্ত্র তোলে নেয়া।
এ কারণে যে, রাশিয়ান আগ্রাসী ও তাদের মিত্রদের বিরূদ্ধে জিহাদ করা আমাদের ককেশাসের ভাইদের অধিকার। অপরাধী হিন্দুদের বিরূদ্ধে জিহাদে জড়িত হওয়া আমাদের কাশ্মিরি ভাইদের অধিকার। এটা সমানভাবে পূর্ব তুর্কিস্তানের ভাইদের অধিকার যে, চীনা জালিমদের বিরুদ্ধে জিহাদে নিজেদের যুক্ত করবে। একইভাবে, ফিলিপাইন, বার্মা এবং প্রত্যেক ভূমিতে যেখানে মুসলমানেরা প্রতিনিয়ত অত্যাচারিত হয় সে সব জালিমদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ওখানকার ভাইদের অধিকার।"
অর্থাৎ “যেখানেই মুসলমানরা নিপীড়িত হচ্ছে—ককেশাসে, কাশ্মীরে, পূর্ব তুর্কিস্তানে, বার্মায়, ফিলিপাইনে—ওখানকার মুসলিমদের অধিকার আছে প্রতিরোধ জিহাদে অংশ নেওয়ার। এটি আমাদের নীতির পরিপন্থী নয়, বরং তারই বাস্তব প্রয়োগ।” [২]
যে সকল দেশ ‘সাপের মাথা’র প্রক্সি বা দোসর হিসেবে কাজ করে, শাইখ আইমান এক জায়গায় তাদের উদ্দেশ্য করে রসিকতা করে বলেন:
"কিছু মানুষ ধারণা করে আমেরিকান ও পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থার মাঝে বেশ পার্থক্য বর্তমান। কিন্তু তাদের মধ্যে ঠিক তেমনি পার্থক্য বিদ্যমান যেমনটি এক ছিঁচকে চোর এবং চোরদের বড় সর্দারের মাঝে থাকে।
চোরদের সর্দার ছিঁচকে চোরকে বলে: আমি তোমাকে অনেক টাকা খাইয়েছি, কিন্তু তুমি এর বিনিময়ে আমার জন্য খুব কমই করেছো।
তখন ছিঁচকে চোর জবাব দেয়: তুমি আমাকে সামান্য টাকা দিয়েছো কিন্তু আমি তোমার জন্য অনেক কিছু করেছি।
তবে, চোরদের সর্দারের সাথে ছিঁচকে চোরের আনুগত্য বজায় থাকে সবসময় এবং অনবরত ছিঁচকে চোর সর্দার-চোরের জন্যই কাজ করে যায়।
পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আমেরিকাকে অভিযোগ করে: তুমি ভারত ও তাদের সংস্থাগুলোকে আমাদের উপর আগ্রাধিকার দিয়ে সীমা অতিক্রম করেছো।
আর আমেরিকানরা পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা ও তাদের সেনানায়ককে উত্তর দেয়: আমরা মুসলমানদের হত্যা করার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে এবং গোপনে ঘুষ দেওয়ার মাধ্যমে তোমাদের অর্থ প্রদান করেছি, কিন্তু যারা আমাদের ও আমাদের এজেন্টদের হত্যা করছে তোমরা তাদের কিছুই করছো না।
যাই হোক, দুই পক্ষের পারস্পারিক সম্পর্ক ক্রমেই উন্নতিলাভ করতে থাকে। চোরদের এই জোট মূলত মুসলিমদের রক্ত, তাদের শরীয়া, এবং তাদের ইজ্জত নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকে।" [৩]
অর্থাৎ “পাকিস্তানি গোয়েন্দারা আমেরিকার ‘ছিঁচকে চোর’ মাত্র। চোরদের বড় সর্দার (আমেরিকা) ও ছোট চোর (পাকিস্তান) একসাথে মুসলমানদের রক্ত দিয়ে ব্যবসা করে। তখন এই ছিঁচকে চোরের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অপরিহার্য হয়ে পড়ে।”
“সবাইকে শত্রু বানিয়ে ফেলার” ধারণা: মিডিয়া-চালিত অতিরঞ্জন
যারা বলেন—“আল-কায়েদা তো সবাইকে শত্রু বানিয়ে নিয়েছে”—তারা আসলে কিছু বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ দেখে সার্বজনীন সিদ্ধান্ত টানেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, আল-কায়েদা অনেক দেশের সাথে দ্বন্দ্বে যায়নি, যেমন—তুরস্ক, কাতার, ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়া। এমনকি ইরানের সাথেও কিছু সময় কৌশলগত বিরতি রেখেছে। তো একে “সবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ” বলা রাজনৈতিক কিংবা মিডিয়াগত অতিরঞ্জন—এটা আল-কায়েদার স্বঘোষিত স্ট্র্যাটেজি নয়।
এখানে প্রতিপক্ষ নির্ধারিত হয় আচরণের ভিত্তিতে, স্রেফ কাফের দেশ হওয়ার ভিত্তিতে নয়। এটিকে ‘সবাইকে শত্রু বানানো’ বললে তা হবে রাজনৈতিক অসততা কিংবা মিডিয়ার বিভ্রান্তির পুনরাবৃত্তি।
উপসংহার
আল-কায়েদার যুদ্ধের ক্যানভাস গোটা দুনিয়ার বিরুদ্ধে নয়। বরং তাদের দৃষ্টিতে যুদ্ধ হচ্ছে সুনির্দিষ্ট কিছু আগ্রাসী শক্তি ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে, যারা মুসলমানদের রক্ত, সম্মান ও স্বাধীনতাকে পদদলিত করছে।
নীতির দিক থেকে তারা যতটা সম্ভব সংঘর্ষ এড়িয়ে চলে। কিন্তু বাস্তবে যখন কেউ জুলুমের শরিক হয়ে পড়ে, তখন প্রতিরোধ একটি অনিবার্য কর্তব্যে পরিণত হয়।
অতএব, আলোচনায় সততা ও প্রেক্ষাপটের প্রতি শ্রদ্ধা জরুরি—বিচ্ছিন্নতা নয়, সামগ্রিকতা দিয়ে বিচার করাই বস্তুনিষ্ঠতা।
সংশ্লিষ্ট লিংকসমূহ:
[১] জিহাদের সাধারণ দিক-নির্দেশনা – শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী - https://archive.ph/0lgo7
[২] জিহাদের সাধারণ দিক-নির্দেশনা – শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী - https://archive.ph/0lgo7
[৩] কাশ্মীরকে ভুলে যেও না- শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী- https://archive.ph/OMW22
Comment