Announcement

Collapse
No announcement yet.

জাতীয় নাগরিক পার্টি: মধ্যপন্থার মুখোশে এক নতুন রাজনৈতিক ট্রোজান হর্স

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • জাতীয় নাগরিক পার্টি: মধ্যপন্থার মুখোশে এক নতুন রাজনৈতিক ট্রোজান হর্স

    রাজনীতি একটি মতাদর্শিক যুদ্ধক্ষেত্র—এখানে ‘মধ্যপন্থা’ নামে কোনো নিরাপদ আশ্রয়স্থল নেই।
    বিশেষত যখন সমাজ স্পষ্টভাবে দুই মেরুতে বিভক্ত, তখন মধ্যপন্থা শুধু একটি অলীক কল্পনা নয়, বরং একধরনের রাজনৈতিক আত্মপ্রবঞ্চনা। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় অনেক সময় দেখা যায়, জনসংখ্যার গড় মানসিকতা ডানদিকে ঝুঁকে থাকে কিন্তু একই সময়ে রাষ্ট্রের কাঠামো, শিক্ষাব্যবস্থা, মিডিয়া ও এনজিও খাত হয়ে ওঠে বামপন্থী আদর্শে প্রভাবিত।

    এই দ্বৈত বাস্তবতায় “মধ্যপন্থা” আর কোনো স্বাধীন মতাদর্শিক অবস্থান নয়—বরং তা এক ধরনের ছদ্মবেশী আত্মসমর্পণ। এটি এমন একটি অবস্থান, যার পেছনে নেই কোনো দৃঢ় বিশ্বাস বা আদর্শিক মেরুদণ্ড। বরং মধ্যপন্থা হয়ে দাঁড়ায় কেবল একটি কৌশলগত সমীকরণ, যেখানে মূল লক্ষ্য হলো ক্ষমতার বৃত্তে প্রবেশাধিকার অর্জন।

    এখানে নীতির চেয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে অনুমোদন, আদর্শের বদলে প্রাধান্য পায় গ্রহণযোগ্যতার হিসাব। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা নয়, বরং ক্ষমতার ভাষা, আধিপত্য ও রাজনৈতিক প্রবণতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে ওঠার জন্যই এই অবস্থান গঠিত হয়। ফলে “মধ্যপন্থা” আর কোনো নৈতিক শক্তি নয়—বরং তা পরিণত হয় রাজনৈতিক সুবিধাবাদের এক মার্জিত মুখোশে, যা মুখে ভারসাম্যের কথা বলে, অথচ আদতে ভারসাম্যহীন আত্মবিক্রয়ের পথে এগিয়ে যায়।

    এমন এক বাস্তবতায়, যেখানে রাষ্ট্রীয় কাঠামো, মিডিয়া, এবং আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় বাম আদর্শের সুস্পষ্ট প্রভাব বিদ্যমান, সেখানে মধ্যপন্থী দলগুলোর পক্ষে 'নিরপেক্ষতা' বজায় রাখা কল্পনাতীত। কারণ, ক্ষমতার প্রবাহ নির্ধারিত হয় 'নিরপেক্ষতা' দিয়ে নয়, বরং সেই মতাদর্শ দিয়ে যা ক্ষমতার কেন্দ্রে গ্রহণযোগ্য—এবং বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সেই গ্রহণযোগ্যতা বাম আদর্শের হাতে কেন্দ্রীভূত।

    ফলে যারা নিজেকে ‘মধ্যপন্থী’ বলে দাবি করে, তারা বাস্তবে জনগণের ডানমুখী আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করে ধীরে ধীরে ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছানোর আশায় বামমুখী হয়ে পড়ে। এই শ্রেণির কাছে ‘জনগণের পাশে থাকা’ কোনো নীতিগত দায় নয়—বরং এটি এক প্রকার জনপ্রিয়তাবাদী চমক। তাদের মূল লক্ষ্য থাকে সেই এলিট কাঠামো, যেখানে আছে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক স্বীকৃতি ও আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা।

    তাই এমনটা বলা অতিরঞ্জন হবে না যে, মধ্যপন্থা আসলে এক ধরনের ‘ট্রোজান হর্স’—যার বাইরের রূপ নিরপেক্ষতা ও ভারসাম্যের ছদ্মবেশে আবৃত, অথচ ভেতরে লুকিয়ে থাকে বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামোর স্বার্থ রক্ষা এবং এলিটদের মতাদর্শিক আধিপত্য টিকিয়ে রাখার এক কৌশলী ছলনা।

    গ্রিক পুরাণে ট্রোজান হর্স ছিল এক প্রতারণামূলক কৌশল—যার মাধ্যমে গ্রিক সেনারা ট্রয় নগর দখল করে। ট্রয় যুদ্ধের দীর্ঘ অবরোধ শেষে গ্রিকরা যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করার ভান করে একটি বিশাল কাঠের ঘোড়া রেখে যায়, উপহারস্বরূপ — যার ভেতরে লুকিয়ে থাকে তাদের কিছু বাছাই করা সৈন্য। ট্রয়ের জনগণ ঘোড়াটিকে বিজয়ের নিদর্শন ভেবে নগরীর ভেতরে এনে উৎসব করতে থাকে। কিন্তু রাতে ঘোড়ার ভেতর থেকে গ্রিক সেনারা বের হয়ে নগরীর প্রধান ফটক খুলে দেয়, ফলে মূল বাহিনী শহরে ঢুকে পড়ে এবং ট্রয় শহর ধ্বংস হয়ে যায়।

    এই কাহিনি সময়ের ধারায় রূপ নিয়েছে এক শক্তিশালী প্রতীকে—‘ট্রোজান হর্স’ হয়ে উঠেছে এক প্রতীকি শব্দ—যেখানে বাইরের শান্ত মুখোশের পেছনে থাকে প্রতারণা ও নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা।

    আজকের ‘মধ্যপন্থা’ ঠিক তেমনই—এটি যেন এক রাজনৈতিক ট্রোজান হর্স। মুখে বলে “সব পক্ষের কথা শোনে”, কিন্তু বাস্তবে জনগণের দাবিকে নীরবে উপেক্ষা করে ক্ষমতার ক্যাননের (স্বীকৃত আদর্শ/নিয়ম) ভিতর নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। ফলে এই মধ্যপন্থা আদতে কোনো স্বাধীন অবস্থান নয়—বরং এক কৌশলগত হাতিয়ার, যার মাধ্যমে জনগণের আস্থাকে কাজে লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় সেই শক্তিগুলো, যারা আগে থেকেই নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্র, অর্থনীতি এবং মতাদর্শিক কাঠামো।

    এই সমীকরণ শুধু বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়—এটি আজকের বৈশ্বিক লিবারেল গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত সংকট। যেখানে গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতা চলে গেছে এক ক্ষুদ্র, সাংস্কৃতিকভাবে সুসংগঠিত শ্রেণির হাতে—এবং “মধ্যপন্থী” রাজনীতি তার সবচেয়ে উপযোগী বাহক।

    বাংলাদেশের সমাজিক কাঠামোতে স্পষ্টভাবে ২০১৩ পরবর্তী সময় থেকে একটি গভীর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিভাজন ঘটেছে—একদিকে রয়েছে ইসলাম প্রিয়, মূল্যবোধ-নির্ভর, ঐতিহ্যনিষ্ঠ বৃহৎ জনগোষ্ঠী; অন্যদিকে রয়েছে একপ্রকার সংস্কৃতিগত আধিপত্য বিস্তারকারী শ্রেণি, যাদের চিন্তা-ভাবনা পশ্চিমা লিবারেল আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত এবং যাদের হাতে রয়েছে প্রশাসন, আইন, এনজিও, মিডিয়া ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ।

    জার্মান-ইটালীয় সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট মিশেলস এর “Iron Law Of Oligarchy” তত্ত্ব অনুসারে, যে কোনো সংগঠন বা রাষ্ট্রে ক্ষমতা শেষ পর্যন্ত একটি ক্ষুদ্র শ্রেণির হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। এই ক্ষমতাধর শ্রেণিই নির্ধারণ করে কোন আদর্শ গ্রহণযোগ্য, কোনটি বাতিলযোগ্য। বাংলাদেশে, এই এলিট শ্রেণির পুরোটাই বাম ঘরানার আদর্শের সঙ্গে যুক্ত এখানে ঐ ইসলাম প্রিয় জনগোষ্ঠীর কোনো ভাগ নেই।

    মধ্যপন্থা শব্দটি শোনায় ভারসাম্যের মতো, কিন্তু বাস্তবতা হলো, মধ্যপন্থা সবসময় শক্তিশালী মেরুটিকেই প্রাধান্য দেয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কাঠামোগত শক্তি বামদের হাতে, ফলে মধ্যপন্থী দল বা নেতারা বাম মতাদর্শের প্রতি ঝুঁকে পড়বে—যা ধীরে ধীরে তাদের প্রকাশ্য অবস্থানে, নীতিগত অবস্থানে এবং ন্যারেটিভ নির্মাণে প্রতিফলিত হবে।

    উদাহরণস্বরূপ, আপনি দেখবেন মধ্যপন্থী দলগুলো কখনোই ধর্মীয় মূল্যবোধের পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নেয় না/নিবে না, কারণ তারা জানে এটি “প্রগতিশীল” মহলের মধ্যে বিতর্ক তৈরি করবে। অথচ তারা স্বাধীনতা, নারী অধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি বিষয়ে কথাবার্তা বলে ঠিক সেই ভাষায়—যা এনজিও, মিডিয়া এবং আন্তর্জাতিক দাতাদের কাছে গ্রহণযোগ্য।

    আপনি দেখবেন রাষ্ট্র যখন নির্ধারণ করে দেয়—কোন উৎসব ‘জাতীয়’, কোন বিশ্বাস ‘গোঁড়ামি’, কোন পোশাক ‘উগ্রতা’, আর কোন ভাষা ‘বিদ্বেষ’—তখন মধ্যপন্থী দলগুলো এই সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় না, বরং তারা ক্ষমতার সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে—নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার উদ্দেশ্যে—কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় জনগণের বিশ্বাস, ও অনুভূতিগুলো ধীরে ধীরে "অগ্রহণযোগ্য" ও "বিপজ্জনক" হিসেবে সংজ্ঞায়িত হতে থাকে যা দীর্ঘ মেয়াদে জনগণের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাড়ায়—কিন্তু সে ব্যাপারে তাদের (মধ্যপন্থীদের) কোনো কনসার্ন লক্ষ করা যায় না।

    সমাজের মূল্যবোধ যদি একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর ভিত্তি করে গঠিত হয়, তাহলে যৌক্তিক হলো সেই মূল্যবোধ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে প্রভাবিত করবে। কিন্তু আমাদের দেশে (অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশে) বিষয়টি উল্টো—রাষ্ট্রীয় কাঠামো একটি নির্দিষ্ট মতবাদকে সমাজের উপর চাপিয়ে দেয়, যা সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাসের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। আর মধ্যপন্থী রাজনীতি এই চাপিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াকে নীরবে বৈধতা দেয়।

    এই অবস্থায়, মধ্যপন্থী দলের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতাকেন্দ্রিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন—জনগণের সাথে আন্তরিকতা নয়, বরং আন্তর্জাতিক ফান্ডিং ও মিডিয়া-সমর্থন নিশ্চিত করা। তারা যতই নিজেকে নিরপেক্ষ দাবি করুক না কেন, আসলে তারা সেই সংস্কৃতিগত একনায়কতন্ত্রের ছায়া, যা একপাক্ষিকভাবে ‘আধুনিকতা’ ও ‘প্রগতিশীলতা’র সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেয়।

    মধ্যপন্থা কোনো বাস্তবসম্মত সমাধান নয়। যখন সমাজ গভীরভাবে দুই মেরুতে বিভক্ত—একদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মূল্যবোধ, অন্যদিকে ক্ষমতার দখলে থাকা এলিট কাঠামো—তখন ‘মধ্যপন্থা’ আসলে ক্ষমতার কাছে নতজানু হওয়ার মার্জিত রূপ। এই পথ অনুসরণকারীরা জনগণের হৃদয়ের ভাষা নয়, শিখে নেয় ক্ষমতার সুবিধাজনক ভাষা—আর ক্ষমতার ভাষা মূলত পশ্চিমা বাম লিবারেল কাঠামোর অনুবাদ।

    ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে, তারই ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় নতুন রাজনৈতিক দল—জাতীয় নাগরিক পার্টি, যারা নিজেদের অবস্থান ‘মধ্যপন্থী’ হিসেবে ঘোষণা করে।

    বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় “জাতীয় নাগরিক পার্টি” কে শুধু একটি নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে দেখা ভুল হবে। তারা নিজেদের ‘মধ্যপন্থী’ দাবি করলেও, আসলে তারা ঠিক কোন আদর্শে বিশ্বাস করে, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ।

    তাই এই সময় রাজনৈতিকভাবে সচেতন হওয়া জরুরি। বিশেষত জাতীয় নাগরিক পার্টির মতো নতুন মধ্যপন্থী দলগুলোর প্রতি সতর্ক দৃষ্টিতে নজর রাখা প্রয়োজন—মুখে ‘নতুন সূচনা’ ও ‘জনগণের স্বার্থ’ এর কথা বললেও, বাস্তবে তারা হয়তো কাজ করবে সেই পুরনো ক্ষমতাকাঠামোর ধারাবাহিকতাকে রক্ষা করতেই।

  • #2
    মাশাআল্লাহ ভাই, খুব সুন্দর লিখেছেন। আল্লাহ আপনার কলমী জিহাদকে কবুল করুন। আমীন
    নিয়মিত লিখে যাবেন বলে আশা রাখছি প্রিয় ভাই শের খাঁ

    ‘যার গুনাহ অনেক বেশি তার সর্বোত্তম চিকিৎসা হল জিহাদ’-শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ.

    Comment

    Working...
    X