|| পর্ব ৩ ||
বাংলাদেশে জঙ্গি ন্যারেটিভ পুনর্গঠনের চেষ্টা: আমাদের করণীয় কী?
বাংলাদেশে জঙ্গি ন্যারেটিভ পুনর্গঠনের চেষ্টা: আমাদের করণীয় কী?
পূর্ববর্তী পর্বগুলোতে আলোচনা করেছিলাম—দেশে জঙ্গি ন্যারেটিভের পুনর্নির্মাণ একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং এই চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় স্বল্পমেয়াদী কিছু প্রাথমিক প্রতিরোধমূলক কৌশল সম্পর্কে। যদিও এসব স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ তাৎক্ষণিক অভিঘাত সামাল দিতে সহায়তা করে, তবে প্রকৃত ও স্থায়ী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। কেবলমাত্র দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগই এই বিপদকে কার্যকরভাবে প্রতিহত করতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরোধ
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মৌলিক স্তম্ভকে যদি এক শব্দে প্রকাশ করতে চাই তাহলে সেটা হবে "দাওয়াহ"। হ্যা, দাওয়াহ। দাওয়াহ শুধু জঙ্গি ন্যারেটিভের মোকাবেলাতেই সাহায্য করবে না, বরং সামনের দিনগুলোতে আগত সকল ধরনের বিপদাপদ মোকাবেলাতেই সাহায্য করবে। তবে প্রশ্ন হলো—দাওয়াহ তো এখনো চলমান, তাহলে নতুন করে আবার কেন দাওয়াহর কথা নির্দিষ্ট করে বলছি?
উক্ত প্রশ্নের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত—হ্যাঁ, দাওয়াহ বর্তমানে চলমান একটি প্রক্রিয়া। তবে এখানেই আরেকটি প্রশ্ন উঠে আসে: যদি দাওয়াহ চলমানই থাকে, তাহলে আমরা কেন আমাদের সম্মুখীন হওয়া বিভিন্ন সংকটের কার্যকর প্রতিরোধে সক্ষম হচ্ছি না?
আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা করলে একটি শব্দ বারবার চোখে পড়ে—‘Anarchy’ বা ‘অরাজকতা’। এ ধারণার মাধ্যমে মূলত বোঝানো হয় যে, বর্তমান বিশ্বে কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব বা ‘সেন্ট্রাল অথোরিটি’ নেই, আর ঠিক এই অনুপস্থিতির কারণেই বৈশ্বিক অঙ্গনে এত জটিলতা ও সংকট তৈরি হচ্ছে। বৈশ্বিক এই কর্তৃত্বহীনতার ফলে প্রতিটি রাষ্ট্র নিজেকে নিরাপদ রাখার দায়িত্ব নিজেই বহন করে এবং স্বার্থরক্ষার জন্য স্বতন্ত্রভাবে সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়, এবং একে অপরের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ কাজ করে। এই অবিশ্বাসই গড়ে তোলে নিরাপত্তাহীনতার এক জটিল চক্র।
আজকের আলোচনা আন্তর্জাতিক রাজনীতির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নিয়ে নয়, বরং সংকট মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধ গড়ে তোলার পথে কী করণীয়—সে বিষয়েই। তাহলে প্রশ্ন হলো: এই প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ধারণা, বিশেষ করে ‘Anarchy’ এর মতো পশ্চিমা অ্যাকাডেমিক পরিভাষা টেনে আনার যৌক্তিকতা কী? আমি কি তবে মুসলিম সমাজের সমস্যা সমাধানে পশ্চিমা চিন্তাবিদদের তৈরি ধারণা ব্যবহার করছি?
না, আমি মুসলিম সমাজের সমস্যার সমাধানে পশ্চিমা চিন্তাবিদদের তৈরি কোনো ধারণা ব্যবহার করছি না, করতেও বলছি না। সুতরাং, এমনটি ভাবা ভুল হবে যে আমি পশ্চিমা চিন্তাধারার ওপর নির্ভর করে মুসলিম সমাজের সংকট সমাধানের পথ খুঁজছি।
এই দুনিয়াতে বেশ কিছু বিষয় রয়েছে, যা মুসলিম-কাফির উভয়ের জন্যই সমান, উভয়ের জন্যই একই। উদাহরণস্বরূপ, কোনো কাফির যদি আগুনের ভিতর হাত দেয়; তাহলে তার হাত পুড়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক—এখন কোনো মুসলিম যদি আগুনের ভিতর হাত দেয়; তাহলে তার হাত কী পুড়বে না? হ্যা, অবশ্যই পুড়বে অর্থাৎ উভয়ের জন্যই ফলাফল একই হবে।
অর্থাৎ, এই পৃথিবীতে এমন অনেক বিষয় রয়েছে, যা মুসলিম ও কাফির—উভয়ের জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য। আমার মতে, সেন্ট্রাল অথোরিটির অনুপস্থিতিজনিত বিশৃঙ্খলার বিষয়টিও ঠিক তেমনই—এটি মুসলিম ও কাফির উভয়ের জন্যই সমভাবে প্রযোজ্য।
ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এই ভূখণ্ডের দাওয়াহ অঙ্গনেও কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব বা সেন্ট্রাল অথোরিটি নেই। যার ফলে, যেমন বৈশ্বিক পর্যায়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অভাবে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, তেমনি এখানকার দাওয়াহ অঙ্গনেও অনুরূপ বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে।
যেভাবে বৈশ্বিক কর্তৃত্বহীনতায় প্রতিটি রাষ্ট্র নিজের নিরাপত্তা ও স্বার্থরক্ষার দায়িত্ব নিজেই বহন করে, ঠিক সেভাবেই দাওয়াহ অঙ্গনেও প্রতিটি ঘরানা বা মাসলাকের অনুসারীরা নিজেদের নিরাপদ রাখতে স্বতন্ত্রভাবে কাজ করে। ফলে, যেমন রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সন্দেহ জন্ম নেয়, তেমনি দাওয়াহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ঘরানা ও মাসলাকের মাঝেও বিশ্বাসের অভাব ও উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়।
এই পারস্পরিক অবিশ্বাস, দ্বিধা ও বিচ্ছিন্নতা যেমন বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বিশৃঙ্খলার জন্ম দিয়েছে, তেমনি দাওয়াহ অঙ্গনকেও ঠেলে দিচ্ছে এক অস্থির ও অগোছালো অবস্থার দিকে। মূলত এর ফলেই, দাওয়াহ কার্যক্রম চলমান থাকলেও আমরা বিভিন্ন সংকটের কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছি না।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রসঙ্গটি উপস্থাপনের মূল উদ্দেশ্য এটাই ছিল—উভয় অঙ্গনের (বৈশ্বিক ও দাওয়াহ) সংকটের মধ্যে বিদ্যমান সাদৃশ্য তুলে ধরা। এই সাদৃশ্যের মাধ্যমে বোঝানো যে, সংকট মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব বা সেন্ট্রাল অথোরিটির উপস্থিতি সর্বত্রই অপরিহার্য, তা যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন। কার্যকর নেতৃত্ব ও সমন্বয়ের অভাব আমাদেরকে বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেয়—এটি বাস্তব ও চক্ষুষ্মান উদাহরণ দিয়ে তুলে ধরাই ছিল মূল অভিপ্রায়।
আশা করি, পরিষ্কার হয়েছে—পশ্চিমা চিন্তাধারার উপর নির্ভর করে মুসলিম সমাজের সংকটের সমাধান খোঁজা আমার উদ্দেশ্য ছিল না। বরং লক্ষ্য ছিল উভয় অঙ্গনের (আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও দাওয়াহ অঙ্গন) সংকটের মধ্যে যে সাদৃশ্য ও অভিন্নতা রয়েছে, তা তুলে ধরা। আর এই সাদৃশ্যতা খুবই যৌক্তিক, কারণ উভয় ক্ষেত্রেই ইসলামের প্রদর্শিত সমাধানকে উপেক্ষা করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইসলামের প্রদর্শিত সমাধানকে উপেক্ষা করা হয়েছে সর্বোচ্চ মাত্রায় ও ব্যাপকতায়, আর এই ভূখণ্ডে সে উপেক্ষা তুলনামূলকভাবে কম পরিসরে ঘটেছে। তবে মাত্রার তারতম্য থাকলেও মূল বাস্তবতা একটাই—উভয় ক্ষেত্রেই ইসলামের নির্দেশিত সমাধানকে অবহেলা করা হয়েছে।
তাহলে এখন করণীয় কী?
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
اَلْجَمَاعَةُ رَحْمَةٌ وَالْفُرْقَةُ عَذَابٌ
"জামা‘আতবদ্ধভাবে বসবাস রহমত স্বরূপ এবং বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস আযাব স্বরূপ"
اَلْجَمَاعَةُ رَحْمَةٌ وَالْفُرْقَةُ عَذَابٌ
"জামা‘আতবদ্ধভাবে বসবাস রহমত স্বরূপ এবং বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস আযাব স্বরূপ"
তবে এই রহমত পেতে হলে ইসলামের নির্ধারিত প্রতিটি শর্ত পূর্ণাঙ্গভাবে পালন করতে হবে—সামান্যতম আপোষও আমাদের কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই এখন প্রশ্ন হলো—কীভাবে আমরা জামাআহবদ্ধ হবো? কার নেতৃত্বে একত্রিত হবো? জামাআহর ভিতর কী কী বৈশিষ্ট্য থাকলে বুঝব যে তারা হকের উপর প্রতিষ্ঠিত? এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা নির্ভরযোগ্য ও হকপন্থী আলেমদের কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে নিবো, ইনশাআল্লাহ।
জামাআহ বদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে আমরা অনেক অবাস্তব ধারণা পোষণ করি, সেই ধারণাগুলো আমাদের বর্জন করতে হবে। আমরা ভাবি, সবাই মিলে এক হতে হবে, সব ঘরানা, সব মাসলাক, সব মানহাজের সকলকে এক হতে হবে বা হওয়া উচিত—বাস্তবতার আলোকে দেখলে এই ধারণাই প্রচন্ডরকম অপরিপক্কতার ছাপ ফুটে ওঠে। আদতে এরকম ঐক্য কখনোই সম্ভব না। যখন কেউ জামাআহ বদ্ধ হওয়ার কথা বলে বা আমি যেরকম বলছি—এখানে মূলত উদ্দেশ্য থাকে তাওহীদবাদী অংশটাকে জামাআহ বদ্ধ হতে বলা।
দেখুন যারা অলরেডি কোনো তানজিমের সাথে যুক্ত আছে তাদের কথা ভিন্ন, তাদের নির্দিষ্ট রোডম্যাপ আছে, তারা সে অনুযায়ী কাজ করছে। কিন্তু আমরা যারা কোনো তানজিমের সাথে যুক্ত নেই, আমরা সময় নষ্ট ছাড়া আর কী করছি? বিগত কয়েক বছরে আলহামদুলিল্লাহ অনেক যুবক দ্বীনে ফিরেছে, এদের সংখ্যা কিন্তু অনেক, এরা সবাই বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে, এদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে হবে।
এখন এই নতুন দ্বীনে ফেরা যুবকদের জামাআহ বদ্ধ করতে গেলে তো নতুন আরও একটা দল হয়ে যাবে—এর ফলে ঐক্যের বদলে বিচ্ছিন্নতা কী আরও বাড়ছে না?
আমি কোনো তানজিমের সাথে যুক্ত নেই কিন্তু বিভিন্ন তানজিম সম্পর্কে আমার ব্যাক্তিগত একটা ধারণা হলো—তাদের কাছে যেয়ে যদি আমি বা আপনি বলি, যে আমরা জিহাদ করতে চায়, আপনাদের সাথে একসঙ্গে কাজ করতে চায়—আমার মনে হয়না শুধু এভাবে ইচ্ছা প্রকাশের কারণেই তারা আমাদের তাদের সাথে যুক্ত করে নিবে। অন্তত আমার নিয়ন্ত্রণে যদি কোনো তানজিমের দায়িত্ব থাকতো তাহলে শুধু ইচ্ছা প্রকাশের কারণেই কাউকে আমি উক্ত তানজিমের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতাম না। কারণ এখানে ইচ্ছা প্রকাশ গুরুত্বপূর্ণ তবে তার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো যোগ্যতা। কেননা তানজিমে যুক্ত করার অর্থ তাকে কোনো না কোনো দায়িত্ব দিতে হবে; আর সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার যোগ্যতা যদি তার না থাকে তাহলে তাকে তানজিমে যুক্ত করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এই ক্ষেত্রে যৌক্তিক হবে পরোক্ষ উপায়ে সেই সকল ইচ্ছাপোষণকারী ব্যাক্তিদের যোগ্যতাসম্পন্ন করে গড়ে তোলা।
তাই সেসকল ইচ্ছাপোষণকারী ভাইদের যোগ্যতা সম্পন্ন করে গড়ে তোলার জন্য যদি বাহ্যিকভাবে আরেকটা দলের সংখ্যা বেড়েও যায়; তাতে আমার মনে হয়না যে অনৈক্য বাড়বে। কারণ, পর্দার আড়ালে তারা একই পথেরই পথিক, কেউ অগ্রবর্তীদের কাতারে দাড়িয়ে আছে তো কেউ অগ্রবর্তীদের কাতারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আর দাওয়াহ অঙ্গনে আমরা শক্তিশালী হলে জিহাদের পথও প্রসারিত হবে। আমরা সবাই কখনো না কখনো ফুটবল খেলেছি, অনেকে এখনো খেলি। ফুটবল খেলায় খেলোয়াড়রা একটি সুশৃঙ্খল কাঠামোর আওতায় কাজ করে। প্রতিটি পজিশনের জন্য নির্দিষ্ট ভূমিকা থাকে—গোলকিপার, ডিফেন্ডার, মিডফিল্ডার, এবং স্ট্রাইকার—সবাই মিলেই একটি দল পূর্ণতা পায়।
ধরা যাক, কোনো দলে শুধু স্ট্রাইকারই ভালো খেলছে, কিন্তু বাকি পজিশনগুলো দুর্বল—তাহলে সেই দলের পক্ষে জয় অর্জন করা প্রায় অসম্ভব। অন্যদিকে, যদি কোনো দলের স্ট্রাইকার তুলনামূলকভাবে দুর্বল হয়, কিন্তু গোলকিপার, ডিফেন্ডার ও মিডফিল্ডাররা যদি দক্ষ ও শক্তিশালী হয়, তাহলে তাদের জয়ের সম্ভাবনা অনেক বেশি। অর্থাৎ, একটি দলের সফলতা নির্ভর করে পুরো কাঠামোর উপর, শুধু কোনো একক অংশের উপর নয়।
এই কারণেই শুধু দাওয়াহ কিংবা শুধু জিহাদের কথা বলা হয় না; বরং উভয়ের সমন্বয় করেই বলা হয়—দাওয়াহ ও জিহাদ। আপনি চাইলে দাওয়াহ অঙ্গনকে তুলনা করতে পারেন একটি ফুটবল দলের গোলকিপার, ডিফেন্ডার এবং মিডফিল্ডারের সাথে; আর জিহাদের ময়দানে থাকা কাফেলাগুলো হলো স্ট্রাইকার।
ফুটবল খেলায় যেমন স্ট্রাইকার একটু দুর্বল হলেও গোল এবং জয় সম্ভব, যদি রক্ষণভাগ তথা গোলকিপার, ডিফেন্ডার ও মিডফিল্ডাররা শক্তিশালী থাকে—ঠিক তেমনি, জিহাদের কাফেলাগুলো কিছুটা দুর্বল হলেও বিজয় সম্ভব, যদি দাওয়াহর ময়দান থাকে মজবুত, সুসংগঠিত ও আদর্শিকভাবে সুদৃঢ়। এর অর্থ, দাওয়াহ অঙ্গনে আমাদের হতে হবে অত্যন্ত শক্তিশালী—বিশুদ্ধ তাওহীদ, সহীহ আকীদা ও সঠিক মানহাজের ভিত্তিতে মুসলিমদের একতাবদ্ধ করতে হবে।
বাস্তবতা হলো, সামরিক দিক থেকে এগিয়ে যাওয়ার মতো আমাদের হাতে প্রয়োজনীয় রিসোর্স নেই—সুতরাং সেখানে কিছুটা পিছিয়ে থাকার যৌক্তিকতা রয়েছে। কিন্তু দাওয়াহর অঙ্গনে কাজ করার জন্য যে রিসোর্সগুলো দরকার, তার সবই আমাদের হাতে রয়েছে। তবুও আমরা অলসতা, দায়িত্বহীনতা ও আত্মতুষ্টির কারণে সেগুলোর যথাযথ ব্যবহার করছি না—এটা নিঃসন্দেহে আমাদেরই ব্যর্থতা।
তাই এখন উচিত হবে ব্যর্থতাকে দূর করা।
কীভাবে জামাআহ বদ্ধ হবো?
দুইভাবে আমরা জামাআহ বদ্ধ হতে পারি।
[১]
ক) কেন্দ্র: দল গঠনের শুরুতে কিছু মূল ব্যক্তি বা নেতা থাকবে, যাদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা, বোঝাপড়া এবং উদ্দেশ্য স্পষ্ট থাকে। এটাই হবে কেন্দ্র।
খ) ছড়ানো: এই কেন্দ্র থেকে তারা ধীরে ধীরে আরও সদস্য সংযোজন করতে থাকবে, যারা তাদের চিন্তাধারা, উদ্দেশ্য ও কার্যক্রমের সঙ্গে সহমত পোষণ করে।
গ) চারিদিকে বিস্তার: সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই কেন্দ্রভুক্ত সদস্যরা নতুন সদস্যদের যুক্ত করবে, ফলে দলটি আয়তনে ও প্রভাবে বাড়তে থাকবে—একটা বৃত্তের মতো, যেখানে কেন্দ্র থেকে তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে দলের পরিধি। যেমন, একটি পুকুরে পাথর ফেললে কেন্দ্র থেকে তরঙ্গ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে—একইভাবে দলও প্রথমে ছোট একটি গোষ্ঠী দিয়ে শুরু হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে।
[২]
প্রথম পদ্ধতি যেটা উল্লেখ করলাম সেটা হলো কেন্দ্রীভূত (হায়ারার্কি) স্ট্রাকচার আর দ্বিতীয় পদ্ধতি যেটা বললাম সেটা হলো বিকেন্দ্রীভূত (হোলাক্রেসি) স্ট্রাকচার।
হায়ারার্কি/কেন্দ্রীভূত: হায়ারার্কি হলো একটি ধাপভিত্তিক সংগঠন কাঠামো। এখানে এক বা একাধিক শীর্ষ নেতা সকল সিদ্ধান্ত নেয়; পর্যায়ক্রমিক নির্দেশনা থাকে, উপর থেকে নিচে আদেশ যায়। প্রত্যেকের নির্দিষ্ট ভূমিকা ও দায়িত্ব থাকে, কে কাকে রিপোর্ট করবে তা স্পষ্ট থাকে, ইত্যাদি।
হোলাক্রেসি/বিকেন্দ্রীভূত: হোলাক্রেসি হলো এক ধরনের বিতরণকৃত নেতৃত্ব কাঠামো, যেখানে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নয়, বরং ভিন্ন ভিন্ন সার্কেল বা টিম দায়িত্ব ভাগ করে নেয়। একেকটি সার্কেল নিজের কাজের জন্য নিজে সিদ্ধান্ত নেয়, ইত্যাদি।
২৪ এর জুলাই আন্দোলনে হোলাক্রেসি স্ট্রাকচার বেইজড সাংগঠনিক কাঠামো ব্যাবহার করা হয়েছিলো। সেজন্য কিছু সমন্বয়ককে গুম/গ্রেফতার করে আন্দোলন বন্ধ করার ঘোষণা দেওয়া হলেও আন্দোলন থেমে যায়নি; কারণ, সেই গুটিকয়েক সমন্বয়ক কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের অধিকারী ছিলো না। আন্দোলন বিকেন্দ্রীভূত ভাবে চলছিল, তাই সেই গুটিকয়েক সমন্বয়কের আন্দোলন বন্ধের ঘোষণার সেরকম কোনো মূল্য ছিলো না।
কোন সাংগঠনিক কাঠামো ভালো?
আমার মতে, আমাদের উচিত হবে—এই দুই সাংগঠনিক কাঠামোর সমন্বয় ঘটানো। হায়ারার্কি স্ট্রাকচার বেইজড সংগঠন/জামাআত থাকবে পর্দার আড়ালে; আর হোলাক্রেসি স্ট্রাকচার বেইজড সংগঠন/জামাআত গুলো থাকবে পর্দার সামনে।
হায়ারার্কি কাঠামোর জামাআতে থাকবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রফেশনাল মানুষজন আর হোলাক্রেসি কাঠামোর জামাআতগুলো থাকবে সকলের জন্য উন্মুক্ত; বাহ্যিকভাবে হোলাক্রেসি কাঠামোর জামাআত গুলো হবে সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীন, কিন্তু পর্দার আড়ালে প্রতিটা ক্ষেত্রে মূলনীতি ঠিক করে দিবে হায়ারার্কি কাঠামোর নেতৃত্ব।
হায়ারার্কি ভিত্তিক কাঠামোয় জামাআত গঠন ও নেতৃত্বের দায়িত্ব বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের ওপর অর্পণযোগ্য। কারণ এতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, শৃঙ্খলা ও শরঈ দিকনির্দেশনার গুরুত্ব থাকে। অন্যদিকে, হোলাক্রেসি ভিত্তিক কাঠামোতে জামাআত গঠন করতে চাইলে আমরাও তা উদ্যোগ নিয়ে করতে পারি—তবে এর জন্য প্রয়োজন আনুগত্যের মানসিকতা ও নেতৃত্বের লোভ থেকে মুক্ত থাকা। কেননা এই কাঠামোতে ভূমিকা ভাগ করে কাজ হয়, আর নেতৃত্ব নয়, দায়িত্বই মুখ্য।
পাশাপাশি যতদিন আনুষ্ঠানিকভাবে হায়ারার্কি ভিত্তিক জামাআতের সঙ্গে আমাদের সংযুক্তি না হয়, ততদিন আমাদের প্রতিটি কাজের পূর্বে নিজেকে/নিজেদের এই প্রশ্নটি করা উচিত হবে—আমার বা আমাদের কাজের প্রভাব কী? এটি কি বলকে আমাদের নিজেদের গোলপোস্টের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, নাকি স্ট্রাইকারের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে? অর্থাৎ, আমাদের কার্যক্রম কি দাওয়াহর ময়দানকে সংকীর্ণ করছে, নাকি জিহাদের পথকে প্রসারিত করছে?—তা বিবেচনায় আনতে হবে।
এভাবে চাইলে আমরা যারা কোনো তানজিমের সাথে যুক্ত নেই, তারা কাজ শুরু করতে পারি, ইনশাআল্লাহ।
Comment