আমরা যখন বিকাশ বা অন্যান্য মোবাইল লেনদেন ভিত্তিক সিস্টেম নিয়ে আলোচনা করি কিংবা সেগুলোর শারঈ মূল্যায়ন করতে চাই, তখন একটি সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে আসে—আমরা যেসব বিকল্প পদ্ধতির কথা বলছি, সেগুলো অনেক সময়েই বর্তমান ব্যবস্থার তুলনায় অনেক বেশি জটিল, সময়সাপেক্ষ এবং কিছুটা পরিশ্রমসাধ্য। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, কেন আমরা একটি সহজ, ঝামেলাহীন, সর্বজনগ্রাহ্য পদ্ধতির বদলে এমন কিছু অনুসরণ করবো যা বাস্তব জীবনে কঠিন বা কষ্টসাধ্য?
এরপর আরেকটি প্রশ্নও উঠে আসে—যেহেতু টাকা লেনদেন নিজেই তো হারাম নয়, বরং এটি মানুষের প্রয়োজন পূরণের একটি স্বাভাবিক উপায়, তাহলে এই আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সিস্টেমগুলোর শরীয়তের দৃষ্টিতে কী এমন সমস্যা থাকতে পারে যে তা নিয়ে আমরা এত কিছু বলছি?
অনেকে বলেন, “আজকের দিনে লেনদেনের ব্যবস্থা যত সহজ হবে, মানুষের জন্য ততই ভালো। বিকাশ-নগদের মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আসলে আমাদের সময় বাঁচায়, ঝামেলা কমায়।” এই দাবিটা এতটাই স্বাভাবিকভাবে উচ্চারিত হয় যেন এটি একটা চিরন্তন সত্য।
কিন্তু আমার প্রশ্নটা একটু গভীরতর জায়গা থেকে আসে—
উত্তরটা পরিষ্কার—কারণ আজকের দিনে প্রচুর পরিমাণে লেনদেন হচ্ছে। মানুষ এত বেশি কেনাবেচা করছে, এত ঘন ঘন আর্থিক লেনদেনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে যে সহজ পদ্ধতি প্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে।
তাহলে আরেকটা বড় প্রশ্ন সামনে আসে:
প্রথমত, জীবনের প্রতিটি অংশকে বাজারে রূপান্তর করার প্রক্রিয়া:
বর্তমান সময়ে লেনদেনের পরিমাণ যেভাবে ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে, সেটি কেবল প্রযুক্তির অগ্রগতি কিংবা মানুষের ‘সুবিধাবাদী’ স্বভাবের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখলে আমরা একটি বড় সত্য আড়াল করে ফেলি। এই পরিবর্তন আসলে একটি পরিকল্পিত সামাজিক প্রকৌশলের ফল—যার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হলো মানব সম্পর্কের প্রাকৃতিক, স্বতঃস্ফূর্ত ও অবাণিজ্যিক কাঠামোগুলোকে ভেঙে ফেলা এবং প্রতিটি সম্পর্ককে বাজারের ছাঁচে ঢেলে দেওয়া। এ প্রক্রিয়ার পেছনে সক্রিয় রয়েছে এক গভীর দার্শনিক চালনা—নব্য-উদারবাদের বিশ্বব্যাপী অভিপ্রায়, যা শুধু অর্থনীতি নয়, সংস্কৃতি, মনোবৃত্তি ও নৈতিকতাকেও বাজারে রূপান্তরিত করতে চায়।
শুরুতে পুঁজিবাদ শিল্প উৎপাদনের ওপর কেন্দ্রিত ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তার লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র। এখনকার পুঁজিবাদ সম্পর্ক, আবেগ, বিশ্বাস, শিক্ষা, সেবা এমনকি সময় পর্যন্ত—সবকিছুকেই বিক্রয়যোগ্য করতে চায়। এই ধারণাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে “স্বাধীনতা” ও “স্বনির্ভরতা”র মোড়কে। ফলে দেখা যাচ্ছে, যে কাজ একসময় পরিবার, আত্মীয়তা বা উম্মাহর বন্ধনে হতো, আজ তা টাকা দিয়ে কেনা সেবায় রূপান্তরিত হয়েছে। মা সন্তানের আদরের পরিবর্তে তাকে ডে-কেয়ারে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন সময়ের অভাবে; শিশু গল্প শুনে নয়, বেড়ে উঠছে YouTube Kids-এ; আর প্রতিবেশীর কাছে সাহায্য চাইতে গিয়ে এখন আমাদের বলা হয়: “Customer Support Number দিন।” ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ ও আত্মত্যাগ আজ সাবস্ক্রিপশন সেবার মতো ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। মানুষ আর পরিবার বা উম্মাহর অংশ নয়—সে হচ্ছে একটি পৃথক অর্থনৈতিক একক, যাকে দিনরাত খরচ করাতে হবে এবং কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে।
এই লেনদেনের সংস্কৃতি শুধু আমাদের সম্পর্কের ধরণকেই পাল্টে দিচ্ছে না, বরং ধীরে ধীরে আমাদের চিন্তার কাঠামো এবং মূল্যবোধকেও পুনর্গঠিত করছে। প্রতিনিয়ত অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত, কনট্রাক্ট, বিল, পেমেন্ট, রেটিং, কুপন—এই জগতের ভেতরে বাস করার মানে হলো, মানুষের চিন্তা সীমিত হয়ে পড়ছে আয়-ব্যয়ের হিসাব-নিকাশে। একটি সমাজ যখন নিজেকে কেবল হিসাবের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে শেখে, তখন তার পক্ষে ত্যাগ, ইখলাস, আদর্শ কিংবা উত্তরাধিকারবোধের মতো অমূল্য গুণগুলো রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। আজকের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যে সম্মানবোধ, আদব-কায়দা এবং আত্মপরিচয়ের সংকট আমরা দেখছি, সেটি আসলে নৈতিকতার স্বাভাবিক অবক্ষয় নয়, বরং একটি এমন ব্যবস্থা তৈরি করে ফেলা হয়েছে যেখানে নৈতিকতা অপ্রয়োজনীয় ও অচল মনে হয়। যদি পরিবারের কাজ বাজার করে দেয়, যদি দায়িত্ব মজুরির মাধ্যমে নিষ্পন্ন হয়ে যায়, তাহলে আদর্শ ও আত্মনিয়ন্ত্রণ শেখানোর সুযোগ কোথায় থাকবে?
এই সংস্কৃতি কেবল ব্যক্তি বা পরিবারের ক্ষতি করছে না; এটি একটি জাতিকে ভেতর থেকে ভেঙে দিচ্ছে। যে জাতি প্রতিটি সম্পর্ককেই অর্থনৈতিক পাটিগণিতের চোখে দেখে, সে জাতি নিজের ঐতিহাসিক দায়িত্ব অনুভব করতে পারে না, আত্মত্যাগের অনুপ্রেরণায় জেগে উঠতে পারে না, এবং উম্মাহর অস্তিত্ববোধ হারিয়ে ফেলে। তখন সে নিজের সন্তানকে সম্পত্তি ভাবে, সমাজকে গ্রাহক ভাবে, এবং নিজের দায়িত্বকে রাষ্ট্র কিংবা কোনো এনজিওর হাতে ঠেলে দিয়ে পাশ কাটিয়ে যায়। এর ফলে সেই জাতিকে আর বাহ্যিকভাবে গোলাম বানাতে হয় না, কারণ সে নিজেই তার চিন্তা, পছন্দ, আচরণ—সবকিছু বাজারের কাছে সমর্পণ করে দেয়।
সুতরাং, আজকের প্রশ্ন হওয়া উচিত: আমরা কেন এত বেশি লেনদেন করছি? এর পেছনে কি কেবল সুযোগ-সুবিধা কাজ করছে, নাকি এটা আমাদের চিন্তাভাবনাকে বাজার-নির্ভর করে তোলার একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও দার্শনিক প্রকল্প? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা মানেই আমাদের আত্মপরিচয়, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সম্পর্কের মৌলিক কাঠামোকে পুনরায় বুঝে নেওয়ার পথ খুঁজে বের করা।
দ্বিতীয়ত, আর্থিক নির্ভরতাই ‘স্বাধীনতা’র ভান!
আজকের মানুষ নিজেকে স্বাধীন ভাবে, কারণ তার হাতে স্মার্টফোন আছে, তার অ্যাপে ব্যালেন্স আছে, তার লেনদেন মুহূর্তেই শেষ হয়। সে মনে করে—ব্যয় করার সক্ষমতা মানেই স্বাধীনতা, ডিজিটাল মাধ্যমে অর্থপ্রবাহ মানেই আধুনিকতা। কিন্তু এই বাহ্যিক শক্তি আসলে তাকে পরিণত করেছে এক চিরস্থায়ী “খরচকারী দাসে”—যার দিন শুরু হয় খরচের চিন্তা দিয়ে, আর রাত ঘুমায় আগামী দিনের খরচের চাপ নিয়ে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই মানুষটি এক অবিরাম চক্রে ঘুরছে—যেখানে তাকে শুধু খরচ বজায় রাখতে হবে, তাই আয় করতেই হবে, আয় করতে হলে সময় দিতে হবে, আর সেই সময় দিতে গিয়ে সে ধীরে ধীরে ইবাদতের পথ থেকে সরে আসছে। সে যেন এক যন্ত্র, যাকে বাজার চাবুক মেরে চালাচ্ছে—আর সে নিজেই সেই দৌড়কে বলছে “উন্নতি”।
এ এক দাসত্ব—যার শেকল চোখে পড়ে না, কারণ তা লুকিয়ে থাকে পকেটের গভীরে। এ এক দাসত্ব—যার স্লোগান শুনতে উদার মনে হয়: “Cashless is freedom!” কিন্তু বাস্তবে তা শুধু এক নতুন রকমের বশ্যতার ভাষা—যেখানে প্রযুক্তি দিয়ে শেকল বাঁধা হয়, আর ‘সুবিধা’ দিয়ে ইচ্ছা গলিয়ে নেওয়া হয়।
অনেকে জিজ্ঞেস করে—মানুষ কেন দুনিয়াবি বিষয়ে এত সময় দেয়, অথচ ইবাদতের সময় পায় না?
এই প্রশ্নের উত্তর কেবল ‘ইমান দুর্বল’ বলে শেষ করা যায় না। বরং বুঝতে হবে, আমাদের সময়ের দুনিয়াব্যবস্থা কৌশলে এমন এক রূপ নিয়েছে, যা মানুষকে স্বাভাবিকভাবে ইবাদত থেকে সরিয়ে দেয়, আর খরচের দিকে টেনে আনে।
আজকের অর্থনীতি মানুষের ভিতরের চাহিদাগুলোকে প্রশমন করে না, বরং উত্তেজিত করে তোলে। মানুষের ফিতরাত—যেখানে সৌন্দর্য, আরাম আর বৈচিত্র্যপ্রবণতা ছিল স্বাভাবিক—তা আজ বাজারের শিকার। ইসলাম যেখানে এই ফিতরাতকে সংযম দিয়ে পরিশুদ্ধ করে, সেখানে আধুনিক বাজারব্যবস্থা তাকে উত্তেজনায় নিক্ষেপ করে।
আমরা শুনি প্রতিনিয়ত:
এখানেই দাসত্বের দ্বিতীয় স্তর শুরু হয়। মানুষ যখন খরচের আনন্দে ডুবে যায়, তখন সে নিজেই ইনকামের জন্য হন্যে হয়ে পড়ে। ইনকাম করতে হবে—না খাওয়ার জন্য, বরং খরচ করার জন্য। আয় বাড়াতে হলে সময় দিতে হবে, দক্ষতা বাড়াতে হবে, প্রতিযোগিতায় জিততে হবে। এবং এই প্রক্রিয়ায় তার সবচেয়ে বড় ত্যাগ হয় ইবাদত।
সময় ফুরিয়ে যায়, অথচ সালাত পড়ে না।
মন ব্যস্ত থাকে, অথচ কুরআন খুলে না।
পকেট ভরে ওঠে, অথচ দুঃখীকে দান করা হয় না।
আত্মা ক্ষয় হতে থাকে, কিন্তু মানুষ ভাবে—সব ঠিক আছে, ব্যালেন্স তো আছে!
পরিবারে এই দাসত্ব এক ভিন্ন রূপ নেয়। পরিবার আর ভালোবাসার স্থান নয়, হয়ে যায় এক ‘ম্যানেজমেন্ট ইউনিট’। কে কখন বাচ্চাকে স্কুল থেকে আনবে, কার ক্রেডিট কার্ডে EMI কিস্তি যাবে, বাজারে কে যাবে—এইসব লজিস্টিক প্ল্যানই হয়ে ওঠে পরিবারের আলোচনার কেন্দ্র। সম্পর্কগুলো হয়ে পড়ে কার্যকরী, হৃদ্যতা নয়।
আর উম্মাহর স্তরে এসে এই দাসত্ব বিপর্যয়কর। মুসলিম আজ এতটাই ব্যস্ত নিজের বিল পরিশোধে, যে সে আর উম্মাহর রক্তে আঁকা দুঃখ দেখতে পায় না। ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, সুদান—সবই আজ শুধুই স্ক্রলযোগ্য সংবাদ, হৃদয়-উপভোগ নয়। মুসলিমের জীবন আজ এমনই গঠন করা হয়েছে, যেন তার কোনো দায়িত্ব নেই, কেবল কিছু খরচ আর কিছু বিনোদন ছাড়া।
তৃতীয়ত, শারঈ ও নৈতিক প্রশ্নের বিলুপ্তি
আজকের দিনে আপনি যেকোনো অনলাইনভিত্তিক বা কার্ডনির্ভর লেনদেন—হোক তা বিকাশ, নগদ, উপায়, ব্যাংকিং অ্যাপ কিংবা আন্তর্জাতিক গেটওয়ে—যেদিকেই তাকান না কেন, তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সুদভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার সাথে যুক্ত। আপনি যতই 'ইসলামিক' বা 'শরিয়া-সম্মত' ট্যাগ দেখুন না কেন, বাস্তবতা হলো এই যে, এসব প্ল্যাটফর্ম কার্যকর হয় তখনই, যখন তা মূলধারার সুদনির্ভর ব্যাংকিং সিস্টেমের কোনো না কোনো স্তরের সাথে সংযুক্ত থাকে।
এই ব্যবস্থার ভেতরে সবচেয়ে কৌশলী বিষয়টি হলো—আপনার লেনদেন যত সহজ হবে, আপনি তত বেশি সুদের চক্রে আবদ্ধ হবেন। আর আপনি যদি সুদের এই ফাঁদ এড়াতে চান, তাহলে আপনার লেনদেন হবে জটিল, সীমিত এবং প্রায় অসম্ভব। সহজতা এখন আর নিরপেক্ষ কোনো সুবিধা নয়; এটি একপ্রকার প্রলোভন, যা মানুষকে তার অজান্তেই শরিয়ত-বিরোধী ব্যবস্থায় প্রবেশ করিয়ে দেয়।
এমন অবস্থায় একজন সাধারণ মানুষ, যার স্বভাব ফিতরাত মোতাবেক সহজ ও সাবলীল পথকে বেছে নেওয়ার, স্বাভাবিকভাবেই এই সুদব্যবস্থার দিকে আকৃষ্ট হয়ে যায়—না গুনাহের নিয়তে, বরং সুবিধা ও কার্যকারিতার দোহাইয়ে। কিন্তু এই দোহাইটাই ব্যবস্থাগতভাবে এমনভাবে সাজানো যে, আপনি যেন "সহজতাকে" আলাদা করতে না পারেন সুদ থেকে।
এই বাস্তবতায় প্রশ্ন আসে—আমরা কি আদৌ ‘বিকল্প’ ছাড়া বাঁচতে শিখেছি? না কি আমরা এমন এক সমাজে বসবাস করছি, যেখানে ‘সুবিধা’ মানেই সুদ, আর ‘নৈতিকতা’ মানেই অসুবিধা।
কারণ কোনো সভ্যতাই টিকে না, যদি তার অর্থব্যবস্থা হয় দাসত্বের ভিত্তিতে, আর নৈতিকতা হয় কেবল অ্যাপ আপডেটের মতো পরিবর্তনশীল।
অনেকের কাছে হয়তো এসব কথা আজগুবি বা বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আজকের বিশ্বায়িত লেনদেন-নির্ভর সমাজব্যবস্থা হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। এর পেছনে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস, এক সুপরিকল্পিত দার্শনিক ও অর্থনৈতিক প্রকৌশল—যা বিশেষ করে পশ্চিমা জগতের নেতৃত্বে বাস্তবায়িত হয়েছে।
১৯২৯ সালের Great Depression ছিল আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জন্য এক ভয়াবহ ধাক্কা। শেয়ারবাজার ধসে পড়ে, ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে যায়, মানুষ কাজ হারায়, এবং বাজারে নেমে আসে চরম অনাস্থা। অর্থনীতি যে “স্বাভাবিকভাবে” সব কিছু ম্যানেজ করে নিতে পারে—এই বিশ্বাসের ভিত্তিই তখন নড়ে গিয়েছিল।
এই বিপর্যয় থেকে বের হওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ একটি নতুন কৌশলের দিকে এগোয়—এটা শুধু সরকারি বিনিয়োগ বা আর্থিক সহায়তার বিষয় ছিল না; বরং মানুষের মনস্তত্ত্ব বদলানোর একটি কৌশল ছিল। পশ্চিমা অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকেরা বুঝতে পারেন—যতক্ষণ না সাধারণ মানুষ মার্কেটের উপর আবার আস্থা রাখে, ততক্ষণ পর্যন্ত সিস্টেম চাঙা হবে না।
এই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্য মানুষের মাঝে ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি ও অধিক লেনদেনকে উৎসাহিত করা হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টের "New Deal" ছিল এর প্রথম বড় ধাপ। এরপর Keynesian অর্থনীতির আবির্ভাব ঘটে, যা বলে—সরকারকে চাইলে সরাসরি খরচ বাড়িয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হবে। এবং এটাই হয়: বৃহৎ সরকারি ব্যয়, কাজের সুযোগ তৈরি, বোনাস, ক্রেডিট সুবিধা, এবং—সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—ভোক্তা হওয়াকে নাগরিক দায়িত্বে রূপান্তর করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়টাতে, Bretton Woods চুক্তি (১৯৪৪)-এর মাধ্যমে একটি নতুন বিশ্ব অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়, যার কেন্দ্রে থাকে মার্কিন ডলার ও সুদভিত্তিক ব্যাংকিং সিস্টেম। ক্রমে দেখা যায়, নাগরিকদের আরও বেশি খরচে উৎসাহিত করতে ব্যাংকগুলো ক্রেডিট কার্ড, লোন, কিস্তি প্রথা চালু করে। ফ্রিতে কিছু পাওয়া যাচ্ছে—এই মানসিকতা তৈরির পেছনে বিজ্ঞাপন শিল্প, সিনেমা, জীবনধারাভিত্তিক প্রচারণা—সবই ব্যবহৃত হয়।
এই সময় থেকেই মানুষের জীবনে “লেনদেন” কেবল একটি আর্থিক প্রক্রিয়া নয়—বরং একটি জীবনদর্শন হয়ে দাঁড়ায়। বাজার থেকে পাওয়া, বাজারে বিক্রি করা, বাজারে প্রমাণ করা—এই সবকিছুই হয়ে দাঁড়ায় মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি। যার বাজারমূল্য নেই, তার আর সামাজিক মূল্যও নেই।
আর এখানে এসে দাঁড়ায় আজকের প্রশ্ন:
আমাদের লেনদেনের সহজতা কি নিছক প্রযুক্তির সুবিধা, না কি একটি দীর্ঘমেয়াদী মানসিক ও রাজনৈতিক প্রকৌশলের ফল?
কারণ এই ব্যবস্থায় আপনি যত বেশি ডিজিটাল হবেন, যত বেশি আরামদায়ক হবে আপনার লেনদেন, আপনি ততই জড়িয়ে পড়বেন এমন একটি আর্থিক চক্রে যার ভিত্তি হচ্ছে সুদ, ঋণ, এবং বাজার-নির্ভরতা। আপনি আর ভাববেন না, এটা হালাল না হারাম; আপনি শুধু ভাববেন, “কাজটা কতটা ফাস্ট?” আর এই ফাস্টনেসের পেছনে থাকে এক গভীর ও শত্রুভাবাপন্ন কাঠামো—যা আপনার চিন্তা, বিশ্বাস, এবং ধর্মীয় আত্মপরিচয়কে ধীরে ধীরে মুছে দিতে চায়।
এবং তাই, আজকের যুগে লেনদেন কেবল অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়; এটি একটি আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও। আপনি কীভাবে লেনদেন করছেন, তা বলে দেয় আপনি কার বিশ্বদর্শনে বিশ্বাস করছেন।
আমাদের ভাবতে হচ্ছে—
সবশেষে, প্রশ্নটা খুব সহজ:
পূর্ববর্তী আলোচনায় আমি যে সমাধানের দিকটি তুলেছিলাম—তা কাঠামোগত। আমরা চাইলে মূল্যবান ধাতু (যেমন স্বর্ণ বা রৌপ্য) কিংবা নির্দিষ্ট দলিলের মাধ্যমে লেনদেন চালু করতে পারি, যাতে সুদ ও ডিজিটাল নজরদারি থেকে মুক্ত থাকা যায়।
কিন্তু এর আগেও একটি আরো মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ ধাপ রয়েছে, যা কেবল কাঠামোগত নয়, বরং আচরণগত ও আত্মিক—সেটি হলো: আমাদের লেনদেনের পরিমাণ ও প্রয়োজনকে নিয়ন্ত্রণ করা।
আমরা যে লেনদেনগুলো করছি, তার মধ্যে কতগুলো সত্যিই প্রয়োজনীয়? আর কতগুলো কেবল মনস্তাত্ত্বিক চাপ, বাজারসৃষ্ট কৃত্রিম জরুরিতা বা সামাজিক প্রতিযোগিতার ফল?
আমাদেরকে একবার থেমে ভাবতে হবে—আমরা কি নিজের ইচ্ছায় লেনদেন করছি, না কি কোনো অদৃশ্য হাত আমাদের “জরুরি” নাম দিয়ে কিছু কিনতে বাধ্য করছে?
আমরা যদি প্রতিটি "প্রয়োজন"কে যাচাই না করি, যদি আমরা নিজেদের প্রবৃত্তি ও চাহিদার লাগাম না টানি, তাহলে কাঠামো যতই ইসলামিক হোক না কেন, আমরা তবুও আত্মার দাসত্ব থেকে মুক্ত হব না।
মনে রাখবেন, আপনাকে দ্রুত লেনদেনের সুযোগ দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য শুধু আপনার সুবিধা নয়—বরং যেন আপনি আরও বেশি লেনদেন করেন এবং এর মাধ্যমে পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সক্রিয় ও চাঙ্গা রাখা যায়।
এরপর আরেকটি প্রশ্নও উঠে আসে—যেহেতু টাকা লেনদেন নিজেই তো হারাম নয়, বরং এটি মানুষের প্রয়োজন পূরণের একটি স্বাভাবিক উপায়, তাহলে এই আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সিস্টেমগুলোর শরীয়তের দৃষ্টিতে কী এমন সমস্যা থাকতে পারে যে তা নিয়ে আমরা এত কিছু বলছি?
অনেকে বলেন, “আজকের দিনে লেনদেনের ব্যবস্থা যত সহজ হবে, মানুষের জন্য ততই ভালো। বিকাশ-নগদের মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আসলে আমাদের সময় বাঁচায়, ঝামেলা কমায়।” এই দাবিটা এতটাই স্বাভাবিকভাবে উচ্চারিত হয় যেন এটি একটা চিরন্তন সত্য।
কিন্তু আমার প্রশ্নটা একটু গভীরতর জায়গা থেকে আসে—
আজকের দিনে "লেনদেন সহজ হওয়া উচিত"—এই কথাটা আসছে কেন? এর পেছনের ভিত্তিটা কী?
উত্তরটা পরিষ্কার—কারণ আজকের দিনে প্রচুর পরিমাণে লেনদেন হচ্ছে। মানুষ এত বেশি কেনাবেচা করছে, এত ঘন ঘন আর্থিক লেনদেনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে যে সহজ পদ্ধতি প্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে।
তাহলে আরেকটা বড় প্রশ্ন সামনে আসে:
কেন আমরা এত বেশি লেনদেন করছি? আগেকার দিনের তুলনায় আমাদের জীবন কেন এত বেশি লেনদেননির্ভর হয়ে পড়েছে? এটা কি প্রগতির লক্ষণ, না কি এক ধরনের সিস্টেমেটিক পরাধীনতা?
প্রথমত, জীবনের প্রতিটি অংশকে বাজারে রূপান্তর করার প্রক্রিয়া:
বর্তমান সময়ে লেনদেনের পরিমাণ যেভাবে ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে, সেটি কেবল প্রযুক্তির অগ্রগতি কিংবা মানুষের ‘সুবিধাবাদী’ স্বভাবের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখলে আমরা একটি বড় সত্য আড়াল করে ফেলি। এই পরিবর্তন আসলে একটি পরিকল্পিত সামাজিক প্রকৌশলের ফল—যার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হলো মানব সম্পর্কের প্রাকৃতিক, স্বতঃস্ফূর্ত ও অবাণিজ্যিক কাঠামোগুলোকে ভেঙে ফেলা এবং প্রতিটি সম্পর্ককে বাজারের ছাঁচে ঢেলে দেওয়া। এ প্রক্রিয়ার পেছনে সক্রিয় রয়েছে এক গভীর দার্শনিক চালনা—নব্য-উদারবাদের বিশ্বব্যাপী অভিপ্রায়, যা শুধু অর্থনীতি নয়, সংস্কৃতি, মনোবৃত্তি ও নৈতিকতাকেও বাজারে রূপান্তরিত করতে চায়।
শুরুতে পুঁজিবাদ শিল্প উৎপাদনের ওপর কেন্দ্রিত ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তার লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র। এখনকার পুঁজিবাদ সম্পর্ক, আবেগ, বিশ্বাস, শিক্ষা, সেবা এমনকি সময় পর্যন্ত—সবকিছুকেই বিক্রয়যোগ্য করতে চায়। এই ধারণাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে “স্বাধীনতা” ও “স্বনির্ভরতা”র মোড়কে। ফলে দেখা যাচ্ছে, যে কাজ একসময় পরিবার, আত্মীয়তা বা উম্মাহর বন্ধনে হতো, আজ তা টাকা দিয়ে কেনা সেবায় রূপান্তরিত হয়েছে। মা সন্তানের আদরের পরিবর্তে তাকে ডে-কেয়ারে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন সময়ের অভাবে; শিশু গল্প শুনে নয়, বেড়ে উঠছে YouTube Kids-এ; আর প্রতিবেশীর কাছে সাহায্য চাইতে গিয়ে এখন আমাদের বলা হয়: “Customer Support Number দিন।” ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ ও আত্মত্যাগ আজ সাবস্ক্রিপশন সেবার মতো ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। মানুষ আর পরিবার বা উম্মাহর অংশ নয়—সে হচ্ছে একটি পৃথক অর্থনৈতিক একক, যাকে দিনরাত খরচ করাতে হবে এবং কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে।
এই লেনদেনের সংস্কৃতি শুধু আমাদের সম্পর্কের ধরণকেই পাল্টে দিচ্ছে না, বরং ধীরে ধীরে আমাদের চিন্তার কাঠামো এবং মূল্যবোধকেও পুনর্গঠিত করছে। প্রতিনিয়ত অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত, কনট্রাক্ট, বিল, পেমেন্ট, রেটিং, কুপন—এই জগতের ভেতরে বাস করার মানে হলো, মানুষের চিন্তা সীমিত হয়ে পড়ছে আয়-ব্যয়ের হিসাব-নিকাশে। একটি সমাজ যখন নিজেকে কেবল হিসাবের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে শেখে, তখন তার পক্ষে ত্যাগ, ইখলাস, আদর্শ কিংবা উত্তরাধিকারবোধের মতো অমূল্য গুণগুলো রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। আজকের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যে সম্মানবোধ, আদব-কায়দা এবং আত্মপরিচয়ের সংকট আমরা দেখছি, সেটি আসলে নৈতিকতার স্বাভাবিক অবক্ষয় নয়, বরং একটি এমন ব্যবস্থা তৈরি করে ফেলা হয়েছে যেখানে নৈতিকতা অপ্রয়োজনীয় ও অচল মনে হয়। যদি পরিবারের কাজ বাজার করে দেয়, যদি দায়িত্ব মজুরির মাধ্যমে নিষ্পন্ন হয়ে যায়, তাহলে আদর্শ ও আত্মনিয়ন্ত্রণ শেখানোর সুযোগ কোথায় থাকবে?
এই সংস্কৃতি কেবল ব্যক্তি বা পরিবারের ক্ষতি করছে না; এটি একটি জাতিকে ভেতর থেকে ভেঙে দিচ্ছে। যে জাতি প্রতিটি সম্পর্ককেই অর্থনৈতিক পাটিগণিতের চোখে দেখে, সে জাতি নিজের ঐতিহাসিক দায়িত্ব অনুভব করতে পারে না, আত্মত্যাগের অনুপ্রেরণায় জেগে উঠতে পারে না, এবং উম্মাহর অস্তিত্ববোধ হারিয়ে ফেলে। তখন সে নিজের সন্তানকে সম্পত্তি ভাবে, সমাজকে গ্রাহক ভাবে, এবং নিজের দায়িত্বকে রাষ্ট্র কিংবা কোনো এনজিওর হাতে ঠেলে দিয়ে পাশ কাটিয়ে যায়। এর ফলে সেই জাতিকে আর বাহ্যিকভাবে গোলাম বানাতে হয় না, কারণ সে নিজেই তার চিন্তা, পছন্দ, আচরণ—সবকিছু বাজারের কাছে সমর্পণ করে দেয়।
সুতরাং, আজকের প্রশ্ন হওয়া উচিত: আমরা কেন এত বেশি লেনদেন করছি? এর পেছনে কি কেবল সুযোগ-সুবিধা কাজ করছে, নাকি এটা আমাদের চিন্তাভাবনাকে বাজার-নির্ভর করে তোলার একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও দার্শনিক প্রকল্প? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা মানেই আমাদের আত্মপরিচয়, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সম্পর্কের মৌলিক কাঠামোকে পুনরায় বুঝে নেওয়ার পথ খুঁজে বের করা।
দ্বিতীয়ত, আর্থিক নির্ভরতাই ‘স্বাধীনতা’র ভান!
আজকের মানুষ নিজেকে স্বাধীন ভাবে, কারণ তার হাতে স্মার্টফোন আছে, তার অ্যাপে ব্যালেন্স আছে, তার লেনদেন মুহূর্তেই শেষ হয়। সে মনে করে—ব্যয় করার সক্ষমতা মানেই স্বাধীনতা, ডিজিটাল মাধ্যমে অর্থপ্রবাহ মানেই আধুনিকতা। কিন্তু এই বাহ্যিক শক্তি আসলে তাকে পরিণত করেছে এক চিরস্থায়ী “খরচকারী দাসে”—যার দিন শুরু হয় খরচের চিন্তা দিয়ে, আর রাত ঘুমায় আগামী দিনের খরচের চাপ নিয়ে।
সে ভাবে, আয় করছি—তাই শক্তিশালী।
সে ভাবে, ব্যয় করছি—তাই আধুনিক।
সে ভাবে, সময় নেই—তাই গুরুত্বপূর্ণ।
সে ভাবে, ব্যয় করছি—তাই আধুনিক।
সে ভাবে, সময় নেই—তাই গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই মানুষটি এক অবিরাম চক্রে ঘুরছে—যেখানে তাকে শুধু খরচ বজায় রাখতে হবে, তাই আয় করতেই হবে, আয় করতে হলে সময় দিতে হবে, আর সেই সময় দিতে গিয়ে সে ধীরে ধীরে ইবাদতের পথ থেকে সরে আসছে। সে যেন এক যন্ত্র, যাকে বাজার চাবুক মেরে চালাচ্ছে—আর সে নিজেই সেই দৌড়কে বলছে “উন্নতি”।
এ এক দাসত্ব—যার শেকল চোখে পড়ে না, কারণ তা লুকিয়ে থাকে পকেটের গভীরে। এ এক দাসত্ব—যার স্লোগান শুনতে উদার মনে হয়: “Cashless is freedom!” কিন্তু বাস্তবে তা শুধু এক নতুন রকমের বশ্যতার ভাষা—যেখানে প্রযুক্তি দিয়ে শেকল বাঁধা হয়, আর ‘সুবিধা’ দিয়ে ইচ্ছা গলিয়ে নেওয়া হয়।
অনেকে জিজ্ঞেস করে—মানুষ কেন দুনিয়াবি বিষয়ে এত সময় দেয়, অথচ ইবাদতের সময় পায় না?
এই প্রশ্নের উত্তর কেবল ‘ইমান দুর্বল’ বলে শেষ করা যায় না। বরং বুঝতে হবে, আমাদের সময়ের দুনিয়াব্যবস্থা কৌশলে এমন এক রূপ নিয়েছে, যা মানুষকে স্বাভাবিকভাবে ইবাদত থেকে সরিয়ে দেয়, আর খরচের দিকে টেনে আনে।
আজকের অর্থনীতি মানুষের ভিতরের চাহিদাগুলোকে প্রশমন করে না, বরং উত্তেজিত করে তোলে। মানুষের ফিতরাত—যেখানে সৌন্দর্য, আরাম আর বৈচিত্র্যপ্রবণতা ছিল স্বাভাবিক—তা আজ বাজারের শিকার। ইসলাম যেখানে এই ফিতরাতকে সংযম দিয়ে পরিশুদ্ধ করে, সেখানে আধুনিক বাজারব্যবস্থা তাকে উত্তেজনায় নিক্ষেপ করে।
আমরা শুনি প্রতিনিয়ত:
“চাইলেই পাচ্ছেন, এখনই অর্ডার করুন!”
“Buy now, pay later!”
“আগে পেয়ে যান, পরে চিন্তা করুন!”
“Buy now, pay later!”
“আগে পেয়ে যান, পরে চিন্তা করুন!”
এখানেই দাসত্বের দ্বিতীয় স্তর শুরু হয়। মানুষ যখন খরচের আনন্দে ডুবে যায়, তখন সে নিজেই ইনকামের জন্য হন্যে হয়ে পড়ে। ইনকাম করতে হবে—না খাওয়ার জন্য, বরং খরচ করার জন্য। আয় বাড়াতে হলে সময় দিতে হবে, দক্ষতা বাড়াতে হবে, প্রতিযোগিতায় জিততে হবে। এবং এই প্রক্রিয়ায় তার সবচেয়ে বড় ত্যাগ হয় ইবাদত।
সময় ফুরিয়ে যায়, অথচ সালাত পড়ে না।
মন ব্যস্ত থাকে, অথচ কুরআন খুলে না।
পকেট ভরে ওঠে, অথচ দুঃখীকে দান করা হয় না।
আত্মা ক্ষয় হতে থাকে, কিন্তু মানুষ ভাবে—সব ঠিক আছে, ব্যালেন্স তো আছে!
সে এখন এমন এক দাস, যে দাসত্বকে বলছে ‘আধুনিকতা’, আর শেকলকেই মনে করছে স্মার্ট ওয়ালেট।
পরিবারে এই দাসত্ব এক ভিন্ন রূপ নেয়। পরিবার আর ভালোবাসার স্থান নয়, হয়ে যায় এক ‘ম্যানেজমেন্ট ইউনিট’। কে কখন বাচ্চাকে স্কুল থেকে আনবে, কার ক্রেডিট কার্ডে EMI কিস্তি যাবে, বাজারে কে যাবে—এইসব লজিস্টিক প্ল্যানই হয়ে ওঠে পরিবারের আলোচনার কেন্দ্র। সম্পর্কগুলো হয়ে পড়ে কার্যকরী, হৃদ্যতা নয়।
আর উম্মাহর স্তরে এসে এই দাসত্ব বিপর্যয়কর। মুসলিম আজ এতটাই ব্যস্ত নিজের বিল পরিশোধে, যে সে আর উম্মাহর রক্তে আঁকা দুঃখ দেখতে পায় না। ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, সুদান—সবই আজ শুধুই স্ক্রলযোগ্য সংবাদ, হৃদয়-উপভোগ নয়। মুসলিমের জীবন আজ এমনই গঠন করা হয়েছে, যেন তার কোনো দায়িত্ব নেই, কেবল কিছু খরচ আর কিছু বিনোদন ছাড়া।
তাই, যে যত বেশি খরচ করে, সে তত আধুনিক নয়—সে হয়তো ততটাই বন্দী।
যে যত বেশি লেনদেন করে, সে তত স্বাধীন নয়—সে হয়তো ততটাই শোষিত।
যে যত বেশি লেনদেন করে, সে তত স্বাধীন নয়—সে হয়তো ততটাই শোষিত।
তৃতীয়ত, শারঈ ও নৈতিক প্রশ্নের বিলুপ্তি
আজকের দিনে আপনি যেকোনো অনলাইনভিত্তিক বা কার্ডনির্ভর লেনদেন—হোক তা বিকাশ, নগদ, উপায়, ব্যাংকিং অ্যাপ কিংবা আন্তর্জাতিক গেটওয়ে—যেদিকেই তাকান না কেন, তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সুদভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার সাথে যুক্ত। আপনি যতই 'ইসলামিক' বা 'শরিয়া-সম্মত' ট্যাগ দেখুন না কেন, বাস্তবতা হলো এই যে, এসব প্ল্যাটফর্ম কার্যকর হয় তখনই, যখন তা মূলধারার সুদনির্ভর ব্যাংকিং সিস্টেমের কোনো না কোনো স্তরের সাথে সংযুক্ত থাকে।
এই ব্যবস্থার ভেতরে সবচেয়ে কৌশলী বিষয়টি হলো—আপনার লেনদেন যত সহজ হবে, আপনি তত বেশি সুদের চক্রে আবদ্ধ হবেন। আর আপনি যদি সুদের এই ফাঁদ এড়াতে চান, তাহলে আপনার লেনদেন হবে জটিল, সীমিত এবং প্রায় অসম্ভব। সহজতা এখন আর নিরপেক্ষ কোনো সুবিধা নয়; এটি একপ্রকার প্রলোভন, যা মানুষকে তার অজান্তেই শরিয়ত-বিরোধী ব্যবস্থায় প্রবেশ করিয়ে দেয়।
এমন অবস্থায় একজন সাধারণ মানুষ, যার স্বভাব ফিতরাত মোতাবেক সহজ ও সাবলীল পথকে বেছে নেওয়ার, স্বাভাবিকভাবেই এই সুদব্যবস্থার দিকে আকৃষ্ট হয়ে যায়—না গুনাহের নিয়তে, বরং সুবিধা ও কার্যকারিতার দোহাইয়ে। কিন্তু এই দোহাইটাই ব্যবস্থাগতভাবে এমনভাবে সাজানো যে, আপনি যেন "সহজতাকে" আলাদা করতে না পারেন সুদ থেকে।
এই বাস্তবতায় প্রশ্ন আসে—আমরা কি আদৌ ‘বিকল্প’ ছাড়া বাঁচতে শিখেছি? না কি আমরা এমন এক সমাজে বসবাস করছি, যেখানে ‘সুবিধা’ মানেই সুদ, আর ‘নৈতিকতা’ মানেই অসুবিধা।
কারণ কোনো সভ্যতাই টিকে না, যদি তার অর্থব্যবস্থা হয় দাসত্বের ভিত্তিতে, আর নৈতিকতা হয় কেবল অ্যাপ আপডেটের মতো পরিবর্তনশীল।
ইতিহাস কি বলে?
অনেকের কাছে হয়তো এসব কথা আজগুবি বা বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আজকের বিশ্বায়িত লেনদেন-নির্ভর সমাজব্যবস্থা হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। এর পেছনে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস, এক সুপরিকল্পিত দার্শনিক ও অর্থনৈতিক প্রকৌশল—যা বিশেষ করে পশ্চিমা জগতের নেতৃত্বে বাস্তবায়িত হয়েছে।
১৯২৯ সালের Great Depression ছিল আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জন্য এক ভয়াবহ ধাক্কা। শেয়ারবাজার ধসে পড়ে, ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে যায়, মানুষ কাজ হারায়, এবং বাজারে নেমে আসে চরম অনাস্থা। অর্থনীতি যে “স্বাভাবিকভাবে” সব কিছু ম্যানেজ করে নিতে পারে—এই বিশ্বাসের ভিত্তিই তখন নড়ে গিয়েছিল।
এই বিপর্যয় থেকে বের হওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ একটি নতুন কৌশলের দিকে এগোয়—এটা শুধু সরকারি বিনিয়োগ বা আর্থিক সহায়তার বিষয় ছিল না; বরং মানুষের মনস্তত্ত্ব বদলানোর একটি কৌশল ছিল। পশ্চিমা অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকেরা বুঝতে পারেন—যতক্ষণ না সাধারণ মানুষ মার্কেটের উপর আবার আস্থা রাখে, ততক্ষণ পর্যন্ত সিস্টেম চাঙা হবে না।
এই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্য মানুষের মাঝে ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি ও অধিক লেনদেনকে উৎসাহিত করা হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টের "New Deal" ছিল এর প্রথম বড় ধাপ। এরপর Keynesian অর্থনীতির আবির্ভাব ঘটে, যা বলে—সরকারকে চাইলে সরাসরি খরচ বাড়িয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হবে। এবং এটাই হয়: বৃহৎ সরকারি ব্যয়, কাজের সুযোগ তৈরি, বোনাস, ক্রেডিট সুবিধা, এবং—সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—ভোক্তা হওয়াকে নাগরিক দায়িত্বে রূপান্তর করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়টাতে, Bretton Woods চুক্তি (১৯৪৪)-এর মাধ্যমে একটি নতুন বিশ্ব অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়, যার কেন্দ্রে থাকে মার্কিন ডলার ও সুদভিত্তিক ব্যাংকিং সিস্টেম। ক্রমে দেখা যায়, নাগরিকদের আরও বেশি খরচে উৎসাহিত করতে ব্যাংকগুলো ক্রেডিট কার্ড, লোন, কিস্তি প্রথা চালু করে। ফ্রিতে কিছু পাওয়া যাচ্ছে—এই মানসিকতা তৈরির পেছনে বিজ্ঞাপন শিল্প, সিনেমা, জীবনধারাভিত্তিক প্রচারণা—সবই ব্যবহৃত হয়।
এই সময় থেকেই মানুষের জীবনে “লেনদেন” কেবল একটি আর্থিক প্রক্রিয়া নয়—বরং একটি জীবনদর্শন হয়ে দাঁড়ায়। বাজার থেকে পাওয়া, বাজারে বিক্রি করা, বাজারে প্রমাণ করা—এই সবকিছুই হয়ে দাঁড়ায় মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি। যার বাজারমূল্য নেই, তার আর সামাজিক মূল্যও নেই।
আর এখানে এসে দাঁড়ায় আজকের প্রশ্ন:
আমাদের লেনদেনের সহজতা কি নিছক প্রযুক্তির সুবিধা, না কি একটি দীর্ঘমেয়াদী মানসিক ও রাজনৈতিক প্রকৌশলের ফল?
কারণ এই ব্যবস্থায় আপনি যত বেশি ডিজিটাল হবেন, যত বেশি আরামদায়ক হবে আপনার লেনদেন, আপনি ততই জড়িয়ে পড়বেন এমন একটি আর্থিক চক্রে যার ভিত্তি হচ্ছে সুদ, ঋণ, এবং বাজার-নির্ভরতা। আপনি আর ভাববেন না, এটা হালাল না হারাম; আপনি শুধু ভাববেন, “কাজটা কতটা ফাস্ট?” আর এই ফাস্টনেসের পেছনে থাকে এক গভীর ও শত্রুভাবাপন্ন কাঠামো—যা আপনার চিন্তা, বিশ্বাস, এবং ধর্মীয় আত্মপরিচয়কে ধীরে ধীরে মুছে দিতে চায়।
এবং তাই, আজকের যুগে লেনদেন কেবল অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়; এটি একটি আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও। আপনি কীভাবে লেনদেন করছেন, তা বলে দেয় আপনি কার বিশ্বদর্শনে বিশ্বাস করছেন।
আমাদের ভাবতে হচ্ছে—
- এই লেনদেনের এত “সহজতা” অর্জনের জন্য এত খরচ, এত প্রযুক্তি, এত নিরাপত্তাব্যবস্থা, এত ইনফ্রাস্ট্রাকচার—এসব কি সত্যিই অনিবার্য?
- আমাদেরকে এত বেশি খরচ করতে হচ্ছে কেন, শুধুমাত্র লেনদেনকে কয়েক সেকেন্ডে পৌঁছে দেওয়ার জন্য? কার স্বার্থে এই ব্যয়? এবং কেন এই ব্যয়কেই ‘উন্নয়ন’ বলে গণ্য করা হচ্ছে?
- আমরা কি ভেবে দেখেছি—এই তথাকথিত “সহজতা”র পেছনে কি মূল্য আমরা দিচ্ছি? শুধু কি অর্থমূল্য? না কি আত্মনিয়ন্ত্রণ, সামাজিক সম্পর্ক, এবং ফিতরাতভিত্তিক জীবনধারাও এর সাথে বিলীন হয়ে যাচ্ছে?
- আমরা যদি এই ডিজিটাল লেনদেন না করি—তা হলে কী হয়? সত্যিই কি আমরা অচল হয়ে পড়ি? নাকি শুধু অচল হয়ে যায় সেই বাজার কাঠামো, যার ভেতর আমাদের ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে?
- আজ থেকে দশ বছর আগেও তো আমরা নগদ টাকায়, হাতে হাতে, সরাসরি লেনদেন করতাম। তখন কি আমাদের সময় নষ্ট হতো? নাকি তখনো আমরা সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিছু রক্ষা করছিলাম—বিশ্বাস, ব্যক্তিগত সংযোগ, আস্থা, এবং শরিয়তের সীমারেখা?
সবশেষে, প্রশ্নটা খুব সহজ:
- আমরা কি আসলেই নিজের প্রয়োজন মেটাতে লেনদেন করছি? নাকি আমাদের লেনদেনগুলোই এমনভাবে রূপান্তরিত হয়েছে, যা আমাদেরকে এক বিশেষ ধরণের বাজার-নির্ভর মানুষ বানিয়ে তুলছে—যার চিন্তাও আর বাজারের বাইরে যায় না?
পূর্ববর্তী আলোচনায় আমি যে সমাধানের দিকটি তুলেছিলাম—তা কাঠামোগত। আমরা চাইলে মূল্যবান ধাতু (যেমন স্বর্ণ বা রৌপ্য) কিংবা নির্দিষ্ট দলিলের মাধ্যমে লেনদেন চালু করতে পারি, যাতে সুদ ও ডিজিটাল নজরদারি থেকে মুক্ত থাকা যায়।
কিন্তু এর আগেও একটি আরো মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ ধাপ রয়েছে, যা কেবল কাঠামোগত নয়, বরং আচরণগত ও আত্মিক—সেটি হলো: আমাদের লেনদেনের পরিমাণ ও প্রয়োজনকে নিয়ন্ত্রণ করা।
আমরা যে লেনদেনগুলো করছি, তার মধ্যে কতগুলো সত্যিই প্রয়োজনীয়? আর কতগুলো কেবল মনস্তাত্ত্বিক চাপ, বাজারসৃষ্ট কৃত্রিম জরুরিতা বা সামাজিক প্রতিযোগিতার ফল?
আমাদেরকে একবার থেমে ভাবতে হবে—আমরা কি নিজের ইচ্ছায় লেনদেন করছি, না কি কোনো অদৃশ্য হাত আমাদের “জরুরি” নাম দিয়ে কিছু কিনতে বাধ্য করছে?
আমরা যদি প্রতিটি "প্রয়োজন"কে যাচাই না করি, যদি আমরা নিজেদের প্রবৃত্তি ও চাহিদার লাগাম না টানি, তাহলে কাঠামো যতই ইসলামিক হোক না কেন, আমরা তবুও আত্মার দাসত্ব থেকে মুক্ত হব না।
মনে রাখবেন, আপনাকে দ্রুত লেনদেনের সুযোগ দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য শুধু আপনার সুবিধা নয়—বরং যেন আপনি আরও বেশি লেনদেন করেন এবং এর মাধ্যমে পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সক্রিয় ও চাঙ্গা রাখা যায়।
Comment