ইসলামী সভ্যতা নিয়ে চিন্তাবিদ ও ঐতিহাসিকদের মাঝে একটি প্রায় সর্বসম্মত আলোচনা হলো—এই সভ্যতা আইন ও নৈতিকতার দিক দিয়ে বিস্ময়কর সফলতা অর্জন করলেও রাজনৈতিক বাস্তবতার ক্ষেত্রে একধরনের পিছুটান, ছন্দপতন ও অপূর্ণতা সব সময়ই রয়ে গেছে। ইসলামী ইতিহাসের ভেতরেই যেন গেঁথে আছে এই দ্বৈত রূপ—একদিকে আদর্শিক আইনব্যবস্থার এক পরিণত রূপ, যা রাষ্ট্রের বাহ্যিক শক্তি ছাড়াও সমাজে টিকে থেকেছে এবং ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে ব্যবসা, পরিবার, এমনকি যুদ্ধবিরতির নীতিতেও দিকনির্দেশনা দিয়েছে; অন্যদিকে রাজনৈতিক শাসনের ক্ষেত্রে বহুবার দেখা গেছে স্থিতিশীলতার অভাব, আদর্শচ্যুতি, ক্ষমতার লোভ ও বিশ্বাসঘাতকতা।
ইসলামী সভ্যতাকে তাই "nomocratic and nomocentric" বলা হয়ে থাকে—যেখানে শরিয়াহ শুধুই আইন নয়, বরং একটি মূল্যভিত্তিক সামাজিক চুক্তি, যা ব্যক্তি থেকে সমাজ এবং সমাজ থেকে রাষ্ট্র—সবকিছুকে সংজ্ঞায়িত করে। এটা এমন এক কাঠামো, যা যুগে যুগে মসজিদ, মাদ্রাসা, ক্বাযী আদালত, ওলামা-মুফতিদের ফতোয়া ও পরামর্শের মাধ্যমে মানুষের জীবনযাপনকে ন্যায়, আমানত, ও তাওয়াক্কুলের ছাঁচে গড়ে তুলেছে। এখানে রাষ্ট্র ছিল না সব কিছুর কেন্দ্র; বরং আইন ও নৈতিকতা ছিল সমাজের কাণ্ডারী। রাষ্ট্রপ্রধান যদি অনুপস্থিত থাকত বা দুর্বল হত, তবুও সমাজ চলত; কারণ শরিয়াহ ছিল মানুষের অন্তর ও লেনদেনে উপস্থিত।
এই শক্তিশালী আইনভিত্তিক সভ্যতার পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক গভীর রাজনৈতিক সংকটের ইতিহাস। ইসলামী রাজনৈতিক কাঠামো কখনোই এমনভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি যাতে একটানা ও ন্যায়ভিত্তিক শাসনের নিশ্চয়তা থাকে। খিলাফতের আদর্শকে যতই মহিমান্বিত করা হোক না কেন, ইতিহাস বলে—উমাইয়্য, আব্বাসীয় কিংবা উসমানীয় শাসনের ভেতরে অসংখ্য বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান, উত্তরাধিকার নিয়ে রক্তক্ষয়, এমনকি ভাইয়ের হাতে ভাইয়ের হত্যাকাণ্ড ইসলামী রাজনৈতিক বাস্তবতাকে কণ্টকিত করেছে। রাজনৈতিক বৈধতা লাভের জন্য যাঁরা শুধু বংশপরম্পরা নয় বরং ধর্মীয় অনুমোদন (religious legitimation) চেয়েছেন, তাঁরা বহু সময়েই ওলামাদের দ্বারে গিয়েছেন। এবং সেই দরজায় ওলামা কখনো ন্যায়ের দিক থেকে, কখনো স্বার্থের দিক থেকে, আবার কখনো কেবল প্রাণরক্ষার তাগিদে—দখলদারদেরকে “ইমাম” বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এর ফলে ধর্মীয় আদর্শ যেমন ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে, তেমনি ওলামা সমাজও রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
সমস্যাটা এখানেই শেষ নয়। এই দ্বৈত ভূমিকা, যেখানে একদিকে ওলামারা উচ্চ নৈতিকতা ও আদর্শচিন্তা নিয়ে এক বাস্তবতাবর্জিত ধারণা লালন করেছেন, আবার অন্যদিকে রাজনৈতিক সুবিধাবাদে শরিক হয়েছেন—তা একটি গভীর আস্থাহীনতা সৃষ্টি করেছে মুসলিম জনগণের মাঝে। একদিকে তাদের সামনে ছিল এক স্বপ্নময় খিলাফতের কল্পনা, যা “খুলাফায়ে রাশেদীন”-এর মতো ন্যায়পরায়ণ, অন্যদিকে বাস্তবে তারা দেখেছে দুর্নীতি, জবরদস্তি, ও ধর্মের নামে রাজনীতি। এই বিচ্ছিন্নতা (dislocation) শুধুমাত্র ইতিহাসের ঘটনা নয়, বরং মুসলিম মননে গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে।
এই আলোচনা যদি আমরা বর্তমানের প্রেক্ষাপটে নিয়ে আসি, তাহলে দেখা যাবে এই দ্বৈত বাস্তবতা এখনো আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আজকের আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের (nation-state) কাঠামোতে ইসলামী আইন প্রায় কোথাও পূর্ণভাবে কার্যকর নয়। অনেক মুসলিম রাষ্ট্রে শরিয়াহ একটি প্রতীক মাত্র, একটি সাংস্কৃতিক পরিচয় বা সংবিধানের “প্রস্তাবনামূলক ভাষা”—কিন্তু বাস্তবে ব্যবস্থাপনার কেন্দ্রবিন্দু নয়। উদাহরণস্বরূপ, সৌদি আরবে শরিয়াহর নামে যে আইন প্রয়োগ হয়, তা অনেক সময়ে ক্ষমতাসীন রাজপরিবারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও স্বার্থানুযায়ী পরিচালিত হয়, না যে তা সর্বদা আদর্শিকভাবে ওলামাদের তত্ত্ব অনুযায়ী হয়। আবার পাকিস্তান বা মিসরের মতো দেশে ইসলামিক আইনকে অনেক সময় রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্র ও আধুনিক আইনি কাঠামোর ভেতর একটি নিয়ন্ত্রিত ও সীমানাবদ্ধ সংস্করণ হিসেবে দেখা যায়।
অপরদিকে, মুসলিম বিশ্বে এখনো এমন বহু গোষ্ঠী আছে, যারা খিলাফতের কল্পনা নিয়ে রাজনীতি করে বা ইসলামিক রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—তাদের রাজনৈতিক চিন্তা কি বাস্তববাদী? তারা কি ঐতিহাসিক ব্যর্থতাগুলো থেকে শিক্ষা নিচ্ছে, নাকি কেবল সোনালি অতীতের রোমান্টিক পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চাইছে?
বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি এই ইসলামী সভ্যতা সংক্রান্ত আলোচনাকে প্রাসঙ্গিক করা হয়, তাহলে আমরা এক গভীর দ্বৈত বাস্তবতার মুখোমুখি হই—যেটা ইসলামী ইতিহাসের আলোচনার সাথেও চমৎকারভাবে মিলে যায়। এখানে একদিকে শরিয়াহ ও ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি জনগণের প্রবল আবেগ ও আনুগত্য রয়েছে, অপরদিকে রাষ্ট্রব্যবস্থা, প্রশাসনিক কাঠামো ও আইনি পরিকাঠামো মূলত একটি সেক্যুলার, উপনিবেশিক উত্তরাধিকারভিত্তিক সিস্টেমে আবদ্ধ।
বাংলাদেশের সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। অনেকেই একে ইসলামের বিজয় হিসেবে উপস্থাপন করেন, কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এটি মূলত একটি প্রতীকী ঘোষণা, যার কার্যকর অনুবাদ রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় খুবই সীমিত। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা এখনো ইংরেজি কমন ল’ (common law) ও ব্রিটিশ উপনিবেশিক ধাঁচে গঠিত, যেখানে শরিয়াহ মূলত পারিবারিক আইন (personal law) যেমন—বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার—এই ক্ষেত্রগুলোতেই সীমাবদ্ধ।
শরিয়াহভিত্তিক বিচারব্যবস্থার ব্যাপক কার্যকারিতা এখানে নেই, এবং যেখানে তা আছে, সেখানেও নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক বিবেচনায় তা প্রায়শই বিকৃত বা সীমাবদ্ধভাবে প্রয়োগ হয়। এমনকি ইসলামী আইনব্যবস্থার দাবিদার অনেক প্রতিষ্ঠানও—যেমন কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা—রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে, কিন্তু তাতে শরিয়াহর সামগ্রিক নৈতিক কাঠামো বা সামাজিক প্রভাব কি প্রকৃতপক্ষে বৃদ্ধি পেয়েছে, নাকি তা শুধুই রাজনৈতিক আপস ও সত্তা-খর্বকরণ, এই প্রশ্ন অনিবার্যভাবে ওঠে।
আরেকদিকে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা স্পষ্টভাবে এক সেক্যুলার আধুনিক জাতি-রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যেই আবদ্ধ। নির্বাচন, সংসদ, বিচারব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র—সবকিছু এমন এক কাঠামোতে পরিচালিত হয়, যেখানে ইসলামী নৈতিকতা বা ন্যায়ভিত্তিক শাসনের ধারণা প্রায় অনুপস্থিত। রাজনৈতিক দলগুলোর মুখে ইসলামী ভাষা থাকলেও বাস্তবতায় তারা বারবার ক্ষমতা দখলের খেলায় অংশগ্রহণ করে—জনগণের শাসন নয়, ক্ষমতার স্থায়িত্বই তাদের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আর এখানে ওলামাদের ভূমিকা, ইতিহাসের মতোই দ্বৈত ও বিতর্কিত। একদিকে কিছু আলেম সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে কথা বলেন, অন্যদিকে অনেকেই রাজনৈতিক দল বা স্বার্থগোষ্ঠীর হয়ে ফতোয়া দেন, মঞ্চে বসেন, ও চুপ থাকেন। রাজনীতির বৈধতা অর্জনে ওলামা সমাজকে ব্যবহারের নজির বাংলাদেশেও আছে—কখনো ইসলামের নামে, কখনো ইসলামকে পেছনে রেখে। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে একধরনের আস্থাহীনতা ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে—যেখানে ইসলাম আছে, কিন্তু রাজনৈতিক পরিসরে নেই; শরিয়াহ আছে, কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে নেই; ওলামারা আছেন, কিন্তু কণ্ঠস্বর বিভক্ত ও প্রায়শই নীরব।
বাংলাদেশে ইসলামী চিন্তা এখনো মূলত আবেগ, সংস্কৃতি ও আনুষ্ঠানিকতা নির্ভর। শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে গণমাধ্যম, সবখানে ইসলাম একটি "অনুষঙ্গ" (token) হিসেবে ব্যবহৃত হয়, বাস্তব দিকনির্দেশনা বা রাষ্ট্রপরিচালনার মূল কাঠামো হিসেবে নয়। এমনকি দাওয়াহ, ইসলামী আন্দোলন, ও মসজিদভিত্তিক কার্যক্রমও অনেক সময় রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত ও নিরাপদ রেখার মধ্যে পরিচালিত হয়। ইসলামী আদর্শিক রাজনীতিচিন্তা যেটা এক সময় রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখেছিল, আজ তা রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখে বারবার পরাভূত হচ্ছে।
তবে এই চিত্র পুরোপুরি হতাশাজনকও নয়। বাংলাদেশে এখনো বিশাল সংখ্যক মানুষ ন্যায়ভিত্তিক, আদর্শিক রাজনীতির স্বপ্ন দেখে। তারা ইসলামকে শুধু নামাজ-রোজা নয়, বরং সামাজিক ন্যায়, দুর্নীতিমুক্ত শাসন, এবং জনকল্যাণের ভিত্তি হিসেবে দেখতে চায়। ইসলামী অর্থনীতি, জাকাতভিত্তিক পুনর্বন্টন, ইসলামি শিক্ষানীতির দাবি—এসব এখনো সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থান পায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই আদর্শগুলো কি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কাঠামোয় স্থান পাবে, নাকি কেবল মঞ্চ ও ওয়াজের কথা হয়ে থাকবে?
অতএব, বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা এক নিখুঁত প্রতিবিম্ব—ইসলামী সভ্যতার সেই চিরায়ত দ্বন্দ্বের। যেখানে শরিয়াহ এখনো মানুষের হৃদয়ে স্থান পায়, কিন্তু রাষ্ট্রচালনার কাঠামোতে কার্যকর নয়; যেখানে ওলামা এখনো সম্মানিত, কিন্তু তাঁদের কণ্ঠ প্রায়শই রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ নয়; যেখানে জনগণ ইসলাম চায়, কিন্তু তারা পায় আধুনিক, বিচ্ছিন্ন, ও প্রায়শই বৈদেশিক ধারণার রাষ্ট্রতন্ত্র।
এই অবস্থায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দায়িত্ব হবে—এই বিচ্ছিন্নতাকে চিহ্নিত করা, ইতিহাসের পাঠ থেকে শিখে নতুন এক ইসলামিক চিন্তা ও কাঠামো নির্মাণ করা—যেখানে শরিয়াহ কেবল ব্যক্তি আচরণ নয়, বরং রাষ্ট্রপরিচালনার মূল ভিত্তি হবে; এবং যেখানে ওলামা হবেন কেবল শরিয়াহর ভাষ্যকার নয়, বরং ন্যায় ও আদর্শের সত্যনিষ্ঠ পথপ্রদর্শক।
এর মধ্যেই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে—যে শক্তি এত দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্র ছাড়াই আইনকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে, সেই শক্তির মাঝে এখনো ভবিষ্যতের সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। ইসলামী সভ্যতা আজ যদি রাজনৈতিক দিক দিয়ে পুনর্জন্ম ঘটাতে চায়, তবে তা কেবল ঐতিহাসিক নস্টালজিয়া নয় বরং নৈতিক শুদ্ধি, বাস্তববোধ, ও প্রাতিষ্ঠানিক নবায়নের মাধ্যমে হতে হবে। এখানে ওলামাদের দায়িত্ব যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সাধারণ মুসলমানদের সচেতনতাও অপরিহার্য।
অতএব, ইসলামী সভ্যতা আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক অনন্য নজির ও এক অপূর্ণ অধ্যায় নিয়ে—যেখানে আইন ও নৈতিকতা তার শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছে, অথচ রাজনীতি বারবার সেই আদর্শকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। এই দ্বৈত বাস্তবতার মাঝে দিয়ে যদি আমরা সত্যিকারের পরিবর্তনের পথ খুঁজে নিতে পারি, তাহলে হয়তো নতুন করে লেখা যেতে পারে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও স্থিতিশীল উম্মাহর ইতিহাস।
ইসলামী সভ্যতাকে তাই "nomocratic and nomocentric" বলা হয়ে থাকে—যেখানে শরিয়াহ শুধুই আইন নয়, বরং একটি মূল্যভিত্তিক সামাজিক চুক্তি, যা ব্যক্তি থেকে সমাজ এবং সমাজ থেকে রাষ্ট্র—সবকিছুকে সংজ্ঞায়িত করে। এটা এমন এক কাঠামো, যা যুগে যুগে মসজিদ, মাদ্রাসা, ক্বাযী আদালত, ওলামা-মুফতিদের ফতোয়া ও পরামর্শের মাধ্যমে মানুষের জীবনযাপনকে ন্যায়, আমানত, ও তাওয়াক্কুলের ছাঁচে গড়ে তুলেছে। এখানে রাষ্ট্র ছিল না সব কিছুর কেন্দ্র; বরং আইন ও নৈতিকতা ছিল সমাজের কাণ্ডারী। রাষ্ট্রপ্রধান যদি অনুপস্থিত থাকত বা দুর্বল হত, তবুও সমাজ চলত; কারণ শরিয়াহ ছিল মানুষের অন্তর ও লেনদেনে উপস্থিত।
এই শক্তিশালী আইনভিত্তিক সভ্যতার পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক গভীর রাজনৈতিক সংকটের ইতিহাস। ইসলামী রাজনৈতিক কাঠামো কখনোই এমনভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি যাতে একটানা ও ন্যায়ভিত্তিক শাসনের নিশ্চয়তা থাকে। খিলাফতের আদর্শকে যতই মহিমান্বিত করা হোক না কেন, ইতিহাস বলে—উমাইয়্য, আব্বাসীয় কিংবা উসমানীয় শাসনের ভেতরে অসংখ্য বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান, উত্তরাধিকার নিয়ে রক্তক্ষয়, এমনকি ভাইয়ের হাতে ভাইয়ের হত্যাকাণ্ড ইসলামী রাজনৈতিক বাস্তবতাকে কণ্টকিত করেছে। রাজনৈতিক বৈধতা লাভের জন্য যাঁরা শুধু বংশপরম্পরা নয় বরং ধর্মীয় অনুমোদন (religious legitimation) চেয়েছেন, তাঁরা বহু সময়েই ওলামাদের দ্বারে গিয়েছেন। এবং সেই দরজায় ওলামা কখনো ন্যায়ের দিক থেকে, কখনো স্বার্থের দিক থেকে, আবার কখনো কেবল প্রাণরক্ষার তাগিদে—দখলদারদেরকে “ইমাম” বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এর ফলে ধর্মীয় আদর্শ যেমন ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে, তেমনি ওলামা সমাজও রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
সমস্যাটা এখানেই শেষ নয়। এই দ্বৈত ভূমিকা, যেখানে একদিকে ওলামারা উচ্চ নৈতিকতা ও আদর্শচিন্তা নিয়ে এক বাস্তবতাবর্জিত ধারণা লালন করেছেন, আবার অন্যদিকে রাজনৈতিক সুবিধাবাদে শরিক হয়েছেন—তা একটি গভীর আস্থাহীনতা সৃষ্টি করেছে মুসলিম জনগণের মাঝে। একদিকে তাদের সামনে ছিল এক স্বপ্নময় খিলাফতের কল্পনা, যা “খুলাফায়ে রাশেদীন”-এর মতো ন্যায়পরায়ণ, অন্যদিকে বাস্তবে তারা দেখেছে দুর্নীতি, জবরদস্তি, ও ধর্মের নামে রাজনীতি। এই বিচ্ছিন্নতা (dislocation) শুধুমাত্র ইতিহাসের ঘটনা নয়, বরং মুসলিম মননে গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে।
এই আলোচনা যদি আমরা বর্তমানের প্রেক্ষাপটে নিয়ে আসি, তাহলে দেখা যাবে এই দ্বৈত বাস্তবতা এখনো আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আজকের আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের (nation-state) কাঠামোতে ইসলামী আইন প্রায় কোথাও পূর্ণভাবে কার্যকর নয়। অনেক মুসলিম রাষ্ট্রে শরিয়াহ একটি প্রতীক মাত্র, একটি সাংস্কৃতিক পরিচয় বা সংবিধানের “প্রস্তাবনামূলক ভাষা”—কিন্তু বাস্তবে ব্যবস্থাপনার কেন্দ্রবিন্দু নয়। উদাহরণস্বরূপ, সৌদি আরবে শরিয়াহর নামে যে আইন প্রয়োগ হয়, তা অনেক সময়ে ক্ষমতাসীন রাজপরিবারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও স্বার্থানুযায়ী পরিচালিত হয়, না যে তা সর্বদা আদর্শিকভাবে ওলামাদের তত্ত্ব অনুযায়ী হয়। আবার পাকিস্তান বা মিসরের মতো দেশে ইসলামিক আইনকে অনেক সময় রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্র ও আধুনিক আইনি কাঠামোর ভেতর একটি নিয়ন্ত্রিত ও সীমানাবদ্ধ সংস্করণ হিসেবে দেখা যায়।
অপরদিকে, মুসলিম বিশ্বে এখনো এমন বহু গোষ্ঠী আছে, যারা খিলাফতের কল্পনা নিয়ে রাজনীতি করে বা ইসলামিক রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—তাদের রাজনৈতিক চিন্তা কি বাস্তববাদী? তারা কি ঐতিহাসিক ব্যর্থতাগুলো থেকে শিক্ষা নিচ্ছে, নাকি কেবল সোনালি অতীতের রোমান্টিক পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চাইছে?
বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি এই ইসলামী সভ্যতা সংক্রান্ত আলোচনাকে প্রাসঙ্গিক করা হয়, তাহলে আমরা এক গভীর দ্বৈত বাস্তবতার মুখোমুখি হই—যেটা ইসলামী ইতিহাসের আলোচনার সাথেও চমৎকারভাবে মিলে যায়। এখানে একদিকে শরিয়াহ ও ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি জনগণের প্রবল আবেগ ও আনুগত্য রয়েছে, অপরদিকে রাষ্ট্রব্যবস্থা, প্রশাসনিক কাঠামো ও আইনি পরিকাঠামো মূলত একটি সেক্যুলার, উপনিবেশিক উত্তরাধিকারভিত্তিক সিস্টেমে আবদ্ধ।
বাংলাদেশের সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। অনেকেই একে ইসলামের বিজয় হিসেবে উপস্থাপন করেন, কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এটি মূলত একটি প্রতীকী ঘোষণা, যার কার্যকর অনুবাদ রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় খুবই সীমিত। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা এখনো ইংরেজি কমন ল’ (common law) ও ব্রিটিশ উপনিবেশিক ধাঁচে গঠিত, যেখানে শরিয়াহ মূলত পারিবারিক আইন (personal law) যেমন—বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার—এই ক্ষেত্রগুলোতেই সীমাবদ্ধ।
শরিয়াহভিত্তিক বিচারব্যবস্থার ব্যাপক কার্যকারিতা এখানে নেই, এবং যেখানে তা আছে, সেখানেও নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক বিবেচনায় তা প্রায়শই বিকৃত বা সীমাবদ্ধভাবে প্রয়োগ হয়। এমনকি ইসলামী আইনব্যবস্থার দাবিদার অনেক প্রতিষ্ঠানও—যেমন কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা—রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে, কিন্তু তাতে শরিয়াহর সামগ্রিক নৈতিক কাঠামো বা সামাজিক প্রভাব কি প্রকৃতপক্ষে বৃদ্ধি পেয়েছে, নাকি তা শুধুই রাজনৈতিক আপস ও সত্তা-খর্বকরণ, এই প্রশ্ন অনিবার্যভাবে ওঠে।
আরেকদিকে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা স্পষ্টভাবে এক সেক্যুলার আধুনিক জাতি-রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যেই আবদ্ধ। নির্বাচন, সংসদ, বিচারব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র—সবকিছু এমন এক কাঠামোতে পরিচালিত হয়, যেখানে ইসলামী নৈতিকতা বা ন্যায়ভিত্তিক শাসনের ধারণা প্রায় অনুপস্থিত। রাজনৈতিক দলগুলোর মুখে ইসলামী ভাষা থাকলেও বাস্তবতায় তারা বারবার ক্ষমতা দখলের খেলায় অংশগ্রহণ করে—জনগণের শাসন নয়, ক্ষমতার স্থায়িত্বই তাদের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আর এখানে ওলামাদের ভূমিকা, ইতিহাসের মতোই দ্বৈত ও বিতর্কিত। একদিকে কিছু আলেম সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে কথা বলেন, অন্যদিকে অনেকেই রাজনৈতিক দল বা স্বার্থগোষ্ঠীর হয়ে ফতোয়া দেন, মঞ্চে বসেন, ও চুপ থাকেন। রাজনীতির বৈধতা অর্জনে ওলামা সমাজকে ব্যবহারের নজির বাংলাদেশেও আছে—কখনো ইসলামের নামে, কখনো ইসলামকে পেছনে রেখে। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে একধরনের আস্থাহীনতা ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে—যেখানে ইসলাম আছে, কিন্তু রাজনৈতিক পরিসরে নেই; শরিয়াহ আছে, কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে নেই; ওলামারা আছেন, কিন্তু কণ্ঠস্বর বিভক্ত ও প্রায়শই নীরব।
বাংলাদেশে ইসলামী চিন্তা এখনো মূলত আবেগ, সংস্কৃতি ও আনুষ্ঠানিকতা নির্ভর। শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে গণমাধ্যম, সবখানে ইসলাম একটি "অনুষঙ্গ" (token) হিসেবে ব্যবহৃত হয়, বাস্তব দিকনির্দেশনা বা রাষ্ট্রপরিচালনার মূল কাঠামো হিসেবে নয়। এমনকি দাওয়াহ, ইসলামী আন্দোলন, ও মসজিদভিত্তিক কার্যক্রমও অনেক সময় রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত ও নিরাপদ রেখার মধ্যে পরিচালিত হয়। ইসলামী আদর্শিক রাজনীতিচিন্তা যেটা এক সময় রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখেছিল, আজ তা রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখে বারবার পরাভূত হচ্ছে।
তবে এই চিত্র পুরোপুরি হতাশাজনকও নয়। বাংলাদেশে এখনো বিশাল সংখ্যক মানুষ ন্যায়ভিত্তিক, আদর্শিক রাজনীতির স্বপ্ন দেখে। তারা ইসলামকে শুধু নামাজ-রোজা নয়, বরং সামাজিক ন্যায়, দুর্নীতিমুক্ত শাসন, এবং জনকল্যাণের ভিত্তি হিসেবে দেখতে চায়। ইসলামী অর্থনীতি, জাকাতভিত্তিক পুনর্বন্টন, ইসলামি শিক্ষানীতির দাবি—এসব এখনো সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থান পায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই আদর্শগুলো কি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কাঠামোয় স্থান পাবে, নাকি কেবল মঞ্চ ও ওয়াজের কথা হয়ে থাকবে?
অতএব, বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা এক নিখুঁত প্রতিবিম্ব—ইসলামী সভ্যতার সেই চিরায়ত দ্বন্দ্বের। যেখানে শরিয়াহ এখনো মানুষের হৃদয়ে স্থান পায়, কিন্তু রাষ্ট্রচালনার কাঠামোতে কার্যকর নয়; যেখানে ওলামা এখনো সম্মানিত, কিন্তু তাঁদের কণ্ঠ প্রায়শই রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ নয়; যেখানে জনগণ ইসলাম চায়, কিন্তু তারা পায় আধুনিক, বিচ্ছিন্ন, ও প্রায়শই বৈদেশিক ধারণার রাষ্ট্রতন্ত্র।
এই অবস্থায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দায়িত্ব হবে—এই বিচ্ছিন্নতাকে চিহ্নিত করা, ইতিহাসের পাঠ থেকে শিখে নতুন এক ইসলামিক চিন্তা ও কাঠামো নির্মাণ করা—যেখানে শরিয়াহ কেবল ব্যক্তি আচরণ নয়, বরং রাষ্ট্রপরিচালনার মূল ভিত্তি হবে; এবং যেখানে ওলামা হবেন কেবল শরিয়াহর ভাষ্যকার নয়, বরং ন্যায় ও আদর্শের সত্যনিষ্ঠ পথপ্রদর্শক।
এর মধ্যেই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে—যে শক্তি এত দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্র ছাড়াই আইনকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে, সেই শক্তির মাঝে এখনো ভবিষ্যতের সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। ইসলামী সভ্যতা আজ যদি রাজনৈতিক দিক দিয়ে পুনর্জন্ম ঘটাতে চায়, তবে তা কেবল ঐতিহাসিক নস্টালজিয়া নয় বরং নৈতিক শুদ্ধি, বাস্তববোধ, ও প্রাতিষ্ঠানিক নবায়নের মাধ্যমে হতে হবে। এখানে ওলামাদের দায়িত্ব যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সাধারণ মুসলমানদের সচেতনতাও অপরিহার্য।
অতএব, ইসলামী সভ্যতা আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক অনন্য নজির ও এক অপূর্ণ অধ্যায় নিয়ে—যেখানে আইন ও নৈতিকতা তার শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছে, অথচ রাজনীতি বারবার সেই আদর্শকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। এই দ্বৈত বাস্তবতার মাঝে দিয়ে যদি আমরা সত্যিকারের পরিবর্তনের পথ খুঁজে নিতে পারি, তাহলে হয়তো নতুন করে লেখা যেতে পারে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও স্থিতিশীল উম্মাহর ইতিহাস।