Announcement

Collapse
No announcement yet.

বিকাশের (Bkash) ধারা: শেষ থেকে শুরুর পথে।

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • বিকাশের (Bkash) ধারা: শেষ থেকে শুরুর পথে।

    ভোগবাদের যুগে
    (In the Age of Consumption)


    ভোগবাদের যুগ বলতে বোঝানো হয় এমন একটি সময় ও সাংস্কৃতিক ধারা, যেখানে মানুষের পরিচিতি, সাফল্য, ও সুখ পরিমাপ করা হয় তারা কতটা ভোগ করে, কতটা পণ্য কিনে, কতটা ব্যয় করে—এই দিয়ে। মানুষ নিজেকে প্রকাশ করে ব্র্যান্ডেড পোশাক, দামি গ্যাজেট, বিলাসবহুল গাড়ি বা বিদেশভ্রমণের মাধ্যমে। প্রয়োজনকে ছাড়িয়ে গিয়ে চাহিদা তৈরি করা এবং এই কৃত্রিম চাহিদার পেছনে মানুষকে ছুটিয়ে রাখা—এটাই ভোগবাদ। এখানে বস্তুই হচ্ছে মানদণ্ড, আর মানুষ পরিণত হয় এক ধরনের ‘পণ্য-গ্রহীতা রোবট’-এ।

    ভোগবাদ—এটি কোনো নিরীহ জীবনধারা নয়, বরং একটি সুপরিকল্পিত, দার্শনিকভাবে ভিত্তিশীল, এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে প্রণয়নকৃত ব্যবস্থা, যার গোড়াপত্তন হয়েছিল গ্রেট ডিপ্রেশনের পরবর্তী সময়টিতে। ১৯২৯ সালের অক্টোবর মাসে শুরু হওয়া এই ভয়াবহ মন্দা পশ্চিমা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার তাবৎ দুর্বলতাকে উন্মোচন করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা জগতে উৎপাদনশীলতা ছিল চরম মাত্রায়, কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ছিল সেই তুলনায় খুব কম। ফলাফল: পণ্য জমা হয়ে পড়ে গুদামে, শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যায়, এবং এক অসহনীয় বেকারত্ব ও দারিদ্র্য সারা সমাজে ছড়িয়ে পড়ে।

    এই পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদ, সমাজতাত্ত্বিক ও কর্পোরেট নেতারা নতুন এক ধারণার আশ্রয় নেয়—মানুষকে এমনভাবে পরিবর্তন করতে হবে যেন সে কেবল প্রয়োজন নয়, চাহিদার দাস হয়ে ওঠে। তার জীবনযাপন এমন হতে হবে যেন সে কেবল ভোগ করার জন্যই বেঁচে থাকে। এভাবেই শুরু হয় আধুনিক কনজিউমার কালচারের সূচনা, যার সবচেয়ে প্রভাবশালী রূপকারদের মধ্যে একজন ছিল এডওয়ার্ড বার্নেইস (Edward Bernays)—সিগমুন্ড ফ্রয়েডের (যারা মতে পৃথিবীর সবকিছুই যৌনতার সাথে সম্পৃক্ত) ভাগ্নে। বার্নেইস ছিল “public relations (জনসংযোগ)” ধারণার জনক এবং বিজ্ঞাপন ও প্রোপাগান্ডার আধুনিক রূপকার।

    বার্নেইস ও তাঁর সহযোদ্ধারা ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্ব ব্যবহার করে মার্কিন জনগণের চেতনায় ঢুকিয়ে দেয় এক নতুন বার্তা: তুমি যা চাও, সেটাই তুমি। যদি তুমি নতুন গাড়ি চাও, তাহলে তা মানে তুমি একজন সফল মানুষ; যদি তুমি নতুন ফ্যাশন ট্রেন্ড ধরতে না পারো, তাহলে তুমি পশ্চাদপদ। এই মনস্তাত্ত্বিক প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে একজন 'সাবজেক্ট' কে পরিণত করা হয় 'কনজিউমার'-এ।

    ১৯৫৫ সালে মার্কিন সমাজবিদ Victor Lebow লিখেছিল এক ঐতিহাসিক ঘোষণা:


    “Our enormously productive economy demands that we make consumption our way of life... We need things consumed, burned up, replaced and discarded at an ever-accelerating rate.”

    “আমাদের অত্যন্ত উৎপাদনশীল অর্থনীতি দাবি করে যে আমরা ভোগকে আমাদের জীবনের ধারা বানিয়ে নিই... আমাদের এমন একটি সমাজ দরকার যেখানে জিনিসপত্র ক্রমাগত ব্যবহৃত হবে, পুরে ফেলা হবে, বদলানো হবে, ও ফেলে দেওয়া হবে ক্রমবর্ধমান গতিতে।”
    Journal of Retailing (Spring 1955)
    article titled “Price Competition in 1955”


    এটি নিছক এক পর্যবেক্ষণ নয়, এটি ছিল এক ধরনের “সামাজিক নির্দেশনা”। অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে মানুষকে সারাক্ষণ ব্যস্ত রাখতে হবে নতুন কিছু কিনতে, পুরাতন কিছু ছুঁড়ে ফেলতে। যে সমাজ এই খেলায় অংশ নেবে না, সে অর্থনৈতিকভাবে ‘আধুনিক’ হতে পারবে না।

    এই চিন্তা পুঁজিবাদকে রক্ষা করেছিল, কিন্তু মানবতার ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল এক প্রলয়ঙ্কর সংস্কৃতি। পশ্চিমা সমাজ এই ভোগবাদকে কেবল অর্থনৈতিক কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেনি, বরং এটি রূপ নেয় এক ধরণের ধর্মীয় বিকল্পে—যেখানে সুপারমার্কেট হয় মন্দির, বিজ্ঞাপন হয় খুতবা, এবং ক্রেডিট কার্ড হয় তওবা-বিহীন আনন্দের টিকেট। Jean Baudrillard, একজন ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক বলেন,


    “We live in a world where there is more and more information, and less and less meaning.”
    “আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করছি, যেখানে তথ্য প্রতিনিয়ত বাড়ছে, কিন্তু অর্থ বা তাৎপর্য ক্রমশ কমে যাচ্ছে।”
    — সিম্যুলাকরা অ্যান্ড সিম্যুলেশন (১৯৮১)

    তিনি দেখান কিভাবে বিজ্ঞাপন ও চিত্রভাষা মানুষকে এমন এক জগতে ফেলে দেয়, যেখানে প্রতীকই বাস্তবতার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

    এই ভোগবাদ চালু করে পশ্চিমারা কেবল তাদের শিল্প ও অর্থনীতি বাঁচায়নি, বরং একধরনের নব্য-ঔপনিবেশিক শক্তি অর্জন করেছে। তারা তৃতীয় বিশ্বের বাজারগুলোকে তাদের পণ্যের জন্য খুলে দেয়—কিন্তু শুধু পণ্য বিক্রির জন্য নয়, বরং মূল্যবোধ ও জীবনধারাও রপ্তানি করে। তারা অন্য জাতিগুলোর মধ্যে এমন এক ‘কমপ্লেক্স’ ঢুকিয়ে দেয়, যেন পশ্চিমা জীবনযাপনই শ্রেষ্ঠ, এবং তা অনুসরণ করাই আধুনিকতার মাপকাঠি। ফলে বিশ্বজুড়ে এক ‘ইমিটেশন কালচার’ গড়ে ওঠে, যেখানে প্রত্যেকে পশ্চিমা জীবনধারার কপি হতে চায়।

    মুসলিম উম্মাহ এই ভোগবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল না। কারণ উম্মাহ তখন ঔপনিবেশিক শাসন থেকে সদ্য মুক্ত হলেও, সাংস্কৃতিকভাবে এখনো পরাধীন ছিল। পশ্চিমা আধুনিকতা, উন্নয়ন, প্রযুক্তি, এবং ‘লাইফস্টাইল’—সব কিছু মুসলমানদের কাছে ছিল ঈর্ষণীয় ও অনুকরণযোগ্য। ফলে মুসলিম সমাজে এক বিক্ষিপ্ত, দিশেহারা মনস্তত্ত্ব তৈরি হয়: একদিকে কুরআনের শিক্ষা ও সন্ন্যাসের অনুপ্রেরণা, অপরদিকে বিলবোর্ড ও বিজ্ঞাপনের চিৎকার।

    ভোগবাদ কেবল মুসলমানদের অর্থনীতি নয়, তাদের পরিবার, সংস্কৃতি ও আত্মিক কাঠামোকে ভেঙে দিয়েছে। পরিবার ভেঙে পড়েছে, কারণ সুখের সংজ্ঞা হয়ে গেছে জিনিসপত্রে; বাবা-মা সন্তানদের সময় দেন না, কিন্তু দামি উপহার দেন। নারীদেরকে টেনে আনা হয়েছে বাজারের কেন্দ্রস্থলে—ভোগের পণ্য হিসেবে নয়, বরং ভোগ তৈরির একটি যন্ত্র হিসেবে। Hijab (হিজাব) বা Modesty (লজ্জাশীলতা)'র ধারণাকে বানানো হয়েছে পশ্চাদপদতার প্রতীক। মুসলিম নারীদের এমন একটি পরিচয়ে পরিণত করা হয়েছে, যেখানে তাদের সৌন্দর্য ও শরীরই হয় ‘সামাজিক মুদ্রা’।

    মুসলিম যুবসমাজ নিজেদের পরিচয় ভুলে গিয়ে ‘কনজিউমার আইডেন্টিটি’ গ্রহণ করে। ইসলাম যেখানে জান্নাতকে উদ্দেশ্য করে মানুষকে ‘আখিরাহমুখী’ বানায়, সেখানে ভোগবাদ মানুষকে করে ‘দুনিয়ামুখী’। মোবাইল ফোন, ভিডিও গেম, ব্র্যান্ডেড পোশাক, প্রমোদভ্রমণ—এসব জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। ইসলামী সভ্যতার মৌলিক ভিত্তি—আখলাক, কনটেন্টমেন্ট (কানাআত), তাকওয়া, তাওয়াক্কুল, জুহদ—সবই হারিয়ে যেতে থাকে।

    সামগ্রিকভাবে মুসলমানদের মধ্যে এক স্থায়ী অসন্তুষ্টি তৈরি হয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লার দেয়া রিজিকের ওপর ভরসা করার বদলে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে আরো আরো উপার্জন, বিলাসিতা, ঋণ, প্রতিযোগিতা আর হিংসায়। মুসলমানদের সামগ্রিক চিন্তা-চেতনায় ‘আখিরাত’ এর ধারণা প্রায় হারিয়ে গেছে। অথচ, ইসলামী জীবনব্যবস্থা মানুষকে তৈরি করতো এমন এক রুহানী ও আত্মসন্তুষ্ট মুমিন হিসেবে, যে দুনিয়াকে দেখে পরীক্ষার জায়গা হিসেবে—Not an amusement park.

    আর এই ভোগবাদ, যার জন্ম হয়েছিল পুঁজিবাদী চরম সংকটের এক প্রতিক্রিয়ায়, তা আজ পরিণত হয়েছে একটি বিশ্বব্যাপী সংস্কৃতিতে—যা মুসলমানদের মন, সমাজ ও রাষ্ট্রকে করে তুলেছে এমন এক ব্যবস্থার অংশ, যার মূল দর্শনই হলো: "Consume, obey, repeat."

    “ভোগ করো, আনুগত্য করো, পুনরাবৃত্তি করো।”


    পশ্চিমা দার্শনিক Slavoj Žižek একবার বলেছিল,

    “We feel free because we lack the very language to articulate our unfreedom.”

    “আমরা নিজেদেরকে মুক্ত মনে করি, কারণ আমাদের নেই সেই ভাষাই — যা দিয়ে আমরা আমাদের অমুক্তির কথাটি প্রকাশ করতে পারতাম।”
    - Welcome to the Desert of the Real: Five Essays on September 11 and Related Dates (Page-2)

    ভোগবাদ ঠিক এভাবেই কাজ করে। সে মানুষকে বুঝতে দেয় না যে সে দাস হয়ে গেছে—এক প্রকার নিঃশব্দ দাসত্ব।

    সুতরাং, গ্রেট ডিপ্রেশনের পর পশ্চিমা পুঁজিবাদ নিজেকে বাঁচাতে ভোগবাদকে অস্ত্র বানিয়ে চালু করে এক ধ্বংসাত্মক সভ্যতা—যার ভেতরে ঢুকে আজ মুসলিম উম্মাহ তাদের প্রকৃত রুহানিয়াত, আত্মিক আত্মসম্মান ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলছে।




    নোট: যারা আমার "বিকাশ (Bkash) ধারা" বিষয়ক লেখাটি পড়েছেন, তারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে আমি লেখাটির বর্ণনা ক্রমে সাধারণ ধারার বিপরীতে গিয়েছি—অর্থাৎ শুরু থেকে শেষের দিকে না গিয়ে, শেষদিকের চিন্তা থেকেই আলোচনা শুরু করেছি। এর একটি বড় কারণ হলো আমার নিজস্ব সীমাবদ্ধতা ও অজ্ঞতা।

    আমি প্রথমে মনে করেছিলাম যে একটি পর্বই যথেষ্ট হবে আমার বক্তব্য ও উদ্বেগ পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। কিন্তু সেই প্রথম পর্ব প্রকাশের পর, যখন নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হলাম, তখন উপলব্ধি করলাম—আমি নিজেই যেখানে মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি ও সম্পৃক্ততার কথা বলি, সেই জায়গায় আমার নিজের মধ্যেই কিছু ঘাটতি ও ব্যর্থতা রয়ে গেছে।

    এই উপলব্ধি থেকেই আমি লেখার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার প্রয়োজন অনুভব করেছি। আমি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে দোয়া করি, তিনি যেন আমার অজ্ঞতা দূর করে দেন এবং মানুষকে সচেতন করার এ প্রয়াসে আমার ব্যক্তিগত ভুলভ্রান্তিগুলো সংশোধনের তাওফিক দান করেন।
    আমীন।​
    فَاَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ وَ انۡتَظِرۡ اِنَّهُمۡ مُّنۡتَظِرُوۡنَ

  • #2
    জ্বি ভাই, আপনি যদি এই গ্রেট ডিপ্রেশনের কথা আগে তুলে আনতেন, তারপর পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা তৈরির পিছনের ইতিহাস আনতেন, তারপর অর্থনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে বলতেন, তাহলে বিষয়গুলো বুঝতে কোন সমস্যাই হতো না।
    এখন ধরতে পারছি সমস্যার গোঁড়া কোথায়। জাযাকাল্লাহ খাইরান। আল্লাহ তাআলা আপনার ইলম ও ফাহাম বাড়িয়ে দিন, আমীন
    বছর ফুরিয়ে যাবে এতো রিসোর্স আছে https://gazwah.net সাইটে

    Comment


    • #3
      ভাই, আপনার এই লিখাগুলো সব একত্র করে বই আকারে পাবলিশ করা বা পিডিএফ আনার অনুরোধ করছি।
      তখন বইয়ে এই ক্রমানুসারে বিষয়গুলো সাজালে উত্তম হবে বলে মনে করছি।
      আল্লাহ তাআলা সহজ করুন, আমীন
      বছর ফুরিয়ে যাবে এতো রিসোর্স আছে https://gazwah.net সাইটে

      Comment


      • #4
        Sabbir Ahmed ভাই,

        আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ

        ভাই, আপনার এই লিখাগুলো সব একত্র করে বই আকারে পাবলিশ করা বা পিডিএফ আনার অনুরোধ করছি।
        ভাই, আমার কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে এটা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু, যেহুতু আমি আমার চিন্তা ফোরামে বা প্রকাশে আলোচনা করছি তাই আপনারা আপনার অবস্থান থেকে এই কথাগুলো মানুষের মাঝে পৌছানোর চেষ্টা করুন।

        আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লার আমাদের চেষ্টাগুলো কবুল করুন।

        ​​​​​
        فَاَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ وَ انۡتَظِرۡ اِنَّهُمۡ مُّنۡتَظِرُوۡنَ

        Comment

        Working...
        X