প্রশ্ন: যদি ইসলাম সত্যিই এমন এক সমাজ গড়ে তুলতে সফল হয়, যেখানে উদ্ভাবন ছিল, অগ্রগতি ছিল, এবং যা সংস্কৃতি, সভ্যতা ও বিজ্ঞান সৃষ্টি করেছিল—তাহলে আমরা কেন সবকিছু ছেড়ে পাশ্চাত্য আধুনিকতাকে গ্রহণ করলাম? এই গ্রহণের পেছনে মূল কারণটা কী?
উত্তর: অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী প্রশ্ন এটি। এর সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর ব্যাখ্যা আমরা পাই মিসরের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ মুস্তাসফা সাবের (রাহিমাহুল্লাহ) কথায়, যিনি তাঁর বিশাল গবেষণামূলক রচনায়—বিশেষত ১৯৫০-এর দশকে রচিত আধুনিকতা ও তথাকথিত ‘ইসলামি আধুনিকতার’ সমালোচনায়—এই প্রশ্নটির মূলে গিয়ে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন আসল ব্যথার জায়গাটি। তিনি বলেন,
আমাদের সেই আত্মার গভীরে বিঁধে যাওয়া পরাজয়ের বেদনা, সম্মানের ক্ষয়, আত্মমর্যাদার চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়া—সবকিছু মিলে একধরনের মানসিক জড়তা ও হীনম্মন্যতা তৈরি করেছিল। সেই মূহূর্তে মুসলিম বিশ্ব যেন বিশ্বাস করতে শুরু করল:
এমন নয় যে পাশ্চাত্য সমাজে কোনো অগ্রগতি হয়নি। হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নানা শাখায় চমকপ্রদ সফলতা অর্জন করেছে। কিন্তু আমরা ভুল করেছিলাম এই অগ্রগতিকে 'নিরপেক্ষ' বা 'সার্বজনীন সত্য' বলে ধরে নেওয়ার মধ্যে। আমরা ভাবলাম, বিজ্ঞান তো কেবল নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ, এবং যুক্তি—তাতে আদর্শ বা দৃষ্টিভঙ্গির কী আসার আছে? অথচ ব্যাপারটা এত সরল নয়।
এই বিভ্রান্তি দূর করতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে সেই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণের দিকে, যখন ১৭শ শতকের ‘বৈজ্ঞানিক বিপ্লব’ (Scientific Revolution) পাশ্চাত্য সভ্যতার জ্ঞানচর্চার রূপরেখা আমূল পাল্টে দিয়েছিল। সেই সময় একটি গভীর দার্শনিক রূপান্তর ঘটে: মানুষ প্রকৃতিকে দেখা বন্ধ করে দেয় আল্লাহর নিদর্শন (আয়াত) হিসেবে। আগে প্রকৃতি ছিল এক ধরনের “তাওহিদি আয়না”—যার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর অস্তিত্ব, গুণাবলি ও মহিমার ছায়া দেখতে পেতাম। আল-কুরআন বারবার আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে বলে “আফাক” (দিগন্তে) ও “আনফুস” (আত্মার ভেতর) থাকা আয়াতগুলোর দিকে। ইসলামি সভ্যতায় প্রকৃতির জ্ঞান মানে ছিল আল্লাহর প্রতি গভীর অনুগত্য ও চিন্তার উৎকর্ষে পৌঁছানো। জ্ঞান ছিল ইবাদতেরই এক রূপ।
এই দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রযুক্তি ও ব্যবহারিক প্রয়োগের জায়গা ছিল, কিন্তু তা ছিল গৌণ—মূল লক্ষ্য ছিল আত্মিক শুদ্ধি, ঈমানের দৃঢ়তা, এবং মহাবিশ্বের নির্মাতা সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি।
কিন্তু পাশ্চাত্য সভ্যতা সেই পথ ছেড়ে নতুন এক পদ্ধতিগত ও দার্শনিক ধারা গ্রহণ করল। এখন প্রকৃতি আর “আয়াত” নয়, বরং "উপাদান মাত্র"—যাকে আমরা যত ইচ্ছা শোষণ, ব্যবহার ও বদলাতে পারি। Brad Gregory একে বীভৎস ভাবে বর্ণনা করেছে:
এই দৃষ্টিভঙ্গি বলছে: “প্রকৃতির কোনো আত্মা নেই, কোনো তাওহিদি তাৎপর্য নেই, কোনো রহস্য নেই। এগুলো কেবল তোমার বিশ্বাস—ব্যক্তিগত ও অবান্তর। বাস্তবতা মানে হলো: কীভাবে তুমি প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে, শোষণ করবে, এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।”
এটাই হলো আধুনিক পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও অর্থনীতির ভিত্তি। এই বিজ্ঞান আর আরিফদের জ্ঞান নয়, এটা আর খুদা-ভীত শ্রদ্ধা নয়, বরং ‘মাস্টারি’—প্রকৃতির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ, যা মানুষকে খোদার আসনে বসিয়ে দেয়।
এখানেই প্রশ্নটা গভীরতর হয়ে যায়: আমরা কেন এই ধারা গ্রহণ করলাম? কারণ, আমরা আমাদের আত্মবিশ্বাস হারিয়েছিলাম। আমরা আমাদের ঐতিহ্য, ইতিহাস, এবং আত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচ্যুত হয়েছিলাম। আমরা ভাবলাম, আধুনিকতা কোনো নিরপেক্ষ ও স্বাভাবিক জিনিস—যা সবাইকে গ্রহণ করতেই হবে।
উত্তর: অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী প্রশ্ন এটি। এর সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর ব্যাখ্যা আমরা পাই মিসরের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ মুস্তাসফা সাবের (রাহিমাহুল্লাহ) কথায়, যিনি তাঁর বিশাল গবেষণামূলক রচনায়—বিশেষত ১৯৫০-এর দশকে রচিত আধুনিকতা ও তথাকথিত ‘ইসলামি আধুনিকতার’ সমালোচনায়—এই প্রশ্নটির মূলে গিয়ে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন আসল ব্যথার জায়গাটি। তিনি বলেন,
আমরা মুসলমানেরা একটি চরম বিভ্রান্তিতে পড়েছিলাম। আমরা মনে করেছিলাম যে, যেহেতু আমরা সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হয়েছি, অতএব পরাজিত শক্তির সবকিছুই সঠিক, কার্যকরী ও শ্রেষ্ঠ।
আমাদের সেই আত্মার গভীরে বিঁধে যাওয়া পরাজয়ের বেদনা, সম্মানের ক্ষয়, আত্মমর্যাদার চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়া—সবকিছু মিলে একধরনের মানসিক জড়তা ও হীনম্মন্যতা তৈরি করেছিল। সেই মূহূর্তে মুসলিম বিশ্ব যেন বিশ্বাস করতে শুরু করল:
"আমরাই ভুল পথে ছিলাম, পিছিয়ে পড়েছিলাম, আর ওরাই সামনে এগিয়েছে। অতএব আমাদের বাঁচতে হলে ওদের মতোই হতে হবে।"
এমন নয় যে পাশ্চাত্য সমাজে কোনো অগ্রগতি হয়নি। হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নানা শাখায় চমকপ্রদ সফলতা অর্জন করেছে। কিন্তু আমরা ভুল করেছিলাম এই অগ্রগতিকে 'নিরপেক্ষ' বা 'সার্বজনীন সত্য' বলে ধরে নেওয়ার মধ্যে। আমরা ভাবলাম, বিজ্ঞান তো কেবল নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ, এবং যুক্তি—তাতে আদর্শ বা দৃষ্টিভঙ্গির কী আসার আছে? অথচ ব্যাপারটা এত সরল নয়।
এই বিভ্রান্তি দূর করতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে সেই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণের দিকে, যখন ১৭শ শতকের ‘বৈজ্ঞানিক বিপ্লব’ (Scientific Revolution) পাশ্চাত্য সভ্যতার জ্ঞানচর্চার রূপরেখা আমূল পাল্টে দিয়েছিল। সেই সময় একটি গভীর দার্শনিক রূপান্তর ঘটে: মানুষ প্রকৃতিকে দেখা বন্ধ করে দেয় আল্লাহর নিদর্শন (আয়াত) হিসেবে। আগে প্রকৃতি ছিল এক ধরনের “তাওহিদি আয়না”—যার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর অস্তিত্ব, গুণাবলি ও মহিমার ছায়া দেখতে পেতাম। আল-কুরআন বারবার আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে বলে “আফাক” (দিগন্তে) ও “আনফুস” (আত্মার ভেতর) থাকা আয়াতগুলোর দিকে। ইসলামি সভ্যতায় প্রকৃতির জ্ঞান মানে ছিল আল্লাহর প্রতি গভীর অনুগত্য ও চিন্তার উৎকর্ষে পৌঁছানো। জ্ঞান ছিল ইবাদতেরই এক রূপ।
এই দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রযুক্তি ও ব্যবহারিক প্রয়োগের জায়গা ছিল, কিন্তু তা ছিল গৌণ—মূল লক্ষ্য ছিল আত্মিক শুদ্ধি, ঈমানের দৃঢ়তা, এবং মহাবিশ্বের নির্মাতা সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি।
কিন্তু পাশ্চাত্য সভ্যতা সেই পথ ছেড়ে নতুন এক পদ্ধতিগত ও দার্শনিক ধারা গ্রহণ করল। এখন প্রকৃতি আর “আয়াত” নয়, বরং "উপাদান মাত্র"—যাকে আমরা যত ইচ্ছা শোষণ, ব্যবহার ও বদলাতে পারি। Brad Gregory একে বীভৎস ভাবে বর্ণনা করেছে:
"প্রকৃতি হলো এমন এক কাঁচামাল, যা অপেক্ষা করে আছে আমাদের আকাঙ্ক্ষা ও ইচ্ছার ছাপ পড়ার জন্য।"
এই দৃষ্টিভঙ্গি বলছে: “প্রকৃতির কোনো আত্মা নেই, কোনো তাওহিদি তাৎপর্য নেই, কোনো রহস্য নেই। এগুলো কেবল তোমার বিশ্বাস—ব্যক্তিগত ও অবান্তর। বাস্তবতা মানে হলো: কীভাবে তুমি প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে, শোষণ করবে, এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।”
এটাই হলো আধুনিক পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও অর্থনীতির ভিত্তি। এই বিজ্ঞান আর আরিফদের জ্ঞান নয়, এটা আর খুদা-ভীত শ্রদ্ধা নয়, বরং ‘মাস্টারি’—প্রকৃতির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ, যা মানুষকে খোদার আসনে বসিয়ে দেয়।
এখানেই প্রশ্নটা গভীরতর হয়ে যায়: আমরা কেন এই ধারা গ্রহণ করলাম? কারণ, আমরা আমাদের আত্মবিশ্বাস হারিয়েছিলাম। আমরা আমাদের ঐতিহ্য, ইতিহাস, এবং আত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচ্যুত হয়েছিলাম। আমরা ভাবলাম, আধুনিকতা কোনো নিরপেক্ষ ও স্বাভাবিক জিনিস—যা সবাইকে গ্রহণ করতেই হবে।
Comment