Announcement

Collapse
No announcement yet.

আধুনিকতা, ইসলাম ও মুসলিমদের ক্ষমতাহীনতার সংকট (৩য় পর্ব)

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • আধুনিকতা, ইসলাম ও মুসলিমদের ক্ষমতাহীনতার সংকট (৩য় পর্ব)

    পবিত্র আইন ও আত্মার মধ্যে বিভাজন:
    একটি
    পলীয় (Pauline) খ্রিস্টীয় দৃষ্টিভঙ্গি

    খ্রিস্টধর্মের, বিশেষ করে পলীয় (Pauline) খ্রিস্টধর্মের, অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর মধ্যে পবিত্র আইন (Sacred Law) ও আত্মিকতা বা রূহানিয়াত (Spirit)-এর মধ্যে একটি গভীর বিচ্ছেদ সৃষ্টি হয়েছে।

    পল অফ তারস (Paul of Tarsus), যাকে অনেকে যীশুর শিষ্য মনে করেন—বাস্তবে তিনি কখনও যীশুর সাক্ষাৎ পাননি। তবুও, আধুনিক খ্রিস্টান দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে আলোচনার সুবিধার্থে এখানে আমরা ‘যীশু’ বলেই উল্লেখ করছি। যীশুর সঙ্গে সাক্ষাৎ না করেও পল খ্রিস্টধর্মে এক বিশাল প্রভাব ফেলেন।

    তিনি ছিলেন একজন ইহুদি, এবং খ্রিস্টধর্মে প্রবেশের আগে তিনি প্রাথমিক খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান বিরোধী ছিলেন। দামেস্ক যাওয়ার পথে, তার দাবি অনুযায়ী, তিনি এক রহস্যময় আধ্যাত্মিক দর্শন লাভ করেন, যেখানে যীশু তাকে গির্জায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানান। এই মিস্টিক অভিজ্ঞতার পর তিনি খ্রিস্টান হন এবং একটি নতুন ধরনের খ্রিস্টধর্ম প্রচার শুরু করেন।

    কিন্তু এই খ্রিস্টধর্ম ছিল যীশুর প্রকৃত শিষ্যদের (যারা যিরূশালেমে অবস্থান করছিলেন) শিক্ষার থেকে ভিন্ন। এমনকি বাইবেলের "Acts of the Apostles" গ্রন্থেও এই পার্থক্যের কথা বলা হয়েছে। যেখানে যীশু ইনজিলে (এবং কুরআনেও) বলেছেন তিনি কেবল “ইসরাইলের হারিয়ে যাওয়া ভেড়াদের” জন্য প্রেরিত, পল সেখানে অ-ইহুদি জাতির মধ্যেও ধর্ম প্রচারের উদ্যোগ নেন।

    এই পার্থক্যের মূল বিষয় হলো—আইন বাতিল করা। পলের মতে, যীশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়া মানে হলো পূর্ববর্তী ধর্মীয় আইন (তওরাতের শরিয়াহ) এখন অপ্রয়োজনে পরিণত হয়েছে। তার ভাষায়, খ্রিস্টের আত্মত্যাগ আমাদের পাপ মোচন করেছে, এবং এখন মুক্তি পাওয়ার একমাত্র পথ হলো তাঁর প্রতি বিশ্বাস। আর সেই বিশ্বাসই হল ঈশ্বরের করুণায় পূর্ণ—pure grace। তিনি এমনকি ‘আইন’-কে একটি অভিশাপ (curse) বলে অভিহিত করেন, কারণ মানুষের পক্ষে প্রতিটি খুঁটিনাটি নিয়ম মানা সম্ভব নয়।

    যীশু নিজেই ইনজিলে বলেছেন, ‘আইনের প্রতিটি অক্ষর ও যতিচিহ্ন (jot and tittle)’ পর্যন্ত মানতে হবে। কিন্তু পলের যুক্তি হলো, এটা বাস্তবে অসম্ভব। তাই আইন থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যই যীশু এসেছেন, এবং এখন নতুন যুগের ধর্মীয় জীবন কেবল বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে—এই বিশ্বাস ও খ্রিস্টের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কই আত্মিকতার চূড়ান্ত রূপ।

    এই দৃষ্টিভঙ্গি খ্রিস্টধর্মে আইন ও আত্মার মাঝে বিভাজনকে গাঢ় করেছে। আত্মিক জীবন মানে এখন আর পবিত্র আইন মানা নয়, বরং তার বিপরীত। আত্মিকতা যেন একপ্রকার আইনের অস্বীকৃতি! এটা এমন একটা চিন্তা যে এই জগত একটি আলাদা, আত্মনির্ভর জগত—এবং ঈশ্বর প্রতিটি কাজের জন্য নির্দিষ্ট কোনো আইন দেননি। কী হারাম, কী হালাল—এ নিয়ে চিন্তা করাও অপ্রয়োজনীয়! কারণ তা আমাদের মুক্তি আনবে না—এই ধরনের ‘আইন-ভিত্তিক’ ধর্মতত্ত্ব এখন তাদের মতে পুরনো।

    এই দৃষ্টিভঙ্গির ফল হলো—তারা বুঝতেই পারে না যে ইসলামের একটি বিশদ, পবিত্র আইন আছে (যা ইসলামি শরিয়াহ নামে পরিচিত), যা প্রতিটি কাজ, বস্তুর, পরিস্থিতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে দিকনির্দেশনা দেয়।

    ইসলামে শরিয়াহ কোনো বোঝা নয়—এটি এমন একটি পবিত্র জীবনব্যবস্থা যা আমাদের আল্লাহর আরও কাছে নিয়ে যায়। এটি জীবনের প্রতিটি দিককে—খাওয়া, চলা, লেনদেন, উপার্জন, সম্পর্ক—আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে পরিচালিত করে।

    খ্রিস্টধর্ম, বিশেষ করে পলীয় বা পরবর্তী লুথারীয় (Lutheran) ব্যাখ্যাগুলোতে, এই ধরনের আইন-কেন্দ্রিক ধারার কোনো স্থান নেই। সেখানে মুক্তি আসে কেবল বিশ্বাস দিয়ে—তারা এটিকে বলে Soteriology অর্থাৎ ‘মুক্তি সম্পর্কিত ধর্মতত্ত্ব’। এই মুক্তি খ্রিস্টের প্রতি বিশ্বাসের মাধ্যমে আসে, পবিত্র আইন মানার মাধ্যমে নয়।

    এমনকি আরও পরে, খ্রিস্টকে শুধু নবী নয়, বরং ঈশ্বরের অবতারিত রূপ (Incarnate God) হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়—যিনি কেবল একবারই মানবরূপে আগমন করেন। যদি সেই মুহূর্ত মিস করো, তাহলে তোমার আর রক্ষা নেই—এই ভয়ংকর নির্দয় ধারণা তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে।

    আজকের অনেক আধুনিক মুসলিম চিন্তাবিদ — বিশেষত যারা উদারবাদ, আধ্যাত্মবাদ বা 'সকল ধর্ম সমান' জাতীয় ভাবধারায় প্রভাবিত — তারা শরিয়াহর ভূমিকাকে অবমূল্যায়ন করেন। তাদের বক্তব্য এমন, যেন শরিয়াহ কোনো আবশ্যিক বিষয় নয়, বরং ঐচ্ছিক বা গৌণ কিছু। তারা বলেন,

    “আসল বিষয় হলো আত্মিকতা, আল্লাহর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, মানবিক মূল্যবোধ—এইগুলো। শরিয়াহ, ফিকহ, হালাল-হারাম এসব তো বাইরের খোলস।”

    কিন্তু বিষয়টা আসলে এখানেই নাটকীয় মোড় নেয়: “আইন” ও “আত্মিকতা”-এর এই দ্বন্দ্ব ইসলামি চিন্তাধারার নিজস্ব কিছু নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি এসেছে — সচেতন বা অচেতনভাবে — পলীয় খ্রিস্টধর্ম (Pauline Christianity) থেকে, যেখানে ধর্মীয় আইনকে ‘অভিশাপ’ হিসেবে দেখা হয় এবং আত্মিক মুক্তিকে আইন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়।

    এরপর আধুনিকতা — বিশেষত ইউরোপীয় প্রগতি ও সেক্যুলারিজম — এই খ্রিস্টীয় দ্বন্দ্বকে সার্বজনীন করে তোলে, এবং সেটাকে জোর করে সব ধর্মের ওপর আরোপ করে দেয়, এমনকি ইসলামের ওপরও।

    তাই যখন কেউ বলেন, “ইসলাম মানে আত্মিকতা, ভালো মানুষ হওয়া, আইন-কানুনের দাসত্ব নয়,”
    তখন তারা প্রায়ই নিজের অজান্তেই পলীয় খ্রিস্টধর্ম ও আধুনিকতার যৌথ ফ্রেমওয়ার্ক-এর মধ্যে কথা বলছেন — যেখানে আল্লাহর বিধানকে এক ধরনের বোরডেন, সময়োত্তীর্ণ এবং মানবিক মুক্তির পথে বাধা মনে করা হয়।

    কিন্তু ইসলাম কখনোই শরিয়াহ ও আত্মিকতাকে আলাদা করেনি।
    শরিয়াহ কোনো বন্দিশালার নাম নয় — এটা এক পথ (طريق)।

    এই পথই আমাদের অন্তর্দুনিয়াকে বাহ্যিক কর্মে রূপ দেয়, ইবাদতকে বাস্তবে নিয়ে আসে, এবং আল্লাহর প্রতি ভালোবাসাকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আত্মসমর্পণে পরিণত করে। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে নামাজ, খাদ্যাভ্যাস, বিয়ে, আদালত — সবকিছুতেই আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ থাকে। এই বিশ্বদৃষ্টি আধুনিক খ্রিস্টধর্ম বা সেক্যুলার পশ্চিমা দুনিয়ার কাছে একেবারে অচেনা।


    তাই পলীয় (Pauline) খ্রিস্টীয় দৃষ্টিভঙ্গির সারাংশ হলো:
    • এই বিভাজনের মূল উৎস হচ্ছে: পলীয় খ্রিস্টধর্ম
    • এর বিস্তারের হাতিয়ার হলো: আধুনিকতা
    • এবং এর শিকার হলো: ইসলামের সামগ্রিক ও পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে দীন-এর ধারণা।
    فَاَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ وَ انۡتَظِرۡ اِنَّهُمۡ مُّنۡتَظِرُوۡنَ
Working...
X