Announcement

Collapse
No announcement yet.

আধুনিকতা, ইসলাম ও মুসলিমদের ক্ষমতাহীনতার সংকট (৪থ পর্ব)

Collapse
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • আধুনিকতা, ইসলাম ও মুসলিমদের ক্ষমতাহীনতার সংকট (৪থ পর্ব)

    সুফিবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে: পবিত্র শরীয়াহ ও আত্মিকতার মধ্যে বিভাজন — এটি একটি মৌলিক ভুল বোঝাবুঝি

    অনেকেই আজকাল মনে করেন যে আত্মিকতা ও শরীয়াহ আলাদা জিনিস—এটা একেবারেই সত্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। এটা আজকের সময়ে খুব সাধারণ একটি ভুল ধারণা, এবং এর পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে। আমার ধারণা, এটা অনেকটাই খ্রিস্টান ধর্মীয় চিন্তাধারার প্রভাবে এসেছে, যেখানে ‘আইন’ ও ‘আত্মা’র মধ্যে মৌলিক একটি দ্বন্দ্ব বা বিচ্ছেদ দেখানো হয়—যেন আত্মা থাকলে আর আইনের দরকার নেই। এই ধারণাটি আধুনিক মানসিকতায় এমনভাবে ঢুকে গেছে যে, মানুষ মুসলিম হোক বা না হোক, সকলেই অনেক সময় এমনভাবে ইসলামকে উপস্থাপন করতে চায় যেন, “দেখুন, এখানে সুফিবাদ আছে, যেখানে শরীয়াহর দরকার নেই—এটাই ইসলামি আধ্যাত্মিকতা।”

    আজকের ধর্ম-আলোচনার জগতে একটি প্রচলিত ও বিপজ্জনক ভ্রান্তি হল এই ধারণা—আত্মিকতা (spirituality) বা মিস্টিক অভিজ্ঞতা যদি থাকে, তাহলে তা অবশ্যই শরীয়াহ বা ইসলামী বিধান-বিধির পরিপন্থী হবে। এই ধারণা অনেকটা এমন যে, ইবাদতের বাইরের কাঠামো, নিয়মকানুন, হালাল-হারামের সীমারেখা কেবল ‘মামুলি’ বা ‘সাধারণ মানুষের’ জন্য, আর যে কেউ আত্মিক জগতে প্রবেশ করেছে, তার আর এসব মানার প্রয়োজন নেই। কেউ কেউ এটিকে সুফিবাদের নামে উপস্থাপন করেন, যেন সুফিবাদ মানেই শরীয়াহ-বর্জিত একধরনের অন্তর্গত ধ্যান-যোগ বা নিছক হৃদয়ের সফর।

    অথচ এই ধারণা শুধু ভ্রান্ত নয়, বরং সুফিবাদের মৌলিক দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত।

    সুফিবাদের মূল দর্শন এই বিশ্বাসে গাঁথা যে, আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে প্রেরিত শরীয়াহ (ইলাহি আইন) এবং হাকিকাহ (আধ্যাত্মিক সত্য) — এ দু’টি একটি অপরটির পরিপূরক, অবিচ্ছেদ্য এবং আন্তর্নির্ভরশীল বাস্তবতা। শরীয়াহ মানুষকে বাহ্যিকভাবে আল্লাহর আদেশ পালনের উপযোগী করে তোলে, আর হাকিকাহ সেই আদেশ পালনের অন্তরজগতকে সঞ্জীবিত করে তোলে। একটি নিছক নিয়ম হয়ে পড়ে, যদি তা হৃদয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়; আবার হৃদয় যদি শরীয়াহর সীমারেখা ছাড়িয়ে যায়, তবে তা পথভ্রষ্ট অন্তর্চিন্তায় পরিণত হয়।

    সুফিগণ এ বিশ্বাসে দৃঢ় যে, শরীয়াহর আনুগত্যই হল হাকিকাহর প্রকৃত ভিত্তি। যেমন কোনো ব্যক্তি বলতে পারে না, “আমি এতটাই আত্মিক হয়ে গেছি যে নামাজ আর আমার জন্য প্রয়োজন নেই,” – এই মনোভাব ইসলামের মূল চেতনারই পরিপন্থী। কেননা ইবাদত, নামাজ, রোজা, হালাল-হারাম মানা – এগুলো আত্মিক উন্নতির প্রতিবন্ধক নয়, বরং এগুলো সেই উন্নতির সহায়ক সোপান।

    আল্লাহর প্রতি একজন বান্দার খালিস আনুগত্য নিশ্চিত করার জন্য, যা সুফিবাদের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য, সেখানে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে শরীয়াহ মেনে চলা আবশ্যক। কেউ যদি বলে, "আমি এতটাই আত্মিক হয়ে গেছি যে আর নামাজ পড়ার দরকার নেই, কারণ আমি তো আল্লাহকেই দেখে ফেলেছি,"—এটা অত্যন্ত ভুল। ইবাদত ও আনুগত্য তো আমাদের জীবনের অংশ এবং আল্লাহর হুকুম পালনের প্রকাশ।

    আবার, যে ব্যক্তি কেবল আইন মানে কিন্তু ভুলে যায় যে সে আল্লাহর ইবাদত করছে—তাও সঠিক নয়। এটাই সুফিবাদের ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি।

    অনেক অমুসলিম বা এমন মুসলিম যারা ইসলাম থেকে দূরে ছিল কিন্তু পরে ফিরে এসেছে—তারা সুফিবাদের এমন এক রূপ গ্রহণ করে যেখানে শরীয়াহকে একপ্রকার অগ্রাহ্য করা হয়। আর এ ধরনের লোকজন প্রায়ই ইমাম গাযালী রাহিমাহুল্লাহ–কে উদাহরণ হিসেবে পেশ করে বলেন, তিনি নাকি চল্লিশ বছর বয়সে শরীয়াহ বর্জন করে কেবল আত্মিকতায় মনোযোগ দেন।

    কিন্তু এটা ইমাম গাযালী রাহিমাহুল্লাহর চিন্তার মারাত্মক অপব্যাখ্যা।

    আমরা বুঝতে পারি—এই ভুল ব্যাখ্যার উৎপত্তি কোথা থেকে হয়। কারণ এর পেছনে রয়েছে ইমাম গাযালী রাহিমাহুল্লাহর সেই সমালোচনা, যা অনেকেই ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেন। বাস্তবে, ইমাম গাযালী রাহিমাহুল্লাহর সমালোচনার লক্ষ্য ছিল শরীয়াহ নয়, বরং এমন সব আলিম ও ‘ফকীহ’, যারা শরীয়তের বাহ্যিক দিক নিয়েই মগ্ন থাকেন অথচ এর আত্মিক উদ্দেশ্য—আল্লাহর প্রতি আন্তরিক আনুগত্য ও ঈমানি সংবেদনশীলতা—তাকে বিস্মৃত হন।

    ইমাম গাযালী রাহিমাহুল্লাহ লক্ষ্য করেছিলেন, অনেক ফকীহ শরীয়াহর খুঁটিনাটি আলোচনা ও দুনিয়াবি ব্যাখ্যা-প্রয়োগে এতটাই ডুবে আছেন যে, শরীয়াহ তাদের কাছে হয়ে উঠেছে কেবলমাত্র জ্ঞানের বস্তু, একটি পেশাগত দক্ষতা—আল্লাহর দিকে আত্মসমর্পণের মাধ্যম নয়। এইভাবে শরীয়াহর আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য হারিয়ে গেলে তা নিছকই দুনিয়াবি লাভালাভ, সামাজিক মর্যাদা ও পণ্ডিতগিরির খেলায় রূপ নেয়—যেটা প্রকৃত দ্বীন নয়।

    সুতরাং, ইমাম গাযালী রাহিমাহুল্লাহর সমালোচনা ছিল সেই বিকৃত চর্চার বিরুদ্ধে, যেখানে শরীয়াহকে আত্মিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং তা দুনিয়াবি স্বার্থে ব্যবহার করা হয়। এটি শরীয়াহর নিন্দা নয়, বরং শরীয়াহকে তার যথার্থ, আলোকিত ও আত্মিক রূপে ফিরিয়ে আনারই আহ্বান।

    বাস্তবতা হচ্ছে, ইমাম গাযালী রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন শরীয়াহর একনিষ্ঠ সমর্থক এবং ইসলামী আইনের ইতিহাসে অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব। তিনি শুধু একজন সুফি নন, বরং একজন উচ্চ পর্যায়ের ফকীহও। তিনি ছিলেন শাফিই মাযহাবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্কলার এবং তাঁর গ্রন্থ আল-মুস্তাসফা ফিকহ ও উসূলুল ফিকহে অন্যতম ক্লাসিক রচনা হিসেবে পরিগণিত।

    অতএব, যাঁরা বলেন যে ইমাম গাযালী রাহিমাহুল্লাহ শরীয়াহ পরিত্যাগ করে আত্মিকতাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে তাঁর চিন্তা ও কাজের গভীরতা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। বরং তাঁর জীবন ও রচনা উভয়ই সাক্ষ্য দেয় যে, শরীয়াহ ও হাকিকাহ—এই দুইয়ের একত্র সঙ্গেই দ্বীনের পূর্ণতা সম্ভব।
    فَاَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ وَ انۡتَظِرۡ اِنَّهُمۡ مُّنۡتَظِرُوۡنَ
Working...
X