Announcement

Collapse
No announcement yet.

আধুনিকতা, ইসলাম ও মুসলিমদের ক্ষমতাহীনতার সংকট (৫ম পর্ব)

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • আধুনিকতা, ইসলাম ও মুসলিমদের ক্ষমতাহীনতার সংকট (৫ম পর্ব)

    আধুনিকতার প্রমাণ হলো—ধর্মীয় ক্ষমতা ও পার্থিব (রাজনৈতিক) ক্ষমতার বিভাজন।

    আধুনিকতার অন্যতম সুস্পষ্ট নিদর্শন হচ্ছে—ধর্মীয় ক্ষমতা ও পার্থিব (অর্থাৎ রাজনৈতিক) ক্ষমতার পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দাঁড়ানো। এই বিচ্ছিন্নতা কেবল প্রশাসনিক নয়; বরং এটি এক গভীর দার্শনিক ও ঐতিহাসিক রূপান্তরের ফল, যা পাশ্চাত্য চিন্তার রূপরেখা নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

    খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্থ ইঞ্জিলে যীশু নাকি বলেছিলেন:
    “কায়সারের প্রাপ্য কায়সারকে দাও, আর ঈশ্বরের প্রাপ্য ঈশ্বরকে।”

    এই উক্তির ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে আমরা নিশ্চিত কিছু বলতে পারি না। তিনি আদৌ এই কথা বলেছিলেন কি না, তা নির্ধারণ করার অবস্থানে কেউই নেই। সুতরাং, এখানে আমাদের করণীয় হলো—বিচার স্থগিত রাখা।

    কিন্তু এই কথার পশ্চিমা ইতিহাসে প্রভাব?—তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

    এই উক্তিই পরবর্তীতে ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতিতে পরিণত হয়। এর মাধ্যমে ধীরে ধীরে জন্ম নেয় এমন একটি ধারণা, যেখানে ধর্ম ও রাজনীতি—এই দুই শক্তিকে পৃথক ও স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে কল্পনা করা হয়।

    এই ধারণা, মধ্যযুগীয় ইউরোপে বাস্তব সংঘাতের রূপ নেয়। পোপ ও রাজন্যবর্গের মধ্যে একের পর এক সংঘর্ষ দেখা দেয়—কে আসলে চূড়ান্ত কর্তৃত্বের অধিকারী: স্বর্গীয় ঐশ্বর্য নাকি পার্থিব সিংহাসন?

    এই দ্বন্দ্ব শুধু মতভেদে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং এটি ইতিহাসজুড়ে নানাবিধ সংঘাত, বিদ্রোহ, এমনকি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের জন্ম দেয়।

    এইভাবেই, “Caesar ও God”-এর মধ্যে কর্তৃত্ববোধের দ্বৈততা পশ্চিমা সভ্যতার ভিতরে গেঁথে যায় এবং ক্রমে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্ম দেয়—যেখানে ধর্ম ব্যক্তিগত আস্থা হিসেবে আবদ্ধ, আর রাষ্ট্র চলে ধর্ম-বিচ্ছিন্ন আইন ও নীতিমালায়।

    অন্যদিকে, ইসলামি জগতে এই সমস্যা মোটেই দেখা যায় না। এর প্রধান কারণ—ইসলাম কেবল একটি আধ্যাত্মিক বিশ্বাসব্যবস্থা নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা; যার কেন্দ্রস্থলে রয়েছে শরিয়া। এই শরিয়া কেবল ব্যক্তি পর্যায়ের ইবাদত বা নৈতিক আচরণই নয়, বরং রাষ্ট্রব্যবস্থা, বিচারনীতি, শাসনকাঠামো এবং এমনকি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পর্যন্ত নির্ধারিত করে দেয়।

    অতএব, ইসলামী শাসনব্যবস্থায় "ধর্ম বনাম রাজনীতি" নামে কোনো দ্বৈত পরিসর তৈরি হয় না। রাষ্ট্র ও ধর্ম—দুটিই একক শরিয়ার ছায়ায় পরিচালিত হয়। তাই পোপ-প্রিন্স বিরোধের মতো বিভ্রান্তিকর দ্বন্দ্ব এখানে দেখা যায় না।

    তবে ইউরোপের চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। একদিকে ছিলেন পোপ, যিনি ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব দাবি করেন। কিন্তু তাঁর সেই কর্তৃত্ব শরিয়ার মতো কোনো সুনির্দিষ্ট, ঈশ্বরপ্রদত্ত আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়—বরং তাঁর ব্যক্তিই আইন।তিনি যা বলেন, সেটাই ধর্মীয় সত্য। তার ভিত্তি?
    তিনি পোপ! এই পরিচয়ই তাঁর চূড়ান্ত বৈধতা।

    অন্যদিকে রয়েছে রাজা বা প্রিন্স, যিনি বিশ্বাসগতভাবে পোপের অধীন, কারণ তিনি ক্যাথলিক খ্রিস্টান। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে তিনি একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ শাসক। এখানে আসে মূল দ্বন্দ্ব—দুজনেই ক্ষমতার দাবিদার, কিন্তু কেউই কোনও নির্দিষ্ট ঐশী আইন দ্বারা আবদ্ধ নন। ফলে, সংঘাত অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।

    এই দ্বৈতকেন্দ্রিক ব্যবস্থাই ইউরোপকে ধাবিত করেছে ধর্মীয় যুদ্ধ, রাজনৈতিক জটিলতা এবং শেষমেশ ধর্মনিরপেক্ষতা নামক এক কৃত্রিম ‘সমাধানে’।

    একটি বিখ্যাত ঘটনা হলো—
    ১৪শ শতাব্দীতে পোপ বোনিফেস (Boniface VIII) ও ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ দ্য ফেয়ার-এর মধ্যে সংঘর্ষ। পোপ বোনিফেস দাবি করেছিলেন যে, ফ্রান্সের গির্জার যাজকগণ কর দিবেন না। তিনি বলেছিলেন, “আমরা কর দেব না, কারণ আমরা আধ্যাত্মিক কর্তৃপক্ষ।” অবশ্য, রাজা ফিলিপ একেবারেই রাজি হননি। গির্জার অপার সম্পদ ছিল রাজ্যের কর আয়ের বিশাল উৎস— অতএব, ফিলিপ কর ছাড় দেবে না।

    এই প্রেক্ষিতে পোপ বোনিফেস একটি বিখ্যাত পোপিয় রুল জারি করেন: Unam Sanctam। এটি পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষতা ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দলিল।

    বনিফেস অষ্টম, তাঁর বিখ্যাত ঘোষণাপত্র Unam Sanctam-এ ঘোষণা করেন: "আমাদের চর্চিত গির্জা-ব্যবস্থা স্বর্গীয় ফেরেশতাদের শ্রেণিবিন্যাসের প্রতিফলন। তাই আমাদের রয়েছে এক প্রকার মেটাফিজিক্যাল অধিকার। আমরাই আসলে তোমার উপরেও কর্তৃত্ব রাখি।”

    অর্থাৎ, পোপ এখানে দাবি করছেন—পার্থিব শাসকগণ কেবল বাহ্যিক বাস্তবতায় উচ্চ ক্ষমতার অধিকারী, কিন্তু গির্জা ও পোপাল ক্ষমতা আত্মিক ও মহত্তম, যা ফেরেশতাদের পরিপাটি শৃঙ্খলা অনুসরণ করে চলে। এটি একটি মেটাফিজিক্যাল হায়ার্কি—যেখানে ধর্মীয় নেতৃত্ব কেবল প্রতিষ্ঠানগত নয়, বরং ontological ও মহাজাগতিক পর্যায়েও শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার।

    এই ধারণার পেছনে রয়েছে একজন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নাম—Pseudo-Dionysius the Areopagite। তাঁর লেখায় “hierarchy” মানে শুধু সামাজিক বা প্রশাসনিক স্তর নয়—বরং একটি cosmic order—একটি সুশৃঙ্খল, ঈশ্বরকেন্দ্রিক, আলোকমুখী সত্তার সারি, যা নিচ থেকে উপরের দিকে আলো ও করুণা গ্রহণ করে এবং উপরের দিক থেকে নিচের দিকে দায়িত্ব ও নির্দেশ পৌঁছে দেয়।

    এই দৃষ্টিকোণ থেকে, গির্জা শুধু একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়, বরং সার্বজনীন সৌন্দর্য ও দয়াপূর্ণ বণ্টনের স্বর্গীয় কাঠামোর প্রতিফলন। আর পোপ সেই কাঠামোর শীর্ষস্থানে।

    সুতরাং, এই যুক্তির ভিত্তিতে পোপ ঘোষণা করেন—রাজা, যদিও তাঁর রাজ্য শাসন করেন, তবে তাঁর আত্মিক ও নৈতিক কর্তৃত্ব আমাদের নিচেই পড়ে। আমরা চাইলে তাঁকেও সংশোধন করতে পারি, কারণ আমরা ঈশ্বরের প্রতিভূ।

    পোপ ভেবেছিলেন, এতে রাজার মাথা নত হবে। কিন্তু রাজার জবাব ছিল একেবারেই ভিন্ন— সে পোপকে অপহরণ করল এবং একটি দুর্গে বন্দি রাখল। কিছুদিন পর পোপ আঘাত বা শকে মারা যান।

    এটা ছিল শুধু একটি উদাহরণ। এই ধরনের সংঘাত বহুবার ঘটেছে— আর্চবিশপ থমাস বেকেটের হত্যা (ক্যান্টারবেরি ক্যাথেড্রালে), হেনরি অষ্টম ও পোপের মধ্যে সংঘর্ষ, এবং ইংলিশ রিফরমেশন— সবই এই দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ।

    এইসবের ফলাফল হলো— ধর্মীয় ও পার্থিব ক্ষমতার মধ্যে একটা স্পষ্ট সীমারেখা টানা হয়। এবং সময়ের সাথে সাথে, ধর্ম হয়ে যায় একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়— যা জনসম্মুখে আনলে বিব্রত লাগে। তাকে “সন্মান করা হয়”, কিন্তু বলা হয়: “তুমি এটা বাড়িতে রাখো”।

    পরবর্তী দুই শতকে এই দ্বন্দ্ব আরো প্রকট আকার ধারণ করে। একদিকে পোপাল কর্তৃত্ব দুর্বল হতে থাকে, অন্যদিকে ইউরোপজুড়ে ক্রমাগত ধর্মযুদ্ধ, অভ্যন্তরীণ দাঙ্গা ও মহামারির মতো ঘটনা চার্চের নৈতিক অধিপত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। এই পটভূমিতে জন্ম নেয় সংস্কারমুখী মনোভাব—যা ব্যক্তিগত ধর্মীয় অনুশীলন, বাইবেলের স্বাধীন পাঠ ও গির্জার দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবে গড়ে ওঠে।

    এই ধারার চূড়ান্ত রূপ আসে ১৫১৭ সালে, যখন মার্টিন লুথার তার বিখ্যাত ৯৫টি আপত্তি Wittenberg গির্জার দরজায় টানিয়ে দেন। তিনি ক্যাথলিক চার্চের স্বেচ্ছাচারিতা ও পোপীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেন, এবং দাবি করেন যে পরিত্রাণ আসে একমাত্র ঈমান ও ঈশ্বরের অনুগ্রহ থেকে—পোপের দয়া কিংবা গির্জার আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে নয়। এখানেই শুরু হয় প্রোটেস্টান্ট ধর্মসংস্কার, যা শুধু ধর্মীয় বিপ্লব নয়, বরং একটি রাজনৈতিক যুগান্তরেরও সূচনা।

    প্রোটেস্টান্ট ধর্মসংস্কার (Protestant Reformation) ধর্মনিরপেক্ষতার বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। মার্টিন লুথার, যিনি প্রোটেস্টান্ট রিফর্মেশনের প্রধান সূচনাকারী, ‘Caesar-এর অধীনে থাকো’—এই নীতিতে গভীরভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, ধর্মীয় বিধান ও আচার-অনুষ্ঠান মেনে চলা অবশ্যই প্রয়োজন, তবে একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় শাসন ও কর্তৃত্বকে সম্মান করা অপরিহার্য। অর্থাৎ, ধর্মীয় বিশ্বাস ব্যক্তিগত ব্যাপার হলেও, রাষ্ট্রীয় শাসন ও আইন মানতে হবে বাধ্যতামূলক।

    লুথার যখন রোমান ক্যাথলিক চার্চ থেকে বিচ্ছিন্ন হন, তখন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে—একজন প্রভাবশালী রাজকুমার (prince) লুথারের পক্ষে দাঁড়ান এবং নিজে লুথারান ধর্ম গ্রহণ করেন। এর ফলে, তাঁর রাজ্যও লুথারান ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে। এই ঘটনা ছিল প্রোটেস্টান্ট রিফর্মেশনকে রাজনৈতিক মঞ্চে সুদৃঢ় অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে এক বিরাট কৌশলগত সাফল্য।

    এরপর আসে অগসবার্গ চুক্তি (1555) এবং ওয়েস্টফেলিয়া শান্তিচুক্তি (1648), যা দীর্ঘকাল চলা ধর্মীয় সংঘাত এবং রক্তক্ষয়নের অবসান ঘটায়। এই চুক্তিগুলো ধর্মীয় সহনশীলতার নীতিকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় এবং রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে “প্রজা যার রাজা, তার ধর্মই মানবে” (cuius regio, eius religio) নীতিকে প্রতিষ্ঠা করে। এর অর্থ, যদি একটি রাজা লুথারান ধর্ম গ্রহণ করেন, তবে তাঁর রাজ্যও লুথারান ধর্মাবলম্বী হবে; অন্যদিকে, যদি রাজা ক্যাথলিক হন, রাজ্যটিও ক্যাথলিক থাকবে।

    এখানে ধর্মীয় সত্য-মিথ্যার প্রশ্ন তৃতীয় কোনো বিষয় নয়; বরং এটি ছিল রাজনৈতিক আপোষ এবং বাস্তববাদী সমঝোতা। এই সমঝোতার ফলে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের (nation-state) ধারণার ভিত্তি গড়ে ওঠে, যার নিজস্ব একটি জাতীয় ধর্মীয় পরিচয় থাকে—যেমন ইংল্যান্ডে অ্যাংলিকানিজম, জার্মানিতে লুথারানিজম, ফ্রান্সে ক্যাথলিসিজম।

    এই রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় বিভাজনই ছিল পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষতার অন্যতম মূল ভিত্তি। ধর্মীয় শক্তিকে পার্থিব (রাজনৈতিক) ক্ষমতা থেকে আলাদা করা হয় এবং ধর্মকে ব্যক্তিগত জীবন ও আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়। আজকের ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের ভিত্তি এই ইতিহাসের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে, যেখানে ধর্মের স্থান ব্যক্তিগত অনুভূতি ও বিশ্বাস হিসেবে স্বীকৃত, কিন্তু রাজ্য ও সরকারের কার্যক্রম থেকে পৃথকীকৃত।


    فَاَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ وَ انۡتَظِرۡ اِنَّهُمۡ مُّنۡتَظِرُوۡنَ

  • #2
    মাশাআল্লাহ, আল্লাহ তাআলা আপনাকে চালিয়ে যাওয়ার তাওফিক দিন, আমীন

    ভাইয়ের সকল লিখা একসাথে পড়তে
    https://dawahilallah.com/search?searchJSON=%7B"authorid"%3A%5B"44367"%5D%2C "channel"%3A"2"%2C"exclude_type"%3A%5B"vBForum_Pri vateMessage"%2C+"vBForum_Channel"%5D%2C"starter_on ly"%3A"1"%7D

    বছর ফুরিয়ে যাবে এতো রিসোর্স আছে https://gazwah.net সাইটে

    Comment

    Working...
    X