মুসলমানরা ইতিহাসে কখনোই ভিন্ন মতবাদ বা চিন্তাধারার সঙ্গে যুক্ত হতে ভয় পায়নি। আমাদের ইতিহাসে এমন বহু মুসলিম আছেন যারা কখনোই ভিন্ন মতবাদ নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক জড়তা বা হীনমন্যতায় ভোগেননি। আজকেও আমরা দেখতে পাই, বিশেষ করে অনেক তরুণ মুসলিম ভালোভাবে এসব চিন্তাধারার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন, আলোচনা করছেন।
কিন্তু, মাঝে মাঝে এই যুক্ত থাকা বা শিখে বোঝার চেয়েও কিছুটা বেশি হয়ে যাচ্ছে। এমনও দেখা যাচ্ছে, কেউ কেউ নিজেদের সোশ্যালিস্ট মুসলিম, ক্যাপিটালিস্ট মুসলিম, লিবারেল মুসলিম ইত্যাদি বলতে শুরু করছেন। এমনকি আরও অনেক ধরনের 'ইজম' আছে—ডানপন্থা হোক বা বামপন্থা—সেইগুলোও কেউ কেউ নিজেদের পরিচয়ের অংশ বানিয়ে নিচ্ছেন।
তাহলে প্রশ্ন হলো:
🔸 একজন মুসলিম হিসেবে, আমাদের কি এসব 'ইজম'-এর সঙ্গে নিজেদের পরিচয় জড়ানো উচিত?
🔸 শেখা আর যুক্ত থাকা এক জিনিস, কিন্তু নিজেদেরকে এসব মতবাদের অংশ হিসেবে পরিচয় দেওয়া কি ইসলামসম্মত?
🔸 কোথায় সেই সূক্ষ্ম সীমারেখা, যেখানে আমরা শেখা এবং যুক্ত থাকার মধ্যে থাকবো, কিন্তু নিজেদের পরিচয়ের মৌলিক ভিত্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কিছু করবো না?
এটা কোনো নতুন বিষয় না যে মুসলমানরা ভিন্নমতাবলম্বী দর্শনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ইতিহাসের শুরু থেকেই—যেদিন মুসলমানরা আরব উপদ্বীপ পেরিয়ে পারস্য বা রোমান সভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে—তারা এসব দর্শনের মুখোমুখি হয়েছে এবং তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছে।
আসলে, মুসলমানরা প্রাচীন গ্রিক দর্শনের বহু রচনাই অনুবাদ করেছে, শুধু তা নিজেদের মধ্যে গ্রহণ করার জন্য নয়, বরং এই দর্শনগুলোকে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে বুঝে তাদের সঙ্গে দাওয়াহর উদ্দেশ্যে যুক্ত হওয়ার জন্য। তারা চেয়েছিল অন্যদের চিন্তাভাবনাকে তাদের নিজস্ব ভিত্তি থেকে বোঝে এবং সঠিকভাবে তা মোকাবিলা করতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, ইমাম গাযযালী (রাহিমাহুল্লাহ) প্লেটোর দর্শনের ওপর একটি বই লেখেন। তিনি দেখেছিলেন, তখনকার অনেক মুসলিম চিন্তাবিদ গ্রিক দর্শনকে নিজের চিন্তা-পদ্ধতির সঙ্গে মিশিয়ে নিচ্ছেন, যা তাকে খুবই সমস্যাজনক মনে হয়েছিল।
তিনি একইসাথে লক্ষ্য করেন, তখনকার অমুসলিম দার্শনিকেরা নিজেদের ‘যুক্তিনির্ভর’ বা ‘বুদ্ধিবাদী’ বলে দাবি করে ইসলামের ওপর একধরনের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতো—যেন ইসলাম তেমন যুক্তির ধার ধারে না। তাই ইমাম গাযযালী সিদ্ধান্ত নেন, আগে তিনি প্লেটোর দর্শনকে তার মৌলিক ভিত্তি থেকে ভালোভাবে বুঝবেন, তারপর সে দর্শনের সমালোচনা করবেন।
এই কারণে তিনি প্রথমে একটি বই লেখেন যেখানে শুধুমাত্র গ্রিক দর্শন কী—তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে, কোনো সমালোচনা নয়। এই বই এতটাই মানসম্মত ছিল যে, ইউরোপীয় দার্শনিকরাও সেটা নিজেদের শেখার জন্য ব্যবহার করতে শুরু করে। পরবর্তীতে তারা বইটি আরবী থেকে নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করে নেয়, কিন্তু বইয়ের শুরুতে ইমাম গাযযালীর লেখা ভূমিকা অংশটা বাদ দিয়ে দেয়—যেখানে তিনি বলেছিলেন, “আমি এই বইটা লিখছি সমালোচনা করার পূর্বশর্ত হিসেবে, যাতে আমি আগে ভালোভাবে বুঝতে পারি।” এরপর সেই অনুবাদিত বইটা তারা পাঠ্যবই হিসেবে ব্যবহার করে।
অতএব, মুসলমানরা সবসময়ই বাইরের চিন্তা-ধারার সঙ্গে যুক্ত থেকেছে—তাদের ইসলামি বিশ্বাসের বাইরে যেসব ধারণা এসেছে, সেগুলো বোঝার চেষ্টা করেছে, এবং সেটি মোটেও অস্বাভাবিক কিছু নয়।
ইতিহাসে আমরা লক্ষ্য করি যে, মুসলিম চিন্তাজগতে ভিনদেশি দর্শনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা একধরনের দ্বিমুখী প্রবণতা সৃষ্টি করেছিল। একদিকে কিছু চিন্তাবিদ ছিলেন, যাঁরা এই দর্শনগুলোর সঙ্গে গঠনমূলক বোঝাপড়া স্থাপন করেন—তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল এগুলোর সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ ও সত্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক দিকগুলো চিহ্নিত করা। অপরদিকে, একটি শ্রেণি গড়ে ওঠে, যারা এসব দর্শনকে ইসলামি চিন্তার সঙ্গে মিশিয়ে একটি সংকর (syncretic) জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণের চেষ্টা করেন। এই দ্বিতীয় প্রবণতাটি দীর্ঘমেয়াদে চিন্তাগত বিপর্যয়ের জন্ম দেয়।
বিশেষত আব্বাসীয় যুগে আল-মামুনের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘বায়তুল হিকমা’-এর মাধ্যমে গ্রিক দর্শনের বিপুল পরিমাণ অনুবাদ কার্যক্রম শুরু হয়। এই অনুবাদ ও অধ্যয়নের একটি ইতিবাচক দিক নিঃসন্দেহে ছিল; তবে তার পাশাপাশি মুসলিম দার্শনিকদের একাংশের মধ্যে গ্রিক দর্শনের প্রতি একধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক মোহ জন্ম নেয়। এ শ্রেণির চিন্তাবিদেরা ক্রমে এ ধারণা লালন করতে শুরু করেন যে, যুক্তি, বুদ্ধিবৃত্তি এবং দর্শনের ক্ষেত্রে ইসলামিক চিন্তাচেতনা গ্রিক দার্শনিকদের তুলনায় নাকি পশ্চাদপদ।
এই মনোভাবমূলক হীনমন্যতা ইসলামী আকীদা ও জ্ঞানতত্ত্বের শুদ্ধতা ও স্বাতন্ত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। ফলস্বরূপ, এমন একটি দার্শনিক চর্চার ধারা গড়ে ওঠে, যেখানে ঈমান, নবুয়ত, আখিরাত ও আল্লাহর সত্তার মতো মৌলিক বিষয়গুলোকে এমন ব্যাখ্যাগত কাঠামোতে উপস্থাপন করা হয়, যা মূল কুরআনিক বার্তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে।
ইমাম গাজ্জালী (রাহিমাহুল্লাহ) এই প্রবণতার তীব্র সমালোচক ছিলেন। তিনি প্রথমে গ্রিক দর্শন—বিশেষ করে প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের চিন্তাধারাকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন এবং এরপর রচনা করেন "মাকাসিদ আল-ফালাসিফা", যেখানে তিনি দর্শনের মূল উপাদানসমূহ বিশ্লেষণ করেন। পরে তিনি "তাহাফুত আল-ফালাসিফা" নামক বিখ্যাত গ্রন্থে দর্শনের আধ্যাত্মিক ও ধর্মতাত্ত্বিক অসঙ্গতিগুলোর বিস্তারিত সমালোচনা করেন।
তবে তাঁর এই প্রয়াস সত্ত্বেও, মুসলিম জ্ঞানজগতে দর্শনভিত্তিক চিন্তার অতিরিক্ত প্রশ্রয় পরবর্তীতে রোধ করা সম্ভব হয়নি। ইবন সীনা, ফারাবি ও ইবন রুশদের মতো চিন্তাবিদদের লেখায় দেখা যায়, ইসলামি মতবাদ ও গ্রিক দার্শনিক চিন্তাকে একত্রিত করার চেষ্টা। যদিও একাংশ তাঁদের অবদানকে ইতিবাচক বিবেচনা করে, তথাপি বাস্তবে এ চর্চা অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ মুসলিম সমাজে বিভ্রান্তি, দার্শনিক অভিজাততন্ত্র এবং দ্বীনকে দুর্বোধ্য করে তোলার ঝুঁকি তৈরি করে।
বর্তমান যুগেও আমরা অতীতের মতোই একটি দৃষ্টান্তমূলক সমস্যার পুনরাবৃত্তি প্রত্যক্ষ করছি। আজকের অনেক মুসলিম চিন্তাবিদ এবং শিক্ষিত যুবসমাজ এমন কিছু মতবাদ, তন্ত্র বা ‘ইজম’-এর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন, যেগুলো তাদের কাছে একধরনের ‘পুরস্কৃত জ্ঞান’ বা আধুনিকতার পরিচায়ক হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে। এই মতবাদগুলো নিয়ে বিশদ আলোচনা, তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, এবং তথ্যভিত্তিক প্রবন্ধ-গ্রন্থ এখন সহজলভ্য; ফলে সেগুলোর প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাওয়া খুব স্বাভাবিক।
যদিও আকীদা, বিধান এবং মূল বিশ্বাস নিয়ে অধিকাংশ সচেতন মুসলিমের মধ্যে এখন আগের চেয়ে বেশি সতর্কতা দেখা যায়, তথাপি যখন বিষয়টি সমাজ ও রাষ্ট্রের কাঠামো পরিবর্তন বা শাসনব্যবস্থার প্রশ্নে চলে আসে, তখন এই সতর্কতা অনেকক্ষেত্রেই শিথিল হয়ে পড়ে। দেখা যায়, একাংশ ইসলামী চিন্তাবিদ ও কর্মী সমাজে পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে ভিন্ন মতবাদ ও দার্শনিক চিন্তাধারা থেকে নীতিকাঠামো ও কৌশল ধার করার চেষ্টা করছেন।
এখানে কারো ব্যক্তিগত নিয়ত বা আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার প্রয়োজন নেই; বরং এখানে মূল আলোচ্য বিষয় হলো—ইতিহাসে পূর্বে যে সমস্যা দেখা দিয়েছিল, অর্থাৎ দর্শন ও চিন্তার ক্ষেত্রে আত্মপরিচয়ের বিকৃতি ও হীনমন্যতা, সেই একই সমস্যা বর্তমান প্রেক্ষাপটেও পুনরায় সংঘটিত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
আমাদের এখন অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে মূল্যায়ন করতে হবে—যদি আমরা ভিন্ন মতবাদ বা বিপ্লবী চিন্তা থেকে কিছু ধারণ করি, তাহলে সে গ্রহণ কতটুকু পরিমিত এবং ইসলামি বিশ্বদর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? আমরা কি সেসব উপাদানকে নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করে কেবলমাত্র উপকারী অংশ গ্রহণ করছি, নাকি কোনো নির্দিষ্ট ধারণাকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে তার ওপরই আমাদের চিন্তা, দাওয়াহ ও রাজনৈতিক কর্মপ্রচেষ্টা প্রতিষ্ঠা করে ফেলছি?
যদি পরেরটি ঘটে—অর্থাৎ কোনো দর্শনের একটি বিশেষ উপাদানকে অতিমূল্যায়ন করে সেটিকে ইসলামের তুলনায় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়—তাহলে তা একটি বুদ্ধিবৃত্তিক হীনমন্যতার জন্ম দেয়। এর ফলাফল হয় আত্মপরিচয়ের দুর্বলতা, চিন্তার আত্মনির্ভরতার বিলুপ্তি এবং শেষপর্যন্ত এমন এক দ্বিন নির্মাণ, যা প্রকৃত ইসলামি আকীদা ও শরিয়তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সুতরাং, আজকের মুসলিম চিন্তাজগতের জন্য একটি অত্যন্ত জরুরি কাজ হলো:
(১) আত্মপরিচয়ের ভিত্তিতে সমস্ত ভিন্ন দর্শনের সঙ্গে সমালোচনামূলক ও বৈষয়িক বোঝাপড়া গড়ে তোলা,
(২) ‘উপাদানগত গ্রহণ’ (instrumental borrowing) এবং ‘মূলগত আত্মসাৎ’ (essential assimilation)-এর পার্থক্য স্পষ্টভাবে নির্ণয় করা,
(৩) এবং সর্বোপরি, ইসলামকে কোনো মতবাদ, তত্ত্ব বা বিপ্লবের অনুসঙ্গ নয়—বরং একটি স্বতন্ত্র, পূর্ণাঙ্গ ও সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্বদর্শন হিসেবে স্থাপন করা।
সুতরাং, বর্তমান প্রজন্মের চিন্তাবিদদের দায়িত্ব হলো—তাদের চিন্তা, বিশ্লেষণ ও সমাজগঠনের প্রচেষ্টায় ইসলামকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে এগিয়ে যাওয়া। ইসলামের আকীদা, মূল্যবোধ ও বিশ্বদর্শনের প্রতি অটল থেকে ভিন্ন মতবাদকে বোঝা যেতে পারে, সমালোচনা করা যেতে পারে, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে কিছু উপকারী দিক গ্রহণ করাও যেতে পারে। তবে তা হতে হবে একটি দৃঢ় ঈমানি অবস্থান থেকে, কোনো হীনমন্যতা বা আত্মবিস্মরণের জায়গা থেকে নয়।
ইসলাম কোনো তত্ত্ব বা ‘ইজম’-এর বিকল্প নয়—বরং তা সত্যের পরিপূর্ণ রূপ, যে রূপ সমস্ত মতবাদকে ছাড়িয়ে যায় এবং সমগ্র মানবজাতিকে একটি সুষম ও ইনসাফভিত্তিক পথের দিশা দেয়। আত্মপরিচয়ের এই বোধ পুনরুদ্ধার করাই আজকের মুসলিম উম্মাহর চিন্তাগত মুক্তি ও জাগরণের অন্যতম শর্ত।
কিন্তু, মাঝে মাঝে এই যুক্ত থাকা বা শিখে বোঝার চেয়েও কিছুটা বেশি হয়ে যাচ্ছে। এমনও দেখা যাচ্ছে, কেউ কেউ নিজেদের সোশ্যালিস্ট মুসলিম, ক্যাপিটালিস্ট মুসলিম, লিবারেল মুসলিম ইত্যাদি বলতে শুরু করছেন। এমনকি আরও অনেক ধরনের 'ইজম' আছে—ডানপন্থা হোক বা বামপন্থা—সেইগুলোও কেউ কেউ নিজেদের পরিচয়ের অংশ বানিয়ে নিচ্ছেন।
তাহলে প্রশ্ন হলো:
🔸 একজন মুসলিম হিসেবে, আমাদের কি এসব 'ইজম'-এর সঙ্গে নিজেদের পরিচয় জড়ানো উচিত?
🔸 শেখা আর যুক্ত থাকা এক জিনিস, কিন্তু নিজেদেরকে এসব মতবাদের অংশ হিসেবে পরিচয় দেওয়া কি ইসলামসম্মত?
🔸 কোথায় সেই সূক্ষ্ম সীমারেখা, যেখানে আমরা শেখা এবং যুক্ত থাকার মধ্যে থাকবো, কিন্তু নিজেদের পরিচয়ের মৌলিক ভিত্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কিছু করবো না?
এটা কোনো নতুন বিষয় না যে মুসলমানরা ভিন্নমতাবলম্বী দর্শনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ইতিহাসের শুরু থেকেই—যেদিন মুসলমানরা আরব উপদ্বীপ পেরিয়ে পারস্য বা রোমান সভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে—তারা এসব দর্শনের মুখোমুখি হয়েছে এবং তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছে।
আসলে, মুসলমানরা প্রাচীন গ্রিক দর্শনের বহু রচনাই অনুবাদ করেছে, শুধু তা নিজেদের মধ্যে গ্রহণ করার জন্য নয়, বরং এই দর্শনগুলোকে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে বুঝে তাদের সঙ্গে দাওয়াহর উদ্দেশ্যে যুক্ত হওয়ার জন্য। তারা চেয়েছিল অন্যদের চিন্তাভাবনাকে তাদের নিজস্ব ভিত্তি থেকে বোঝে এবং সঠিকভাবে তা মোকাবিলা করতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, ইমাম গাযযালী (রাহিমাহুল্লাহ) প্লেটোর দর্শনের ওপর একটি বই লেখেন। তিনি দেখেছিলেন, তখনকার অনেক মুসলিম চিন্তাবিদ গ্রিক দর্শনকে নিজের চিন্তা-পদ্ধতির সঙ্গে মিশিয়ে নিচ্ছেন, যা তাকে খুবই সমস্যাজনক মনে হয়েছিল।
তিনি একইসাথে লক্ষ্য করেন, তখনকার অমুসলিম দার্শনিকেরা নিজেদের ‘যুক্তিনির্ভর’ বা ‘বুদ্ধিবাদী’ বলে দাবি করে ইসলামের ওপর একধরনের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতো—যেন ইসলাম তেমন যুক্তির ধার ধারে না। তাই ইমাম গাযযালী সিদ্ধান্ত নেন, আগে তিনি প্লেটোর দর্শনকে তার মৌলিক ভিত্তি থেকে ভালোভাবে বুঝবেন, তারপর সে দর্শনের সমালোচনা করবেন।
এই কারণে তিনি প্রথমে একটি বই লেখেন যেখানে শুধুমাত্র গ্রিক দর্শন কী—তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে, কোনো সমালোচনা নয়। এই বই এতটাই মানসম্মত ছিল যে, ইউরোপীয় দার্শনিকরাও সেটা নিজেদের শেখার জন্য ব্যবহার করতে শুরু করে। পরবর্তীতে তারা বইটি আরবী থেকে নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করে নেয়, কিন্তু বইয়ের শুরুতে ইমাম গাযযালীর লেখা ভূমিকা অংশটা বাদ দিয়ে দেয়—যেখানে তিনি বলেছিলেন, “আমি এই বইটা লিখছি সমালোচনা করার পূর্বশর্ত হিসেবে, যাতে আমি আগে ভালোভাবে বুঝতে পারি।” এরপর সেই অনুবাদিত বইটা তারা পাঠ্যবই হিসেবে ব্যবহার করে।
অতএব, মুসলমানরা সবসময়ই বাইরের চিন্তা-ধারার সঙ্গে যুক্ত থেকেছে—তাদের ইসলামি বিশ্বাসের বাইরে যেসব ধারণা এসেছে, সেগুলো বোঝার চেষ্টা করেছে, এবং সেটি মোটেও অস্বাভাবিক কিছু নয়।
ইতিহাসে আমরা লক্ষ্য করি যে, মুসলিম চিন্তাজগতে ভিনদেশি দর্শনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা একধরনের দ্বিমুখী প্রবণতা সৃষ্টি করেছিল। একদিকে কিছু চিন্তাবিদ ছিলেন, যাঁরা এই দর্শনগুলোর সঙ্গে গঠনমূলক বোঝাপড়া স্থাপন করেন—তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল এগুলোর সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ ও সত্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক দিকগুলো চিহ্নিত করা। অপরদিকে, একটি শ্রেণি গড়ে ওঠে, যারা এসব দর্শনকে ইসলামি চিন্তার সঙ্গে মিশিয়ে একটি সংকর (syncretic) জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণের চেষ্টা করেন। এই দ্বিতীয় প্রবণতাটি দীর্ঘমেয়াদে চিন্তাগত বিপর্যয়ের জন্ম দেয়।
বিশেষত আব্বাসীয় যুগে আল-মামুনের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘বায়তুল হিকমা’-এর মাধ্যমে গ্রিক দর্শনের বিপুল পরিমাণ অনুবাদ কার্যক্রম শুরু হয়। এই অনুবাদ ও অধ্যয়নের একটি ইতিবাচক দিক নিঃসন্দেহে ছিল; তবে তার পাশাপাশি মুসলিম দার্শনিকদের একাংশের মধ্যে গ্রিক দর্শনের প্রতি একধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক মোহ জন্ম নেয়। এ শ্রেণির চিন্তাবিদেরা ক্রমে এ ধারণা লালন করতে শুরু করেন যে, যুক্তি, বুদ্ধিবৃত্তি এবং দর্শনের ক্ষেত্রে ইসলামিক চিন্তাচেতনা গ্রিক দার্শনিকদের তুলনায় নাকি পশ্চাদপদ।
এই মনোভাবমূলক হীনমন্যতা ইসলামী আকীদা ও জ্ঞানতত্ত্বের শুদ্ধতা ও স্বাতন্ত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। ফলস্বরূপ, এমন একটি দার্শনিক চর্চার ধারা গড়ে ওঠে, যেখানে ঈমান, নবুয়ত, আখিরাত ও আল্লাহর সত্তার মতো মৌলিক বিষয়গুলোকে এমন ব্যাখ্যাগত কাঠামোতে উপস্থাপন করা হয়, যা মূল কুরআনিক বার্তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে।
ইমাম গাজ্জালী (রাহিমাহুল্লাহ) এই প্রবণতার তীব্র সমালোচক ছিলেন। তিনি প্রথমে গ্রিক দর্শন—বিশেষ করে প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের চিন্তাধারাকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন এবং এরপর রচনা করেন "মাকাসিদ আল-ফালাসিফা", যেখানে তিনি দর্শনের মূল উপাদানসমূহ বিশ্লেষণ করেন। পরে তিনি "তাহাফুত আল-ফালাসিফা" নামক বিখ্যাত গ্রন্থে দর্শনের আধ্যাত্মিক ও ধর্মতাত্ত্বিক অসঙ্গতিগুলোর বিস্তারিত সমালোচনা করেন।
তবে তাঁর এই প্রয়াস সত্ত্বেও, মুসলিম জ্ঞানজগতে দর্শনভিত্তিক চিন্তার অতিরিক্ত প্রশ্রয় পরবর্তীতে রোধ করা সম্ভব হয়নি। ইবন সীনা, ফারাবি ও ইবন রুশদের মতো চিন্তাবিদদের লেখায় দেখা যায়, ইসলামি মতবাদ ও গ্রিক দার্শনিক চিন্তাকে একত্রিত করার চেষ্টা। যদিও একাংশ তাঁদের অবদানকে ইতিবাচক বিবেচনা করে, তথাপি বাস্তবে এ চর্চা অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ মুসলিম সমাজে বিভ্রান্তি, দার্শনিক অভিজাততন্ত্র এবং দ্বীনকে দুর্বোধ্য করে তোলার ঝুঁকি তৈরি করে।
বর্তমান যুগেও আমরা অতীতের মতোই একটি দৃষ্টান্তমূলক সমস্যার পুনরাবৃত্তি প্রত্যক্ষ করছি। আজকের অনেক মুসলিম চিন্তাবিদ এবং শিক্ষিত যুবসমাজ এমন কিছু মতবাদ, তন্ত্র বা ‘ইজম’-এর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন, যেগুলো তাদের কাছে একধরনের ‘পুরস্কৃত জ্ঞান’ বা আধুনিকতার পরিচায়ক হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে। এই মতবাদগুলো নিয়ে বিশদ আলোচনা, তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, এবং তথ্যভিত্তিক প্রবন্ধ-গ্রন্থ এখন সহজলভ্য; ফলে সেগুলোর প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাওয়া খুব স্বাভাবিক।
যদিও আকীদা, বিধান এবং মূল বিশ্বাস নিয়ে অধিকাংশ সচেতন মুসলিমের মধ্যে এখন আগের চেয়ে বেশি সতর্কতা দেখা যায়, তথাপি যখন বিষয়টি সমাজ ও রাষ্ট্রের কাঠামো পরিবর্তন বা শাসনব্যবস্থার প্রশ্নে চলে আসে, তখন এই সতর্কতা অনেকক্ষেত্রেই শিথিল হয়ে পড়ে। দেখা যায়, একাংশ ইসলামী চিন্তাবিদ ও কর্মী সমাজে পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে ভিন্ন মতবাদ ও দার্শনিক চিন্তাধারা থেকে নীতিকাঠামো ও কৌশল ধার করার চেষ্টা করছেন।
এখানে কারো ব্যক্তিগত নিয়ত বা আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার প্রয়োজন নেই; বরং এখানে মূল আলোচ্য বিষয় হলো—ইতিহাসে পূর্বে যে সমস্যা দেখা দিয়েছিল, অর্থাৎ দর্শন ও চিন্তার ক্ষেত্রে আত্মপরিচয়ের বিকৃতি ও হীনমন্যতা, সেই একই সমস্যা বর্তমান প্রেক্ষাপটেও পুনরায় সংঘটিত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
আমাদের এখন অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে মূল্যায়ন করতে হবে—যদি আমরা ভিন্ন মতবাদ বা বিপ্লবী চিন্তা থেকে কিছু ধারণ করি, তাহলে সে গ্রহণ কতটুকু পরিমিত এবং ইসলামি বিশ্বদর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? আমরা কি সেসব উপাদানকে নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করে কেবলমাত্র উপকারী অংশ গ্রহণ করছি, নাকি কোনো নির্দিষ্ট ধারণাকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে তার ওপরই আমাদের চিন্তা, দাওয়াহ ও রাজনৈতিক কর্মপ্রচেষ্টা প্রতিষ্ঠা করে ফেলছি?
যদি পরেরটি ঘটে—অর্থাৎ কোনো দর্শনের একটি বিশেষ উপাদানকে অতিমূল্যায়ন করে সেটিকে ইসলামের তুলনায় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়—তাহলে তা একটি বুদ্ধিবৃত্তিক হীনমন্যতার জন্ম দেয়। এর ফলাফল হয় আত্মপরিচয়ের দুর্বলতা, চিন্তার আত্মনির্ভরতার বিলুপ্তি এবং শেষপর্যন্ত এমন এক দ্বিন নির্মাণ, যা প্রকৃত ইসলামি আকীদা ও শরিয়তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সুতরাং, আজকের মুসলিম চিন্তাজগতের জন্য একটি অত্যন্ত জরুরি কাজ হলো:
(১) আত্মপরিচয়ের ভিত্তিতে সমস্ত ভিন্ন দর্শনের সঙ্গে সমালোচনামূলক ও বৈষয়িক বোঝাপড়া গড়ে তোলা,
(২) ‘উপাদানগত গ্রহণ’ (instrumental borrowing) এবং ‘মূলগত আত্মসাৎ’ (essential assimilation)-এর পার্থক্য স্পষ্টভাবে নির্ণয় করা,
(৩) এবং সর্বোপরি, ইসলামকে কোনো মতবাদ, তত্ত্ব বা বিপ্লবের অনুসঙ্গ নয়—বরং একটি স্বতন্ত্র, পূর্ণাঙ্গ ও সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্বদর্শন হিসেবে স্থাপন করা।
সুতরাং, বর্তমান প্রজন্মের চিন্তাবিদদের দায়িত্ব হলো—তাদের চিন্তা, বিশ্লেষণ ও সমাজগঠনের প্রচেষ্টায় ইসলামকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে এগিয়ে যাওয়া। ইসলামের আকীদা, মূল্যবোধ ও বিশ্বদর্শনের প্রতি অটল থেকে ভিন্ন মতবাদকে বোঝা যেতে পারে, সমালোচনা করা যেতে পারে, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে কিছু উপকারী দিক গ্রহণ করাও যেতে পারে। তবে তা হতে হবে একটি দৃঢ় ঈমানি অবস্থান থেকে, কোনো হীনমন্যতা বা আত্মবিস্মরণের জায়গা থেকে নয়।
ইসলাম কোনো তত্ত্ব বা ‘ইজম’-এর বিকল্প নয়—বরং তা সত্যের পরিপূর্ণ রূপ, যে রূপ সমস্ত মতবাদকে ছাড়িয়ে যায় এবং সমগ্র মানবজাতিকে একটি সুষম ও ইনসাফভিত্তিক পথের দিশা দেয়। আত্মপরিচয়ের এই বোধ পুনরুদ্ধার করাই আজকের মুসলিম উম্মাহর চিন্তাগত মুক্তি ও জাগরণের অন্যতম শর্ত।
Comment