Announcement

Collapse
No announcement yet.

বিব্রতকর মানহায

Collapse
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • বিব্রতকর মানহায

    আমি পূর্বেও এই কথাটি বলেছি, এবং আজ আবারও তা বলছি—সমাজের সংস্কার, সমাজ বিপ্লব বা তাজদিদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য একটি কাজ। যখন সমাজ আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে, জাহেলিয়াতের অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়, তখন এই সমাজকে পরিবর্তনের ডাক দেওয়া, তা নববী দাওয়াতেরই অংশ। কিন্তু এই মহান কাজের আড়ালে যদি এমন কোনো চিন্তা, নীতি বা মানহাজ প্রবেশ করে, যা উম্মাহর ভেতরে বিভক্তি, ফাটল ও দলাদলি সৃষ্টি করে, তাহলে তা আর إصلاح (সংস্কার) নয়, বরং إفْساد (ধ্বংস) হয়ে দাঁড়ায়।

    কিছুদিন যাবৎ লক্ষ্য করা যাচ্ছে, আমাদের তরুণ সমাজের মধ্যে এক নতুন ধরনের মানহাজ ছড়িয়ে পড়ছে—যাকে অনেকেই "তাজদিদের দাওয়াত" হিসেবে চিহ্নিত করছেন। এই মানহাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হলো এমন এক চিন্তা, যা দ্বীনের মৌলিক শাসনতাত্ত্বিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করে। এই চিন্তার মূলকথা হলো:

    "গ্লোবাল মানহাজের লোকেরা নবুওয়াতের আদলে খিলাফাহ প্রতিষ্ঠার দাওয়াত দেয়, পক্ষান্তরে আমরা সালতানাত প্রতিষ্ঠার কথা বলি।"

    নবুওয়াতের আদলে খিলাফাহ প্রতিষ্ঠা এবং সালতানাত প্রতিষ্ঠার নামে ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে দু'টি ভাগে ভাগ করার চিন্তা ইসলামের মৌলিক আকীদা, শাসনতত্ত্ব এবং নববী ম্যানহাজের পরিপন্থী। ইসলামের শরী‘আতে শাসনব্যবস্থা একটি নিরবিচ্ছিন্ন ধারার নাম—যা শুরু হয়েছিল নবী ﷺ-এর মাধ্যমে, এরপর আবু বকর, উমর, উসমান, আলী (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম)-এর খিলাফাহ দ্বারা তা অব্যাহত ছিল। তার পরের যে কোনও রূপ যদি সেই ধারাবাহিকতা থেকে বিচ্যুত হয়, তবে তা বিকৃতি হিসেবে গণ্য হবে; আলাদা কোনো ধর্মীয় গ্রহণযোগ্য পরিভাষা বা রাজনৈতিক বিভাজন হিসেবে নয়।

    ইসলামে খিলাফাহ হলো নবুওয়াতের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার। নবী ﷺ ইরশাদ করেছেন:

    قال رسول الله ﷺ:
    "كانت النبوة فيكم ما شاء الله أن تكون، ثم يرفعها الله إذا شاء أن يرفعها، ثم تكون خلافة على منهاج النبوة، ثم يكون ملكاً عاضّاً، ثم يكون ملكاً جبريّاً، ثم تكون خلافة على منهاج النبوة، ثم سكت."
    — (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস: ১৮৪০৬)

    অর্থ: “তোমাদের মাঝে নবুওয়াত (অর্থাৎ, নবী ﷺ-এর নেতৃত্ব ও ওহির ভিত্তিতে পরিচালিত শাসনব্যবস্থা) থাকবে যতদিন আল্লাহ তা চাহেন। তারপর আল্লাহ তা তুলে নেবেন যখন তিনি চান। এরপর আসবে খিলাফাহ—নবুওয়াতের আদর্শ ও পন্থায় প্রতিষ্ঠিত। এরপর আসবে কামড়ে ধরা (উত্তরাধিকারভিত্তিক) রাজত্ব। এরপর আসবে জবরদস্তিমূলক (জুলুমভিত্তিক) রাজত্ব। এরপর আবার ফিরে আসবে খিলাফাহ—নবুওয়াতের আদর্শ ও পন্থায়। এরপর রাসূল ﷺ চুপ করে গেলেন।”

    এই হাদীস সরাসরি প্রমাণ করে যে, নবুওয়াত ও খিলাফাহের মধ্যে ধারাবাহিকতা রয়েছে। এখানে “নবুওয়াতের পন্থা” বলতে বোঝানো হয়েছে এমন শাসনযন্ত্র যা শরীয়াহর ভিত্তিতে, ইনসাফের সাথে এবং উম্মাহর ঐকমত্য দ্বারা গঠিত হয়। নবুওয়াতের আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত খিলাফাহই হচ্ছে একমাত্র স্বীকৃত ইসলামি শাসনব্যবস্থা। তাই এই খিলাফাহ থেকে বিচ্যুতি ঘটিয়ে যেকোনো নতুন নাম বা গঠন যেমন “সালতানাত”, “মুল্ক”, “রাজতন্ত্র”—সেসব আলাদা ভাগ করাকে ইসলামী শরী‘আ অনুমোদন করে না।

    ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:

    "الخلافة هي خلافة النبوة في حراسة الدين وسياسة الدنيا، والمُلك هو التسلط الذي قد يكون بحق أو بغير حق، ولا يلزم فيه إقامة الدين."
    “খিলাফাহ হচ্ছে দ্বীনের হেফাজত এবং দুনিয়ার রাজনীতি পরিচালনায় নবুওয়াতের উত্তরাধিকার। আর মুল্ক হলো একধরনের ক্ষমতার দখলদারিত্ব—যা হয়তো ন্যায়ের উপর হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে; তবে এতে দ্বীন প্রতিষ্ঠার কোনো গ্যারান্টি নেই।” — Majmū‘ al-Fatāwā, 35/18

    এখানে তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করছেন যে খিলাফাহ ও মুল্কের মধ্যে প্রকৃত ভিত্তিভেদ রয়েছে। কিন্তু তা এই অর্থে নয় যে ইসলামে মুল্কও খিলাফাহর মতো একটি বিকল্প ধর্মীয় শাসনব্যবস্থা হতে পারে। বরং খিলাফাহ একটি আদর্শ, আর মুল্ক একটি ক্ষতিকর বিচ্যুতি—যা প্রয়োজনীয় হলেও শরিয়াহ সম্মত নয়।

    ইমাম আবু বকর আল-মারূযী, ইমাম ত্বর্তুশী, এবং ইমাম নববী (রাহিমাহুমুল্লাহ) সহ বহু সালাফ-ই-সালেহীন বলেছেন, যে শাসনব্যবস্থা জনগণের ওপর জুলুম ও অত্যাচার চাপিয়ে দেয়, শরিয়াহর বদলে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক নীতিতে চলে, তা "সুলতান" নাম ধারণ করলেও খিলাফাহ নয়। নবুওয়াতের উত্তরাধিকার হতে হলে সেই শাসনব্যবস্থাকে ন্যূনতমভাবে শরীয়াহর প্রতিষ্ঠা, ইনসাফের কায়েম, এবং উম্মাহর স্বীকৃতির ভিত্তিতে পরিচালিত হতে হবে।

    খিলাফাহ ও সালতানাতকে আলাদা দ্বীনি মণ্ডল হিসেবে চিন্তা করা এমন একটি জাহেলিয়াতি ধোঁকাবাজি, যা ইসলামি শাসনের ঐক্য ধারণাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ইতিহাসে ওসমানীয় সালতানাত দীর্ঘকাল ধরে নিজেদের “খলিফা” বলে পরিচয় দিয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তা ছিল উত্তরাধিকারভিত্তিক রাজতন্ত্র—যেখানে অনেক সময় শরীয়াহ দ্বিতীয়স্তরের কর্তৃত্বে রূপ নিয়েছিল। ঠিক একইভাবে সমসাময়িক সময়ে অনেক রাজতান্ত্রিক শাসক নিজেদের “ইসলামি নেতা” পরিচয় দিলেও তাদের শাসনব্যবস্থা খিলাফাহর মাপকাঠিতে পড়ে না।

    যে “গ্লোবাল মানহাজ” খিলাফাহর দাওয়াত দেয়, তা মূলত নবুওয়াতের মানহাজে ফিরতে চায়—যেখানে হুকুম শুধু আল্লাহর, আইন কেবল শরীয়াহর, শাসন কেবল তাকওয়াবান নেতৃত্বের এবং উম্মাহর রাজনৈতিক ঐক্য অখণ্ড। পক্ষান্তরে যে পক্ষ “সালতানাত” বা “মুল্ক” প্রতিষ্ঠার কথা বলে, তারা আদতে নবুওয়াত থেকে বিচ্যুত একটি বংশগত রাজনীতিকে ধর্মীয় মোড়কে প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

    ইবনে তাইমিয়্যাহর আলোচনার মূল কথা এই যে, “মুল্ক” শব্দটি হাদীস ও কুরআনে আসে নেতিবাচক অর্থে, যেমন কুরআনে ফেরাউনের শাসন, নেমরুদের রাজত্ব, এবং সুলাইমান (আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর “মুল্ক” (যা ছিল আল্লাহর দান) এর মধ্যে পার্থক্য টেনে দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ, একমাত্র তখনই মুল্ক গ্রহণযোগ্য হতে পারে, যখন তা নবুওয়াতের অনুসরণে হয়—নচেৎ তা শির্ক, জুলুম ও দ্বীন থেকে বিচ্যুতির এক প্রকার বাহানা।

    সুতরাং, ইসলাম কোনোদিন খিলাফাহ ও সালতানাতকে আলাদা আলাদা করে দুটি ধর্মীয় কাঠামো হিসেবে অনুমোদন দেয়নি। ইসলামে রয়েছে একটি একক রাজনৈতিক আদর্শ—নবুওয়াতের আদলে গঠিত খিলাফাহ। এর বিকৃতি, অপব্যাখ্যা বা বিকল্প নামে পরিচিত সালতানাত বা মুল্ক হলো সেই আদর্শ থেকে সরে আসা এবং উম্মাহকে বিভ্রান্ত করার এক চক্রান্তময় ইতিহাস। ইসলামের দৃষ্টিতে, খিলাফাহ ছাড়া আর কোনো শাসনব্যবস্থা পূর্ণভাবে বৈধতা লাভ করতে পারে না—তা যতই ইসলামী পরিভাষায় মোড়ানো হোক না কেন।

    তাদের মানহাজে একটি অদ্ভুত বক্তব্য হয়, যা হতাশার এবং বিব্রতকর। তারা বলে— “আমরা মনে করি আমাদের পক্ষে নবুওয়াতের আদলে খিলাফাহ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না।” অথচ প্রশ্ন হলো—যখন আপনারাই স্বীকার করছেন এই কাজ আপনাদের পক্ষে সম্ভব নয়, তখন কে আপনাদের ওপর এই দায় চাপিয়ে দিয়েছে? কে আপনাদের বাধ্য করেছে এমন একটি কাজের নেতৃত্বে থাকতে, যার সক্ষমতা আপনারাই অস্বীকার করছেন?

    একটু ভেবে দেখুন—যারা নিজেরাই বিশ্বাস করে না যে এই কাজ সম্ভব, তাদের হাতে কি আদর্শিক দায়িত্ব থাকা উচিত? তারা যদি সত্যিই দ্বীনদার, তাহলে বিনয়ের সঙ্গে এই কাজ তাদের হাতে ছেড়ে দেবে, যারা তা করতে চায়, যারা নবুওয়াতি পন্থায় উম্মাহর ঐক্য ফিরিয়ে আনতে চায়।

    দায়িত্ব না নেওয়া এক জিনিস, কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার যোগ্য যারা, তাদের হেয় করা, তাদের লক্ষ্যকে অস্বীকার করা, এবং পথরোধ করা—এটা একেবারে অন্য জিনিস। এটা কেবল ব্যর্থতা নয়, এটা হচ্ছে উম্মাহর পিঠে ছুরি চালানোর আরেক রূপ। যদি আপনারা সত্যিই বিশ্বাস করেন যে নবুওয়াতের আদলে খিলাফাহ কায়েম করা সম্ভব নয়, তাহলে আপনারা সেই দায়িত্ব ছেড়ে দিন, এবং যারা যুগে যুগে সেই দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে, এখনও নিচ্ছে, তাদেরকে অন্তত দুআ দিন, সহানুভূতি দিন—নচেৎ অন্তত চুপ থাকুন।

    যারা পারেনা—তাদের কাজ হচ্ছে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া, বিভ্রান্তি ছড়ানো নয়। যারা পারে—তাদের পথ খোলা রাখা, বাধা দেওয়া নয়। আর যারা আদর্শের পথে চলেছে, তাদের ঈমানী মেহনতকে সন্দেহের চোখে না দেখা, বরং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া।

    আল্লাহর দ্বীনের নেতৃত্ব কেউ নিজের পছন্দে নেয় না—এটা আল্লাহ দেন, যাদের তিনি উপযুক্ত মনে করেন। কারণ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—খিলাফাহর পুনর্জাগরণ সবসময় শুরু হয় সেই ছোট্ট কিছু মানুষের হাতে, যারা “আমরা পারি না” বলেনি, বরং বলেছে, “আমরা শুরু করব, আর তাওফিক আল্লাহর হাতে।”
    فَاَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ وَ انۡتَظِرۡ اِنَّهُمۡ مُّنۡتَظِرُوۡنَ

  • #2
    আল্লাহর দ্বীনের নেতৃত্ব কেউ নিজের পছন্দে নেয় না—এটা আল্লাহ দেন, যাদের তিনি উপযুক্ত মনে করেন। কারণ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—খিলাফাহর পুনর্জাগরণ সবসময় শুরু হয় সেই ছোট্ট কিছু মানুষের হাতে, যারা “আমরা পারি না” বলেনি, বরং বলেছে, “আমরা শুরু করব, আর তাওফিক আল্লাহর হাতে।”

    রিলেটেড -
    ..نحن الذين بايعوا محمدا ﷺ على الجهاد ما بقينا أبدا

    Comment


    • #3

      “খিলাফাহ হচ্ছে দ্বীনের হেফাজত এবং দুনিয়ার রাজনীতি পরিচালনায় নবুওয়াতের উত্তরাধিকার। আর মুল্ক হলো একধরনের ক্ষমতার দখলদারিত্ব—যা হয়তো ন্যায়ের উপর হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে; তবে এতে দ্বীন প্রতিষ্ঠার কোনো গ্যারান্টি নেই।” — ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ)

      জাজাকুমুল্লাহ, প্রিয় আখি।

      Comment

      Working...
      X