Announcement

Collapse
No announcement yet.

গভীর রাষ্ট্রের ছায়াতলে: কী বদলায়, কে বদলায়? (খন্ড এক)

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • গভীর রাষ্ট্রের ছায়াতলে: কী বদলায়, কে বদলায়? (খন্ড এক)

    ভূমিকা:

    ডিপ স্টেট থেকে যদি পরিবর্তন আসে, তাহলে একটি শাসনব্যবস্থাকে পরিবর্তন করা সম্ভব"— বর্তমান সময়ে সমাজে এই ধরনের একটি ভাবনা ক্রমশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। একে একদিকে রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত চিন্তা বলা যায়, আবার অন্যদিকে এটি একটি জটিল আত্মবিভ্রান্তির প্রতিফলনও হতে পারে। বহু মানুষ মনে করেন, দৃশ্যমান রাজনীতিকেরা নন, বরং রাষ্ট্রের অদৃশ্য শক্তিসমূহ— যেমন সামরিক অভিজাতগোষ্ঠী, নিরাপত্তা সংস্থা, আমলাতন্ত্র, কিংবা আন্তর্জাতিক লবিরা— প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী। ফলে, তারা ধরে নেন যে কোনো মৌলিক বা গভীর কাঠামোগত পরিবর্তন কেবল তখনই সম্ভব, যখন এই ‘ডিপ স্টেট’ নিজের স্বার্থে বা চাপের মুখে পরিবর্তনের অনুমতি দেয়।

    "ডিপ স্টেট থেকে যদি পরিবর্তন আসে তাহলে একটি শাসনব্যবস্থাকে পরিবর্তন করা সম্ভব"—এই ধারণাটি সরাসরি কোনো একজন চিন্তাবিদের একক তত্ত্ব হিসেবে প্রণীত নয়, তবে এটি রাষ্ট্রতত্ত্ব, অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা কাঠামো এবং গোপন রাষ্ট্রীয় বলয় (deep state dynamics) নিয়ে আলোচনা করা একাধিক রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ও বিশ্লেষকের লেখায় ছড়িয়ে আছে। বিশেষ করে এই ধারণার সবচেয়ে গভীর রূপ পাওয়া যায় Antonio Gramsci, Michel Foucault, এবং আধুনিক যুগে Peter Dale Scott-এর মতো বিশ্লেষকদের চিন্তায়, যদিও তারা "ডিপ স্টেট" শব্দটি প্রত্যক্ষভাবে ব্যবহার করেননি।

    তবে আধুনিক বিশ্লেষণে, Peter Dale Scott নামটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি একজন প্রাক্তন কূটনীতিক, অধ্যাপক এবং লেখক, যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতার অদৃশ্য ও স্থায়ী বলয় (deep politics) নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা করেছেন। তার মতে, রাষ্ট্রের অনেক গভীর সিদ্ধান্ত বাস্তবত গ্রহণ করে সেইসব গোষ্ঠী যারা নির্বাচিত নয়, কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর গভীর প্রভাব রাখে। তিনি বলেন, "Official government is often subordinate to deeper structures of power."

    তাই মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে আমাদের ‘ডিপ স্টেট’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে, তা পরিষ্কারভাবে বুঝে নেওয়া জরুরি। কারণ, এই শব্দটি যতটা জনপ্রিয়, তার অর্থ ততটাই অস্পষ্ট ও বহুস্তরবিশিষ্ট।

    শাসনব্যবস্থায় "ডিপ স্টেট" বলতে বোঝানো হয় রাষ্ট্রের এমন একটি অদৃশ্য ও শক্তিশালী স্তর, যা সরাসরি জননির্বাচিত নয়, কিন্তু রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ ও ক্ষমতা পরিচালনায় গভীরভাবে প্রভাবশালী। এটি সাধারণত সরকারি কাঠামোর গভীরে প্রোথিত, দীর্ঘস্থায়ী আমলাতন্ত্র, সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, বিচার বিভাগ, কিছু নির্দিষ্ট কর্পোরেট গোষ্ঠী ও মিডিয়ার একাংশ নিয়ে গঠিত হয়, যারা রাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের চেয়েও বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে পারে।

    ডিপ স্টেট কারা—এই প্রশ্নের উত্তর প্রেক্ষিতনির্ভর। কোনো রাষ্ট্রে এটি হতে পারে সামরিক বাহিনী, যারা সরাসরি রাজনীতি থেকে অবসর নিলেও পেছন থেকে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। কোনো রাষ্ট্রে এটি হতে পারে উচ্চপদস্থ আমলারা, যারা সরকার পরিবর্তনের পরও নিজের পদ ও প্রভাব ধরে রাখে এবং নীতিমালাকে নিজেদের অভিপ্রায় অনুযায়ী মোড় দিতে সক্ষম হয়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে শক্তিশালী গোপন গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক জীবননাড়ি ধরে রাখা কর্পোরেট এলিটরাও এর অংশ হতে পারে। তারা প্রত্যক্ষভাবে সরকারে না থেকেও রাষ্ট্রের ভিতরে এক ধরনের "স্থায়ী সরকার" হিসেবে টিকে থাকে।

    ডিপ স্টেট কীভাবে কাজ করে তা সরাসরি দেখা যায় না, কিন্তু ফলাফল থেকে তা বোঝা যায়। তারা নির্বাচিত সরকারকে নানা প্রকার সীমাবদ্ধতায় ফেলে, কখনো মিডিয়া ও বিচারব্যবস্থাকে ব্যবহার করে নীতি পরিবর্তনে বাধ্য করে, কখনো নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে কিছু সিদ্ধান্তকে গোপনে আটকে দেয়, আবার কোনো কোনো সময় রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে বিভাজন তৈরি করে ক্ষমতার ভারসাম্য নিজের পক্ষে রাখতে সচেষ্ট হয়। সরকারের নীতিগত ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যে "দৃশ্যমান সরকার" কাজ করে, ডিপ স্টেট সেই কার্যক্রমের পেছনে থেকে নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাব বিস্তার করে।

    বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ডিপ স্টেট গঠনে মূলত কয়েকটি শক্তি কাজ করে—উচ্চপর্যায়ের আমলাতন্ত্র, সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর একটি অংশ, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর স্থায়ী কাঠামো, কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়িক গোষ্ঠী, এবং কখনো কখনো বিচারব্যবস্থার নির্দিষ্ট অংশ। এদের মধ্যে অনেকেই সরাসরি রাজনৈতিক দলের সদস্য না হলেও রাজনৈতিক ক্ষমতার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে সক্ষম।

    যেমন, বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র একটি শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী প্রশাসনিক কাঠামো হিসেবে কাজ করে। যে দলই ক্ষমতায় আসুক, মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সচিবালয় পর্যন্ত অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের চাবিকাঠি থাকে আমলাদের হাতে। ফলে আমলাতন্ত্রের একাংশ তাদের পছন্দের রাজনৈতিক ধারা বা দলকে সুবিধা দিতে সচেষ্ট হয়, আবার কেউ কেউ ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা পূরণের জন্য নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করেন। এতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নীতিমালা প্রায়ই এই দীর্ঘস্থায়ী কাঠামোর বাধায় আটকে যায় বা বিকৃত হয়।

    একইভাবে, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো—যেমন ডিজিএফআই, এনএসআই বা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (PBI)—নিরাপত্তার নামে রাজনৈতিক নজরদারি, দলীয় বিরোধীদের দমন, অথবা মিডিয়া ও নাগরিক সমাজকে নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হয়েছে বলে বহুবার অভিযোগ উঠেছে। এসব সংস্থার নির্দিষ্ট কিছু ইউনিট বা ব্যক্তি তাদের অবস্থান ও সংযোগ ব্যবহার করে রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন, যা ডিপ স্টেটের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলে যায়।

    বাংলাদেশে ‘ডিপ স্টেট’ ধারণাটি শুধু সামরিক বা গোয়েন্দা কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং একে ক্রমবর্ধমানভাবে ব্যবসায়িক বা কর্পোরেট শক্তির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলেও দেখা যায়। বিগত কয়েক দশকে দেশের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ, মিডিয়া মালিকানা, এবং নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় কর্পোরেট স্বার্থ যেভাবে প্রবল হয়ে উঠেছে, তা স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে একটি অদৃশ্য কিন্তু অত্যন্ত প্রভাবশালী কর্পোরেট ডিপ স্টেট গড়ে উঠেছে।

    পৃথিবীর বহু উদাহরণ থেকে দেখা যায় যে, ডিপ স্টেট নানা সময়ে ক্ষমতার পালাবদলের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কখনো তারা কোনো সরকারের পতন ঘটিয়েছে, কখনো নির্দিষ্ট কোনো দল বা গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় এনেছে, আবার কখনো ক্ষমতাসীনদের মধ্যে রদবদল ঘটিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। তবে এই সব ঘটনার মধ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে, যেটি সচরাচর বিশ্লেষণে অবহেলিত থেকে যায় — এই পরিবর্তন কি কেবল শাসনক্ষমতার রদবদল ছিল, নাকি শাসনব্যবস্থারই মৌলিক পরিবর্তন?

    এই প্রশ্ন অত্যন্ত জরুরি, কারণ ক্ষমতার পরিবর্তন (regime change) মানেই সর্বদা শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন (systemic transformation) নয়। একনায়ককে সরিয়ে আরেক একনায়ককে বসালে, বা একদল রাজনীতিকের বদলে আরেক দল এলে যদি নীতি, কাঠামো, মূল্যবোধ ও জনসেবার চরিত্র অপরিবর্তিত থাকে — তাহলে আসলে কিছুই বদলায় না, কেবল চেহারা বদলায়।

    ... (চলবে)।

    নোট: লেখাটি শুরুতে এক পর্বেই শেষ করার ইচ্ছা ছিল; কিন্তু বিষয়ের গভীরতা, প্রাসঙ্গিক উদাহরণ এবং বিশ্লেষণের বিস্তার এতটাই বিশাল যে, তা একটি পর্বে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়। তাই লেখাটি কয়েকটি খণ্ডে ভাগ করে পর্যায়ক্রমে উপস্থাপন করার নিয়ত করেছি, ইনশাআল্লাহ। পরবর্তী পর্বে ইনশাআল্লাহ আমরা কিছু নির্বাচিত বাস্তব উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করব— বিশেষ করে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ডিপ স্টেট গঠনের সবচেয়ে কাছাকাছি প্রচেষ্টা কারা করেছে, তাদের স্বরূপ কী, এবং এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আদৌ কি আমাদের শাসনব্যবস্থার কোনও মৌলিক পরিবর্তন সম্ভব?

    আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যেন আমাদেরকে সত্য বিশ্লেষণ করার তাওফিক দেন, হক বুঝে তা অনুযায়ী কাজ করার শক্তি দান করেন। আমিন।
    فَاَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ وَ انۡتَظِرۡ اِنَّهُمۡ مُّنۡتَظِرُوۡنَ

  • #2

    হাজারো দ্বন্দ্ব, কোন্দল এই ডিপ স্টেট এর কলাকুশলীদের মাঝে, কিন্তু তারা সকলেই একটা অলিখিত বিষয়ে একমত যে-
    \\এই সিস্টেমকে বহাল তবিয়তে রাখতে হবে, চাই যেকোন মূল্যে//

    Comment

    Working...
    X