উদাহরণ:
ডিপ স্টেটের মাধ্যমে পৃথিবীর বহু দেশে রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে, কিন্তু এই পরিবর্তনগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শুধু শাসনক্ষমতার (regime) পরিবর্তন ঘটিয়েছে; শাসনব্যবস্থার (system) মৌলিক কাঠামো একই থেকে গেছে। শাসনক্ষমতার রদবদলে নেতৃত্ব পরিবর্তন হতে পারে, রাজনৈতিক দলের হাতবদল ঘটতে পারে, এমনকি সাময়িকভাবে নীতিগত কিছু রদবদলও দেখা যায়। কিন্তু শাসনব্যবস্থা বলতে যে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর সমষ্টিকে বোঝায়, সেটি একই থাকে—একই স্বার্থে, একই মূল নীতিতে, একই বলয়ে।
মিশর: মিশরের ২০১১ সালের উদাহরণটি এখানে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। হোসনি মোবারকের দীর্ঘদিনের শাসনের বিরুদ্ধে গণবিপ্লব ঘটে, এবং অবশেষে তিনি পদত্যাগে বাধ্য হন। দেশজুড়ে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, এবং সমাজ-অধিকার প্রতিষ্ঠার আশা ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এই পরিবর্তন যতটা না ছিল শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন, তারচেয়েও বেশি ছিল কেবল শাসনক্ষমতার রদবদল। নতুন করে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি, যিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থী ছিলেন, ক্ষমতায় আসলেও তাকে টিকতে দেয়া হয়নি। মাত্র এক বছরের মধ্যেই মিশরের সেনাবাহিনী আবারও ক্ষমতা দখল করে এবং একটি রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে অপসারণ করে। এখানে স্পষ্টভাবে দেখা যায়, সেনাবাহিনী এবং নিরাপত্তা সংস্থার দীর্ঘস্থায়ী বলয়—অর্থাৎ ডিপ স্টেট—একজন নির্বাচিত নেতাকে সরিয়ে আবার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের চাবিকাঠি ফিরিয়ে নেয়। ক্ষমতার পালাবদল ঘটে, কিন্তু মিশরের রাজনীতির প্রকৃতি, অর্থনৈতিক কাঠামো, বিচারব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ ও বিদেশনীতি—সবই পূর্বের মতো থেকে যায়। শাসনব্যবস্থা অপরিবর্তিত থাকে, পরিবর্তন ঘটে কেবল চেহারায়।
তুরস্ক: তুরস্কেও একই রকম একটি চিত্র দেখা যায় অতীতে। ১৯৯৭ সালের তথাকথিত “post-modern coup” বা "নরম অভ্যুত্থান"-এর মাধ্যমে তৎকালীন ইসলামপন্থী প্রধানমন্ত্রী নাজমেত্তিন আরবাকানকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। সামরিক বাহিনী সরাসরি ক্ষমতা গ্রহণ করেনি, কিন্তু রাষ্ট্রের নিরাপত্তা পরিষদ, বিচার বিভাগ ও মিডিয়ার মাধ্যমে তাকে চাপ দিয়ে সরিয়ে দেয়। আরবাকানের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ইসলামি অনুপ্রাণিত, যা ছিল তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ কেমালিস্ট কাঠামোর বিপরীতমুখী। ডিপ স্টেট এই ক্ষেত্রে ইসলামি রাজনৈতিক প্রভাবকে ঠেকাতে সক্রিয় হয়। যদিও ক্ষমতায় পরিবর্তন আসে, তথাপি তুরস্কের রাষ্ট্রকাঠামো—যা দীর্ঘকাল ধরে সামরিক ও আমলাতন্ত্রের ছায়ায় পরিচালিত—তা অটুট থেকে যায়। এর মাধ্যমে বোঝা যায় যে, শাসকের পরিবর্তন ঘটলেও ব্যবস্থার ভিত্তিতে পরিবর্তন ঘটেনি। পরবর্তীতে রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ানের ক্ষমতায় আসার পর ব্যাপক রদবদল ঘটলেও, শুরুতে তাকে একই ডিপ স্টেটের সঙ্গে বোঝাপড়ার মাধ্যমেই চলতে হয়েছে, এবং এক দশকের বেশি সময় পরে তিনি নিজেই একটি নতুন ডিপ স্টেট গঠন করে ফেলেন।
পাকিস্তান: পাকিস্তানও ডিপ স্টেট কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত শাসনক্ষমতার রদবদলের একটি চমৎকার উদাহরণ। দেশটির ইতিহাসে একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে, যেখানে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীদের সরিয়ে দিয়ে সামরিক জান্তা রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। ১৯৯৯ সালে জেনারেল পারভেজ মুশাররফ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে সরিয়ে দেন। এরপর তিনি রাষ্ট্রপতি হন, কিন্তু সংবিধানিক কাঠামো, আমলাতন্ত্র, বিচারব্যবস্থা এবং সামরিক অর্থনীতি—সবই অপরিবর্তিত থাকে। পরবর্তীতে সামরিক নিয়ন্ত্রণ শিথিল হলেও সেনাবাহিনী ও আইএসআই (Inter-Services Intelligence) দেশের রাজনীতিতে একটি দীর্ঘস্থায়ী ও অদৃশ্য প্রভাব ধরে রাখে। ২০১৭ সালের নির্বাচনে ইমরান খান-এর উত্থানও অনেক পর্যবেক্ষকের মতে সেনাবাহিনীর নীরব সমর্থনের ফসল ছিল, যদিও পরবর্তীতে সেই সম্পর্ক ভেঙে যায়। তবুও পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থায় ডিপ স্টেট এতটাই প্রোথিত যে কোনো দলই মূল কাঠামোর বাইরে গিয়ে শাসন করার ক্ষমতা পায় না। ক্ষমতা বদলায়, মুখ বদলায়, কিন্তু সিস্টেম সেই একই।
লাতিন আমেরিকা: লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে ডিপ স্টেটের একটি নীরব রূপ বিদ্যমান। বিশেষ করে ২০১৬ সালে রাষ্ট্রপতি দিলমা রুশেফ-এর অভিশংসন এবং অপসারণ প্রক্রিয়াকে অনেকে ‘আইনগত অভ্যুত্থান’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এখানে রাষ্ট্রের উচ্চ আদালত, কর্পোরেট মিডিয়া এবং বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি একজোট হয়ে ক্ষমতার রদবদল ঘটায়। কিন্তু এই পরিবর্তন নতুন কোন সামাজিক ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক সমতা, বা রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। বরং পরবর্তীতে নির্বাচিত সরকারের অধীনেও আগের দুর্নীতি, নিপীড়ন ও কর্পোরেট আধিপত্য চলমান থাকে। অতএব, এটি ছিল একপ্রকার সিস্টেম-প্রিজার্ভিং পালাবদল—ব্যবস্থাকে না বদলে শুধু তার পরিচালকদের অদলবদল।
সুদান: সুদানের রাজনৈতিক ইতিহাসেও আমরা ডিপ স্টেটের ছায়ায় এক বিশেষ রকমের ক্ষমতার পালাবদলের নাটক দেখতে পাই—এবং তার কেন্দ্রে ছিলেন ড. হাসান তুরাবি। একজন প্রজ্ঞাবান ইসলামি চিন্তাবিদ, সাংবিধানিক আইনজ্ঞ ও রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি বিশ্বাস করতেন যে সুদানে একটি ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, যদি রাষ্ট্রক্ষমতার বলয় অভ্যন্তর থেকেই রূপান্তরিত করা যায়। এই উদ্দেশ্যে তিনি সুদানিজ ইসলামি আন্দোলনকে সংগঠিত করেন এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন।
১৯৮৯ সালে, তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার ওমর আল-বাশিরের নেতৃত্বে একটি সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। বলা হয়ে থাকে যে এই অভ্যুত্থানের মূল পরিকল্পনার পেছনে ছিলেন হাসান তুরাবি নিজেই। উদ্দেশ্য ছিল, ইসলামী শক্তিকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া এবং একটি ইসলাম-ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা। শুরুতে তুরাবি এই নতুন সরকারে প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেন এবং আইনী কাঠামোতেও ইসলামি অনুপ্রেরণায় নানা সংস্কার আনতে সচেষ্ট হন।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল যে সেনাবাহিনী—যারা ছিল এই ইসলামী অভিযানের বাহ্যিক বাহন—তারা তুরাবির চেতনা ও উদ্দেশ্য থেকে ধীরে ধীরে সরে যেতে শুরু করল। সামরিক প্রশাসনের মধ্যে থাকা জাতীয়তাবাদী, আধিপত্যবাদী এবং পশ্চিমা ঘেঁষা ডিপ স্টেট উপাদানসমূহ, বিশেষ করে গোয়েন্দা সংস্থা ও বুরোক্রেটিক কাঠামো—তারা ইসলামি রূপান্তরের প্রকল্পটিকে আদতে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর, বিশেষ করে আমেরিকা ও ইউরোপের পক্ষ থেকেও ব্যাপক কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ আসে। ইসলামি শাসনব্যবস্থার ধারণা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে “র্যাডিকাল” আখ্যা পায়, এবং সুদানকে একঘরে করার হুমকি দেওয়া হয়।
ফলে, সামরিক নেতৃত্ব ধীরে ধীরে তুরাবিকে কোণঠাসা করতে শুরু করে। ১৯৯৯ সালে প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বাশির তাকে সমস্ত সরকারি পদ থেকে সরিয়ে দেন এবং রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেন। এর পরপরই সুদানে ইসলামি কাঠামো প্রায় পুরোপুরি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যদিও বাহ্যিকভাবে কিছু ইসলামি আইন টিকে ছিল, বাস্তবে শাসনব্যবস্থা রয়ে যায় পুরনো সামরিক-বুরোক্রেটিক শাসনের কায়দায়। রাজনৈতিক বিরোধিতা, দমন-পীড়ন, দুর্নীতি এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ অব্যাহত থাকে। পরিণতিতে তুরাবির স্বপ্নভঙ্গ ঘটে—যেখানে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটেছিল ঠিকই, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত শাসনব্যবস্থার রূপান্তর ঘটেনি। বরং সেনাবাহিনী ও ডিপ স্টেট নতুন বৈধতা নিয়ে নিজেদের আধিপত্য বহাল রাখে।
এই সব উদাহরণই প্রমাণ করে যে ডিপ স্টেটের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল ঘটতে পারে, কিন্তু সে পালাবদল কেবল রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত—ব্যবস্থাগত নয়। শাসনব্যবস্থা তখনই প্রকৃতপক্ষে পরিবর্তিত হয় যখন কাঠামোর ভিত্তি, নীতিনির্ধারণের উৎস, কর্তৃত্বের জবাবদিহিতা ও জনগণের ভূমিকা পুনর্নির্মিত হয়। কিন্তু ডিপ স্টেটের প্রকৃতিই এমন যে, তারা নিজেদের স্বার্থে সাময়িক পরিবর্তন ঘটিয়ে মূল কাঠামোকে অক্ষুণ্ণ রাখে। এটি একটি ছদ্মরূপের খেলা—নতুন মুখ, পুরোনো নিয়ম।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং মৌলিক প্রশ্ন আমাদের সামনে উঠে আসে—আমরা যারা ইসলাম ও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার শরিয়া প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তারা কি কেবল শাসনক্ষমতায় থাকা কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে সরাতে চাই, নাকি আমরা সম্পূর্ণ শাসনব্যবস্থাকে—তার চিন্তা, কাঠামো, এবং আইনসহ—পরিবর্তন করতে চাই?
এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের কাজের দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করবে। কারণ যদি লক্ষ্য হয় কেবল ক্ষমতার মুখ বদলানো—অর্থাৎ একদল শাসকের পরিবর্তে আরেক দলকে আনা—তবে সেটি হবে একটি অস্থায়ী, নড়বড়ে, এবং সহজেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার মতো পরিবর্তন। ইতিহাসের বহু ঘটনার মতো, এমন পরিবর্তনের ফলে দিনের শেষে রাষ্ট্রটি ফিরে যাবে তার পুরোনো পথেই। পুরোনো আমলাতন্ত্র, পুরোনো অর্থনৈতিক শৃঙ্খল, পুরোনো শিক্ষাব্যবস্থা, পুরোনো বিচার কাঠামো—সবই রয়ে যাবে অটুট। আর এগুলোই হল সেই গভীর শিকড়, যেখান থেকে শাসনব্যবস্থার প্রকৃত চরিত্র গঠিত হয়।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা যদি কোনো দেশের ডিপ স্টেট বা বিদ্যমান রাষ্ট্র কাঠামোকে অপরিবর্তিত রেখে তথাকথিত "ইসলামী" পরিবর্তনের আশা করি, তবে তা হবে মরুভূমিতে বৃক্ষরোপণের মতো। সাময়িক ছায়া দিতে পারে, কিন্তু গভীর শিকড় না থাকলে তা প্রথম ঝড়েই উপড়ে পড়বে। এমনকি যদি শুরুর দিকে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়ও, সে পদক্ষেপগুলো বিদ্যমান ব্যবস্থার বলয়, বিদেশি চাপ, অথবা অভ্যন্তরীণ ডিপ স্টেটের অপারেশনের মুখে টিকে থাকতে পারবে না।
•إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا۟ مَا بِأَنفُسِهِمْ•
... চলবে। - ইনশাআল্লাহ।
নোট: বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় ডিপ স্টেট বা ছায়া রাষ্ট্র কাঠামোর সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসা সবচেয়ে সম্ভাবনাময় কোন দল বা সংগঠন? তারা কীভাবে এই কাঠামোর সঙ্গে মিলে চলার বা তাকে ব্যবহারের চেষ্টা করছে?আমরা আগামী পর্বে এই দল বা জোটের রাজনৈতিক কৌশল, নেপথ্য যোগাযোগ এবং তাদের উত্থানের সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করব। পাশাপাশি, এই ধরনের ডিপ স্টেট-নির্ভর ক্ষমতা দখলের পন্থার কী কী বিপদ ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তা-ও বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। ইনশাআল্লাহ।
Comment