তালিবান ও আল-কায়েদার মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে উত্থাপিত আপত্তিসমূহের জবাব (৪)
মুনশি আব্দুর রহমান
মুনশি আব্দুর রহমান
১ম অধ্যায় | ২য় পরিচ্ছেদ (১)
২য় পরিচ্ছেদ
মোল্লা উমর রহিমাহুল্লাহ কি এই বাইআত গ্রহণ করেছিলেন?
এই প্রশ্নের উত্তর ইতিহাসই সবচেয়ে জোরালো ভাষায় দিয়েছে। ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে—আমীরুল মুমিনীন মোল্লা মুহাম্মদ উমর রহিমাহুল্লাহ শায়খ উসামা বিন লাদেন রহিমাহুল্লাহ’র বাইআত গ্রহণ করেছিলেন, বাইআত গ্রহণ করার ভিত্তিতে তাঁকে ইহুদীদের বিরুদ্ধে জিহাদের জিম্মাদারী অর্পণ করেছিলেন, তাঁকে মহান মুজাহিদ এবং মুসলমানদের খাদেম উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন এবং শায়খ উসামার দেওয়া সেই বাইআতের হক আমীরুল মুমিনিন যথার্থভাবে আদায় করেছিলেন। তিনি শুধু কাগজে-কলমে বাইআত গ্রহণ করে থেমে থাকেননি, বরং শত্রুর কঠোর চাপে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাইআতের প্রতি দায়িত্বশীলতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।
এ বিষয়ে কিছু শক্তিশালী ঐতিহাসিক দলিল নিচে উপস্থাপন করা হলো:
প্রথম দলিল: মোল্লা উমর রহিমাহুল্লাহ’র পক্ষ থেকে শায়খ উসামা রহিমাহুল্লাহ-কে পৃথিবীর সমস্ত জায়গায় ইহুদীদের বিরুদ্ধে জিহাদের অনুমতি প্রদান।
১। মোল্লা উমর রহিমাহুল্লাহ শায়খ উসামা রহিমাহুল্লাহ’র বিশ্বব্যাপী জিহাদের বিস্তারিত পরিকল্পনা মনোযোগ সহকারে শুনেছিলেন। এরপর শায়খ উসামা রহিমাহুল্লাহ-কে ইহুদীদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সমস্ত জায়গায় আক্রমণ পরিচালনার নির্দেশ ও অনুমোদন দিয়েছিলেন।
শায়খ আইমান আয-যাওয়াহিরী লিখেছেন-
"আমীরুল মুমিনিন মোল্লা মুহাম্মাদ উমর রহিমাহুল্লাহ’র সাথে একটি সাক্ষাতের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে, যেখানে আমি শায়খ উসামা রহিমাহুল্লাহ’র সাথে উপস্থিত হয়েছিলাম। শায়খ উসামা আমীরুল মুমিনিনের সামনে মাসজিদুল আকসার উপর ইহুদীদের আগ্রাসন এবং ফিলিস্তিনের মুসলমানদের উপর ভয়াবহ নির্যাতনের উপাখ্যান বিস্তারিত তুলে ধরেছিলেন। তখন আমীরুল মুমিনিন তাঁকে ইহুদীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার অনুমতি প্রদান করেন।" [10]
এই ঘটনার বিবরণ দিয়ে শায়খ খুবাইব আস সুদানী হাফিজাহুল্লাহ লিখেছেন-
"শায়খ উসামা রহিমাহুল্লাহ-কে মোল্লা উমর রহিমাহুল্লাহ বলেছিলেন, আমি চাই আপনি পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় আক্রমণ করুন! শায়খ উসামা রহিমাহুল্লাহ বলেছিলেন- "সামআন ওয়া ত্বয়াতান", আজকের সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই আমরা এই জিম্মাদারী বাস্তবায়নের জন্য কাজ শুরু করব ইনশাআল্লাহ।" [11]
মোল্লা উমর রহিমাহুল্লাহ যদি শায়খ উসামা রহিমাহুল্লাহ’র বাইআত কবুল না করতেন, তাঁকে নিজের একজন বাধ্যগত সৈনিক গণ্য না করতেন, তাহলে শায়খ উসামা রহিমাহুল্লাহকে আদেশ-নিষেধ করবেন কেন?
শায়খ উসামা রহিমাহুল্লাহ তাঁকে বাইআত দিয়ে আমীর মেনে তাঁর কাছে পরিকল্পনা পেশ করছেন, অনুমোদন প্রার্থনা করছেন, আর তিনিও কোনো কোনো পরিকল্পনা তাৎক্ষণিক অনুমোদন করছেন, আর কিছু কিছু পরিকল্পনার বাস্তবায়ন বিলম্বিত করার পরামর্শ দিচ্ছেন, নিজের অন্য সকল সৈনিক ও মামুরদের মতই শায়খ উসামা রহিমাহুল্লা ‘র নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দেওয়াকে নিজের জিম্মাদারী মনে করছেন - মোল্লা উমর রহিমাহুল্লাহ’র পক্ষ থেকে বাইআত কবুল করার এর চেয়ে বড় দলিল আর কি হতে পারে??
মূলত, একজন আমীরকে যখন কেউ বাইআত প্রদান করেন, তখন তো তিনি ঘোষণা করে বলা জরুরী না যে, আমি অমুকের বাইআত কবুল করলাম। এমনকি প্রত্যেকের নাম ধরে এভাবে গ্রহণের ঘোষণা দেওয়া সম্ভবও না। খোলাফায়ে রাশেদীনের ক্ষেত্রেও তো এমন দলিল দেখানো যাবে না, যে তাঁরা একজন একজন করে সাহাবীর নাম ধরে বলেছেন যে, আমি অমুকের বাইআত কবুল করলাম...
বরং 'আমি অমুকের বাইআত গ্রহণ করিনি' এমন কোন কথা না বলে মৌনতা অবলম্বন করলেও তো সেটা বাইআত কবুল করার দলিল হিসেবে যথেষ্ট, আর যদি তিনি বাইআত প্রদানকারীকে নিজের একজন অনুগত সৈনিক হিসেবে বিভিন্ন আদেশ-নিষেধ, নির্দেশ ও পরামর্শ দেন তাহলে সেটা তো বাইআত কবুল করার অকাট্য দলিল।
এ ধরনের বিষয় আসলে সবার কাছে এমনিতেই স্পষ্ট থাকার কথা ছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে মিডিয়ার অপপ্রচার ও প্রোপাগাণ্ডার কারণে এমন স্বতঃসিদ্ধ বিষয়কেও দলিল দিয়ে প্রমাণ করতে হচ্ছে!
দ্বিতীয় দলিল: শায়খ আয-যাওয়াহিরী’র স্মৃতিচারণ
শায়খ আয-যাওয়াহিরী মোল্লা উমর রহিমাহুল্লাহ-কে নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক এক বার্তায় বলেন:
“একবার আমি শায়খ উসামা রহিমাহুল্লাহ‘র সাথে ছিলাম। ইমারতে ইসলামী’র এক প্রতিনিধি দল মোল্লা মুহাম্মদ উমর রহিমাহুল্লাহ’র পত্র নিয়ে তাঁর সাক্ষাতে এসেছিলেন। পত্রে তিনি লিখেছিলেন, ‘আফগানিস্তানের কঠিন প্রস্তর ও বৃক্ষরাজি যদি শত্রুদের আঘাতে আঘাতে ভস্মীভূত হয়ে যায় তবুও আপনাকে শত্রুদের হাতে তুলে দেওয়া হবে না’। তিনি তাঁর বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণ করেছিলেন। আমীরুল মুমিনীন মোল্লা মুহাম্মদ উমর রহিমাহুল্লাহ’র হিম্মত ছিল আকাশচুম্বী। যে সকল গুণাবলী তাঁর মধ্যে পূর্ণ মাত্রায় ছিল সেগুলোর মধ্যে তাঁর হিকমত ছিল সবচেয়ে বেশি।” [12]
তৃতীয় দলিল: সৌদি বাদশাহর চাপ প্রত্যাখ্যান
৯/১১-এর পর শায়খ উসামা রহিমাহুল্লাহ-কে হস্তান্তরের জন্য সারা দুনিয়া থেকে তালিবান সরকারকে প্রবল চাপের মুখে পড়তে হয়েছিল। আরব বিশ্বের একাধিক মিত্র রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে হস্তান্তরের অনুরোধ আসে। এমনকি সৌদি আরবের রাজপরিবারের প্রভাবশালী সদস্য প্রিন্স তুর্কি আল-ফয়সাল স্বয়ং কান্দাহার পর্যন্ত চলে আসেন এক বিশাল বিমান বহরসহ। এই পুরো ইতিহাসটি শাইখ আইমানের একটি আলোচনায় উঠে এসেছে-
“শায়খ উসামা রহিমাহুল্লাহ-কে আমেরিকার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য সারা বিশ্বের পক্ষ থেকে ইমারতে ইসলামী’র উপর ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিল। সৌদি এবং আমেরিকার আরব মিত্ররা চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেনি। স্বয়ং সৌদির বাদশাহ তুর্কি আল ফয়সাল কান্দাহার এসেছিল শায়খ উসামা রহিমাহুল্লাহ এবং তাঁর সঙ্গীগণকে নেওয়ার জন্য, সাথে এনেছিল মস্ত বড় এক বিমান। আমীরুল মুমিনীনের সাথে সাক্ষাৎ করে তুর্কি বলল, ‘আপনি তো উসামাকে হস্তান্তর করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এখন প্রতিশ্রুতি পূরণের সময় হয়েছে। তাকে আমাদের হাতে তুলে দিন’। উক্ত বক্তব্য আমীরুল মুমিনীনের কাছে খুবই অবমাননাকর মনে হলো। তিনি তুর্কিকে বললেন, ‘আফ্রিকায় ঘটিত একটি বিষয় নিয়ে শায়খ উসামা রহিমাহুল্লাহ ও আমেরিকার মাঝে বিরোধ হয়েছিল। এটা তো আপনার ব্যাপার না। আপনি এখানে এই মিশন নিয়ে কেন আসবেন? আপনার পিতৃপুরুষ সাহাবায়ে কেরাম দুনিয়াবাসীকে ইজ্জতের জিন্দেগী যাপনের শিক্ষা দিয়ে গেছেন, আর আপনি কিনা আমেরিকার স্বার্থে কাজ করতে এসেছেন!’
এই আলোচনার দুইদিন পর সৌদি সরকার ইমারতে ইসলামী’র সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। তবে এর কারণে ইমারতে ইসলামী নিজের সিদ্ধান্তে বিন্দুমাত্রও পরিবর্তন আনেনি।
উল্লেখ্য, ইমারতে ইসলামী আফগানিস্তানকে স্বীকৃতি দানকারী মাত্র তিনটি রাষ্ট্রের মধ্যে সৌদি ছিল অন্যতম।” [13]
*****
চলবে...ইনশা আল্লাহ
সংশ্লিষ্ট টীকা ও লিংক-
[10] আল আমিরুল ওয়াফিয়্যু, সিলসিলাতু ইহমিল সিলাহাশ শহীদ: পৃষ্ঠা ১৭
[11] শাজারাতুম মিন তারিখিল ক্বায়িদাহ: পৃষ্ঠা ২৫৭
[12] আল আমিরুল ওয়াফিয়্যু, সিলসিলাতু ইহমিল সিলাহাশ শাহীদ, আলহালাকাতুল উলা, ভিডিও সংস্করণ- আস সাহাব মিডিয়া, শাবান ১৪৩৭ হিজরি / মে ২০১৬ ইংরেজি, আলবুশরয়াত কর্তৃক প্রকাশিত লিখিত মুদ্রণ- পৃষ্ঠা-১৬, ২০১৮ ইং- ১৪৩৯ হিজরি, মাকতাবা বাইতুল মাকদিস কর্তৃক প্রকাশিত লিখিত মুদ্রণ- পৃষ্ঠা-৩২, ২০১৯ ইং- ১৪৪১ হিজরি
ভিডিও লিংক- https://archive.org/details/20211006_20211006_2357
বাইতুল মাকদিস লিংক- https://archive.org/details/Ihmilsilahshahid
আলবুশরয়াত লিংক- https://archive.org/details/ihmil-silah
বাংলা অনুবাদ লিংক- https://archive.ph/Pxp8D
[13] সুত্র- আল আমিরুল ওয়াফিয়্যু, সিলসিলাতু ইহমিল সিলাহাশ শাহীদ, আলহালকাতুল উলা, ভিডিও সংস্করণ- আস সাহাব মিডিয়া, শাবান ১৪৩৭ হিজরি / মে ২০১৬ ইংরেজি, আলবুশরয়াত কর্তৃক প্রকাশিত লিখিত মুদ্রণ- পৃষ্ঠা-৬, ২০১৮ ইং- ১৪৩৯ হিজরি, মাকতাবা বাইতুল মাকদিস কর্তৃক প্রকাশিত লিখিত মুদ্রণ- পৃষ্ঠা-১৩, ২০১৯ ইং- ১৪৪১ হিজরি
ভিডিও লিংক- https://archive.org/details/20211006_20211006_2357
বাইতুল মাকদিস লিংক- https://archive.org/details/Ihmilsilahshahid
আলবুশরয়াত লিংক- https://archive.org/details/ihmil-silah
বাংলা অনুবাদ লিংক- https://archive.ph/Pxp8D
Comment