প্রশ্ন: বাংলাদেশে এমন কোনো সংগঠন বা রাজনৈতিক দল আছে কি, যারা ‘ডিপ স্টেট’ বা গভীর রাষ্ট্রের স্তরে প্রভাব বিস্তার করে শাসনব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন আনার সক্ষমতা রাখে?
উত্তর: বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এমন একটি মাত্র সংগঠন রয়েছে, যার ‘ডিপ স্টেট’ পর্যায়ে পরিবর্তন আনার সম্ভাব্যতা এখনো আংশিকভাবে বিদ্যমান। যদিও তারা এই কাজের জন্য বর্তমানে সক্রিয় বা পূর্ণ উদ্যমে সচেষ্ট নয়, তথাপি কাঠামোগত পরিকল্পনা ও সমাজগঠনের অতীত প্রয়াসের কারণে তাদের ভেতরে এই সম্ভাবনা নিহিত আছে।
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ও বিদ্রূপাত্মক বিষয় হলো—এই সংগঠনটি একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, এবং আরও অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে, তারা নিজেদের ইসলামী গণতান্ত্রিক দল হিসেবে পরিচয় দেয়। দলটির নাম
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
এই দ্বৈততা বা প্যারাডক্সটি বেশ উল্লেখযোগ্য:
একদিকে তারা একটি আদর্শভিত্তিক ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বলে, অন্যদিকে তারা সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার (গণতন্ত্র) ভেতরে কাজ করছে—যে ব্যবস্থার মূল ভিত্তিই ইসলামি রাষ্ট্রচিন্তার পরিপন্থী।
যদিও জামায়াত বর্তমানে নির্বাচনী রাজনীতিতে সংকুচিত ও কৌশলগতভাবে বিপর্যস্ত অবস্থানে আছে, তথাপি অতীতের প্রতিষ্ঠানভিত্তিক কর্মকাণ্ড (শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দাওয়াহ, সামাজিক সংগঠন ইত্যাদি) এবং একটি আদর্শবাদী ক্যাডারভিত্তিক সংগঠনের কাঠামো ডিপ স্টেট পর্যায়ে বিকল্প রাষ্ট্রিক চিন্তা বাস্তবায়নের সম্ভাব্য সূচনা বিন্দু হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক ইতিহাস ও কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দলটি শুধুমাত্র একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগঠন নয়, বরং অতীতে তাদের কর্মকৌশলের মধ্যে একটি সুদূরপ্রসারী রাষ্ট্র বিনির্মাণের পরিকল্পনার ছাপ বিদ্যমান ছিল। যদিও বর্তমানে তাদের সকল কার্যক্রম নির্বাচন, ক্ষমতায় যাওয়ার পথ ও রাজনৈতিক কৌশল ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে, কিন্তু তাদের ইতিহাসের শুরুর দিকে যে ধরনের সাংগঠনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশল অনুসরণ করা হয়েছিল, তা অনেক গভীরতর এবং কাঠামোগত ছিল।
জামায়াতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সচেতনভাবে দেশের মেধাবী, শিক্ষিত, আদর্শবাদী তরুণদের সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করে। তারা উপলব্ধি করেছিল যে, একটি আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের জন্য কেবল জনসমর্থন যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন একটি চিন্তাশীল, দক্ষ, আদর্শিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রস্তুত নেতৃত্বশ্রেণী, যারা রাষ্ট্র পরিচালনায় সক্ষম এবং ইসলামি আদর্শে সুসংগঠিত। এরই ধারাবাহিকতায় তারা ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির গঠন করে, যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদর্শিক ক্যাডার তৈরির একটি প্রধান মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জামায়াত-শিবিরের প্রভাব এক সময় এতটাই বিস্তৃত ছিল যে তা একটি "ছায়া বুদ্ধিবৃত্তিক নেটওয়ার্ক" হিসেবে কাজ করত।
তারা কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতা নয়, বরং প্রশাসনিক, আইন-শৃঙ্খলা, বিচার বিভাগ এবং সেনাবাহিনীর মতো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্তরগুলোতেও নিজেদের আদর্শিক অনুসারীদের পৌঁছাতে আগ্রহী ছিল। এ উদ্দেশ্যে তারা উচ্চশিক্ষায় মনোযোগী, সুশৃঙ্খল, আত্মনিয়মী ও আদর্শিক ছাত্র প্রস্তুত করে দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রযন্ত্রে প্রবেশের পথ প্রশস্ত করতে চেয়েছে। অনেক সময় এই প্রচেষ্টা সমালোচিত হলেও বাস্তবতা হলো—এটি ছিল একটি স্পষ্ট কৌশল যার লক্ষ্য ছিল “ডিপ স্টেট” পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার।
এর পাশাপাশি জামায়াতের অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনাও লক্ষণীয়। তারা খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পারে যে একটি আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের জন্য শুধু রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণই যথেষ্ট নয়, বরং প্রয়োজন অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা ও প্রভাব। তাই তারা একাধিক ব্যবসা, বীমা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, এনজিও, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থায় তাদের প্রভাব, ইসলামী বিমা (তাকাফুল) ব্যবস্থা, এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নমূলক কাজের মাধ্যমে তারা একটি বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার চেষ্টা করে। তারা জানত, অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ছাড়া নীতিনির্ধারণে প্রভাব বিস্তার সম্ভব নয়।
এই অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিকাঠামোগুলো আসলে একটি রাষ্ট্রের ভেতরে আরেকটি রাষ্ট্র বা ‘ ছায়া রাষ্ট্র’(deep state) তৈরির সূচনা বিন্দু হতে পারত। শিক্ষা, প্রশাসন, অর্থনীতি, সমাজসেবা—প্রতিটি খাতে তারা যে কাঠামোগত ভিত্তি গড়তে চেয়েছিল, তা একটি আদর্শভিত্তিক ছায়া রাষ্ট্র (deep state) নির্মাণের লক্ষণ বলেই পরিগণিত হতে পারে। বিশেষ করে ৮০ ও ৯০-এর দশকে, যখন জামায়াত সরাসরি ক্ষমতায় না থেকেও সামাজিক ও সাংগঠনিক স্তরে অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিল, তখন তাদের এ প্রচেষ্টা অনেকাংশেই সফল হয়েছিল।
একটি সময় জামায়াত এতটা সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী ও কাঠামোগতভাবে বিস্তৃত ছিল যে তারা ছিল রাষ্ট্রের বাইরে একটি “আদর্শ রাষ্ট্রের ছায়া সংস্করণ”—যেখানে প্রশাসনিক দক্ষতা, অর্থনৈতিক কৌশল, সাংস্কৃতিক নির্মাণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব একই সঙ্গে কাজ করছিল। তারা হাসপাতাল দিয়েছিল, বিদ্যালয় গড়েছিল, গবেষণা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেছিল, এমনকি মিডিয়া প্ল্যাটফর্মও তৈরি করেছিল। এটি নিছক “ক্ষমতায় যাওয়ার দল” হওয়ার চাইতে অনেক বড় পরিসরে ছিল।
যদিও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি অতীতে একটি 'ডিপ স্টেট' নির্মাণের সূচনা করেছিল—শিক্ষা, প্রশাসন, অর্থনীতি ও সমাজসেবার কাঠামোয় একটি আদর্শিক প্রজন্ম গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে—তবুও এই পরিকল্পনার একটি গভীর অন্তর্নিহিত সীমাবদ্ধতা ছিল, যেটা হয়তো তারা পুরোপুরি অনুধাবন করেনি।
একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এখানে দাঁড়ায়—যারা ইতোমধ্যে রাষ্ট্রের কেন্দ্রে অবস্থান করছে, তারা কি এত সহজে নিজেদের ক্ষমতা, আধিপত্য ও প্রতিষ্ঠিত শাসন কাঠামোর নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেবে? ইতিহাস বলছে—না, কখনোই না।
জামায়াত যে কৌশল গ্রহণ করেছিল তা ছিল "ধৈর্যশীল, প্রজন্মভিত্তিক, কাঠামোগত অনুপ্রবেশের কৌশল"। অর্থাৎ তারা এমন কোনো হঠাৎ অভ্যুত্থানের পথে হাঁটেনি বা রাষ্ট্রক্ষমতায় তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপের চিন্তা করেনি। বরং তারা ভাবছিল—একটি প্রজন্ম তৈরি করে, ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে নৈতিক, দক্ষ, এবং আদর্শবান লোকদের বসিয়ে ভবিষ্যতে শাসনব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
এই চিন্তা একদিকে যেমন বাস্তববাদী এবং দীর্ঘমেয়াদি, তেমনি অন্যদিকে ছিল একটি জায়ান্ট শক্তিকে ক্রমশ বিরক্ত করে তোলা—একটা কুমিরকে জলের নিচে ঘা দেওয়া। কারণ, ক্ষমতাবান মহলও অলস বসে ছিল না। তারা বুঝতে পেরেছিল—এই আদর্শিক ক্যাডারদের সংখ্যা যত বাড়বে, তাদের অস্তিত্ব ততই হুমকির মুখে পড়বে। ফলে যা হলো, তা ছিল অত্যন্ত হিসেবি ও ধাপে ধাপে পরিকল্পিত দমনপ্রক্রিয়া। প্রশাসনে, সেনাবাহিনীতে, বিচারব্যবস্থায় জামায়াতপন্থী বলে পরিচিত বহু ব্যক্তিকে প্রমোশন থেকে বঞ্চিত করা হলো, কেউ চাকরি হারাল, কারও বিরুদ্ধে অপ্রকাশ্য তদন্ত চলল, কেউ নিঃশব্দে সরিয়ে দেওয়া হলো। ইসলামপন্থী পরিচয় বা সামান্যতম আদর্শিক সংশ্লিষ্টতাও অনেকের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠল।
বিশেষ করে ২০১০ সালের পর, যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বকে বিচারের মুখোমুখি করা হয় এবং ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করা শুরু হয়, তখন এই দলটির ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নির্মাণের প্রকল্প কার্যত ভেঙে পড়ে। শুধু নেতৃত্ব নয়, ক্যাডার, ছাত্রসংগঠন, প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি—সব জায়গায় ব্যাপক রকমের দমন ও অবরোধ শুরু হয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও পেশাদার ক্ষেত্র থেকে জামায়াত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিচ্ছিন্ন করা হয়; কেউ কেউ আত্মগোপনে চলে যায়, কেউ বিদেশে পাড়ি জমায়, কেউ আত্মরক্ষা করতে নিজ পরিচয় আড়াল করে ফেলে।
এই প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, যে "ক্যাডারভিত্তিক ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র নির্মাণ" কৌশল একসময় জামায়াতের মূল সম্পদ ছিল, সেটিই পরবর্তীতে তাদের জন্য দায়বদ্ধতা ও ঝুঁকির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। যাদের তারা অ্যাসেট ভেবেছিল—তাদের উপস্থিতিই রাষ্ট্রের ক্ষমতাশালী মহলের চোখে হুমকি হয়ে ওঠে। ফলে এই প্রকল্পের সব স্তরেই পরিকল্পিতভাবে অবক্ষয়, অবরুদ্ধতা ও নিশ্চিহ্ন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
তবে এই দমন কৌশল হঠাৎ হয়নি। ক্ষমতাবানরা সময় নিয়েছে, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছে, এবং যখন দেখেছে যে জামায়াত সময় নিয়ে রাষ্ট্রের গভীরে প্রবেশের প্রয়াস নিচ্ছে—তখনই ধীরে ধীরে একে চিহ্নিত, কোণঠাসা ও নির্মূল করার পথে এগিয়েছে। এই লড়াইটা হয়েছে ‘নীরব রাষ্ট্রযুদ্ধ’-এর মতো। প্রকাশ্যে নয়, বরং একপ্রকার ছায়াযুদ্ধে।
এই বাস্তবতা আমাদের একটি বড় শিক্ষাও দেয়: শুধু প্রজন্ম গঠন বা কাঠামোগত অনুপ্রবেশ দিয়ে ডিপ স্টেট পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখলে হবে না, বরং বুঝতে হবে—ক্ষমতার প্রকৃতি নিজেই আত্মরক্ষামূলক এবং প্রতিক্রিয়াশীল। তাই ক্ষমতা কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করতে হলে কেবল দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি নয়, চাই সমান্তরাল বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও কৌশলগত বৈপ্লবিক প্রজ্ঞা।
জামায়াতে ইসলামির এই অধ্যায় থেকে আমরা বুঝতে পারি, একটি আদর্শভিত্তিক বিপরীত রাষ্ট্র নির্মাণ কৌশল তখনই টিকে থাকতে পারে, যখন তা ক্ষমতাকাঠামোর চোখ ফাঁকি দিয়ে নয়, বরং তাদের চেয়েও গভীর ও বিচক্ষণ এক নকশা ও স্বনির্ভর শক্তির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। অন্যথায়, প্রতিপক্ষ যখন বুঝে ফেলে যে আপনি দশ বছরের মধ্যে তার জুতা খুলে নিতে চাইছেন, তখন সে দশ মাসও অপেক্ষা করবে না।
জামায়াতে ইসলাম বাংলাদেশ একটি ব্যতিক্রমধর্মী রাজনৈতিক দল হিসেবে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনার ভিত্তিতে রাষ্ট্রক্ষমতা অর্জনের পরিবর্তে রাষ্ট্র কাঠামোর গভীরে প্রবেশ এবং ধীরে ধীরে তার উপর একটি আদর্শিক “ছায়া রাষ্ট্র” প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নিয়েছিল। তারা বিশ্বাস করেছিল, এক বা দুই প্রজন্ম পর এই ‘ডিপ স্টেট’ এতটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠবে যে মূল রাষ্ট্র কাঠামোর জায়গা দখল করে নিতে পারবে। এক অর্থে, তারা বিপ্লব নয়, বরং "ক্রিপটিক ট্রান্সফর্মেশন" বা ছায়াময় রূপান্তরের পথে হাঁটছিল।
তবে বাস্তবতা হলো—তাদের এই কৌশল সফল হয়নি। কারণ, রাষ্ট্রের আসল ক্ষমতা কাঠামো, অর্থাৎ ডিপ স্টেট—যেটি সেনা, গোয়েন্দা, আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ, অর্থনৈতিক অভিজাত শ্রেণি, এবং আন্তর্জাতিক শক্তি-সম্পৃক্ত অংশের সমন্বয়ে গঠিত—তা কখনোই চুপচাপ বসে ছিল না। তারা জামায়াতের কৌশল বুঝে ফেলে, এবং খুব কৌশলী ও পর্যায়ক্রমিক পদ্ধতিতে এই কাঠামো নির্মাণের প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করে দেয়।
এখানেই গুরুত্বপূর্ণ সেই শিক্ষা—যদি কেউ মনে করেন যে এই বর্তমান ডিপ স্টেট কাঠামো অক্ষুণ্ন রেখে শুধু তার উপর চাপ প্রয়োগ করে শাসনব্যবস্থা বদলে দেওয়া যাবে, তাহলে সেটা ভয়ানক একটি ভুল।
ডিপ স্টেট হচ্ছে এমন এক ক্ষমতা কাঠামো, যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু রাষ্ট্রের প্রতিটি সংবেদনশীল ও নীতিনির্ধারক স্তরে প্রোথিত থাকে। এই কাঠামো তার নিজের আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত, সক্রিয়, এবং প্রায়শঃ নিষ্ঠুরভাবে প্রতিক্রিয়াশীল। যদি কেউ এই কাঠামোকে অক্ষত রেখে শুধু ‘চাপ প্রয়োগ’-এর মাধ্যমে বড় ধরনের রাষ্ট্রিক পরিবর্তন আনতে চায়, তাহলে সে হয়তো মাঝেমধ্যে এক-আধটা প্রতীকী সফলতা অর্জন করতে পারে—যেমন:
তবে এসব সফলতা হবে কেবলই "token victories", সাময়িক চাপ সৃষ্টির ফল। এগুলোর মাধ্যমে ডিপ স্টেট পরিবর্তন সম্ভব নয়। কারণ, ডিপ স্টেট তার কাঠামো বদলায় না চাপে, বরং বদলায় সংঘাতে বা পুনর্গঠনে, যেখানে কেবল দাবিনামা নয়, প্রয়োজন বিকল্প ক্ষমতার বাস্তব কাঠামো।
উত্তর: বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এমন একটি মাত্র সংগঠন রয়েছে, যার ‘ডিপ স্টেট’ পর্যায়ে পরিবর্তন আনার সম্ভাব্যতা এখনো আংশিকভাবে বিদ্যমান। যদিও তারা এই কাজের জন্য বর্তমানে সক্রিয় বা পূর্ণ উদ্যমে সচেষ্ট নয়, তথাপি কাঠামোগত পরিকল্পনা ও সমাজগঠনের অতীত প্রয়াসের কারণে তাদের ভেতরে এই সম্ভাবনা নিহিত আছে।
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ও বিদ্রূপাত্মক বিষয় হলো—এই সংগঠনটি একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, এবং আরও অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে, তারা নিজেদের ইসলামী গণতান্ত্রিক দল হিসেবে পরিচয় দেয়। দলটির নাম
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
এই দ্বৈততা বা প্যারাডক্সটি বেশ উল্লেখযোগ্য:
একদিকে তারা একটি আদর্শভিত্তিক ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বলে, অন্যদিকে তারা সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার (গণতন্ত্র) ভেতরে কাজ করছে—যে ব্যবস্থার মূল ভিত্তিই ইসলামি রাষ্ট্রচিন্তার পরিপন্থী।
যদিও জামায়াত বর্তমানে নির্বাচনী রাজনীতিতে সংকুচিত ও কৌশলগতভাবে বিপর্যস্ত অবস্থানে আছে, তথাপি অতীতের প্রতিষ্ঠানভিত্তিক কর্মকাণ্ড (শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দাওয়াহ, সামাজিক সংগঠন ইত্যাদি) এবং একটি আদর্শবাদী ক্যাডারভিত্তিক সংগঠনের কাঠামো ডিপ স্টেট পর্যায়ে বিকল্প রাষ্ট্রিক চিন্তা বাস্তবায়নের সম্ভাব্য সূচনা বিন্দু হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক ইতিহাস ও কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দলটি শুধুমাত্র একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগঠন নয়, বরং অতীতে তাদের কর্মকৌশলের মধ্যে একটি সুদূরপ্রসারী রাষ্ট্র বিনির্মাণের পরিকল্পনার ছাপ বিদ্যমান ছিল। যদিও বর্তমানে তাদের সকল কার্যক্রম নির্বাচন, ক্ষমতায় যাওয়ার পথ ও রাজনৈতিক কৌশল ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে, কিন্তু তাদের ইতিহাসের শুরুর দিকে যে ধরনের সাংগঠনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশল অনুসরণ করা হয়েছিল, তা অনেক গভীরতর এবং কাঠামোগত ছিল।
জামায়াতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সচেতনভাবে দেশের মেধাবী, শিক্ষিত, আদর্শবাদী তরুণদের সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করে। তারা উপলব্ধি করেছিল যে, একটি আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের জন্য কেবল জনসমর্থন যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন একটি চিন্তাশীল, দক্ষ, আদর্শিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রস্তুত নেতৃত্বশ্রেণী, যারা রাষ্ট্র পরিচালনায় সক্ষম এবং ইসলামি আদর্শে সুসংগঠিত। এরই ধারাবাহিকতায় তারা ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির গঠন করে, যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদর্শিক ক্যাডার তৈরির একটি প্রধান মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জামায়াত-শিবিরের প্রভাব এক সময় এতটাই বিস্তৃত ছিল যে তা একটি "ছায়া বুদ্ধিবৃত্তিক নেটওয়ার্ক" হিসেবে কাজ করত।
তারা কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতা নয়, বরং প্রশাসনিক, আইন-শৃঙ্খলা, বিচার বিভাগ এবং সেনাবাহিনীর মতো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্তরগুলোতেও নিজেদের আদর্শিক অনুসারীদের পৌঁছাতে আগ্রহী ছিল। এ উদ্দেশ্যে তারা উচ্চশিক্ষায় মনোযোগী, সুশৃঙ্খল, আত্মনিয়মী ও আদর্শিক ছাত্র প্রস্তুত করে দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রযন্ত্রে প্রবেশের পথ প্রশস্ত করতে চেয়েছে। অনেক সময় এই প্রচেষ্টা সমালোচিত হলেও বাস্তবতা হলো—এটি ছিল একটি স্পষ্ট কৌশল যার লক্ষ্য ছিল “ডিপ স্টেট” পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার।
এর পাশাপাশি জামায়াতের অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনাও লক্ষণীয়। তারা খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পারে যে একটি আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের জন্য শুধু রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণই যথেষ্ট নয়, বরং প্রয়োজন অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা ও প্রভাব। তাই তারা একাধিক ব্যবসা, বীমা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, এনজিও, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থায় তাদের প্রভাব, ইসলামী বিমা (তাকাফুল) ব্যবস্থা, এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নমূলক কাজের মাধ্যমে তারা একটি বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার চেষ্টা করে। তারা জানত, অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ছাড়া নীতিনির্ধারণে প্রভাব বিস্তার সম্ভব নয়।
এই অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিকাঠামোগুলো আসলে একটি রাষ্ট্রের ভেতরে আরেকটি রাষ্ট্র বা ‘ ছায়া রাষ্ট্র’(deep state) তৈরির সূচনা বিন্দু হতে পারত। শিক্ষা, প্রশাসন, অর্থনীতি, সমাজসেবা—প্রতিটি খাতে তারা যে কাঠামোগত ভিত্তি গড়তে চেয়েছিল, তা একটি আদর্শভিত্তিক ছায়া রাষ্ট্র (deep state) নির্মাণের লক্ষণ বলেই পরিগণিত হতে পারে। বিশেষ করে ৮০ ও ৯০-এর দশকে, যখন জামায়াত সরাসরি ক্ষমতায় না থেকেও সামাজিক ও সাংগঠনিক স্তরে অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিল, তখন তাদের এ প্রচেষ্টা অনেকাংশেই সফল হয়েছিল।
একটি সময় জামায়াত এতটা সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী ও কাঠামোগতভাবে বিস্তৃত ছিল যে তারা ছিল রাষ্ট্রের বাইরে একটি “আদর্শ রাষ্ট্রের ছায়া সংস্করণ”—যেখানে প্রশাসনিক দক্ষতা, অর্থনৈতিক কৌশল, সাংস্কৃতিক নির্মাণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব একই সঙ্গে কাজ করছিল। তারা হাসপাতাল দিয়েছিল, বিদ্যালয় গড়েছিল, গবেষণা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেছিল, এমনকি মিডিয়া প্ল্যাটফর্মও তৈরি করেছিল। এটি নিছক “ক্ষমতায় যাওয়ার দল” হওয়ার চাইতে অনেক বড় পরিসরে ছিল।
যদিও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি অতীতে একটি 'ডিপ স্টেট' নির্মাণের সূচনা করেছিল—শিক্ষা, প্রশাসন, অর্থনীতি ও সমাজসেবার কাঠামোয় একটি আদর্শিক প্রজন্ম গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে—তবুও এই পরিকল্পনার একটি গভীর অন্তর্নিহিত সীমাবদ্ধতা ছিল, যেটা হয়তো তারা পুরোপুরি অনুধাবন করেনি।
একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এখানে দাঁড়ায়—যারা ইতোমধ্যে রাষ্ট্রের কেন্দ্রে অবস্থান করছে, তারা কি এত সহজে নিজেদের ক্ষমতা, আধিপত্য ও প্রতিষ্ঠিত শাসন কাঠামোর নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেবে? ইতিহাস বলছে—না, কখনোই না।
জামায়াত যে কৌশল গ্রহণ করেছিল তা ছিল "ধৈর্যশীল, প্রজন্মভিত্তিক, কাঠামোগত অনুপ্রবেশের কৌশল"। অর্থাৎ তারা এমন কোনো হঠাৎ অভ্যুত্থানের পথে হাঁটেনি বা রাষ্ট্রক্ষমতায় তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপের চিন্তা করেনি। বরং তারা ভাবছিল—একটি প্রজন্ম তৈরি করে, ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে নৈতিক, দক্ষ, এবং আদর্শবান লোকদের বসিয়ে ভবিষ্যতে শাসনব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
এই চিন্তা একদিকে যেমন বাস্তববাদী এবং দীর্ঘমেয়াদি, তেমনি অন্যদিকে ছিল একটি জায়ান্ট শক্তিকে ক্রমশ বিরক্ত করে তোলা—একটা কুমিরকে জলের নিচে ঘা দেওয়া। কারণ, ক্ষমতাবান মহলও অলস বসে ছিল না। তারা বুঝতে পেরেছিল—এই আদর্শিক ক্যাডারদের সংখ্যা যত বাড়বে, তাদের অস্তিত্ব ততই হুমকির মুখে পড়বে। ফলে যা হলো, তা ছিল অত্যন্ত হিসেবি ও ধাপে ধাপে পরিকল্পিত দমনপ্রক্রিয়া। প্রশাসনে, সেনাবাহিনীতে, বিচারব্যবস্থায় জামায়াতপন্থী বলে পরিচিত বহু ব্যক্তিকে প্রমোশন থেকে বঞ্চিত করা হলো, কেউ চাকরি হারাল, কারও বিরুদ্ধে অপ্রকাশ্য তদন্ত চলল, কেউ নিঃশব্দে সরিয়ে দেওয়া হলো। ইসলামপন্থী পরিচয় বা সামান্যতম আদর্শিক সংশ্লিষ্টতাও অনেকের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠল।
বিশেষ করে ২০১০ সালের পর, যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বকে বিচারের মুখোমুখি করা হয় এবং ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করা শুরু হয়, তখন এই দলটির ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নির্মাণের প্রকল্প কার্যত ভেঙে পড়ে। শুধু নেতৃত্ব নয়, ক্যাডার, ছাত্রসংগঠন, প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি—সব জায়গায় ব্যাপক রকমের দমন ও অবরোধ শুরু হয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও পেশাদার ক্ষেত্র থেকে জামায়াত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিচ্ছিন্ন করা হয়; কেউ কেউ আত্মগোপনে চলে যায়, কেউ বিদেশে পাড়ি জমায়, কেউ আত্মরক্ষা করতে নিজ পরিচয় আড়াল করে ফেলে।
এই প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, যে "ক্যাডারভিত্তিক ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র নির্মাণ" কৌশল একসময় জামায়াতের মূল সম্পদ ছিল, সেটিই পরবর্তীতে তাদের জন্য দায়বদ্ধতা ও ঝুঁকির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। যাদের তারা অ্যাসেট ভেবেছিল—তাদের উপস্থিতিই রাষ্ট্রের ক্ষমতাশালী মহলের চোখে হুমকি হয়ে ওঠে। ফলে এই প্রকল্পের সব স্তরেই পরিকল্পিতভাবে অবক্ষয়, অবরুদ্ধতা ও নিশ্চিহ্ন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
তবে এই দমন কৌশল হঠাৎ হয়নি। ক্ষমতাবানরা সময় নিয়েছে, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছে, এবং যখন দেখেছে যে জামায়াত সময় নিয়ে রাষ্ট্রের গভীরে প্রবেশের প্রয়াস নিচ্ছে—তখনই ধীরে ধীরে একে চিহ্নিত, কোণঠাসা ও নির্মূল করার পথে এগিয়েছে। এই লড়াইটা হয়েছে ‘নীরব রাষ্ট্রযুদ্ধ’-এর মতো। প্রকাশ্যে নয়, বরং একপ্রকার ছায়াযুদ্ধে।
এই বাস্তবতা আমাদের একটি বড় শিক্ষাও দেয়: শুধু প্রজন্ম গঠন বা কাঠামোগত অনুপ্রবেশ দিয়ে ডিপ স্টেট পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখলে হবে না, বরং বুঝতে হবে—ক্ষমতার প্রকৃতি নিজেই আত্মরক্ষামূলক এবং প্রতিক্রিয়াশীল। তাই ক্ষমতা কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করতে হলে কেবল দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি নয়, চাই সমান্তরাল বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও কৌশলগত বৈপ্লবিক প্রজ্ঞা।
জামায়াতে ইসলামির এই অধ্যায় থেকে আমরা বুঝতে পারি, একটি আদর্শভিত্তিক বিপরীত রাষ্ট্র নির্মাণ কৌশল তখনই টিকে থাকতে পারে, যখন তা ক্ষমতাকাঠামোর চোখ ফাঁকি দিয়ে নয়, বরং তাদের চেয়েও গভীর ও বিচক্ষণ এক নকশা ও স্বনির্ভর শক্তির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। অন্যথায়, প্রতিপক্ষ যখন বুঝে ফেলে যে আপনি দশ বছরের মধ্যে তার জুতা খুলে নিতে চাইছেন, তখন সে দশ মাসও অপেক্ষা করবে না।
জামায়াতে ইসলাম বাংলাদেশ একটি ব্যতিক্রমধর্মী রাজনৈতিক দল হিসেবে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনার ভিত্তিতে রাষ্ট্রক্ষমতা অর্জনের পরিবর্তে রাষ্ট্র কাঠামোর গভীরে প্রবেশ এবং ধীরে ধীরে তার উপর একটি আদর্শিক “ছায়া রাষ্ট্র” প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নিয়েছিল। তারা বিশ্বাস করেছিল, এক বা দুই প্রজন্ম পর এই ‘ডিপ স্টেট’ এতটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠবে যে মূল রাষ্ট্র কাঠামোর জায়গা দখল করে নিতে পারবে। এক অর্থে, তারা বিপ্লব নয়, বরং "ক্রিপটিক ট্রান্সফর্মেশন" বা ছায়াময় রূপান্তরের পথে হাঁটছিল।
তবে বাস্তবতা হলো—তাদের এই কৌশল সফল হয়নি। কারণ, রাষ্ট্রের আসল ক্ষমতা কাঠামো, অর্থাৎ ডিপ স্টেট—যেটি সেনা, গোয়েন্দা, আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ, অর্থনৈতিক অভিজাত শ্রেণি, এবং আন্তর্জাতিক শক্তি-সম্পৃক্ত অংশের সমন্বয়ে গঠিত—তা কখনোই চুপচাপ বসে ছিল না। তারা জামায়াতের কৌশল বুঝে ফেলে, এবং খুব কৌশলী ও পর্যায়ক্রমিক পদ্ধতিতে এই কাঠামো নির্মাণের প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করে দেয়।
এখানেই গুরুত্বপূর্ণ সেই শিক্ষা—যদি কেউ মনে করেন যে এই বর্তমান ডিপ স্টেট কাঠামো অক্ষুণ্ন রেখে শুধু তার উপর চাপ প্রয়োগ করে শাসনব্যবস্থা বদলে দেওয়া যাবে, তাহলে সেটা ভয়ানক একটি ভুল।
ডিপ স্টেট হচ্ছে এমন এক ক্ষমতা কাঠামো, যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু রাষ্ট্রের প্রতিটি সংবেদনশীল ও নীতিনির্ধারক স্তরে প্রোথিত থাকে। এই কাঠামো তার নিজের আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত, সক্রিয়, এবং প্রায়শঃ নিষ্ঠুরভাবে প্রতিক্রিয়াশীল। যদি কেউ এই কাঠামোকে অক্ষত রেখে শুধু ‘চাপ প্রয়োগ’-এর মাধ্যমে বড় ধরনের রাষ্ট্রিক পরিবর্তন আনতে চায়, তাহলে সে হয়তো মাঝেমধ্যে এক-আধটা প্রতীকী সফলতা অর্জন করতে পারে—যেমন:
- কোন বিতর্কিত আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি (যেমন: সমকামী জাতিসংঘ দূত) প্রবেশে বাধা সৃষ্টি,
- কোনো শিক্ষা পাঠ্যক্রমে সংশোধনী,
- কিংবা মিডিয়ায় নির্দিষ্ট ইসলামবিরোধী কনটেন্টের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
তবে এসব সফলতা হবে কেবলই "token victories", সাময়িক চাপ সৃষ্টির ফল। এগুলোর মাধ্যমে ডিপ স্টেট পরিবর্তন সম্ভব নয়। কারণ, ডিপ স্টেট তার কাঠামো বদলায় না চাপে, বরং বদলায় সংঘাতে বা পুনর্গঠনে, যেখানে কেবল দাবিনামা নয়, প্রয়োজন বিকল্প ক্ষমতার বাস্তব কাঠামো।
Comment