তালিবান ও আল-কায়েদার মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে উত্থাপিত আপত্তিসমূহের জবাব (৯)
মুনশি আব্দুর রহমান

৩য় অধ্যায় | ২য় পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদঃ আমীরুল মুমিনীন মোল্লা হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা (হাফিজাহুল্লাহ) কর্তৃক আল-কায়েদার বাইআত কবুলের প্রমাণ
আমরা আগেও আলোচনা করেছি, কোনো আমীরকে যদি মুসলমানগণ বাইআত প্রদান করেন, তাহলে প্রত্যেকের নাম ধরে ধরে বাইআত কবুলের ঘোষণা দেওয়া আমীরের জন্য আবশ্যক নয়, এবং এটা আসলে পুরোপুরি সম্ভবও নয়। তাই আমীরের পক্ষ থেকে মৌনতাও বাইআত গ্রহণের পক্ষে সম্মতির প্রমাণ হিসেবেই গণ্য হবে।
যদি নির্দিষ্ট করে নাম ধরে বাইআত কবুলের ঘোষণা থাকার শর্ত করা হয়, তাহলে শিয়াদের জন্যও সুযোগ তৈরী হবে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে প্রদত্ত সকল সাহাবীর বাইআতকে বাতিল গণ্য করার। কিংবা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক পূর্ববর্তী তিন খলিফাকে প্রদত্ত বাইআতকে অসম্পন্ন বলে দাবী করার।
তালিবানদের দ্বিতীয় আমীর মোল্লা আখতার মানসুর রহিমাহুল্লাহ স্পষ্টভাবে নাম উল্লেখ করে আল-কায়েদা এবং অন্যান্য কিছু বাইআত প্রদানকারীদের বাইআত কবুল করেছিলেন।
কিন্তু তৃতীয় আমীর মোল্লা হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা (হাফিজাহুল্লাহ)-এর সময়ে যেহেতু আস্তে আস্তে আমেরিকার পরাজয়ের আলামত স্পষ্ট হচ্ছিল এবং তালিবানরা নতুন করে রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা তৈরী হচ্ছিল, তাই তিনি ভবিষ্যত রাষ্ট্রের মাসলাহাতের দিকে তাকিয়ে কৌশলগত কারণে মৌন সম্মতির মাধ্যমে বাইআত কবুল করেছেন।
প্রমাণ হিসেবে যদিও এই মৌন সম্মতিই যথেষ্ট, কিন্তু এর বাইরেও তালিবান কর্তৃক বাইআত কবুলের আরো বেশ কিছু শক্তিশালী এবং স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।
নিম্নে আমি তা পেশ করছি:
১। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে তালিবানের পক্ষ থেকে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে স্পষ্ট দেখানো হয় যে, তালিবান ও আল-কায়েদার মাঝে পুরনো ও পরীক্ষিত ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক আছে, এবং তা এখনো বিদ্যমান।
ভিডিওটি নিয়ে 'লং ওয়ার জার্নাল' একটি প্রতিবেদন তৈরী করেছিল। [1]
২। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বারে মার্কিন সামরিক বাহিনীর জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফসের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলে বলেন, 'তালিবান কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে আল-কায়েদা থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয়নি, কখনোই আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নও করেনি।' [2]
৩। সৌদী ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম Independent Arabia ২০২৫ সালের মার্চ মাসে নিউজ করেছে যে, গত ৩ বছরে তালিবানের অন্তত তিনজন শীর্ষনেতা আল-কায়েদার ব্যাপারে ইতিবাচক বক্তব্য দিয়েছেন।
আমর বিল মারুফ, নাহি আনিল মুনকার মন্ত্রনালয়ের সামরিক সহকারী পদের দায়িত্বশীল সাইদ আহমাদ শহীদ খেল বলেছেন- "আমি উসামা বিন লাদেনকে নিয়ে গর্ব করি, এবং আমাদের সরকারকে নিয়েও গর্ব করি। আমাদের সরকার মানুষের মর্যাদা, ইনসাফ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে।"
এ বছরের মার্চ মাসে কাবুলের একটি আলোচনা সভায় বক্তব্য প্রদানকালে তিনি এ কথা বলেন।
তালেবান সরকারের পানি ও বিদ্যুৎ মন্ত্রী আব্দুল লতিফ মুনাওয়ার বলেন-
"আল-কায়েদা কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন নয়। আল-কায়েদার সদস্যরা তালিবানদের ভাই"...
তিনি আরো বলেন-
"যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের সহায়তায় আমাদের সরকারের পতন ঘটিয়েছিল এই দাবী করে যে, তারা গ্লোবাল সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। কিন্তু আমরা তখনও তাদেরকে (আল-কায়েদাকে) সন্ত্রাসী আখ্যা দেইনি, এখনও সন্ত্রাসী আখ্যা দেই না। জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’র পথে তারা আমাদের ভাই"। [3]
৪। মোল্লা হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা (হাফিজাহুল্লাহ)-এর সময়কাল থেকেই আফগানিস্তানে আল-কায়েদার বিভিন্ন হাইপ্রোফাইল নেতৃত্ব শহীদ হয়েছেন। যাদের মাঝে আছেন- আল-কায়েদার কেন্দ্রীয় মিডিয়া বিভাগের প্রধান শায়খ হুসসাম আব্দুর রউফ, একিউ উপমহাদেশের আমীর মাওলানা আসেম উমর রহিমাহুল্লাহ সহ একিউ উপমহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন কমান্ডার, শায়খ উসামা রহিমাহুল্লাহ’র ছেলে হামজা বিন উসামা রহিমাহুল্লাহ। এমনকি শায়খ আইমান আয-যাওয়াহিরীও রাজধানী কাবুলেই শহীদ হয়েছেন বলে আমেরিকা দাবী করেছে। কিন্তু একিউ বা তালেবান কেউই এটিকে সত্যায়নও করেনি, আবার মিথ্যাও বলেননি।
এই সকল আলোচনা থেকেও বুঝে আসে যে, তালিবানদের সাথে আল-কায়েদার গভীর সম্পর্ক এখনো রয়েছে।
তবে তালিবান ‘আফগানিস্তানে একিউ নেই’ বলে আসলে তাওরিয়া করছে। আফগানে যারা আছেন, তারা তালিবানের পরিচয়ে ও তাদের কমান্ডেই আছেন। ফলে এটি মিথ্যা হবে না। অপরদিকে তালিবান মুজাহিদদের কৌশলের সমর্থনে একিউও আফগানে শহীদ হওয়া নেতৃবৃন্দের ব্যাপারে নিরবতা অবলম্বন করছে।
জিহাদি মিডিয়ায় (যেমন: আস-সাহাব, আল-সাবাত, উম্মাহ ও অন্যান্য) এখনো তালিবান প্রধানকে “আমীরুল মুমিনীন” বলে সম্বোধন করা হয় – এটি বাইআত অব্যাহত থাকার একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত।
সুতরাং এই সমস্ত প্রমাণের আলোকে এই সিদ্ধান্তে সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয় যে, তালিবান এখনো আল-কায়েদার বাইআত এবং সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছে।
কৌশলগত নীরবতা, জিহাদি বাস্তবতা, অতীত সম্পর্কের উত্তরাধিকার এবং একে অপরের প্রতি সম্মান ও প্রতিরক্ষা – সব মিলিয়ে দৃঢ়ভাবে ধারণা করা যায় যে, মোল্লা হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা (হাফিজাহুল্লাহ) বাইআত প্রত্যাখ্যান করেননি, বরং কৌশলগত কারণে মোল্লা উমর রহিমাহুল্লাহ’র মত প্রকাশ্যে ঘোষণার পরিবর্তে মৌন সম্মতির মাধ্যমে বাইআত কবুল করেছেন।
*****
চলবে...ইনশা আল্লাহ
সংশ্লিষ্ট টীকা ও লিংক-
[1] লং ওয়ার জার্নাল ভিডিওটির উপর একটি প্রতিবেদন করেছে- https://archive.ph/IbCDC
http://https://archive.org/download/20230514_20230514_1042/%D8%AF%20%D9%85%D9%84%D8%AA%20%D9%BE%DB%8C%D9%88%D 9%86%D8%AF%20%D9%84%D9%87%20%D9%85%D8%AC%D8%A7%D9% 87%D8%AF%DB%8C%D9%86%D9%88%20%D8%B3%D8%B1%D9%87.mp 4
[2] জেনারেল মার্ক মিলের বক্তব্য-
[3] সাইদ আহমাদ শহীদ খেল এবং আব্দুল লতিফ মুনাওয়ার হাফিজাহুমাল্লাহ’র বক্তব্য সম্পর্কে নিউজ-
https://www.independentarabia.com/node/619527/%D8%B3%D9%8A%D8%A7%D8%B3%D8%A9/%D8%AA%D9%82%D8%A7%D8%B1%D9%8A%D8%B1/%D8%A7%D9%84%D9%82%D8%A7%D8%B9%D8%AF%D8%A9-%D9%88%D8%B7%D8%A7%D9%84%D8%A8%D8%A7%D9%86-%D8%A8%D9%86-%D9%84%D8%A7%D8%AF%D9%86-%D9%84%D9%85-%D9%8A%D8%B2%D9%84-%D9%87%D9%86%D8%A7%D9%83
Comment