আমাদের আলোচনাই আমরা বলেছিলাম একটি প্রবণতা ক্রমে দৃশ্যমান, যা কিছু চিন্তাশীল ভাইদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে—তারা মনে করেন যে সমসাময়িক বাস্তবতায় কেবলমাত্র বাংলাদেশই হতে পারে কৌশলগত লক্ষ্যভূমি। উম্মাহ বা বৃহৎ ভূরাজনৈতিক মাত্রাকে আপাতত পেছনে রেখে, তারা একটি অঞ্চল-কেন্দ্রিক এবং কার্যনির্দেশক বাস্তবতার কথা বলেন। এ দাবির পেছনে তারা কয়েকটি ধারাবাহিক যুক্তির ভিত্তি দাঁড় করিয়েছেন।
প্রথমত, তাদের দাবি হলো—আমেরিকার বিশ্ব-আধিপত্য দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। আফগানিস্তান থেকে তার অপমানজনক প্রস্থান, মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাবের সীমিত হয়ে আসা, ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে অর্থনৈতিক ও সামরিক ভারসাম্যের পুনর্বিন্যাস—এসব কিছুই মিলিয়ে তারা বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন আর আগের মতো দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলোর উপর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারবে না।(১) সেইসাথে তারা রাশিয়া ও চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কথা উল্লেখ করেন, যারা ঐতিহাসিকভাবে পশ্চিমা আগ্রাসনের প্রতিযোগী শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। ফলে বাংলাদেশের উপর বাইরের চাপ কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা দিন দিন ক্ষীণ হচ্ছে বলেই তাদের বিশ্লেষণ।
দ্বিতীয়ত, এই চিন্তাধারার অনুসারীরা গাজওয়াতুল হিন্দ বিষয়ক হাদীসসমূহকে কৌশলগত নির্দেশনা হিসেবে গ্রহণে অনাগ্রহী। তাদের মতে, এই হাদীসগুলো তো দুর্বল, নয়তো বিশ্লেষণের জন্য অপর্যাপ্ত। তারা বলেন, এসব বর্ণনায় যুদ্ধের ভৌগোলিক সীমানা, শত্রুর প্রকৃতি, সময়কাল বা রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে সুসংহত কোনো পরিকল্পনা গ্রহণের উপযুক্ত উপাদান নেই। ফলে এসব হাদীস থেকে তারা আজকের ভূরাজনৈতিক চিত্রে কোনো নির্দিষ্ট নির্দেশনা বা মঞ্জিল নির্ধারণ করতে সক্ষম হন না।
তৃতীয়ত, তারা ভারতের অভ্যন্তরীণ জটিলতা ও বহুমুখী সঙ্কটকে সামনে এনে বলেন—এতবড় একটি রাষ্ট্র, যা একযোগে চীন, পাকিস্তান ও নেপালের সঙ্গে সীমান্তবিরোধে জড়িত এবং যার অভ্যন্তরে সেভেন সিস্টারস, আসাম, কাশ্মীরসহ বহু বিচ্ছিন্নতাবাদী উপাদান সক্রিয়—সেই রাষ্ট্র নতুন করে আর কোনো যুদ্ধ-উদ্যোগ গ্রহণ করবে না। তাই ‘গাযওয়াতুল হিন্দ’ ধাঁচের কোনো আগ্রাসনের ধারণা তারা কল্পনাবিলাসী হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেন।
এই বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তারা বলেন—বর্তমানে মুসলিমদের সামনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠিত তাগুত ব্যবস্থাকে উৎখাতের জন্য চিন্তা, প্রচেষ্টা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করা। তাৎক্ষণিক বাস্তবতায় এই অঞ্চলকেন্দ্রিক পরিবর্তনকে তারা প্রাধান্য দেন। তাদের মতে, জনগণের ঈমানী জাগরণ, রাজনৈতিক চেতনা ও সাংগঠনিক প্রস্তুতি এখন এই ভৌগোলিক সীমানার মধ্যেই কেন্দ্রীভূত হওয়া উচিত।
তবে এখানেই এসে এই প্রবণতা নিজেই দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়ে। এর একটি ধারা এমন, যারা বলেন—আমরা উম্মাহর বিজয়ের স্বপ্ন অস্বীকার করছি না, তবে বাস্তবতায় আমাদের আপাত লক্ষ্য হবে বাংলাদেশ। তারা জাতি রাষ্টের সীমানা ও কাঠামোকে মৌলিকভাবে অস্বীকার করেন কিন্তু কৌশলগত কারণে বিচ্ছিন্নতা গ্রহণ করেন। অন্যদিকে, আরও একটি শক্তিশালী ধারা রয়েছে যারা সরাসরি খিলাফতের নববী মডেলকেই অকার্যকর ঘোষণা করে বলেন—বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নবুওয়াতভিত্তিক খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। তাই আমাদের উচিত একটি বাঙালি জাতীয়তাবাদ-নির্ভর সালতানাত গঠন, যা ইসলামী মূল্যবোধ কিছুটা ধারণ করলেও মূলত জাতিগত রাজনৈতিক শক্তির বাস্তবায়ন হবে।
লক্ষ্য নির্ধারণের প্রশ্নে গ্লোবাল মানহাজ-অনুসারী ভাইদের সঙ্গে স্থানিক রাজনৈতিক বাস্তবতা-কেন্দ্রিক কিছু ভাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান, যা কেবল মতানৈক্যের বহিঃপ্রকাশ নয়—বরং এটি প্রজ্ঞার উৎস, বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির পরিধি, এবং উম্মাহবোধের গভীরতা নির্ধারণে এক গুরুত্বপূর্ণ রেখাচিত্র রচনা করে। এই পার্থক্যের পেছনে রয়েছে একাধিক ঐতিহাসিক ও প্রেক্ষিতভিত্তিক কারণ, যা সরলীকৃত যুক্তির মাধ্যমে ব্যাখ্যাত হবার নয়।
উল্লেখযোগ্য একটি যুক্তি উপস্থাপন করে বলা হয়—বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা আজ মূলত স্বাধীন, এবং অতীতে আমেরিকার যে আধিপত্য ছিল, তা এখন অনেকটাই লুপ্তপ্রায়। অথচ বাস্তবতা হলো, সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক অঙ্কন ও রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তসমূহ এই ধারণাকে বিপরীতভাবে প্রত্যাখ্যান করছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের নামে তথাকথিত মানবাধিকার দপ্তর, যার মাধ্যমে ‘এলজিবিটিকিউ+’ ও নারীবাদী মূল্যবোধকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার অপচেষ্টা চলছে, সেটি সরাসরি আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির সম্প্রসারণ। আর এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে যারা ইসলামি দাওয়াহ এবং আদর্শিক কর্মতৎপরতায় অংশ নিচ্ছেন, তাদের উপর যেভাবে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে, তা নিছক কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়—বরং তা একটি বৃহত্তর বৈশ্বিক নির্দেশনার প্রতিফলন। যদিও যুক্তরাষ্ট্র এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মাটিতে সরাসরি সামরিকভাবে উপস্থিত নয়, তথাপি তাদের মতাদর্শ ও চিন্তাধারাকে আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার প্রক্রিয়া পুরোদমে চলছে। দেশের অভ্যন্তরে গড়ে তোলা তাদের অনুগত পুতুল সরকারকে ব্যবহার করে আমাদের উপর চাপ, প্রভাব এবং দমন-পীড়নের নীতি বাস্তবায়ন করছে—এবং আমরা তা চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। অতি শীঘ্রই আমাদেরকে খুন করা হবে। আমাদেরকে কারাগারে পাঠানো হবে। আমাদেরকে মারধর ও নির্যাতন করা হবে। আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা ও বিচারের নামে প্রহসন চলবে। শুধু আদর্শিকভাবে নয়—আমাদেরকে শারীরিকভাবেও দমন করা হবে, যাতে আমরা নতজানু হই, চুপ করে থাকি, আর কখনো প্রশ্ন করতে না পারি।গ্লোবাল মানহাজ-অনুসারীরা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করেন যে, আজকের দিনে উম্মাহর সংগ্রামকে স্থানিক পরিসরের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা একান্তই অজ্ঞানের পরিচায়ক কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত তাদেরকে গ্লোবাল পর্যায়ে চাপের মাঝে রাখা যাবে ততদিন তারা এই হস্তক্ষেপ থেকে দূরে থাকবে।
গ্লোবাল মানহাজ-অনুসারী ভাইদের বিশ্লেষণে দেখা যায়, উপমহাদেশে জিহাদি চিন্তাধারার মূল ভিত্তি নববী ভবিষ্যদ্বাণীসমূহ—বিশেষত গাজওয়াতুল হিন্দ সংক্রান্ত হাদীসসমূহ। এগুলোর ভাষা যদিও কখনো কখনো সংক্ষিপ্ত বা ইশারাপূর্ণ, তবুও ইসলামী ইতিহাসে এমন বহু ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে—যেগুলো কালক্রমে একটি গোটা সভ্যতার গতিপথ নির্ধারণ করেছে। গাজওয়াতুল হিন্দ-সংক্রান্ত হাদীসগুলো অনেক মুহাদ্দিসের মতে এই হাদিসসমূহের গুরুত্ব অপরিসীম। আর বাস্তবে আজ উপমহাদেশে যে সব মুজাহিদীন ময়দানে রত, তারা এই ভবিষ্যদ্বাণীর উপর ভিত্তি করেই নিজেদের পথরেখা নির্ধারণ করছেন। অতএব, এই ধারাকে উপেক্ষা করা মানে এমন একটি ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক প্রবাহ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা, যা বহু পূর্ব থেকেই উম্মাহর মুক্তির সন্ধান বহন করে চলেছে।
এছাড়া, ভারতের ভূরাজনৈতিক ভূমিকাও এই আলোচনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। কেউ কেউ যুক্তি দেন, ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে সে আর বাহ্যিক আগ্রাসনে আগ্রহী নয়। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করে, দুর্বলতাগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলোই বহির্মুখী আগ্রাসনের আশ্রয় গ্রহণ করে নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ঢাকতে চায়। ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক কাঠামো এবং মুসলিম-বিদ্বেষী নীতিনির্ধারণ একে এক সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত করেছে, যার রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার অন্যতম উপায় হলো সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টির মাধ্যমে ‘জাতীয় ঐক্য’ বজায় রাখা। এভাবে কাশ্মীর দখল, বাংলাদেশে এনআরসি ও সীমান্ত হত্যা, কিংবা হঠাৎ হঠাৎ সামরিক মহড়া—সবই মূলত অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর এক রণকৌশল। পৃথিবীর বহু আগ্রাসন যেমন ভারত-পাকিস্তান, ইরাক-ইসরাইল যুদ্ধ, ইসরায়েল-গাজা আক্রমণ, কিংবা রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন—প্রথমে 'অসম্ভব' বলেই প্রতিপন্ন হয়েছে, অথচ বাস্তবে সেগুলো হঠাৎই সংঘটিত হয়েছে। সুতরাং যেকোনো রাষ্ট্রের আগ্রাসী আচরণকে শুধুমাত্র তার অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে বাতিল করে দেয়া একপ্রকার রাজনৈতিক সরলীকরণ, যা কোনো সচেতন উম্মাহর জন্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
প্রথমত, তাদের দাবি হলো—আমেরিকার বিশ্ব-আধিপত্য দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। আফগানিস্তান থেকে তার অপমানজনক প্রস্থান, মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাবের সীমিত হয়ে আসা, ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে অর্থনৈতিক ও সামরিক ভারসাম্যের পুনর্বিন্যাস—এসব কিছুই মিলিয়ে তারা বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন আর আগের মতো দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলোর উপর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারবে না।(১) সেইসাথে তারা রাশিয়া ও চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কথা উল্লেখ করেন, যারা ঐতিহাসিকভাবে পশ্চিমা আগ্রাসনের প্রতিযোগী শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। ফলে বাংলাদেশের উপর বাইরের চাপ কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা দিন দিন ক্ষীণ হচ্ছে বলেই তাদের বিশ্লেষণ।
দ্বিতীয়ত, এই চিন্তাধারার অনুসারীরা গাজওয়াতুল হিন্দ বিষয়ক হাদীসসমূহকে কৌশলগত নির্দেশনা হিসেবে গ্রহণে অনাগ্রহী। তাদের মতে, এই হাদীসগুলো তো দুর্বল, নয়তো বিশ্লেষণের জন্য অপর্যাপ্ত। তারা বলেন, এসব বর্ণনায় যুদ্ধের ভৌগোলিক সীমানা, শত্রুর প্রকৃতি, সময়কাল বা রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে সুসংহত কোনো পরিকল্পনা গ্রহণের উপযুক্ত উপাদান নেই। ফলে এসব হাদীস থেকে তারা আজকের ভূরাজনৈতিক চিত্রে কোনো নির্দিষ্ট নির্দেশনা বা মঞ্জিল নির্ধারণ করতে সক্ষম হন না।
তৃতীয়ত, তারা ভারতের অভ্যন্তরীণ জটিলতা ও বহুমুখী সঙ্কটকে সামনে এনে বলেন—এতবড় একটি রাষ্ট্র, যা একযোগে চীন, পাকিস্তান ও নেপালের সঙ্গে সীমান্তবিরোধে জড়িত এবং যার অভ্যন্তরে সেভেন সিস্টারস, আসাম, কাশ্মীরসহ বহু বিচ্ছিন্নতাবাদী উপাদান সক্রিয়—সেই রাষ্ট্র নতুন করে আর কোনো যুদ্ধ-উদ্যোগ গ্রহণ করবে না। তাই ‘গাযওয়াতুল হিন্দ’ ধাঁচের কোনো আগ্রাসনের ধারণা তারা কল্পনাবিলাসী হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেন।
এই বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তারা বলেন—বর্তমানে মুসলিমদের সামনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠিত তাগুত ব্যবস্থাকে উৎখাতের জন্য চিন্তা, প্রচেষ্টা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করা। তাৎক্ষণিক বাস্তবতায় এই অঞ্চলকেন্দ্রিক পরিবর্তনকে তারা প্রাধান্য দেন। তাদের মতে, জনগণের ঈমানী জাগরণ, রাজনৈতিক চেতনা ও সাংগঠনিক প্রস্তুতি এখন এই ভৌগোলিক সীমানার মধ্যেই কেন্দ্রীভূত হওয়া উচিত।
তবে এখানেই এসে এই প্রবণতা নিজেই দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়ে। এর একটি ধারা এমন, যারা বলেন—আমরা উম্মাহর বিজয়ের স্বপ্ন অস্বীকার করছি না, তবে বাস্তবতায় আমাদের আপাত লক্ষ্য হবে বাংলাদেশ। তারা জাতি রাষ্টের সীমানা ও কাঠামোকে মৌলিকভাবে অস্বীকার করেন কিন্তু কৌশলগত কারণে বিচ্ছিন্নতা গ্রহণ করেন। অন্যদিকে, আরও একটি শক্তিশালী ধারা রয়েছে যারা সরাসরি খিলাফতের নববী মডেলকেই অকার্যকর ঘোষণা করে বলেন—বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নবুওয়াতভিত্তিক খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। তাই আমাদের উচিত একটি বাঙালি জাতীয়তাবাদ-নির্ভর সালতানাত গঠন, যা ইসলামী মূল্যবোধ কিছুটা ধারণ করলেও মূলত জাতিগত রাজনৈতিক শক্তির বাস্তবায়ন হবে।
লক্ষ্য নির্ধারণের প্রশ্নে গ্লোবাল মানহাজ-অনুসারী ভাইদের সঙ্গে স্থানিক রাজনৈতিক বাস্তবতা-কেন্দ্রিক কিছু ভাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান, যা কেবল মতানৈক্যের বহিঃপ্রকাশ নয়—বরং এটি প্রজ্ঞার উৎস, বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির পরিধি, এবং উম্মাহবোধের গভীরতা নির্ধারণে এক গুরুত্বপূর্ণ রেখাচিত্র রচনা করে। এই পার্থক্যের পেছনে রয়েছে একাধিক ঐতিহাসিক ও প্রেক্ষিতভিত্তিক কারণ, যা সরলীকৃত যুক্তির মাধ্যমে ব্যাখ্যাত হবার নয়।
উল্লেখযোগ্য একটি যুক্তি উপস্থাপন করে বলা হয়—বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা আজ মূলত স্বাধীন, এবং অতীতে আমেরিকার যে আধিপত্য ছিল, তা এখন অনেকটাই লুপ্তপ্রায়। অথচ বাস্তবতা হলো, সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক অঙ্কন ও রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তসমূহ এই ধারণাকে বিপরীতভাবে প্রত্যাখ্যান করছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের নামে তথাকথিত মানবাধিকার দপ্তর, যার মাধ্যমে ‘এলজিবিটিকিউ+’ ও নারীবাদী মূল্যবোধকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার অপচেষ্টা চলছে, সেটি সরাসরি আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির সম্প্রসারণ। আর এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে যারা ইসলামি দাওয়াহ এবং আদর্শিক কর্মতৎপরতায় অংশ নিচ্ছেন, তাদের উপর যেভাবে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে, তা নিছক কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়—বরং তা একটি বৃহত্তর বৈশ্বিক নির্দেশনার প্রতিফলন। যদিও যুক্তরাষ্ট্র এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মাটিতে সরাসরি সামরিকভাবে উপস্থিত নয়, তথাপি তাদের মতাদর্শ ও চিন্তাধারাকে আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার প্রক্রিয়া পুরোদমে চলছে। দেশের অভ্যন্তরে গড়ে তোলা তাদের অনুগত পুতুল সরকারকে ব্যবহার করে আমাদের উপর চাপ, প্রভাব এবং দমন-পীড়নের নীতি বাস্তবায়ন করছে—এবং আমরা তা চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। অতি শীঘ্রই আমাদেরকে খুন করা হবে। আমাদেরকে কারাগারে পাঠানো হবে। আমাদেরকে মারধর ও নির্যাতন করা হবে। আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা ও বিচারের নামে প্রহসন চলবে। শুধু আদর্শিকভাবে নয়—আমাদেরকে শারীরিকভাবেও দমন করা হবে, যাতে আমরা নতজানু হই, চুপ করে থাকি, আর কখনো প্রশ্ন করতে না পারি।গ্লোবাল মানহাজ-অনুসারীরা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করেন যে, আজকের দিনে উম্মাহর সংগ্রামকে স্থানিক পরিসরের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা একান্তই অজ্ঞানের পরিচায়ক কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত তাদেরকে গ্লোবাল পর্যায়ে চাপের মাঝে রাখা যাবে ততদিন তারা এই হস্তক্ষেপ থেকে দূরে থাকবে।
গ্লোবাল মানহাজ-অনুসারী ভাইদের বিশ্লেষণে দেখা যায়, উপমহাদেশে জিহাদি চিন্তাধারার মূল ভিত্তি নববী ভবিষ্যদ্বাণীসমূহ—বিশেষত গাজওয়াতুল হিন্দ সংক্রান্ত হাদীসসমূহ। এগুলোর ভাষা যদিও কখনো কখনো সংক্ষিপ্ত বা ইশারাপূর্ণ, তবুও ইসলামী ইতিহাসে এমন বহু ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে—যেগুলো কালক্রমে একটি গোটা সভ্যতার গতিপথ নির্ধারণ করেছে। গাজওয়াতুল হিন্দ-সংক্রান্ত হাদীসগুলো অনেক মুহাদ্দিসের মতে এই হাদিসসমূহের গুরুত্ব অপরিসীম। আর বাস্তবে আজ উপমহাদেশে যে সব মুজাহিদীন ময়দানে রত, তারা এই ভবিষ্যদ্বাণীর উপর ভিত্তি করেই নিজেদের পথরেখা নির্ধারণ করছেন। অতএব, এই ধারাকে উপেক্ষা করা মানে এমন একটি ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক প্রবাহ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা, যা বহু পূর্ব থেকেই উম্মাহর মুক্তির সন্ধান বহন করে চলেছে।
এছাড়া, ভারতের ভূরাজনৈতিক ভূমিকাও এই আলোচনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। কেউ কেউ যুক্তি দেন, ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে সে আর বাহ্যিক আগ্রাসনে আগ্রহী নয়। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করে, দুর্বলতাগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলোই বহির্মুখী আগ্রাসনের আশ্রয় গ্রহণ করে নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ঢাকতে চায়। ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক কাঠামো এবং মুসলিম-বিদ্বেষী নীতিনির্ধারণ একে এক সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত করেছে, যার রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার অন্যতম উপায় হলো সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টির মাধ্যমে ‘জাতীয় ঐক্য’ বজায় রাখা। এভাবে কাশ্মীর দখল, বাংলাদেশে এনআরসি ও সীমান্ত হত্যা, কিংবা হঠাৎ হঠাৎ সামরিক মহড়া—সবই মূলত অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর এক রণকৌশল। পৃথিবীর বহু আগ্রাসন যেমন ভারত-পাকিস্তান, ইরাক-ইসরাইল যুদ্ধ, ইসরায়েল-গাজা আক্রমণ, কিংবা রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন—প্রথমে 'অসম্ভব' বলেই প্রতিপন্ন হয়েছে, অথচ বাস্তবে সেগুলো হঠাৎই সংঘটিত হয়েছে। সুতরাং যেকোনো রাষ্ট্রের আগ্রাসী আচরণকে শুধুমাত্র তার অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে বাতিল করে দেয়া একপ্রকার রাজনৈতিক সরলীকরণ, যা কোনো সচেতন উম্মাহর জন্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
Comment