আল হিকমাহ মিডিয়া পরিবেশিত
“‘জামাআত কায়িদাতুল জিহাদ’ সম্পর্কে প্রচলিত আপত্তির জবাব
।।ভাই আবু আব্দুল্লাহ আল-মায়াফিরী||
এর থেকে– পঞ্চম পর্ব
“‘জামাআত কায়িদাতুল জিহাদ’ সম্পর্কে প্রচলিত আপত্তির জবাব
।।ভাই আবু আব্দুল্লাহ আল-মায়াফিরী||
এর থেকে– পঞ্চম পর্ব
৮) আল-কায়েদা ও আইএস-এর মাঝে কোনও পার্থক্য আছে কি? থাকলে সেগুলো কি?
উত্তর : আল-কায়েদা ও আইএসের মাঝে রয়েছে বিশাল পার্থক্য। এ বিষয়টি তিনটি পর্যালোচনা ও একটি পরিশিষ্টে আলোচনা করা হচ্ছে।
প্রথম পর্যালোচনা
আইএস সৃষ্টির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা: ইরাকে আল-কায়েদার প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে শাইখ আবু মুসআব যারকাভী রহিমাহুল্লাহ’র নেতৃত্বে। এর নাম রাখা হয়েছিল ‘কায়েদাতুল জিহাদ ফি বিলাদির রাফিদাইন।’ আরও কিছু দল ও উপদলের মিশ্রণের পর এর নামকরণ করা হয় ‘মাজলিসু শুরা আল-মুজাহিদিন।’
এই মজলিস গঠনের মাধ্যমে শাইখ যারকাভী রহিমাহুল্লাহ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বীজ বপন করতে চেয়েছিলেন। তিনি তাতে সফলও হয়েছেন। তবে তার শাহাদাতের পর যখন আবু উমর বাগদাদীকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয় তখন তিনি ‘দাওলাতুল ইরাক আল ইসলামিয়া’র ঘোষণা দেন, যা ছিল চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্ত। এমন পরিস্থিতিতে সি.আই.এ-এর প্রধান পেট্রাউস মুজাহিদদের স্বপ্নের ইসলামী রাষ্ট্র ও তাদেরকে নিঃশেষ করতে এক অভিনব পরিকল্পনা হাতে নেয়।
তার এই নীলনকশার ভিত্তি ছিল; সুন্নিদের মধ্য থেকে একটি সশস্ত্র গ্রুপ তৈরি করতে হবে, যারা সুন্নি এলাকাগুলো থেকে জিহাদের উপস্থিতি ধ্বংস করার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেবে। পেট্রাউস যেমনটি চেয়েছিল ঠিক তেমনটিই হয়েছে। সুন্নি এলাকাসমূহ মুজাহিদশূন্য হয়ে পড়ল। মুজাহিদগণ আম্বারের মরু অঞ্চলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেন এবং সেখানেই থাকতে লাগলেন। রাফেজি প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকীর বিরুদ্ধে নির্যাতিত সুন্নিদের বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পূর্বে তারা আর ফিরে আসেনি।
বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর মুজাহিদগণ আম্বারে ফিরে আসেন এবং বিদ্রোহীদেরকে সাহায্য করতে থাকেন। সে সময়টিতে নুরি’র সৈনিকরা বিদ্রোহীদের অবস্থানসমূহে হামলা করছিল এবং তাদের শিবিরগুলো জালিয়ে দিচ্ছিল। দাওলাতুল ইরাক আল-ইসলামিয়ার মুজাহিদগণ আম্বারে ফিরে আসার সময়টিতে সিরিয়ায় বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়।
ইতিমধ্যে সরকারি বাহিনী দাওলাতুল ইরাক আল ইসলামিয়ার আমীর আবু উমর বাগদাদী এবং যুদ্ধমন্ত্রী আবু হামজা মুহাজির-এর অবস্থান চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়। তাই বড় ধরনের হামলা চালিয়ে সরকার তাদেরকে হত্যা করে এবং তাদের স্ত্রীদেরকে বন্দি করে। আবু উমর বাগদাদী নিহত হওয়ার পর আবু বকর বাগদাদীকে তার স্থলাভিষিক্ত নির্বাচন করা হয়। আল-কায়েদা আবু বকর বাগদাদীকে চিনতেন না। তাই এই নির্বাচনে তারা সায় দেয়নি। আল-কায়েদা তার অপসারণ দাবি করে। কিন্তু ইরাকী নেতৃবৃন্দ এই বলে অক্ষমতা প্রকাশ করে যে, তারা বিষয়টি ঘোষণা করে দেওয়ার পর তা আর প্রত্যাহার করতে পারবেন না। অগত্যা আল-কায়েদা বাগদাদীর ভালোমন্দ জানতে তার জীবন-চরিত পাঠানোর অনুরোধ করেন। কিন্তু তারা তা করেনি।
সিরিয়ার বিদ্রোহের সূচনাকালে বাগদাদী শামবাসীকে সাহায্য করতে আবু মুহাম্মদ জাওলানীর নেতৃত্বে একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। এর নাম দেওয়া হয় ‘জাবহাতুন নুসরাহ লী আহলিশ-শাম’। এ পর্যায়ে জাবহাতুন নুসরাহ ও বাগদাদীর দলের মাঝে চুক্তি হয় যে, জাবহাতুন নুসরাকে দাওলাতুল ইরাক আল-ইসলামিয়ার অনুগত বাহিনী হিসেবে ঘোষণা করা যাবে না। এর মাধ্যমে হয়তো দাওলাতুল ইরাক আল-ইসলামিয়ার অন্যান্য ঘোষণার কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত হবে এবং পশ্চিমা লেখকদের টার্গেট হওয়া থেকে নিরাপদ থাকা যাবে।
আবু মুহাম্মদ জাওলানীর নেতৃত্বে জাবহাতুন নুসরাহ যখন বিশাল সফলতা অর্জন করল তখন বাগদাদী তাদেরকে নিজের অনুগত বলে ঘোষণা করলেন এবং দাওলা ও জাবহাতুন নুসরাহর সমন্বিত নাম রাখেন- ‘দাওলাতুল ইসলামিয়া ফিল ইরাক ওয়াশ-শাম (আইএস)। জাওলানী হাফিযাহুল্লাহ উক্ত সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেন এবং আল-কায়েদার প্রতি তার আনুগত্যের বিষয়টি পুনঃর্ব্যক্ত করেন।
শাইখ জাওলানী ও বাগদাদীর মাঝে এ নিয়ে দ্বন্দ্ব যখন তীব্র আকার ধারণ করে তখন তারা উভয়ে শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরীকে শালিস হিসেবে মেনে নেন। যারা এ বিষয়ে মধ্যস্থতা করছিলেন তারা শাইখ জাওলানী ও বাগদাদীর কাছ থেকে শপথ গ্রহণ করেন যে, সিদ্ধান্ত যাই আসুক তারা মেনে নেবেন। অতঃপর শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী বাগদাদীকে ইরাকে ফিরে যেতে এবং শাইখ জাওলানীকে শামে অবস্থানের নির্দেশ দেন। তখন বাগদাদী তার শপথ ভঙ্গ করেন এবং শাইখ যাওয়াহিরীকে জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী বলে অভিযোগ উত্থাপন করেন। এ পর্যায়ে এসে তিনি খিলাফাহ ঘোষণা করেন এবং শাইখ জাওলানী, শাইখ যাওয়াহিরী এবং সকল জিহাদি দল ও উপদলসমূহকে তার আনুগত্য করার এবং তাকে বাইআত দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি এখানেই থেমে থাকেননি, শাইখ জাওলানীকে[1] তার কথিত খেলাফতের অনুগত বানাতে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। এক পর্যায়ে তার এই যুদ্ধ অন্যান্য জিহাদি দলসমূহের বিরুদ্ধেও সম্প্রসারিত হয়। তারপর আসে তাকফিরের পালা (কাফের ঘোষণা)। তিনি এবং তার দল মিলে সবগুলো দলকে একেরপর এক কাফের আখ্যা দিয়ে (তাকফির করে) তবেই ক্ষান্ত হয়।
প্রতিটি দলের বিরুদ্ধে তারাই প্রথমে যুদ্ধ শুরু করত, তারপর তারা সেই দলকে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অপরাধে তাকফির করত। ইরাকে তারা যে নীতি ও কর্মপন্থা গ্রহণ করেছে সিরিয়াতেও তারা তা প্রয়োগ করতে চেয়েছিল। অথচ ইরাক ও সিরিয়ার অবস্থা মোটেও এক ছিল না। কারণ ইরাকের সাহাওয়াত (দল) আমেরিকার পক্ষ হয়ে মুজাহিদগণকে নিঃশেষ করার চেষ্টা করছিল। আমেরিকার পক্ষাবলম্বী সাহাওয়াতের বিরুদ্ধে আইএস সফলতা পেয়েছে। অপরদিকে সিরিয়ার মুজাহিদগণ যুদ্ধ করছিলেন আত্মরক্ষার খাতিরে এবং তারা যুদ্ধ করছিলেন আইএসের আগ্রাসন প্রতিহত করার লক্ষ্যে।
তারা শুধু নির্বিচারে তাকফির করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং বিদ্রোহী বহু দল ও গোত্রের বিরুদ্ধে নির্মম গণহত্যা চালিয়েছে। নারী ও শিশুদের সামনে তারা শুয়াইত্বাত গোত্রের পুরুষদের হত্যা করেছে। জিহাদি ও বিদ্রোহী বহু নেতৃবৃন্দকে তারা শিরশ্ছেদ করেছে। তাঁদেরকে হত্যা করতে তারা বিভিন্ন ফাঁদ পেতেছে, আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছে। তাদের হামলার হাত থেকে আল্লাহর ঘর মসজিদও রক্ষা পায়নি। আহরারুশ-শামের কতিপয় মুজাহিদ এক মসজিদে তারাবিহ পড়ছিলেন, বাগদাদীর সেনারা তাদেরকে নামাজরত অবস্থায়ই হত্যা করে।
এই পর্যায়ে এসে আল-কায়েদা নীরবতা ভাঙ্গতে বাধ্য হয়, তারা আইএসের সাথে আল-কায়েদার বিচ্ছিন্নতা ঘোষণা করেন। তারা জানিয়ে দেন যে, হত্যা, জবাই ও তাকফির করার যে নীতি আইএস গ্রহণ করেছে তা আল-কায়েদার নীতি নয়। তারা এগুলো সমর্থন করে না।
দ্বিতীয় পর্যালোচনা :
ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসগুলো দুইভাবে জিহাদের মোকাবেলা করে-
- শিথিলতা প্রদর্শন : মিশরের আল জামাতুল ইসলামিয়ার ক্ষেত্রে উক্ত নীতির বাস্তবায়ন পরিলক্ষিত হয়েছে। উক্ত ইসলামি জামাআত মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিল। তবে তারা যখন নৈতিক পরিবর্তনের ঘোষণা দেয় তখন মিডিয়া ও ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসগুলো সহানুভূতিশীল হবার ভান করে।
- তাকফিরের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি ছড়িয়ে দেওয়া: আলজেরিয়ার সশস্ত্র ইসলামি জামাআতের ক্ষেত্রে উক্ত নীতির বাস্তবায়ন ঘটানো হয়েছে। উক্ত জামাআতের অবস্থা এমন হয়েছিল যে, তারা নির্বিচারে তাকফির করে নিজেদের বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদেরকে পর্যন্ত হত্যা করেছিল। একপর্যায়ে তারা গোটা মুসলিম জাতিকে তাকফির করে।
তাকফিরের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্ত হলো - সাম্প্রতিক আইএস। ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসগুলো তাদের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি ছড়িয়ে দেওয়ার নীতি ষোলআনা কাজে লাগিয়েছে। যে সময় জিহাদি দলসমূহের জন্য মুসলিম উম্মাহর সাহায্য-সহযোগিতা ছিল অতি প্রয়োজনীয়, সে সময়টিতে তাদের বাড়াবাড়ি তাদেরকে উম্মাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।
ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসগুলো সবসময়ই বাড়াবাড়ি ছড়িয়ে দেওয়ার নীতি বাস্তবায়ন করতে উপযুক্ত পরিবেশ খুঁজতে থাকে। তাদের খোঁজখবর জেলখানার বন্দিদের থেকে শুরু করে জিহাদের ময়দান পর্যন্ত সর্বত্রই চলতে থাকে।
ইরাকের দিকে দৃষ্টি ফেরালে দেখা যাবে যে, বাড়াবাড়ির বিস্তার প্রথম থেকেই শুরু হয়েছিল। আইএসের বদৌলতে ধীরে ধীরে তা বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছে।
প্রথম দিকে ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস ও মিডিয়া ব্যাপকভাবে তাদের বাড়াবাড়ি প্রচার করে এবং আইএসকে আল-কায়েদার সেকেন্ড জেনারেশন (২G) তথা উন্নত ও দ্বিতীয় প্রজন্ম বলে প্রচারণা চালায়। ফলে অনেকেই আইএসকে আল-কায়েদার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ভাবতে থাকে এবং তাদের দলে ভিড়তে শুরু করে।
সেই সাথে আবু মুসআব যারকাভী রহিমাহুল্লাহ’র কিছু কঠোর অভিমতের আশ্রয় নিয়ে এমন একটি ধারনা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়ে যে, উক্ত 2G (আইএস) তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাস্তবে এই 2G বানিয়েছেন বাগদাদী, শাইখ যারকাভী নয়।
বাড়াবাড়ির সূচনা:
ইরাকে আমেরিকার যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দিকনির্দেশনা দেওয়ার মতো আলেম-উলামা ছিল না বললেই চলে। উম্মাহর আলেমদের লক্ষ্যে এক বার্তায় (الحاق بالقافله কাফেলাবদ্ধ হও) শাইখ যারকাভী বলেন, ‘আল্লাহর কসম! আপনি আমাদের মাঝে এমন কোনও আলেম পাবেন না, আমরা যার শরণাপন্ন হতে পারি’।
ইরাকে উলামায়ে কেরামের অনুপস্থিতির ফলে শরিয়ত সম্পর্কে অজ্ঞতা বিস্তার লাভ করে। সেইসাথে জিহাদি দলসমূহের মাঝে তাকফিরের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির প্রবণতা ছড়িয়ে পরে। ইরাকে বাড়াবাড়ি কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল তার একটি ধারণা পাওয়া যায় শাইখ মায়সারা আল-গরীরের বক্তব্যে। তিনি ছিলেন আল-কায়েদার শরিয়া বোর্ডের প্রধান। পরবর্তীতে দাওলাতুল ইরাক আল ইসলামিয়ার শরিয়া বোর্ডের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
الزرقاوي كماعرفته’’ (আমার দেখা যারকাভী) শিরোনামে এক বার্তায় তিনি বলেন, ‘সৌদির এক যুবক ইরাকের জিহাদে অংশগ্রহণ করতে চাচ্ছিল। জেলা পর্যায়ের একজন আমীর তাকে এই কারণে ফিরিয়ে দেন যে, সে শাইখ বিন বাজ ও শাইখ উসাইমীনকে তাকফির করে না’। শাইখ মায়সারা আল-গরীর বলেন, ‘শাইখ যারকাভী বিষয়টি জানতে পেরে খুব রাগান্বিত হন এবং বলেন, “জাজিরাতুল আরবের উক্ত ভাই বাদশা ফাহাদকে তাকফির না করলেও আমি তাকে জিহাদ থেকে বঞ্চিত করতাম না।”
মোটকথা, শাইখ মায়সারা শাইখ যারকাভীকে এবং বাড়াবাড়িতে লিপ্তদেরকে এক চোখে দেখতেন না। শাইখ যারকাভী আলেম-উলামাদের সাথে দেখা সাক্ষাত করতেন এবং তাদের থেকে তিনি শিক্ষাও গ্রহণ করেছেন। আর বর্তমানে যারা নিজেদেরকে শাইখ যারকাভীর অনুসারী বলে দাবি করছে তারা আলেম-উলামা ও ইলম থেকে সবচেয়ে বেশি দূরে অবস্থান করছে।
ইরাক থেকে ফিরে আসা লোকদের অধিকাংশই বাড়াবাড়ির ভাইরাস নিয়ে ফিরে আসে। জেলখানায় আমার এক বন্ধুর কথা মনে পড়েছে, ইরাক থেকে ফেরার পর তিনি বন্দি হয়েছিলেন। তিনি জেলখানায় ইখওয়ানের বিরুদ্ধে লেখালেখি করতেন এবং তা প্রচার করতেন। তিনি লিখতেন, ‘ইখওয়ানুল মুসলিমীন মুরতাদদের দল’। আমার উক্ত সঙ্গীর ইলম-কালাম মোটামুটি ছিল। তারই যখন এই অবস্থা তাহলে নিরক্ষরদের অবস্থা কী হতে পারে ভাবা যায়?!
আইএসের আবির্ভাবের পূর্বেই ইরাকের মাটিতে বাড়াবাড়ি বিদ্যমান ছিল। তার প্রমাণ পাওয়া যায় জাইশুল মুজাহিদিনের এক কমান্ডার আবু আব্দুল্লাহ মানসূরের রচিত (আদদাওলাতুল ইসলামিয়্যাহ বাইনাল হাকীকতি ওয়াল ওহমি) নামক গ্রন্থে। কিতাবটির এক জায়গায় এসেছে, ‘বর্তমানে নেতৃত্ব - যাদেরকে তথাকথিত দাওলাতুল ইরাক আল-ইসলামিয়া বলা হয়; নিঃসন্দেহে তাকফিরের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি, অন্যায়ভাবে হত্যা ইত্যাদিসহ আরও বহু অপকর্ম তারা খারেজীদের মত করেছে।’
বাড়াবাড়ি ছড়িয়ে দেয়ার পেছনে জিহাদি সংগঠনসমূহের ভূমিকা:
বহু জিহাদি সংগঠন ইন্টারনেটে মুজাহিদগণের সংবাদ পরিবেশন করতো। উম্মাহর মাঝে মুজাহিদদের খবর পৌঁছানোর সাথে তারা বাড়াবাড়ি ধারনারও বিস্তার ঘটিয়েছিল। কারণ ইরাকের সংগঠনসমূহের সিংহভাগই ছিল বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘনের আদর্শের ধারক বাহক। তাই যুবকরা এসব মাধ্যম থেকে মুজাহিদগণের সংবাদ সংগ্রহের পাশাপাশি বাড়াবাড়ির ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছিল।
এখানে আমি দুইটি ঘটনা উল্লেখ করব। আশাকরি এর মাধ্যমে জিহাদি যুবকদের উপর এই সংগঠনসমূহের প্রভাব এবং এগুলোর পেছনে যুবকদের ছুটে চলার প্রবণতা অনুমান করা যাবে।
প্রথমঘটনা: আল-কায়েদার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব শাইখ আতিয়্যাতুল্লাহর একটি প্রবন্ধ ‘ইখলাস আল-ইসলামিয়া ফোরামে’ প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি ইরাকের জিহাদ নিয়ে আলোচনা করেন। তার আলোচনায় তাদের কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতির কথাও স্থান পায়। ফলে সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে প্রতিবাদের ঝড় বইতে থাকে। পরিস্থিতির লাগাম টেনে ধরতে শাইখ যারকাভী নিজেই এগিয়ে আসেন। তিনি এ বিষয়ে তার বিবৃতি প্রকাশ করেন। এর শিরোনাম ছিল “আতিয়্যাতুল্লাহর বিষয় ছাড়ো; তিনি যা বলেন তা তিনি ভালো করে বুঝেই বলেন।”
উক্ত বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘প্রথমেই শাইখকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া সমীচীন হবে। আতিয়্যাতুল্লাহ আমার এবং তোমাদের বড় ভাই, আর আমি তোমাদের ছোট ভাই। প্রকৃত শাইখ তিনিই, আমি নই। আমি এসব বিনয় প্রকাশার্থে বলছি না, বরং এটিই বাস্তবতা।’ অতঃপর পরিস্থিতি শান্ত হয়।
দ্বিতীয়ঘটনা: ইরাকের মুজাহিদগণ যখন ‘দাওলাতুল ইরাক আল-ইসলামিয়া’ ঘোষণা করলেন তখন শাইখ হামিদ আলী এই ঘোষণার বিরোধিতা করেন। সংগঠনগুলো তার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠতে শুরু করলে তাকে পদচ্যুত করা হয়। অথচ তাকে ইরাকী জিহাদের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দের মাঝে গণ্য করা হয়।
ইরাকীদের বাড়াবাড়ি সম্পর্কে আল-কায়েদা নিষ্ক্রিয় ছিল?
আইএসের আত্মপ্রকাশের পূর্বেও আল-কায়েদার নেতৃবৃন্দ ইরাকী মুজাহিদগণের বেশকিছু বিষয়ে সমালোচনা করতেন। সেগুলোর কয়েকটি হলো-
- তাকফিরের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করা এবং ব্যাপক রক্তপাত ঘটানো।
- মসজিদ, বাজার ও গণজমায়েতে হামলা করা।
- সাধারণ ও নিরস্ত্র শিয়াদের উপর হামলা করা।
- ছুরি দিয়ে জবাই করা এবং তা ক্যামেরায় ধারণ করা।
এই বিষয়ে শাইখ আইমান আয যাওয়াহিরী, শাইখ আতিয়্যাতুল্লাহসহ আল-কায়েদার আরও কতিপয় দায়িত্বশীলের বক্তৃতা, বিবৃতি ও পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে। এই বিষয়ের উপর শাইখ আবু মুহাম্মদ মাকদিসীর একটি বার্তা রয়েছে। বার্তাটির শিরোনাম ‘শরিয়ত ও বাস্তবতার সঠিক ধারণা ছাড়া জিহাদের পরিণতি’।
শাইখ মাকদিসী আল-কায়েদার সাথে জড়িত নন। তবে তাঁকে বৈশ্বিক-জিহাদের পক্ষশক্তি গণ্য করা হয়। আল-কায়েদা যদিও উপরোক্ত বাড়াবাড়িমূলক কর্মকাণ্ড করত না, তবুও তারা জিহাদের স্বার্থে এবং মুজাহিদগণের ঐক্য অটুট রাখতে মঙ্গলকামিতা, নম্রতা ও সদুপদেশ প্রদানের কৌশল গ্রহণ করেছিলেন।
মুজাহিদগণ কোনও কোনও সময় সেই সদুপদেশ শুনেছেন এবং মেনেছেন। তবে এখন যা ঘটছে তাতে চুপ থাকার বা শিথিলতা প্রদর্শনের কোনও সুযোগ নেই। জিহাদকে চরমভাবে বিকৃত করে আইএস ঘৃণ্য ও বীভৎস রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। অগত্যা আল-কায়েদা তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। শুধু আল-কায়েদাই নয় বরং সাধারণভাবে অন্য সকল জিহাদি তানজিম তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।
২১শে রবিউল আওয়াল ১৪৩৫ হিজরিতে আল-কায়েদার এক বিবৃতিতে এসেছে-
- আল-কায়েদা ঘোষণা করছে যে, আদ দাওলাতুল ইসলামিয়া ফিল ইরাক ওয়াশ-শামের (আইএস) সাথে আল-কায়েদার কোনও সম্পর্ক নেই।
- জিহাদি কার্যক্রম পরিচালনা করতে আল-কায়েদা কয়েকটি বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করতে চায়। সেগুলোর একটি হলো, ‘আমরা উম্মাহর অংশ’ এবং উম্মাহর অংশ হয়েই থাকতে চাই। স্বেচ্ছাচারীর মতো উম্মাহর ঘাড়ে চেপে বসতে চাই না। আমীর বাছাই করার অধিকার উম্মাহর হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে চাই না। আমরা ইসলামি ইমারত বা রাষ্ট্র ঘোষণার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করা পছন্দ করি না। বরং এক্ষেত্রে উলামায়ে মুজাহিদিন, মুজাহিদ নেতৃবৃন্দ, সাধারণ মুজাহিদ ও মুসলিমগণের পরামর্শ গ্রহণকে আবশ্যক মনে করি। সেই সাথে উম্মাহর পরামর্শ গ্রহণকে আবশ্যক মনে করি। উম্মাহর পরামর্শ ছাড়া নিজেদের খেয়ালখুশি মতো ইসলামি খিলাফাহ ঘোষণা করা এবং এর বিরোধিতাকারীদেরকে মুরতাদ ঘোষণার মতো ধৃষ্টতা দেখানোর প্রশ্নই আসে না।
মূলত আল-কায়েদা এবং অপরাপর ইসলামি দলসমূহ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। তারা আলজেরিয়ার সশস্ত্র ইসলামি দলের বাড়াবাড়ির পরিণাম দেখেছেন। উক্ত বাড়াবাড়ির মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে ধ্বংস করেছে। এসব বিবেচনায় আল-কায়েদা ও অপরাপর ইসলামি তানজিমসমূহ আইএসের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য হয়েছে।
জিহাদি নেতৃবৃন্দ এবং উলামায়ে কেরাম আইএস’কে ‘খারেজি’ বলে ঘোষণা দিয়েছে। এ বিষয়ে কারো কোনও দ্বিমত আছে বলে আমার জানা নেই। তবে শাইখ আবু মুহাম্মদ মাকদিসী তাদের অনেককে খারেজীদের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর বলে মনে করেন।
আইএসের ফিতনা জিহাদের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। তবে তার কিছু ভালো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা গেছে। এই ফিতনার পর যুবকরা অনেক কিছু শিখেছে, যা তারা পূর্বে জানত না। যদি আল-কায়েদার শাইখগণ এই ফিতনার বিরুদ্ধে কঠোর না হতেন এবং উম্মাহকে সতর্ক না করতেন তাহলে হয়তো সিংহভাগ মুজাহিদকে এই ফিতনা গ্রাস করে নিত।
[1] পরবর্তীতে শাইখ জাওলানিও আল-কায়েদার সাথে প্রতারণা করে আল-কায়েদা থেকে বের হয়ে যান। এমনকি আল-কায়েদাকে সিরিয়াতে কাজ করতেও বাঁধা প্রদান করেন। এই ব্যাপারে শাইখ সামী আল উরাইদি হাফিযাহুল্লাহ লিখিত ‘আল-কায়েদা’র সঙ্গে “জাবহাতুন নুসরাহ” (জাবহাতু ফাতহিশ-শাম) এর সম্পর্কচ্ছেদ বিষয়ে কিছু সাক্ষ্য-প্রমাণ’ বইটি পড়লে প্রকৃত বিষয়টি সম্পর্কে পাঠক জানতে পারবেন। লিংক- http://gazwah.net/?p=31856 - অনুবাদক
আরও পড়ুন
চতুর্থ পর্ব ---------------------------------------------------------------------------------------- ষষ্ঠ পর্ব
Comment