Announcement

Collapse
No announcement yet.

ইসলামী আইন বনাম মানবরচিত আইন;তূলনামূলক বিশ্লেষণ-পর্ব ১

Collapse
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • ইসলামী আইন বনাম মানবরচিত আইন;তূলনামূলক বিশ্লেষণ-পর্ব ১

    আইন হলো মানুষের মৌলিক চাহিদা। আইন ছাড়া জীবন সুসংগঠিত হতে পারে না। অতএব, ঐতিহাসিকভাবে, প্রতিটি জাতি এবং যুগে আইনের ধারণা পাওয়া যায়। তবে,সামগ্রিকভাবে বিশ্ব ইতিহাসে, দুই ধরণের আইন পাওয়া যায়: (১) মানবরচিত আইন এবং (২) ইসলামী আইনের আরেক নাম শরিয়াহ।

    কীভাবে মানুষের নিজস্ব চিন্তা থেকে তৈরি আইন (মানবিক আইন) ধীরে ধীরে গড়ে উঠল, আর ইসলামী আইন কীভাবে সেই ধারার একেবারে ভিন্ন, ঐশী উৎস থেকে উদ্ভূত হলো আজকে সেই ব্যাপারে অল্প আলকপাত করবো।ইন শা আল্লাহ।

    মানবরচিত আইনের জন্ম ও বিকাশ

    মানবরচিত আইনের ইতিহাস এক কথায় অস্পষ্ট। কখন এবং কীভাবে প্রথম আইন গঠিত হয়েছিল - ইতিহাস এই ব্যাপারে নিরব।
    তবে সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসদর্শনের গবেষণায় বোঝা যায়, আইন জন্ম নিয়েছিল মানুষের সামাজিক জীবনের প্রয়োজন থেকে।

    প্রথম যুগে মানুষ পরিবার ও গোত্রভিত্তিক সমাজে বাস করত। তারা একত্রে বসবাস করতে শুরু করলে পারস্পরিক সম্পর্ক ও আচরণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন নিয়মের প্রয়োজন দেখা দেয়। এই নিয়মগুলোই ছিল মানবরচিত আইনের প্রাথমিক রূপ।

    কিন্তু সমস্যা তখনই দেখা দেয় যখন শক্তিশালী ব্যক্তিরা দুর্বলদের ওপর অন্যায় করা শুরু করল। তখন মানুষ নিজের অধিকার রক্ষার জন্য সুসংগঠিত কিছু নিয়মের প্রয়োজন অনুভব করল।
    এই অধিকাররক্ষার তাগিদ থেকেই মানব-রচিত আইন তৈরির ধারণা জন্ম নেয়।

    বিভিন্ন জাতি ও অঞ্চলে প্রচলিত রীতিনীতি,প্রথা ও সামাজিক বিধি -নিষেধ ইত্যাদিই আইন তৈরির প্রধান উপাদান হিসেবে কাজ করে। গোত্রপ্রধানরা বা মান্যবর ব্যক্তিরা নিজেদের ইচ্ছামতো এসব সামাজিক প্রথার কিছু কিছু অংশকে বিভিন্ন সময় “আইন” বা "কানুন" হিসেবে ঘোষণা দেয়।

    এরপর সমাজ থেকে জাতি, জাতি থেকে রাষ্ট্র-এই অগ্রযাত্রায় আইনও পরিবর্তিত হলো, আরো সংগঠিত ও ব্যাপক রূপ নিল। রাষ্ট্রগুলো নিজেদের নিরাপত্তা ও ঐক্যের জন্য নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করতে শুরু করল।

    এভাবেই মানুষের তৈরি আইন (Man-made Law) ধীরে ধীরে একটা সংগঠিত রূপ পেল -
    যার মূল উৎস ছিল সামাজিক রীতিনীতি ও রসম-রেওয়াজ।
    (تطبیق الشریعۃ الاسلامیۃ فی البلادالعربیۃ ،ص۱۱۷؍ والتشریع الجنائی الاسلامی:ج۱؍ص ۱۵؍)

    ইসলামী আইনের উৎস:

    এর সম্পূর্ণ বিপরীতে রয়েছে ইসলামী আইন।
    এর শুরু মানুষের চিন্তা থেকে নয়, বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে হযরত আদম (আঃ)-এর নবুওয়তের মাধ্যমে।
    হযরত আদম (আঃ)-এর সময়কার আইন কেমন ছিল,কোন পর্যায়ে কি কি আইন প্রচলিতছিল তা ইতিহাসে বিস্তারিত পাওয়া যায়না।
    তবে কুরআনে তাঁর জীবনের যেসব অংশ বর্ণিত হয়েছে, সেগুলো পড়লে বোঝা যায়—
    আইনের মূল ভিত্তি এসেছে মানববুদ্ধি থেকে নয়, বরং সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে।

    কুরআনে আদম (আঃ)-এর জীবনের কিছু ঘটনার মধ্য দিয়েই তৎকালীন বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক আইনের ধারণা পাওয়া যায়।
    যেমন
    আল্লাহ বলেছেন:
    قلنا اھبطوا منہا جمیعاً فامایأتینکم منی ہدیً فمن تبع ہدایَ فلاخوف علیہم ولاہم یحزنون والذین کفرواوکذبوا بآیاتنا اولٰئک اصحاب النار ہم فیہا خالدون

    “আমি বললাম, ‘তোমরা সকলে এখান থেকে নেমে যাও। অতঃপর যখন আমার পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট কোনো হিদায়াত আসবে তখন যারা আমার হিদায়াত অনুসরণ করবে, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না’আর যারা অস্বীকার করে এবং আমাদের আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করে তারা জাহান্নামী, সেখানে তারা হবে স্থায়ী।
    (সূরা আল-বাকারা ৩৮–৩৯)

    এই আয়াত থেকে শরীয়া আইন বা ইসলামী আইনের মৌলিক ধারণা পাওয়া যায়।এটাও বুঝা যায়,এটা সমগ্র মানবজাতির জন্য বাধ্যতামূলক; এতে কোনো ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা মতামতের স্থান নেই।

    আরেক আয়াতে বলা হয়েছে:
    { وَقُلۡنَا یَـٰۤـَٔادَمُ ٱسۡكُنۡ أَنتَ وَزَوۡجُكَ ٱلۡجَنَّةَ وَكُلَا مِنۡهَا رَغَدًا حَیۡثُ شِئۡتُمَا وَلَا تَقۡرَبَا هَـٰذِهِ ٱلشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ ٱلظَّـٰلِمِینَ }
    "আর আমি বললাম, ‘ হে আদম ! আপনি ও আপনার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করুন এবং যেখান থেকে ইচ্ছা স্বাচ্ছন্দ্যে আহার করুন, কিন্তু এই গাছটির কাছে যাবেন না ; তাহলে আপনারা যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবেন’।
    এখানে ব্যক্তিগত জীবনের নির্দেশনার পাশাপাশি একধরনের নিষেধমূলক আইন-এর ধারণাও দেওয়া হয়েছে।

    একইভাবে সূরা মায়িদায় আদম (আ.)-এর দুই পুত্রের যুদ্ধের ঘটনাটিতেও কিছু আইনি ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
    যেমন
    ১। তাদের মধ্যে যখন বিরোধ দেখা দিল, তখন তারা কুরবানিকে সালিসি বা বিচারক হিসেবে নির্ধারণ করেছিল।
    এটি এক ধরনের আইনি ব্যবস্থার প্রাথমিক রূপের দিকনির্দেশনা দেয়।
    ব্যাখ্যা করি,অনেকের হয়তো বুঝে আসবে না। আইনি ইঙ্গিত যেভাবে বোঝা যায়:
    যখন তাদের মধ্যে এই বিরোধ বা “বিবাদ” দেখা দিল, তখন তারা নিজেদের সিদ্ধান্ত নির্ভর করেনি,বরং কুরবানিকে সালিস বা বিচারক হিসেবে নির্ধারণ করেছিল।
    অর্থাৎ, তারা বলেছিল: “যার কুরবানি আল্লাহ গ্রহণ করবেন, সে-ই সঠিক।”
    এভাবে তারা একটি নিরপেক্ষ মানদণ্ড বা কর্তৃত্ব গ্রহণ করেছিল, যা আজকের ভাষায় “আইন” বা “বিচারব্যবস্থা”-এর প্রাথমিক ধারণা।

    এই ঘটনাটি মানবসভ্যতার ইতিহাসে প্রথম “বিচার প্রক্রিয়া” বা “নিয়ম দ্বারা বিরোধ মীমাংসা”-এর নিদর্শন।
    এখানে দেখা যায় ,
    মানুষ নিজের ইচ্ছা বা শক্তির ওপর নির্ভর না করে, কোনো উচ্চতর নৈতিক বা আইনি কর্তৃত্বের কাছে বিরোধ নিষ্পত্তি করছে।
    (সূরা মায়িদা: আয়াত ২৭)

    (২) একইভাবে হত্যা ও অশান্তি সৃষ্টি করা সম্পর্কে পাপের ধারণাও এখান থেকে বোঝা যায়,
    যেখানে একজন ভাই অন্যজনকে বলে -
    “যদি তুমি আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হাত বাড়াও, তবু আমি তোমাকে হত্যার জন্য হাত তুলব না;
    কারণ আমি সমগ্র বিশ্বের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি।”
    (সূরা মায়িদা: আয়াত ২৮–২৯)

    (৩) কিন্তু এরপর যখন একজন ভাই হিংসার প্রভাবে অন্য ভাইকে হত্যা করল,
    তখন সামাজিক আইন ও পাপবোধের ভয় তাকে লাশ লুকাতে বাধ্য করল।
    আর আল্লাহ তায়ালা তাকে শিক্ষা দিতে একটি কাক পাঠালেন,
    যার মাধ্যমে সে জানল কীভাবে ভাইয়ের লাশ গোপন করা যায়।

    এই ঘটনাগুলোর মাধ্যমে বোঝা যায়, আদম (আঃ)-এর যুগেই আল্লাহর আইন ও নৈতিক নীতি মানুষের জীবনে কার্যকর হতে শুরু করেছিল।

    তারপর, মানবসমাজ যত বিকশিত হয়েছে, নবীগণের মাধ্যমে আল্লাহর আইনও ধাপে ধাপে বিকশিত ও পরিপূর্ণ হয়েছে।
    সব নবীর মূল আইন এক ও অভিন্ন ছিল, কিন্তু শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ-এর মাধ্যমে আল্লাহ সেই আইনের পূর্ণতা দান করেছেন।এটা এমন চিরন্তন আইন, যা কিয়ামত পর্যন্ত প্রতিটি যুগ ও সমাজে সমানভাবে কার্যকর ও উপযোগী থাকবে।
    আর গত চৌদ্দশ বছরের ইতিহাস সেই সত্যের জীবন্ত প্রমাণ বহন করছে।

    (চলবে,ইন শা আল্লাহ)​
Working...
X