আইন (قانون) ও সংবিধান (دستور); পার্থক্য ও ধারণাঃ
সহজ ভাষায় বললে -
সংবিধান (دستور) হলো রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য, কাঠামো ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার নকশা। এটি বলে দেয়—রাষ্ট্র কীভাবে চলবে, ক্ষমতার বিভাজন কীভাবে হবে, এবং নাগরিকদের অধিকার কী।
অন্যদিকে, আইন (قانون) হলো সেই নিয়ম ও বিধানসমূহ, যা ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে শৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে।
আধুনিক যুগে আইনকে সংজ্ঞায়িত করা হয় এভাবে -
“মানুষের পারস্পরিক আচরণ ও সমাজজীবন নিয়ন্ত্রণের জন্য জনগণের সম্মতিক্রমে প্রণীত এবং রাষ্ট্রের দ্বারা কার্যকর করা নিয়মাবলির সমষ্টিকেই আইন বলা হয়।”
অর্থাৎ, আইন শুধু কোনো শাসকের আদেশ নয় -এটি একটি সামষ্টিক সম্মতির ফসল, যা সরকার বাস্তবায়ন করে সমাজে শৃঙ্খলা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে।
পশ্চিমা চিন্তাধারায় আধুনিক আইনের চারটি মৌলিক ভিত্তি রয়েছে:
1️⃣ মানবগোষ্ঠী।
আইনের প্রথম ভিত্তি হলো মানুষ বা সমাজ।
আইন কেবল শাসক বা বিচারকের জন্য নয়; এটি সমাজের সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য।
যদি কোনো আইন সমাজের মানুষের প্রয়োজন, স্বার্থ বা নিরাপত্তা বিবেচনা না করে প্রণয়ন করা হয়, তা কার্যকর হবে না।
সংক্ষেপে, মানুষই আইন তৈরির কেন্দ্রবিন্দু।
2️⃣ বিধি ও নিয়মাবলি
আইন মানে শুধু আদেশ নয়; এটি নিয়ম ও বিধির একটি সমষ্টি।
এই নিয়মাবলি সমাজে মানুষকে কী করা উচিত বা উচিত নয়, তা স্পষ্ট করে।
উদাহরণ: ট্রাফিক আইন, শাস্তি সংক্রান্ত বিধি, চুক্তি বা সম্পত্তি সংক্রান্ত নিয়ম ইত্যাদি।
অর্থাৎ, আইন হলো মানব আচরণকে শৃঙ্খলায় রাখার নিয়মাবলী।
3️⃣ জনগণের সামষ্টিক সম্মতি।
আইন কেবল শাসকের ইচ্ছা নয়; এটি সমাজের বৃহত্তর সম্মতিতে জন্মায়।
মানে, যে নিয়মগুলি সামাজিক স্বীকৃতি পায়, সেটিই কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য হয়।
সাধারণ মানুষ বা সমাজ যদি আইন মেনে চলে, তা তখনই সত্যিকার অর্থে আইন হিসেবে কার্যকর হয়।
4️⃣ এবং সর্বশেষে, সরকার যখন সেগুলোকে স্বীকৃতি দিয়ে আদালতের মাধ্যমে কার্যকর করে, তখন সেটি قانون (আইন) নামে পরিচিত হয়।(এমনটা তাদের বয়ান।এগুলোর সত্যতা কতটুকু তা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট)
چراغ راہ اسلامی قانون نمبر: جلد ١٢)
পশ্চিমা চিন্তাবিদদের মাঝে আইনের সংজ্ঞা নিয়ে মতবিরোধঃ
আইন নিয়ে পশ্চিমা দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের মতামত এতটাই মতানৈক্যপূর্ণ ও পরস্পরবিরোধী যে, সেগুলোকে সমন্বয় করা প্রায় অসম্ভব।
কেউ বলেন, আইন কেবল শাসক শ্রেণির আদেশ ও ইচ্ছার প্রতিফলন-কারণ আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা কেবল তাদের হাতেই থাকে।
অন্যরা বলেন, আইন কোনো নতুন সৃষ্টি নয়; এটি সমাজে প্রচলিত প্রথা ও রীতিনীতিকে রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদন দেওয়ার নাম। রাষ্ট্র শুধু সমাজের পুরনো নিয়মগুলোর সীলমোহর দেয়।
আর কেউ বলেন, আইন মূলত প্রয়োজন ও দায়িত্ববোধ থেকে জন্ম নেয়; রাষ্ট্র কেবল সেই প্রয়োজনকে বাস্তবে রূপ দেয়।
কেউ মনে করেন, আইন ও ন্যায়বিচার (ইনসাফ) এক নয়—কোনো আইন অন্যায়ও হতে পারে, তবুও সেটি আইনই, কারণ তা রাষ্ট্র কর্তৃক প্রণীত।
আবার অন্যদের মতে, আইন ও ন্যায়বিচার একে অপরের পরিপূরক; সত্যিকারের আইন অন্যায় হতে পারে না।
কেউ কেউ ধর্ম,মোরালিটি ও আইনকে সম্পূর্ণ আলাদা মনে করেন, আবার অন্যেরা এই তিনটিকে একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত মনে করেন।
পশ্চিমা চিন্তাবিদদের মাঝে আইন-সম্পর্কিত বিভিন্ন চিন্তাধারা বা মতবাদ প্রচলিত আছে। (Schools of Thought)
১. বিশ্লেষণধর্মী মতবাদ
এই মতবাদ বলে-আইনের ভেতরে যৌক্তিক সামঞ্জস্য থাকতে হবে। আইন হতে হবে স্পষ্ট, সুসংগঠিত ও দ্ব্যর্থহীন।
২. ঐতিহাসিক মতবাদ (Historical School):
তাদের মতে, আইন কোনো একদিনে তৈরি হয় না। এটি সমাজ, সংস্কৃতি ও প্রথার দীর্ঘ বিবর্তনের ফল।
৩. ইতিবাচক মতবাদ
তারা বিশ্বাস করেন, আইন হলো একটি সামাজিক চুক্তি, যা মানুষের পারস্পরিক স্বার্থ ও সহযোগিতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। অর্থাৎ, মানুষের সম্মতি ছাড়া কোনো আইন টিকতে পারে না।
৪. কার্যভিত্তিক মতবাদ (Functional School):
তাদের দৃষ্টি আইনের বাস্তব প্রয়োগে। সমাজে আইন কতটা কার্যকর, কতটা শৃঙ্খলা আনছে -সেই দিকেই তাদের মনোযোগ।
৫. উদ্দেশ্যমূলক বা নৈতিক মতবাদ (Teleological School):
এই মতবাদ জোর দেয়-আইনের মূল লক্ষ্য নৈতিক চেতনা, ন্যায়বিচার ও মানবিক মূল্যবোধ রক্ষা করা।(এতে তারা আদৌ সফল হতে পারল কিনা এই ব্যাপারে পরবর্তী পর্বগুলোতে বিস্তারিত আলোচনা আসবে ইন সা আল্লাহ)
প্লেটো মনে করতেন-সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যক্তির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
খ্রিষ্টান গির্জাও এই মতবাদকে সমর্থন করেছিল।
অন্যদিকে, স্টোইক (Stoics) দার্শনিকরা বলেছিলেন-ব্যক্তিই আসল; সমাজ তার জন্য, সে সমাজের জন্য নয়।
পরে সমাজতন্ত্রী ও ফ্যাসীস্টরাও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন।
আধুনিক গণতন্ত্রবাদীরাও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রকেই সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়।
জন লক ও জন স্টুয়ার্ট মিল ছিলেন এই মতের প্রধান প্রবক্তা।
তাদের চিন্তার বাস্তবিক প্রতিফলন দেখা যায় আধূনিক হুবাল আমেরিকার সংবিধানে।
এসব মতবিরোধ থেকে মানব প্রণীত আইনের অন্তঃসারশূন্যতা এবং অপূর্নাঙ্গতা প্রমাণ হয়।
আধূনিক আইনের প্রাচীন উতসঃ
অন্যদিকে আইনবিশারদরা মনে করেন,আধুনিক আইনের ধারণা শুরু হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব যুগে, যখন আসিরিয়া ও ব্যাবিলনের শাসকেরা বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেন।
তাদের মধ্যে বিশেষভাবে পরিচিত হলো “হামুরাবির বিধি বা আইন” (Code of Hammurabi)-যা প্রাচীন বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত আইনসংগ্রহগুলোর একটি।
তদ্রূপ, প্রাচীন আইনব্যবস্থার ইতিহাসে “রোমের দ্বাদশ ফলক” (Twelve Tables of Rome)-ও একটি মৌলিক ও ভিত্তিমূলক স্থান দখল করে আছে।
দুটোই আধুনিক আইনের প্রাচীন উৎস বা ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।(উল্লেখ্যঃএগুলোই একমাত্র উৎস নয় আধূনিক আইনের)
সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করলেঃ
1️⃣ হামুরাবির বিধি (Code of Hammurabi)
এটি প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব 1754 সালের দিকে ব্যাবিলনের রাজা হামুরাবি প্রণয়ন করেন।
এতে সমাজ, পরিবার, ব্যবসা, শাস্তি ও ন্যায়বিচার সম্পর্কিত প্রায় ২৮২টি ধারা ছিল।
এর মূল ধারণা ছিল: “চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত” -অর্থাৎ শাস্তির সামঞ্জস্য (principle of retribution)।
➡ এটা আধুনিক ফৌজদারি আইন ও ন্যায়বিচারের ধারণার ক্ষেত্রে ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়।
2️⃣ রোমের দ্বাদশ ফলক (Twelve Tables of Rome)
এটি খ্রিষ্টপূর্ব 450 সালের দিকে প্রণীত হয়।
প্রথমবারের মতো আইনকে লিখিত আকারে জনগণের সামনে প্রকাশ করা হয়।
এতে নাগরিক অধিকার, সম্পত্তি, চুক্তি ও পারিবারিক সম্পর্ক বিষয়ে নিয়মাবলি ছিল।
➡ এটা আধুনিক সিভিল ল’ (civil law) ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়।
এতোকিছুর পরেও শতাব্দীর পর শতাব্দী- বরং হাজার হাজার বছরের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা ও গবেষণার পরও - মানবরচিত আইনবিদরা এখনো নির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করতে পারেননি আইন আসলে কী, এবং এর উদ্দেশ্যই বা কী,এর প্রকৃতিই বা কি!এটাই বাস্তবতা।
(চলবে ইন শা আল্লাহ)
সহজ ভাষায় বললে -
সংবিধান (دستور) হলো রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য, কাঠামো ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার নকশা। এটি বলে দেয়—রাষ্ট্র কীভাবে চলবে, ক্ষমতার বিভাজন কীভাবে হবে, এবং নাগরিকদের অধিকার কী।
অন্যদিকে, আইন (قانون) হলো সেই নিয়ম ও বিধানসমূহ, যা ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে শৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে।
আধুনিক যুগে আইনকে সংজ্ঞায়িত করা হয় এভাবে -
“মানুষের পারস্পরিক আচরণ ও সমাজজীবন নিয়ন্ত্রণের জন্য জনগণের সম্মতিক্রমে প্রণীত এবং রাষ্ট্রের দ্বারা কার্যকর করা নিয়মাবলির সমষ্টিকেই আইন বলা হয়।”
অর্থাৎ, আইন শুধু কোনো শাসকের আদেশ নয় -এটি একটি সামষ্টিক সম্মতির ফসল, যা সরকার বাস্তবায়ন করে সমাজে শৃঙ্খলা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে।
পশ্চিমা চিন্তাধারায় আধুনিক আইনের চারটি মৌলিক ভিত্তি রয়েছে:
1️⃣ মানবগোষ্ঠী।
আইনের প্রথম ভিত্তি হলো মানুষ বা সমাজ।
আইন কেবল শাসক বা বিচারকের জন্য নয়; এটি সমাজের সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য।
যদি কোনো আইন সমাজের মানুষের প্রয়োজন, স্বার্থ বা নিরাপত্তা বিবেচনা না করে প্রণয়ন করা হয়, তা কার্যকর হবে না।
সংক্ষেপে, মানুষই আইন তৈরির কেন্দ্রবিন্দু।
2️⃣ বিধি ও নিয়মাবলি
আইন মানে শুধু আদেশ নয়; এটি নিয়ম ও বিধির একটি সমষ্টি।
এই নিয়মাবলি সমাজে মানুষকে কী করা উচিত বা উচিত নয়, তা স্পষ্ট করে।
উদাহরণ: ট্রাফিক আইন, শাস্তি সংক্রান্ত বিধি, চুক্তি বা সম্পত্তি সংক্রান্ত নিয়ম ইত্যাদি।
অর্থাৎ, আইন হলো মানব আচরণকে শৃঙ্খলায় রাখার নিয়মাবলী।
3️⃣ জনগণের সামষ্টিক সম্মতি।
আইন কেবল শাসকের ইচ্ছা নয়; এটি সমাজের বৃহত্তর সম্মতিতে জন্মায়।
মানে, যে নিয়মগুলি সামাজিক স্বীকৃতি পায়, সেটিই কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য হয়।
সাধারণ মানুষ বা সমাজ যদি আইন মেনে চলে, তা তখনই সত্যিকার অর্থে আইন হিসেবে কার্যকর হয়।
4️⃣ এবং সর্বশেষে, সরকার যখন সেগুলোকে স্বীকৃতি দিয়ে আদালতের মাধ্যমে কার্যকর করে, তখন সেটি قانون (আইন) নামে পরিচিত হয়।(এমনটা তাদের বয়ান।এগুলোর সত্যতা কতটুকু তা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট)
چراغ راہ اسلامی قانون نمبر: جلد ١٢)
পশ্চিমা চিন্তাবিদদের মাঝে আইনের সংজ্ঞা নিয়ে মতবিরোধঃ
আইন নিয়ে পশ্চিমা দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের মতামত এতটাই মতানৈক্যপূর্ণ ও পরস্পরবিরোধী যে, সেগুলোকে সমন্বয় করা প্রায় অসম্ভব।
কেউ বলেন, আইন কেবল শাসক শ্রেণির আদেশ ও ইচ্ছার প্রতিফলন-কারণ আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা কেবল তাদের হাতেই থাকে।
অন্যরা বলেন, আইন কোনো নতুন সৃষ্টি নয়; এটি সমাজে প্রচলিত প্রথা ও রীতিনীতিকে রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদন দেওয়ার নাম। রাষ্ট্র শুধু সমাজের পুরনো নিয়মগুলোর সীলমোহর দেয়।
আর কেউ বলেন, আইন মূলত প্রয়োজন ও দায়িত্ববোধ থেকে জন্ম নেয়; রাষ্ট্র কেবল সেই প্রয়োজনকে বাস্তবে রূপ দেয়।
কেউ মনে করেন, আইন ও ন্যায়বিচার (ইনসাফ) এক নয়—কোনো আইন অন্যায়ও হতে পারে, তবুও সেটি আইনই, কারণ তা রাষ্ট্র কর্তৃক প্রণীত।
আবার অন্যদের মতে, আইন ও ন্যায়বিচার একে অপরের পরিপূরক; সত্যিকারের আইন অন্যায় হতে পারে না।
কেউ কেউ ধর্ম,মোরালিটি ও আইনকে সম্পূর্ণ আলাদা মনে করেন, আবার অন্যেরা এই তিনটিকে একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত মনে করেন।
পশ্চিমা চিন্তাবিদদের মাঝে আইন-সম্পর্কিত বিভিন্ন চিন্তাধারা বা মতবাদ প্রচলিত আছে। (Schools of Thought)
১. বিশ্লেষণধর্মী মতবাদ
এই মতবাদ বলে-আইনের ভেতরে যৌক্তিক সামঞ্জস্য থাকতে হবে। আইন হতে হবে স্পষ্ট, সুসংগঠিত ও দ্ব্যর্থহীন।
২. ঐতিহাসিক মতবাদ (Historical School):
তাদের মতে, আইন কোনো একদিনে তৈরি হয় না। এটি সমাজ, সংস্কৃতি ও প্রথার দীর্ঘ বিবর্তনের ফল।
৩. ইতিবাচক মতবাদ
তারা বিশ্বাস করেন, আইন হলো একটি সামাজিক চুক্তি, যা মানুষের পারস্পরিক স্বার্থ ও সহযোগিতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। অর্থাৎ, মানুষের সম্মতি ছাড়া কোনো আইন টিকতে পারে না।
৪. কার্যভিত্তিক মতবাদ (Functional School):
তাদের দৃষ্টি আইনের বাস্তব প্রয়োগে। সমাজে আইন কতটা কার্যকর, কতটা শৃঙ্খলা আনছে -সেই দিকেই তাদের মনোযোগ।
৫. উদ্দেশ্যমূলক বা নৈতিক মতবাদ (Teleological School):
এই মতবাদ জোর দেয়-আইনের মূল লক্ষ্য নৈতিক চেতনা, ন্যায়বিচার ও মানবিক মূল্যবোধ রক্ষা করা।(এতে তারা আদৌ সফল হতে পারল কিনা এই ব্যাপারে পরবর্তী পর্বগুলোতে বিস্তারিত আলোচনা আসবে ইন সা আল্লাহ)
প্লেটো মনে করতেন-সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যক্তির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
খ্রিষ্টান গির্জাও এই মতবাদকে সমর্থন করেছিল।
অন্যদিকে, স্টোইক (Stoics) দার্শনিকরা বলেছিলেন-ব্যক্তিই আসল; সমাজ তার জন্য, সে সমাজের জন্য নয়।
পরে সমাজতন্ত্রী ও ফ্যাসীস্টরাও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন।
আধুনিক গণতন্ত্রবাদীরাও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রকেই সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়।
জন লক ও জন স্টুয়ার্ট মিল ছিলেন এই মতের প্রধান প্রবক্তা।
তাদের চিন্তার বাস্তবিক প্রতিফলন দেখা যায় আধূনিক হুবাল আমেরিকার সংবিধানে।
এসব মতবিরোধ থেকে মানব প্রণীত আইনের অন্তঃসারশূন্যতা এবং অপূর্নাঙ্গতা প্রমাণ হয়।
আধূনিক আইনের প্রাচীন উতসঃ
অন্যদিকে আইনবিশারদরা মনে করেন,আধুনিক আইনের ধারণা শুরু হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব যুগে, যখন আসিরিয়া ও ব্যাবিলনের শাসকেরা বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেন।
তাদের মধ্যে বিশেষভাবে পরিচিত হলো “হামুরাবির বিধি বা আইন” (Code of Hammurabi)-যা প্রাচীন বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত আইনসংগ্রহগুলোর একটি।
তদ্রূপ, প্রাচীন আইনব্যবস্থার ইতিহাসে “রোমের দ্বাদশ ফলক” (Twelve Tables of Rome)-ও একটি মৌলিক ও ভিত্তিমূলক স্থান দখল করে আছে।
দুটোই আধুনিক আইনের প্রাচীন উৎস বা ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।(উল্লেখ্যঃএগুলোই একমাত্র উৎস নয় আধূনিক আইনের)
সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করলেঃ
1️⃣ হামুরাবির বিধি (Code of Hammurabi)
এটি প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব 1754 সালের দিকে ব্যাবিলনের রাজা হামুরাবি প্রণয়ন করেন।
এতে সমাজ, পরিবার, ব্যবসা, শাস্তি ও ন্যায়বিচার সম্পর্কিত প্রায় ২৮২টি ধারা ছিল।
এর মূল ধারণা ছিল: “চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত” -অর্থাৎ শাস্তির সামঞ্জস্য (principle of retribution)।
➡ এটা আধুনিক ফৌজদারি আইন ও ন্যায়বিচারের ধারণার ক্ষেত্রে ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়।
2️⃣ রোমের দ্বাদশ ফলক (Twelve Tables of Rome)
এটি খ্রিষ্টপূর্ব 450 সালের দিকে প্রণীত হয়।
প্রথমবারের মতো আইনকে লিখিত আকারে জনগণের সামনে প্রকাশ করা হয়।
এতে নাগরিক অধিকার, সম্পত্তি, চুক্তি ও পারিবারিক সম্পর্ক বিষয়ে নিয়মাবলি ছিল।
➡ এটা আধুনিক সিভিল ল’ (civil law) ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়।
এতোকিছুর পরেও শতাব্দীর পর শতাব্দী- বরং হাজার হাজার বছরের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা ও গবেষণার পরও - মানবরচিত আইনবিদরা এখনো নির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করতে পারেননি আইন আসলে কী, এবং এর উদ্দেশ্যই বা কী,এর প্রকৃতিই বা কি!এটাই বাস্তবতা।
(চলবে ইন শা আল্লাহ)
Comment