Announcement

Collapse
No announcement yet.

ইসলামি আইন বনাম মানবরচিত আইন;তূলনামূলক বিশ্লেষণ।পর্ব ৩

Collapse
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • ইসলামি আইন বনাম মানবরচিত আইন;তূলনামূলক বিশ্লেষণ।পর্ব ৩


    ❝পশ্চিমা আইনচিন্তারহতাশা ও দ্বন্দ্ব❞

    কোহলার (Kohler),
    যিনি আইনচিন্তার ঐতিহাসিক ধারার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, বলেন:

    "আইনকে কখনোই চিরন্তন বা চিরস্থায়ী মর্যাদা দেওয়া যায় না। যদি কোনো আইন একটি নির্দিষ্ট যুগ বা সময়ের জন্য উপযোগী হয়, তবে তা অপর কোনো যুগের জন্য সমানভাবে উপযোগী নাও হতে পারে। আমরা কেবল এটুকুই করতে পারি যে, প্রতিটি সংস্কৃতির ধরণ অনুযায়ী বিভিন্ন সময় ও স্থানে উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করি। কোনো বিষয় যদি এক পরিস্থিতিতে উপকারী হয়, তবে তা অন্য পরিস্থিতিতে ধ্বংসাত্মকও হতে পারে।"
    Philosophy of Law, Kohler, p. 5


    প্রফেসর প্যাটন (G.W. Paton) লিখেছেন:
    "আধুনিক আইনদর্শন এখনো পর্যন্ত এমন কোনো গ্রহণযোগ্য মূল্যমান আমাদের সামনে উপস্থাপন করতে পারেনি, এবং আইন প্রণয়নের মৌলিক সমস্যাগুলোর যে সমাধান এটি মাঝে মাঝে দিয়েছে, তা কেবল চিন্তার বিশৃঙ্খলাই সৃষ্টি করেছে, ফলপ্রসূ কিছু নয়।"
    A Textbook of Jurisprudence, p. 116


    এই ব্যাখ্যাগুলো থেকে বোঝা যায় যে আধুনিক মানুষ তার আইনসংক্রান্ত ধারণা নিয়ে কতটা গভীর বিভ্রান্তিতে আছে। এখন এই উপলব্ধি দিনে দিনে বাড়ছে যে, আধুনিক দর্শনের সমস্ত প্রচেষ্টা মানুষকে কল্যাণ ও সফলতার পথে নিয়ে যেতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে, এবং মানুষ আজও এই বিশাল মহাবিশ্বে পথহারা ও দিকভ্রান্ত পথিকের মত ঘুরপাক খাচ্ছে।

    মরিস কোহেন (Morris Cohen) বলেন:

    "এখন পর্যন্ত যেসব আদর্শতত্ত্ব উপস্থাপিত হয়েছে, তার কোনোটিই আনুষ্ঠানিক দিক থেকে অপরিহার্য নয়, কিংবা বাস্তবতার দিক থেকেও এতটা ওজনদার নয় যে, তার মাধ্যমে আমাদের পরস্পরবিরোধী স্বার্থগুলোর মধ্যে কোনো একটির পক্ষে ন্যায়সঙ্গত ও চূড়ান্ত রায় দেওয়া সম্ভব হয়।"
    Reason and Nature


    ডব্লিউ ফ্রাইডম্যান (W. Friedmann) দীর্ঘ আলোচনার পর এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান:
    "এই জীবন আসলে কী উদ্দেশ্য নিয়ে চলছে;এই প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক। যেমনভাবে দর্শন, রাজনীতি, নৈতিকতা ও ধর্মের ওপর এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব বর্তায়,তেমনি আইনদর্শনের ওপরও তা বর্তায়। আইনদর্শনের বিভিন্ন চিন্তাধারা বহুবার এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু প্রতিবারই তারা জীবনের মৌলিক মূল্যবোধের গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেয়ে থেমে গেছে।"


    তিনি আরও জোর দিয়ে বলেন:
    "এই সমস্ত বিচিত্র প্রচেষ্টার বিশ্লেষণ করলে একটিই ফলাফলে পৌঁছানো যায়-,ন্যায়বিচারের প্রকৃত মান নির্ধারণে ধর্মীয় দিকনির্দেশনা ছাড়া অন্য সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে। এবং ন্যায়বিচারের আদর্শ ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে ধর্মপ্রদত্ত ভিত্তিই একমাত্র সত্য ও সহজ পথ।"
    Ibid, p. 450


    একপর্যায়ে পশ্চিমা চিন্তাবিদরা ক্লান্ত হয়ে এখন বলতে শুরু করেছেন;

    “আইনের সম্পর্ক মানুষের জীবনের গভীর আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে জড়িত। তাই মানুষের বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষার অধীনে আইনের স্থির ও অপরিবর্তনীয় অবস্থাও সময় সময় পরিবর্তনের শিকার হওয়া অনিবার্য। আইনদর্শনের প্রতিটি সত্যিকারের সমালোচনামূলক মানদণ্ড নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তি চায়, কিন্তু দুঃখজনকভাবে এ বিষয়ে এখনো পর্যন্ত কোনো গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব বিকশিত হয়নি”।
    ( প্যাটনের বই ফিলোসফি অব ল’, পৃষ্ঠা ৯৮; এবং ফুলারের বই Law in Quest of Itself, ১৯৫০)


    ‘সমাজতন্ত্র’ আইনের আরও ভয়াবহ ধারণা উপস্থাপন করেছে।
    কার্ল মার্ক্স দাবি করেন যে, আইন দেশের উৎপাদন পরিস্থিতির অধীন। তিনি তাঁর বই The Origin of the Family, Private Property and the State-এ লেখেন:
    "আইন রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং রাষ্ট্র হলো নিপীড়নের একটি মাধ্যম। রাষ্ট্র আসলে একটি শ্রেণিকে ধ্বংস ও পদদলিত করার জন্য গঠিত একটি সংগঠন।"
    (F. Engels: Introduction to Marx's Civil War in France, p. 19)


    মার্ক্সের এই তত্ত্বকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কমিশনারিয়েট অব জাস্টিস-এর একটি আদেশে (১২ ডিসেম্বর ১৯১৯) আইনের সংজ্ঞা এভাবে দেওয়া হয়:
    "আইন হলো সামাজিক সম্পর্কের জন্য এমন একটি নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যা প্রভাবশালী শ্রেণির স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, এবং সেই শ্রেণির সংগঠিত শক্তি এটার রক্ষণাবেক্ষণ করে।"
    (Prof. A.L. Goodhart: The New Outline of Modern Knowledge, 1956, Chapter on 'Law', p. 581)


    মিস্টার বিশিনস্কি, যিনি রাশিয়ার আইনক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, আইনের সংজ্ঞা এভাবে দিয়েছেন:
    "আইন হলো একটি জাতির রীতিনীতি ও আচরণের সম্পর্কিত নিয়মের সমষ্টি, রাষ্ট্রের ক্ষমতা তা অনুমোদন করে এবং তার দমনশীল শক্তির মাধ্যমে তা রক্ষা করে।"
    Goodhart, The New Outline of Modern Knowledge, p. 582)


    এইভাবে সমাজতান্ত্রিক আইনের ধারণার উপর রাজনীতি এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছে যে, আইন তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে।

    শুধু এইটুকুই না,এই আইন কতটা অকার্যকর ও ব্যর্থ,এবং পশ্চিমে এই আইনের বিষয়ে কত বিচিত্র মতামত প্রকাশিত হয়েছে একটু সেদিকে নজর দেওয়া যাক।

    ❝আইন সম্পর্কে বিভিন্ন আইনবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি❞
    • আইন থেকে ন্যায়বিচার চাওয়া এমনই, যেন বিড়াল ধরতে গিয়ে গরু হারিয়ে ফেলা (চীনা প্রবাদ)
    • লিখিত আইন মাকড়সার জালের মতো: দুর্বলরা এতে আটকে যায়, আর শক্তিশালীরা তা ছিঁড়ে বেরিয়ে যায় (Anacharsis)
    • দুই আইনজীবীর মাঝে একজন গ্রামবাসী ঠিক যেন দুই বিড়ালের মাঝে একটি মাছ (ফ্র্যাঙ্কলিন)
    • আইনের আশ্রয় নেওয়ায় নিশ্চিত কিছু নেই… শুধু একটা বিষয় নিশ্চিত;খরচ। (এস. টেলর)
    • আইন হলো একটি ইঁদুর ধরার ফাঁদ, যাতে ঢোকা সহজ কিন্তু বের হওয়া অত্যন্ত কঠিন (বালফোর)
    • আইন ও চিকিৎসা - এগুলো কেবল চরম প্রয়োজনেই ব্যবহার করা উচিত, নইলে পকেট খালি হবে বা শরীর দুর্বল। (কোয়ারলস)
    • ভালো আইন তৈরি করা সহজ, কিন্তু কার্যকর করা কঠিন। সবচেয়ে বড় ভুল হবে যদি মানুষকে সহজ-সরল ভাবা হয়,মনে করা হয় যে এটা দিয়ে তাকে ভালো বানানো যাবে। (বোলিংব্রোক)
    • আইন একটি মাকড়সার জাল, যেখানে ছোট মাছিরা ধরা পড়ে,বড় মাছিরা ছিড়ে বেরিয়ে যায় (অজ্ঞাত,তবে বাস্তব)
    • আইন একটি জাল: ছোটরা তা এড়িয়ে যায়, বড়রা তা ছিঁড়ে ফেলে, আর মাঝারি শ্রেণি এতে আটকে যায় । (শন স্টোন)
    • জালে আটকে থাকা মাছ ঠিক যেন গরিব মানুষের অধিকার, যা আইনের ফাঁদে পড়ে… বের হওয়া অসম্ভব (শেক্সপিয়ার)
    • ভালো আইন এমন, যা ভালো কাজকে সহজ করে তোলে এবং খারাপ কাজকে কঠিন করে তোলে (গ্ল্যাডস্টোন)
    • "যদি আইনের ভিত্তি জাতির রীতিনীতি ও প্রথার উপর না হয়, তবে আইন অবশ্যই অস্থির হবে, কারণ রীতিনীতি ও প্রথাই একটি জাতির স্থায়ী উপাদান।" (ডি টোকভিল)
    • "যুদ্ধের সময় আইন নীরব থাকে।" (সিসেরো)
    • "আইনের যুক্তি নিজেই আইন।" (ডলার স্কট)
    • "আইন শ্রদ্ধার যোগ্য, শুধু এজন্য নয় যে তা আইন, বরং এজন্য যে তা সত্য ও ন্যায়ভিত্তিক।" (এইচ ডব্লিউ বেজার)
    • "আইন এমন হওয়া উচিত যেন মৃত্যু—যার কবল থেকে কেউ মুক্তি পায় না।" (মন্টেস্কু)
    • "যে দেশে আইনের আধিক্য থাকে, তা চিকিৎসকের আধিক্যের মতো -যা দুর্বলতা ও দুর্দশার লক্ষণ।" (ভলতেয়ার)
    • "বিশ্বজনীন ও বিশুদ্ধ আইন হলো সেই প্রাকৃতিক ন্যায়ের পথ, যা লিখিত নয়, কিন্তু প্রতিটি মানুষের অন্তরে বিদ্যমান। লিখিত আইন হলো সেই সূত্র, যা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে প্রাকৃতিক ন্যায়ের পথ কী হতে পারে তা বোঝাতে চেষ্টা করে।" (ভিক্টর কুজিন)
    • "দেওয়ানি আইনের নীতিতে প্রায়ই দেখা যায় যে, আইনের আধিক্যে ন্যায়ের জায়গা থাকে না, এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি ন্যায়ের সন্ধানে গিয়ে অন্যায়ের শিকার হয়-যেমন সমুদ্রে নাবিক তৃষ্ণায় মারা যায়।" (কোল্টন)
    • "আইনসমূহ রাজাদেরও রাজা।" (লুই চতুর্দশ)
    • "আইনের আধিক্য প্রমাণ করে-হয় রাজা অত্যাচারী, অথবা প্রজারা নিয়ন্ত্রণহীন।" (মারস্টন)
    • "আইনের অজ্ঞানতা কোনো অজুহাত নয়, কারণ এটি এমন অজুহাত যা সবাই দিতে পারে, এবং কেউ তা খণ্ডন করতে পারে না।" (পসলডন)
    • ভলতেয়ার বলেন "আমি জীবনে দুইবার ধ্বংস হয়েছি-একবার যখন আমি একটি মামলা জিতেছিলাম, আরেকবার যখন আমি একটি মামলা হেরেছিলাম।"
    • "দুঃখ ও অত্যাচারের প্রতিকার চেয়ে আইনের দ্বারস্থ হওয়া এমন, যেন একটি ভেড়া আশ্রয়ের খোঁজে কাঁটাঝোপে ঢুকে পড়ে।" (ডলটন)
    • "’সমাজ’ - শান্তি ও আইন ছাড়া টিকে থাকতে পারে না, কিন্তু বিপ্লবী চিন্তাবিদ ছাড়া তার উন্নয়ন অসম্ভব।" (বার্ট্রান্ড রাসেল)
    • "আইন ও ন্যায়-এ দুটি জিনিস ছিল যা ঈশ্বর একত্র করেছিলেন, কিন্তু মানুষ সেগুলোকে সম্পূর্ণভাবে পৃথক করে ফেলেছে।" (কোল্টন)
    • "বিশ্বের সবচেয়ে বড় অন্যায়গুলো সেইসব, যা আইনের নামে সংঘটিত হয়।" (লে এস্ট্রেঞ্জ)
    • (সূত্র: 'চিরাগে রাহ', খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৮৩–৮৪


    এই হলো মানবিক আইনের অবস্থা এবং আইনবিদদের মতামত। এই মতামতের বৈচিত্র্য আসলে মানবিক আইনের ব্যর্থতার জানান দেয়। মানবিক আইনের ইতিহাস এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এর বাস্তব প্রয়োগের নিরপেক্ষ ও গভীর অধ্যয়নকারী প্রত্যেক ব্যক্তি শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বাধ্য যে,
    (যদি তার মধ্যে ন্যায়পরায়ণ মন এবং বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি থাকে)
    “মানবিক আইনের ব্যর্থতা আসলে প্রমাণ করে যে, আজও পৃথিবীর প্রয়োজন সেই ঐশী ও সেই ওহীভিত্তি আইন, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিশ্বের উন্নত ও সভ্য অঞ্চলগুলোতে শাসন করেছে।”


    ❝ইসলামী চিন্তাবিদদের দৃষ্টিতে ‘আইন’ এর ধারণা❞

    "কানূন (আইন)" শব্দটি মূলত গ্রিক ভাষার, যার ব্যবহার "নিয়ম বা নীতিমালা" অর্থে হতো। সিরিয়াক (সুরিয়ানি) ভাষার মধ্যস্থতায় এই শব্দটি আরবি ভাষায় প্রবেশ করে। আরবি ভাষায় এর ব্যবহার শুরু হয় "পরিমাপক" বা "মানদণ্ড" অর্থে। (এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইসলাম, Kanun শব্দের অধীনে)

    তাজুল উরুস (খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা ৩১৫) অনুযায়ী, "কানূন" শব্দটি রোমান (গ্রিক) বা ফারসি শব্দ, এবং মুহীতুল মুহীত গ্রন্থে এটিকে সিরিয়াক বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, এটি গ্রিক শব্দ, যা অন্যান্য শব্দের মতো সিরিয়াক ভাষার মাধ্যমে আরবিতে এসেছে। লিসানুল আরব (ইবন মানজুর, খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা ২২৯) এবং কামুসুল মুহীত (ফিরোজাবাদী, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২৬৯) এ লেখা আছে যে, এই শব্দটি পূর্বাঞ্চলের বাদ্যযন্ত্রের জন্য ব্যবহৃত হতো।বর্তমানে ইউরোপীয় ভাষায় এই শব্দটি "চার্চের আইন" অর্থে ব্যবহৃত হয়। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এই শব্দের ব্যবহার “শরিয়াহ” বা “ফিকহের” জন্য হত না, এবং "আইন প্রণেতা" বা "আইন নির্ধারক" অর্থে "شارع " শব্দের ব্যবহারও তখন ছিল না। এই পরিভাষা পরবর্তীতে "মানবিক আইন" অধ্যয়নের পর পরবর্তী যুগের(মুতাআখ্যিরীন) ইসলামি চিন্তাবিদরা গ্রহণ করেন এবং ইসলামী ফিকহের পরিভাষার সাথে মিলিয়ে ব্যবহার করতে শুরু করেন।

    মানবিক আইনের ক্ষেত্রে "আইন" বলতে সেই নিয়ম ও বিধানসমূহের সমষ্টিকে বোঝানো হয়, যা কোনো সমাজের চিন্তাশীল ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান এবং সমাজের প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে প্রণয়ন করেন। এই আইন তার গঠনের দিক থেকে নমনীয় ও বিকাশযোগ্য হয়, এবং মানব অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতার আলোকে সময়ে সময়ে পরিবর্তনের সুযোগ থাকে।

    এই অর্থে, এক সমাজের আইন অন্য সমাজের আইন থেকে ভিন্ন হতে পারে, কারণ আইনের ভিত্তি যেসব সামাজিক স্বার্থ, রীতিনীতি, অনুভূতি ও ধারণার উপর নির্ভর করে, তা সময়, স্থান ও পরিস্থিতি অনুযায়ী আলাদা হয়।ভিন্ন ভিন্ন হয়। তাই ইতিহাসে বিভিন্ন যুগ ও জাতির মানবিক আইনের মধ্যে খুব কম মিল পাওয়া যায়। কারণ, যখন আইনের উৎসে ঐক্য থাকে না, তখন আইনের মধ্যে ঐক্য কীভাবে সম্ভব?

    একইভাবে এতে নৈতিক পরিশুদ্ধি বা আত্মশুদ্ধির কোনো স্থান নেই। এবং এই অর্থ অনুযায়ী, এতে মানবচেতনা জাগ্রত করার বা কল্যাণের ভিত্তি গড়ে তোলার কোনো ক্ষমতা নেই।

    একইভাবে এই আইনের মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই, এবং এটি মানুষের মৌলিক বিশ্বাস ও চিন্তার বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা দেয় না। একত্ববাদ, পরকাল, কিংবা মানুষের শুরু ও শেষ সম্পর্কে কোনো ধারণাও এতে নেই।

    এই অর্থে, আইন এমন কোনো মর্যাদা ও শ্রদ্ধা রাখে না, যা মানুষের হৃদয় ও মনকে তার সামনে নত করে, কিংবা মানবিক অনুভূতি ও চিন্তার উপর পূর্ণ প্রভাব বিস্তার করতে পারে।


    কিন্তু যখন ইসলামী চিন্তাবিদরা "কানূন" শব্দটি ইসলামী ফিকহ বা ইসলামী শরিয়তের জন্য ব্যবহার করতে শুরু করেন, তখন এই শব্দটি সম্পূর্ণরূপে সেই অর্থে ব্যবহৃত হতে লাগল, যা ইসলামী ফিকহ বা শরিয়তের ধারণা বহন করে। এই ভিত্তিতেই "ইসলামী আইন" এবং "মানবিক আইন" এর মধ্যে পার্থক্য নির্ধারিত হয়। অন্যথায়, এর মূল উৎপত্তি ও প্রকৃত অর্থ অনুসারে "আইন বা কানুন" শব্দটি শুধুমাত্র মানবিক আইনেই প্রযোজ্য ছিল।

    তবে একটি মূলনীতি হলো–যখন কোনো ভাষার শব্দ অন্য ভাষায় প্রবেশ করে, তখন তা শুধু তার পুরনো অর্থেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং নতুন ভাষা থেকে নতুন অর্থও গ্রহণ করে। এই নিয়ম এখানেও প্রযোজ্য হয়েছে, এবং "আইন" শব্দটি ইসলামী পরিভাষায় পূর্ণভাবে শরিয়া বা ইসলামি ফিকহ অর্থে ব্যবহৃত হতে শুরু করে।
    ( تاریخ التشریع الاسلامی:ص ۱۲؍ مناع القطان )


    আরবি ভাষায় "কানূন" শব্দটি প্রথমে "পরিমাপক" অর্থে ব্যবহৃত হতো, পরে এটি এমন সাধারণ অর্থে ব্যবহৃত হতে লাগল, যা প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ও সার্বজনীন নিয়মের জন্য প্রযোজ্য। যেমন: "স্বাস্থ্যবিধি" বা "প্রাকৃতিক আইন" ইত্যাদি। ইমাম গাজালী (রহ.) তাঁর اصول الفقه গ্রন্থ আল-মুস্তাসফা (মুদ্রিত: মিশর, ১৯৩৭, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৮)-তে "কানূন" শব্দটি সীমারেখা ও বিধিনিষেধের অর্থে ব্যবহার করেছেন।

    ফুকাহায়ে কেরামের মতে "কানূন" শব্দটি সাধারণত তিনটি অর্থে ব্যবহৃত হয়:

    1️⃣ প্রথম অর্থ-যা সবচেয়ে প্রচলিত, তা হলো: "আহকামে শারইয়্যাহর সমষ্টি"। যেমন: قانون الجزاء العثمانی (উসমানীয় ফোউজদারী আইন) এবং قانون الموجبات والعقود اللبنانی (উকুদ ও মোজিবাত সংক্রান্ত লেবাননের দেওয়ানি আইন) ইত্যাদি।

    2️⃣ দ্বিতীয় অর্থ-"আইন ও বিধান", যেমন: ইংরেজি আইন বা আইন বিষয়ক পাঠ।

    এই অর্থেই কিতাবুল কাওয়ানিন আল-ফিকহিয়া ফি তালখিস আল-মাযাহিব আল-মালিকিয়া (মুদ্রিত: ফারস, ১৯৩৫) গ্রন্থে ইমাম আবুল কাসিম ইবন জুযি(جزی) এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

    3️⃣ তৃতীয় অর্থ - "কানূন (আইন)" শব্দটি এমন প্রতিটি নিয়মের জন্য ব্যবহৃত হয়, যা সাধারণ সামাজিক বিষয়ে প্রযোজ্য। যেমন বলা হয়: "জাতীয় পরিষদ খাদ্য মজুদ নিষিদ্ধ করার আইন প্রণয়ন করেছে।"

    এই অর্থে "আইন" শব্দ ব্যবহৃত হলে তার কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে:
    • প্রথমত, এর সম্পর্ক দুনিয়াবি বিষয়ের সঙ্গে থাকে, ইবাদতের সঙ্গে নয়।কিন্তু এখানে ইসলামী ফিকহের আলোচনা ভিন্ন, যেখানে ধর্ম ও দুনিয়া উভয় বিষয়ে আলোচনা হয়।
    • দ্বিতীয়ত, এই ধরনের আইনের কার্যকারিতা সরকারের অনুমোদনের উপর নির্ভর করে।
    • তৃতীয়ত, এটি বিচারকের রায়ের মতো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা ঘটনার জন্য নয়, বরং সকল মানুষের জন্য বা নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর জন্য প্রণীত হয়।

    উসমানীয় সাম্রাজ্যে, “কানুন(আইন)" শব্দটি সাধারণত সেই সরকারি আদেশগুলোর জন্য ব্যবহৃত হতো, যেগুলো সরকার জারি করত-যাতে এগুলো শরীয়তের আদেশ থেকে পৃথক হিসেবে গণ্য হয়, কারণ শরীয়তের আদেশ ধর্মীয় দলিলের ভিত্তিতে নির্ধারিত।প্রাচীন জাতিগুলোর দৃষ্টিতে পারস্পরিক লেনদেন ও সামাজিক আচরণের বিধানসমূহ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও দুনিয়াবি রীতিনীতির সঙ্গে মিশ্রিত ছিল। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোতে ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় আইন ধর্মীয় বিষয় থেকে পৃথক হতে শুরু করে। এই বিভাজন তখন সম্পূর্ণ রূপে বাস্তবায়িত হয়, যখন রোমান সাম্রাজ্য উন্নতির মধ্যগগনে পৌঁছেছিল। আজকের দিনে "আইন" শব্দের প্রয়োগ শুধুমাত্র সামাজিক ও নাগরিক বিষয়ের ওপর সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে, এবং আইনশাস্ত্র এখন কেবল দুনিয়াবি লেনদেন ও অধিকার নির্ধারণের জন্য ব্যবহৃত হয়।

    তবে পোস্তিয়ানুস-এর গ্রন্থ আল-আহকাম-এর শুরুতে যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তাতে "আইন" বলতে ধর্মীয় ও দুনিয়াবি–উভয় ধরনের বিধানকে বোঝানো হয়েছে, যা বর্তমান ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত।।

    (ফালসাফাতু আত তাশরী ফিল ইসলাম, ড. সুবহি মুহাম্মাসানি, প্রধান বিচারপতি, আপিল আদালত, বৈরুত)

    সংক্ষেপেঃ জীবন পরিচালনার নীতিমালা ও জীবনব্যবস্থার জন্য ইসলামী পরিভাষায় মূলত "শরিয়ত" বা "ফিকহ" শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। "আইন বা কানূন" শব্দটি পরবর্তীকালে পরিভাষাগতভাবে শরিয়তের সমার্থক হিসেবে পরবর্তী যুগের ফকীহগন ব্যাবহার শুরু করেন।
    ❝শরিয়াহ”


    শাব্দিকভাবে "শরিয়ত" শব্দের অর্থ হলো "সোজা পথ"। এই অর্থই কুরআনের এই আয়াতে বলা হয়েছেঃ

    ثُمَّ جَعَلْنَاكَ عَلَىٰ شَرِيعَةٍ مِّنَ ٱلْأَمْرِ فَٱتَّبِعْهَا
    (সূরা জাসিয়া, আয়াত ১৮)
    অনুবাদ: তারপর আমি আপনাকে দ্বীনের এক স্পষ্ট পথে স্থাপন করেছি, অতএব আপনি তার অনুসরণ করুন।


    ফকিহদের পরিভাষায়, "শরিয়ত" শব্দটি সেই সকল ধর্মীয় বিধান ও নির্দেশনার জন্য ব্যবহৃত হয়, যা আল্লাহ তাঁর বান্দাদের হিদায়াত ও কল্যাণের জন্য অবতীর্ণ করেছেন। যেহেতু ইসলাম যে পথ নির্দেশ করেছে তা অত্যন্ত সোজা এবং সকল প্রকার বক্রতা ও বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত, তাই একে "শরিয়ত" বলা হয়।

    আরেকটি উপযুক্ততা হস-শরিয়ত একটি পবিত্র নহর বা প্রবাহ, যার মাধ্যমে জাতি ও ব্যক্তি আত্মিক জীবন লাভ করে; যেমন দুনিয়ার নহর থেকে শারীরিক জীবন লাভ হয়।

    কুরআন মাজিদে একাধিক স্থানে "শরিয়ত" শব্দটি "দ্বীন" এর সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে:
    • ﴿شَرَعَ لَكُم مِّنَ ٱلدِّينِ مَا وَصَّىٰ بِهِۦ نُوحًا﴾
      (সূরা শূরা, আয়াত ১৩)
      অনুবাদ: আল্লাহ তোমাদের জন্য সেই দ্বীনের পথ নির্ধারণ করেছেন, যার নির্দেশ তিনি নূহকে দিয়েছিলেন।
    • ﴿أَمْ لَهُمْ شُرَكَآءُ شَرَعُوا۟ لَهُم مِّنَ ٱلدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَن بِهِ ٱللَّهُ﴾
      (সূরা শূরা, আয়াত ২১)
      অনুবাদ: তাদের কি এমন শরিক আছে, যারা তাদের জন্য এমন দ্বীনের পথ নির্ধারণ করেছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি?

    এই অর্থ অনুযায়ী, বিধানপ্রণেতা ও আইনপ্রণেতা শুধুমাত্র আল্লাহর সত্তাই হতে পারেন। কোনো মানুষের পক্ষে শরিয়তের বিষয়ে আইন প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে "শারি" বলা হয় শুধুমাত্র এই অর্থে যে, তিনি আল্লাহর বিধানকে ওহী (কুরআন ও সুন্নাহ) এর মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে দেন।

    যদি "শরিয়ত" বলতে সেই সকল বিধান ও নির্দেশনাকে বোঝানো হয়, যা নবুয়তের ভাষা থেকে নির্গত হয়েছে, তাহলে এর পরিধি অত্যন্ত বিস্তৃত হয়ে যায়। এতে অন্তর্ভুক্ত হয়:
    • আকীদা (বিশ্বাস),
    • আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলি,
    • তাওহীদ,
    • পরকাল সম্পর্কিত সকল আলোচনা,
    • মতবিরোধের বিষয়সমূহ,
    • এবং সেই সকল আমলগত বিধান, যা আল্লাহ ও বান্দার পারস্পরিক সম্পর্কের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
    অন্যদিকে, ফিকহ বা ইসলামী আইন সাধারণত সেই আমলগত বিধানসমূহকে অন্তর্ভুক্ত করে, যা মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত।
    চলবে ইন শা আল্লাহ

  • #2
    Zubair Hamdan

    প্রিয় ভাই,আপনার সিরিজ আকারের পোস্টটি সুন্দরভাবে সমাপ্ত হোক, এই কামনা করি। আর একটি মাশোয়ারা ভাই, পর্বগুলো আরেকটু ছোট হলে ভাল হয়। আর লেখাগুলোর সাইজ আরেকটি বড় হলে পড়তে সুবিধা হবে ইনশাআল্লাহ।
    ‘যার গুনাহ অনেক বেশি তার সর্বোত্তম চিকিৎসা হল জিহাদ’-শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ.

    Comment


    • #3
      Originally posted by আবু যুবাইর View Post
      Zubair Hamdan

      প্রিয় ভাই,আপনার সিরিজ আকারের পোস্টটি সুন্দরভাবে সমাপ্ত হোক, এই কামনা করি। আর একটি মাশোয়ারা ভাই, পর্বগুলো আরেকটু ছোট হলে ভাল হয়। আর লেখাগুলোর সাইজ আরেকটি বড় হলে পড়তে সুবিধা হবে ইনশাআল্লাহ।

      আপনার পরামর্শ দুইটি মাথায় রাখবো ইন শা আল্লাহ।
      আসলে বিষয়টা অনেক বিস্তৃত,যার কারণে একটু লম্বা লম্বা পর্ব দিতে হচ্ছে।

      barakallah feek

      Comment

      Working...
      X