Announcement

Collapse
No announcement yet.

ইসলামী আইন বনাম মানবরচিত আইন; তূলনামূলক বিশ্লেষণ - পর্ব ৪, ইসলামি আইন কেন অনন্য?

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • ইসলামী আইন বনাম মানবরচিত আইন; তূলনামূলক বিশ্লেষণ - পর্ব ৪, ইসলামি আইন কেন অনন্য?


    মানবরচিত আইন ও ইসলামী আইনের মধ্যে কোনো তুলনাই চলে না। কারণ, উভয়ের বিকাশের ইতিহাসে সামান্য দৃষ্টিপাত করলেই নিম্নোক্ত বাস্তবতাগুলো স্বীকার না করে উপায় নেই।

    আইনগত মর্যাদা

    সবচেয়ে মৌলিক বিষয় হলো, মানবীয় আইনের অনুমোদন ও স্বীকৃতি দেয় গোত্রপ্রধান বা পার্থিব আদালত। যদি তাদের স্বীকৃতি না মেলে, তাহলে সেই আইন আইনই নয়। অর্থাৎ, তার আইন হওয়া নির্ভর করে কিছু বুদ্ধিমান ও ক্ষমতাধর মানুষের চিন্তা ও সমর্থনের ওপর।

    এর বিপরীতে, ইসলামী আইনের বৈশিষ্ট হলো, তার স্বীকৃতি দেন বিশ্বজগতের পালনকর্তা। পার্থিব আদালত তা মানুক বা না মানুক, তার আইনগত অবস্থানে কোনো পরিবর্তন আসে না। বরং এই আইন থেকে বিচ্যুত হওয়াই অপরাধ ও বিদ্রোহ হিসেবে গণ্য হয়।

    আল্লাহ বলেন:

    "ومن لم یحکم بما انزل اللّٰہ فاولئک هم الفاسقون" (সূরা মায়েদা: ৪৭)

    অনুবাদ: যারা আল্লাহর অবতীর্ণ আইন অনুযায়ী বিচার করে না, তারাই সত্যিকারের অবাধ্য।


    ইসলাম তার আইনকে কখনো "কিতাব" বলে , অর্থাৎ আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত বিধান; কখনো "সুন্নত" বলে অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ কর্তৃক প্রবর্তিত পথ; আবার কখনো "শরীয়ত" বলে, অর্থাৎ আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত বিধান। এভাবে ইসলাম তার আইনকে কোনো পার্থিব ব্যক্তি বা আদালতের অধীন করেনি, বরং এর কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের হাতে রেখেছে। এ কারণেই কোনো বড় ব্যক্তি বা বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠতাও ইসলামী আইনে পরিবর্তন আনার অধিকার রাখে না।

    পবিত্রতার দিক


    মানবরচিত আইন নিজস্ব কোনো পবিত্রতা বা শ্রদ্ধার দিক রাখে না। এটি মানুষের শরীরের ওপর শাসন চালাতে পারে, কিন্তু অন্তরের ওপর নয়। কারণ, কেউ মনে করে না যে গোপনে আইন লঙ্ঘন করলে কারো নজরে পড়বে, কিংবা গোপনে এই আইনের অবাধ্যতা করলে কোনো ভয়ংকর শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।

    অন্যদিকে, ইসলামী আইন তার অনুসারীদের কাছে একটি পবিত্র ও সম্মানিত বিধান। এর সঙ্গে এই বিশ্বাস জড়িত যে, যিনি এই আইন আমাদের দিয়েছেন, তিনি আমাদের প্রতিটি কাজ ও গোপন বিষয় সম্পর্কে অবগত। এই আইন থেকে বিচ্যুত হয়ে দুনিয়ার মানুষের দৃষ্টির আড়ালে থাকা সম্ভব, কিন্তু প্রকৃত আইনদাতার দৃষ্টির আড়ালে থাকা অসম্ভব। এইভাবে ইসলামী আইন বাহ্যিক দিকের পাশাপাশি অন্তরেও এবং শরীরের পাশাপাশি হৃদয় ও বিবেকেও শাসন চালায়।


    ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকের পার্থক্য


    মানবীয় আইন সম্পূর্ণ নেতিবাচক ভিত্তির ওপর গঠিত। এটি অত্যাচারী ও ক্ষমতাধরদের অন্যায় হস্তক্ষেপ ও জুলুমের প্রতিরোধের জন্য তৈরি হয়েছে, এবং অধিকার সংরক্ষণের ধারণা থেকেই এর বিকাশ ঘটেছে। তাই মানবীয় আইন দ্বারা সর্বোচ্চ প্রকাশ্য অপরাধ প্রতিরোধ করা যায়, এবং সমাজে একটি জোরপূর্বক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা যায় সর্বোচ্চ,কিন্তু ব্যক্তিত্ব গঠনে এর কোনো ভূমিকা নেই। ইতিবাচক দিক থেকে এটি একেবারেই শূন্য।নৈতিকতা, ইবাদত, আত্মশুদ্ধি ও পবিত্রতার ক্ষেত্রে এটি কোনো দিকনির্দেশনা দেয় না।

    এর বিপরীতে, ইসলামী আইন নেতিবাচকের চেয়ে ইতিবাচক দিকে বেশি গুরুত্ব দেয়। এটি অপরাধ প্রতিরোধের পাশাপাশি অপরাধীদের এমন সৎ নীতিমালার অনুসরণে বাধ্য করে, যার মাধ্যমে তারা সফল ও নেক মানুষে পরিণত হতে পারে। এবং প্রকৃত আইনের সফলতা এখানেই যে, তা অপরাধের উৎস বন্ধ করে দেয় এবং মন্দের মূল শিকড় উপড়ে ফেলে। পার্থিব আইনের শক্তি দ্বারা অপরাধ ও পাপের ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যায়, কিন্তু সেই পাপকে মূল থেকে নির্মূল করা যায় না। সমূলে উপড়ে ফেলা যায় না। প্রকৃত সফলতা হলো - অপরাধের শিকড়ই উপড়ে ফেলে দেওয়া, আর ইসলামী আইন ঠিক এই কাজটাই করে।


    আইনি আধ্যাত্মিকতা


    মানবরচিত আইনের ভিত্তি কেবল পারিবারিক রীতিনীতি, ঐতিহ্য এবং আঞ্চলিক প্রথা ও অভ্যাসের উপর নির্ভরশীল, যার ফলে এতে পক্ষপাত ও সংকীর্ণতার সমস্ত দূষণ বিদ্যমান। এতে জ্ঞান ও দর্শনের ভিত্তির সংমিশ্রণ নেই। যদিও সাম্প্রতিককালে এই দাবি করা হচ্ছে যে, আইনে জ্ঞান ও দর্শনের ভিত্তি সংযোজনের চেষ্টা চলছে এবং এটি করুণা, ন্যায়বিচার ও সমতার বৈশ্বিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হচ্ছে, কিন্তু যদি এটি সত্যও হয়, তাহলে আমাদের বিশ্বাস, এই প্রচেষ্টার সফল হতে বহু বছর লেগে যাবে। এবং তারপরও, এটি সেই ব্যাপকতা ও স্বাভাবিক ভারসাম্য থেকে বঞ্চিত থাকবে, যা ইসলামী আইনের বৈশিষ্ট্য।


    অন্যদিকে, ইসলামী আইনের ভিত্তি শুরু থেকেই মানবীয় প্রকৃতি ও আল্লাহর নির্দেশনার উপর প্রতিষ্ঠিত। এটি শুরু থেকেই বিশ্বজনীন ও দার্শনিক ভিত্তির উপর নির্মিত। মানবীয় আইন হাজার হাজার বছরের বিবর্তনের পর যে স্তরে পৌঁছাবে, ইসলামী আইন তার প্রথম পদক্ষেপই সেই স্তর থেকে শুরু করেছে।



    আইনি ঐক্য


    আইনে ঐক্য ও সামঞ্জস্য একটি অপরিহার্য বিষয়। মানবীয় আইনে মৌলিকভাবে ঐক্য ও সামঞ্জস্য বিদ্যমান নয়, কারণ এর মূল উপাদান গঠিত হয়েছে পারিবারিক ঐতিহ্য ও জাতিগত প্রথা ও অভ্যাস দ্বারা, যা অঞ্চল ও পরিবারভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। পরবর্তীতে যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে, তা প্রকৃত স্বভাব অনুযায়ী নয়, বরং জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ এবং বাহ্যিক চাপের ভিত্তিতে।


    অন্যদিকে, ইসলামী আইন তার সূচনালগ্ন থেকেই ঐক্যের নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত, কারণ এর ভিত্তি কুসংস্কার ও রীতিনীতির পরিবর্তে আল্লাহর নির্দেশনার উপর। এই নির্দেশনা প্রতিটি যুগে সামঞ্জস্য, ঐক্য, ব্যাপকতা ও চিরস্থায়ীত্বের অধিকারী। হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সকল নবীর আইন একই ঐক্যের ধারক। কুরআন নিজেই এর সাক্ষ্য দেয়:

    شرع لکم من الدین ماوصیّٰ بہ نوحاً والذی اوحیناالیک وماوصینابہ ابراہیم وموسیٰ وعیسیٰ ان اقیموالدین ولاتفرقوا فیہ۔ (شوریٰ:۱۳)

    "তোমাদের জন্য সেই দ্বীনই নির্ধারিত করা হয়েছে, যার শিক্ষা আমি দিয়েছিলাম নূহকে, এবং হে নবী, যা আমি আপনার প্রতি ওহী করেছি, এবং যা আমি ইব্রাহিম, মূসা ও ঈসাকে দিয়েছিলাম যে, দ্বীন প্রতিষ্ঠা করো এবং এতে বিভেদ সৃষ্টি করো না।"



    যেসব পার্থক্য দেখা যায়, তা বাহ্যিক এবং বিভিন্ন জাতির নিজস্ব স্বভাব ও মনোবৃত্তির কারণে। কিন্তু ইসলামী আইন তার প্রকৃত স্বভাব অনুযায়ী এক ঐক্য ও সামঞ্জস্যের ধারক ও বাহক, যেখানে ব্যক্তি ও জাতির মধ্যে কোনো আইনি বৈষম্য নেই।

    আইনের উৎস


    তদ্রূপ, মানবীয় আইন কিছু মানুষের চিন্তার ফসল, পক্ষান্তরে ইসলামী আইন স্বয়ং আল্লাহর দান। আজ এই সত্যটি বুঝতে কোনো অসুবিধা নেই যে, মানুষ কখনোই নিজের জন্য পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন করতে পারে না।


    কারণ, মানুষের জ্ঞান ও অনুভূতি সীমিত। সে কোটি কোটি মানুষের মনোবৃত্তির সাধারণ বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করতে পারে না, এবং সকল মানুষের অনুভূতি ও স্বভাব বিবেচনায় রেখে আইন তৈরি করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। আইন যতই নিষ্ঠার সঙ্গে তৈরি করা হোক না কেন, তাতে ব্যক্তিগত প্রবণতা ও স্বভাবের প্রভাব অনিবার্যভাবে এসে পড়ে। আইন প্রণেতা অবশ্যই নিজের পছন্দের দিকগুলোকে প্রাধান্য দেবে এবং যেসব দিক তার অপছন্দ, সেগুলো উপেক্ষা করবে।এটাই স্বাভাবিক।


    এই কারণে আইন প্রণয়নের অধিকার একমাত্র সেই সৃষ্টিকর্তার, যিনি সকল মানুষের মনোবৃত্তি, স্বভাব, প্রকৃতি, প্রয়োজন ও অনুভূতির পূর্ণ জ্ঞান রাখেন। তিনিই এমন আইন দিতে পারেন, যা প্রতিটি জাতি ও প্রতিটি যুগের মানুষের জন্য সমভাবে উপযোগী ও কল্যাণকর। আর ইসলামী আইন সেই আল্লাহপ্রদত্ত বিধানেরই নাম।


    সমাজ আগে,না আইন আগে?


    মানবীয় আইন ও ইসলামী আইনের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য হলো -মানবীয় আইনে “আইন” সমাজের পরে আসে। প্রথমে সমাজ গঠিত হয়, তারপর তার শৃংখলার জন্য আইন প্রণয়ন করা হয়। অর্থাৎ, আইন সমাজ তৈরি করে না।বরং সমাজের জন্যই আইন তৈরি করা হয়।মানবীয় আইনের বিবর্তনশীল ইতিহাস থেকে এটি স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। সাম্প্রতিক অতীতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমা দেশগুলোর আইনে যে পরিবর্তন এসেছে, তা দেখে প্রতিটি ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি উপলব্ধি করতে পারেন যে, মানুষের তৈরি আইন সমাজ ও সামাজিক অবস্থার চেয়ে এক কদমও এগিয়ে যেতে পারে না।

    অন্যদিকে, ইসলামে আইন সমাজের আগে আসে। সমাজের অস্তিত্ব ও তার অবস্থার উপর আইন নির্ভর করে না; বরং আইন আগে প্রণীত হয়, এবং সেই আইনের ভিত্তিতে সমাজ গঠিত হয়। যদি সমাজের পরিস্থিতি ওই আইনের অনুকূল না হয়, তাহলে দাওয়াহর মাধ্যমে পরিস্থিতির সংস্কার করা হয়,পরিস্থিতিকে অনুকূলে আনা হয়, এবং তা আইন বাস্তবায়নের উপযোগী করে তোলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে আইন পরিবর্তন করা যায় না।


    বিকাশের প্রক্রিয়াগত পার্থক্য


    একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো -মানবীয় আইনের বিকাশ ধাপে ধাপে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটেছে। এর সূচনা হয়েছিল একেবারে প্রাথমিক ও অসম্পূর্ণ রূপে, এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি বিকশিত হয়ে বর্তমান অবস্থানে পৌঁছেছে। এই সময়কালে এটি বিভিন্ন ঐশী ধর্মব্যবস্থা, মানবীয় প্রথা ও স্বভাব অভ্যাস, এবং বিপ্লব ও পরিবর্তন থেকে বিভিন্নভাবে প্রভাব গ্রহণ করেছে।


    এর বিপরীতে, ইসলামী শরিয়াহকে তার বিকাশের জন্য শতাব্দীর পর শতাব্দী অপেক্ষা করতে হয়নি। বরং এর অবতরণ ও পরিপূর্ণতার জন্য যে কয়েক বছর সময় লেগেছে, সেটাই তার বিকাশের পূর্ণ সময়কাল। ইসলামী আইনের প্রথম বিধানও ঠিক ততটাই পূর্ণাঙ্গ ও ভারসাম্যপূর্ণ ছিল, যতটা তার শেষ বিধান। এর সমস্ত বিধানের মধ্যে এমন একটি যুক্তিসঙ্গত সামঞ্জস্য রয়েছে, যার চেয়ে উত্তম কিছুর কল্পনাও করা যায় না। শতাব্দী প্রাচীন আইন(ইসলামী আইন) আজও ঠিক ততটাই সতেজ ও ভারসাম্যপূর্ণ মনে হয়, যেমনটি ছিল তার প্রারম্ভিক যুগে।


    এটি প্রমাণ করে যে, ইসলামী আইন আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ একটি বিধান। যদি এটি মানুষের তৈরি হতো, তাহলে এটিকেও বিকাশের জন্য শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রয়োজন হতো। ইসলামী আইন ও মানবীয় আইনের মধ্যে এটি একটি অত্যন্ত সুস্পষ্ট পার্থক্য।


    আইন বাস্তবায়ন


    মানবীয় আইন বাস্তবায়নের দিক থেকেও দুর্বল। এটি তার নাগরিকদের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না, এবং একমাত্র আইন দ্বারা অপরাধ নির্মূল সম্ভব নয়। এর প্রতিটি আইন কার্যকর করার জন্য জনগণের মানসিক প্রস্তুতি প্রয়োজন হয়, যাতে তারা সরকারের সঙ্গে আইন বাস্তবায়নে সহযোগিতা করে। এই কারণে মানবীয় আইনে অপরাধীদের পালিয়ে যাওয়ার অনেক সুযোগ থাকে, এবং তারা জনসাধারণের দৃষ্টির আড়ালে আইনবিরুদ্ধ কাজ করতে পারে। কারণ এই আইনের কোনো সম্পর্ক পরকাল, মানবীয় বিবেক বা নৈতিকতার সঙ্গে নেই। ফলে অপরাধী তার গোপন জীবনে যেকোনো আইনবিরুদ্ধ কর্মকাণ্ডে স্বাধীন থাকে, এবং সরকার চেষ্টাসত্ত্বেও সহজে তার নাগাল পায় না।


    এর বিপরীতে, ইসলামী আইনের সূচনা হয় পরকালের চিন্তা এবং হালাল-হারামের অনুভূতি থেকে। এটি মানবীয় বিবেককে গঠন করে, এবং বাহ্যিক আচরণের আগে অন্তরকে নিয়ন্ত্রণে আনে। এটি পার্থিব শাস্তির চেয়ে পরকালীন শাস্তির ভয় দেখায় বেশি, এবং বাহ্যিক সুনামের পাশাপাশি অন্তরের পবিত্রতার উপরও গুরুত্ব দেয়। তাই ইসলামী আইন বাস্তবায়নের জন্য শক্তিশালী সরকার বা সেনাবাহিনীর প্রয়োজন হয় না। মানুষ যখন এই আইনের কথা জানতে পারে, তখনই তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা নিজেদের উপর প্রয়োগ করে।নিজেদের জন্য গ্রহণ করে নেয়। মানবীয় আইন ও ইসলামী আইনের মধ্যে এটি একটি বড় মৌলিক পার্থক্য।


    মানবীয় আইনে সরকার আইন বাস্তবায়ন ও তার অনুসরণের জন্য দায়বদ্ধ থাকে, তাই সব প্রচেষ্টা সরকারের পক্ষ থেকেই করতে হয়। কিন্তু ইসলামী আইনে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ নিজ দায়িত্বের জন্য দায়বদ্ধ থাকে, এবং এই বিশ্বাস তার হৃদয় ও চিন্তায় গভীরভাবে প্রোথিত হয়:

    এর উদাহরণ হিসেবে একটা হাদীসের দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে:

    کلکم راع وکلکم مسئول عن رعیتہ۔

    (متفق علیہ ریاض الصالحین: للنووی :ج۱؍ص۱۴۵)


    "তোমাদের প্রত্যেকেই একজন দায়িত্বশীল, এবং প্রত্যেকের কাছ থেকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।"

    (সহিহ হাদিস, রিয়াদুস সালেহীন, ইমাম নববী, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৪৫)



    এই কারণেই ইসলামী আইন অপরাধের জন্য পার্থিব শাস্তির পাশাপাশি পরকালীন শাস্তির বিধানও দেয়।



    ইসলামী আইনে মানবীয় মনোবৃত্তির প্রতি সম্মান


    ইসলামী আইন মানবীয় সভাবের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ, কারণ এই আইনের প্রণেতা হলেন মানবজাতির স্রষ্টা,সর্বজ্ঞ ও সর্ববিষয়ে অবগত সত্তা, যিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল ঘটনা এবং মানুষের স্বভাব ও মনোবৃত্তি সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান রাখেন। কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে এই স্বভাবগত সামঞ্জস্যের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে:

    فاقم وجہک للدین حنیفا فطرۃ اللّٰہ التی فطرالناس علیہا لاتبدیل لخلق اللّٰہ ذلک الدین القیم ولکن اکثر الناس لایعلمون (الروم: ۳۰؍)


    "তুমি একনিষ্ঠভাবে সেই দ্বীনের দিকে মনোনিবেশ করো, যা আল্লাহর সেই প্রকৃতির উপর প্রতিষ্ঠিত, যার উপর তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টিতে কোনো পরিবর্তন নেই। এটাই সঠিক দ্বীন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তা জানে না।"



    যদি কেউ সম্পূর্ণ সততা ও ন্যায়ের সঙ্গে ইসলামী বিধানসমূহ অধ্যয়ন করে, তবে সে অবশ্যই এর সত্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হবে। যেমন -কিসাস এর বিধান। আল্লাহ তা'আলা নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের এই অধিকার দিয়েছেন। আল্লাহ নিহতের উত্তরাধিকারীদের কিসাসের পরিবর্তে দিয়াত (রক্তপণ) গ্রহণের অধিকার দিয়েছেন, এমনকি বিনা পারিশ্রমিকে ক্ষমা করারও অনুমতি দিয়েছেন।


    এই আইনে মানবীয় কল্যাণের প্রতি গভীর সম্মান রয়েছে। কারণ কিছু মানুষ অত্যন্ত প্রতিশোধপরায়ণ, যাদের প্রতিশোধ স্পৃহা শুধুমাত্র কিসাসের মাধ্যমে প্রশমিত হতে পারে,যেমন: গোত্রভিত্তিক সমাজে, যেখানে কল্যাণের চেয়ে সম্মান বেশি গুরুত্বপূর্ণ।এইজন্য আল্লাহ কিসাসের বিধান রেখেছেন।এই ধরনের মানুষ কিসাসই বেছে নেবে।


    আবার কিছু মানুষ দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত, অথবা তাদের স্বভাবে রক্তপাত ও হত্যা অপছন্দনীয় হতে পারে, এমন মানুষ কিসাসের পরিবর্তে দিয়াতকে প্রাধান্য দেবে।আল্লাহ এই বিধানটিও রেখেছেন।


    আর কিছু মানুষ অত্যন্ত ধৈর্যশীল ও সন্তুষ্ট প্রকৃতির, যারা তাদের স্বাভাবিক শালীনতা ও ঈমানের শক্তির ভিত্তিতে বিপদের প্রতিদান শুধু আল্লাহর কাছেই প্রত্যাশা করে, এবং তারা অন্যের সাহায্য নিয়ে আল্লাহর বড় প্রতিদান হারাতে চায় না।

    কখনো কখনো হত্যাকাণ্ড এমন পরিস্থিতিতে ঘটে, যেখানে কিসাস গ্রহণ বা রক্তপণ আদায় করা মন সায় দেয় না-যেমন: হত্যাকারী নিহত ব্যক্তিরই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, এবং নিহতের উত্তরাধিকারীরা চান না যে কিসাসের ফলে পরিবারে আরও হত্যাকাণ্ড ঘটুক, অথবা দিয়াতের কারণে পরিবার অর্থনৈতিকভাবে চাপে পড়ুক। এসব পরিস্থিতিতে তারা কিসাস বা দিয়াতের পরিবর্তে সম্পূর্ণ ক্ষমাকে প্রাধান্য দিতে পারেন।আল্লাহ এই বিধানটিও রেখেছেন।


    এইভাবে ইসলাম মানুষের বিভিন্ন রকমের স্বভাবের পার্থক্যকে বিবেচনায় রেখে আইনে যথেষ্ট নমনীয়তা সৃষ্টি করেছে, এবং বিভিন্ন স্বভাব অনুযায়ী মূল বিধানে বিভিন্ন উপবিধান রেখেছে, যাতে প্রতিটি মানুষ তার নিজস্ব রুচি ও মনোভাব অনুযায়ী আইনের সুবিধা গ্রহণ করতে পারে।


    মানবীয় প্রকৃতি ও মনোবৃত্তির যে গভীর সম্মান ইসলামী আইনে রয়েছে, তা মানব-প্রণীত আইনে সম্ভব নয়। কিছু মানবরচিত আইনে ইচ্ছাকৃত হত্যার শাস্তি শুধু মৃত্যুদণ্ড, আবার কিছুতে শুধু কারাদণ্ড বা আর্থিক জরিমানা নির্ধারিত হয়। কারণ, এসব আইনের প্রণেতারা জ্ঞান, অনুভূতি, চিন্তা ও গবেষণার দিক থেকে অত্যন্ত সীমিত। তারা অতীত ও ভবিষ্যতের কথা তো দূরের, বর্তমান সময়ের সকল পরিস্থিতি ও চাহিদা সম্পর্কেও পূর্ণভাবে অবগত নন। তাদের মধ্যে এমন ক্ষমতা নেই যে, তারা নিরপেক্ষভাবে সকল মানবীয় কল্যাণ ও প্রবণতার প্রতি সম্মান রেখে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন করতে পারেন।


    এই সীমাবদ্ধতার প্রমাণ পাওয়া যায় সেই রাষ্ট্র ও জাতিগুলোর নৈতিক ও আইনগত বিশৃঙ্খলা থেকে যেখানে মানবীয় আইন দ্বারা শাসন প্রচলিত। দেখা যায়,একটি নতুন আইন তৈরি হয়, আর পুরনোটি বাতিল হয়ে যায়। এই আইনি ভাঙাগড়াই মানবীয় আইনের ব্যর্থতার প্রতীক। কারণ, এসব আইনে সকল মানুষের স্বভাবের প্রতি সম্মান রাখা সম্ভব নয়। ফলে যখন একটি স্বভাবের মানুষ ক্ষমতায় থাকে, তখন একটি আইন কার্যকর থাকে; আর যখন অন্য স্বভাবের মানুষ ক্ষমতা গ্রহণ করে, তখন সেই আইন বাতিল করে নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়।


    অনেক সময় এমন হয় যে, একটি আইন নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে কার্যকর মনে হয়, কিন্তু যখন সেই আইন ভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করা হয়, তখন তা সম্পূর্ণ অকার্যকর ও ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়। এর সবচেয়ে খারাপ উদাহরণ হলো -ব্যভিচারের আইন। ইসলামের আইন এই বিষয়ে অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ ও ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত, এবং এটি যেকোনো সমাজে কার্যকরভাবে প্রয়োগযোগ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, কিছু ইসলামী দেশের আধুনিক চিন্তাধারার আইনপ্রণেতারা না ভেবে, অন্ধ অনুকরণের মানসিকতা নিয়ে ফরাসি আইন থেকে ব্যভিচারের আইন গ্রহণ করেছে। যার ফলে সমাজে এমন আইনগত বিশৃঙ্খলা ও নৈতিক অবক্ষয় সৃষ্টি হয়েছে, যা অত্যন্ত ভয়াবহ।


    আসলে এই মানবরচিত আইনের ধারা ফ্রান্সের সেই সমাজে প্রণীত হয়েছিল, যেখানে সম্মতি থাকলে যৌন সম্পর্ককে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় না, এবং এর ফলাফল সমাজে নিন্দনীয়ও নয়। তাই সেখানে শুধুমাত্র জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক (জিনা বিল জবর)-কেই "ব্যভিচার" হিসেবে গণ্য করা হয়। যদি পারস্পরিক সম্মতিতে এই কাজ সম্পন্ন হয় এবং কোনো পক্ষের অভিযোগ না থাকে, তাহলে সেটিকে অপরাধ বা অন্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয় না।


    মানবীয় আইন শুধুই নিষেধমূলক


    ইসলামী আইনের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো - এর বিধানসমূহ ইতিবাচক (ইজাবি) ও নেতিবাচক (সালবি) উভয় ধরনের। অর্থাৎ, একদিকে এটি সদগুণ ও সৎকর্মের নির্দেশ দেয় এবং এর মাধ্যমে ভালো ফলাফল ও পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেয়; অন্যদিকে এটি দুষ্কর্ম ও অপকর্ম থেকে বিরত রাখে, এবং বিভিন্ন সতর্কবাণী ও শাস্তির বিধান দেয়।


    অতএব, বলা যায়,ইসলামী আইনের মৌলিক উদ্দেশ্যের দুটি হলো - ন্যায় অর্জন এবং অন্যায় প্রতিহতকরণ। যেসব সদগুণের উপর জোর দেওয়া হয়, ইসলামী আইনের পরিভাষায় সেগুলোকে বলা হয় "ওয়াজিবাত" (আবশ্যকীয় কর্তব্য), আর যেসব অপকর্ম থেকে বিরত থাকতে বলা হয়, সেগুলোকে বলা হয় "মুহাররামাত বা মুনকারাত" (নিষিদ্ধ বিষয়)।


    অন্যদিকে, মানব-প্রণীত আইনে মূল গুরুত্ব দেওয়া হয় সামাজিক ক্ষতি প্রতিরোধে। নেকি অর্জন বা সৎকর্মের নির্দেশনা যদি থাকেও, তবে তা গৌণভাবে থাকে -মূল উদ্দেশ্য হিসেবে নয়। ফলে মানবীয় আইন সম্পূর্ণ বা অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধুই নিষেধমূলক। পক্ষান্তরে, ইসলামী আইন ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকেই কার্যকর।


    অন্যভাবে বললে, মানবীয় আইন শুধু বস্তুগত বিষয়কে গুরুত্ব দেয়; সদগুণ ও দুষ্কর্ম তার দৃষ্টিতে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু ইসলামী আইন একটি বহুমাত্রিক ও সর্বাঙ্গীন বিধান, যা মানবজীবনের সকল দিককে অন্তর্ভুক্ত করে।

    (চলবে ইন শা আল্লাহ)

  • #2
    ইসলামী আইন বনাম মানবরচিত আইন; তূলনামূলক বিশ্লেষণ - পর্ব ১
    - https://dawahilallah.com/forum/মূল-ফোরাম/মানহায/210686

    ইসলামী আইন বনাম মানবরচিত আইন; তূলনামূলক বিশ্লেষণ - পর্ব ২
    - https://dawahilallah.com/forum/মূল-ফোরাম/মানহায/210718

    ইসলামী আইন বনাম মানবরচিত আইন; তূলনামূলক বিশ্লেষণ - পর্ব ৩
    - https://dawahilallah.com/forum/মূল-ফোরাম/মানহায/210747

    ইসলামী আইন বনাম মানবরচিত আইন; তূলনামূলক বিশ্লেষণ - পর্ব ৪
    - https://dawahilallah.com/forum/মূল-ফোরাম/মানহায/210797
    বছর ফুরিয়ে যাবে এতো রিসোর্স আছে https://gazwah.net সাইটে

    Comment


    • #3
      মাশাআল্লাহ
      জাযাকাল্লাহ খাইরান

      আল্লাহ তাআলা আপনার ইলম ও ফাহমে বারাকা দান করুন, আমিন

      ভাই, ফন্ট সাইজ আরেকটু বড় করে দিলে ভালো হত
      আর আরবি আয়াতে যের যবর সংযুক্ত করে দিলে ভালো হত
      বছর ফুরিয়ে যাবে এতো রিসোর্স আছে https://gazwah.net সাইটে

      Comment

      Working...
      X