(এই পর্ব চতুর্থ পর্বের সাথে সংশ্লিষ্ট)
মানবীয় আইনের সত্যতা নিশ্চিত নয়
ইসলামী আইনের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এর ব্যাপারে সত্য, ন্যায়ের ভারসাম্য এবং সঠিকতার নিশ্চয়তা রয়েছে। এতে কোনো ভুল, ভুল বোঝাবুঝি বা জুলুম-অত্যাচারের সম্ভাবনা নেই, কারণ এই আইনের প্রণেতা এসব ত্রুটি থেকে মুক্ত, এবং সেখানে শুধুই কল্যাণ রয়েছে।
এর বিপরীতে, মানবীয় আইনে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।কারণ এর প্রণেতা মানুষ, আর মানুষ তার চিন্তা ও কর্মে বহু সামাজিক প্রভাব যেমন: রীতি-নীতি ও পরিবেশ, প্রাকৃতিক উপাদান ইত্যাদি দ্বারা প্রভাবিত হয়।
এই কারণে, স্বাভাবিকভাবেই একটি পরিস্থিতিতে তৈরি আইন অন্য পরিস্থিতিতে প্রযোজ্য হতে পারে না, এবং একটি দলের চিন্তা-ভাবনা অনুযায়ী তৈরি সংবিধান অন্য দলের প্রয়োজনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে না। কারণ, মানুষ যতই চিন্তার উচ্চতায় পৌঁছাক না কেন, ভবিষ্যতের পরিস্থিতি ও ঘটনাবলীর নাগাল তার নেই, এবং সে সময়কে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে না—যেন সময় সব যুগে একইভাবে চলে এবং একটি আইন সব যুগের জন্য যথেষ্ট হয়।
এই কারণেই মানবীয় আইনগুলো বারবার ভাঙাগড়ার শিকার হয়, এবং পরবর্তী প্রতিটি যুগে আগের আইনকে অপ্রচলিত ও অচল ঘোষণা করে বাতিল করে দেওয়া হয়।
ইসলামী আইনে মানবিক কল্যাণের প্রতি যত্ন
ইসলামী আইনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এতে মানবিক কল্যাণকে আইনের ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। মানবিক কল্যাণ বলতে পাঁচটি বিষয়ের নিরাপত্তাকে বোঝানো হয়—জীবন, ধর্ম, বংশ, বুদ্ধি এবং সম্পদের সংরক্ষণ। এই পাঁচটি বিষয়ের সংরক্ষণ সম্পর্কিত সকল বিষয়ই মানবিক কল্যাণের অন্তর্ভুক্ত, এবং দীন ও দুনিয়ার সকল বিষয় এইগুলোর ওপর নির্ভরশীল। ব্যক্তি ও সমাজের সকল সমস্যার তত্ত্বাবধানও এগুলোকে ঘিরেই আবর্তিত হয়।
যে কোনো বিষয় এই পাঁচটির যেকোনো একটির ক্ষতি করে - তা অপরাধ এবং শাস্তিযোগ্য। তবে এতে ভিত্তি হলো শরিয়তের দৃষ্টিভঙ্গি। শরিয়ত যেটিকে মানুষের জন্য উপকারী মনে করে, সেটিই কল্যাণ; আর যেটিকে ক্ষতিকর বলে, সেটিই অনিষ্ট। শুধুমাত্র মানবীয় বোধ-বুদ্ধির ওপর নির্ভর করা যায় না, কারণ মানুষ স্বভাবতই তাড়াহুড়া এবং আবেগপ্রবণ হয়, এবং তার ইচ্ছা ও অনুভূতিতে প্রবল পার্থক্য থাকে। এজন্যই কোরআনে বলা হয়েছে:
وَلَوِ اتَّبَعَ الْحَقُّ أَهْوَاءَهُمْ لَفَسَدَتِ السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ وَمَن فِيهِنَّ
(সূরা আল-মু’মিনূন, আয়াত: ৭১)
অনুবাদ: “আর যদি সত্য তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করত, তবে আকাশ, পৃথিবী এবং তাতে যা কিছু আছে সবই বিপর্যস্ত হয়ে যেত।”
আল্লাহ তাআলা বস্তু ও কর্মের ওপর বিধান দিয়েছেন তাদের ফলাফল ও পরিণতির ভিত্তিতে। যে বিষয় ফলাফলের দিক থেকে উপকারী, তা বৈধ; আর যা ক্ষতিকর, তা নিষিদ্ধ। তদুপরি, ক্ষতি ও উপকারের মধ্যে সামাজিক দিকটি অগ্রাধিকার পায়। হতে পারে কোনো বিষয় সমাজের জন্য উপকারী, কিন্তু কিছু ব্যক্তির জন্য ক্ষতিকর। যেমন, ইসলাম যেসব শাস্তির বিধান দিয়েছে, তা অপরাধীদের জন্য কষ্টদায়ক হলেও পুরো সমাজের জন্য উপকারী। সুদ, জবরদখল, ব্যভিচার, মদ্যপান ইত্যাদি—এসব কিছু মানুষের জন্য আনন্দদায়ক হলেও মানব সমাজের জন্য ক্ষতিকর।
ইসলাম সামাজিক পরিণতির ভিত্তিতে কঠোর শাস্তির বিধান দিয়েছে
ইসলাম শাস্তির কঠোরতা নির্ধারণ করেছে তার সামাজিক পরিণতির ভিত্তিতে। যেমন, ইসলামে চুরির শাস্তি হাত কেটে দেওয়া। বাহ্যিকভাবে এটা কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু এর ফলাফল বিবেচনা করলে তা একেবারে যুক্তি ও ন্যায়সঙ্গত। কারণ, চুরি এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে যে সমাজে সম্পদ ও ধণ দৌলতের নিরাপত্তা হুমকির মুখে রয়েছে, এবং এই হুমকি যেকোনো ব্যক্তির ওপর আসতে পারে। স্পষ্টতই, সকল ব্যক্তি তাদের সম্পদের নিরাপত্তার জন্য শক্তিশালী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে না এবং এমন প্রহরী নিয়োগ করতে পারে না যারা তাদের জিনিসপত্রের সার্বক্ষণিক পাহারা দেবে।
এই কারণে, সকলকে আইনগতভাবে তাদের সম্পদের নিরাপত্তার দায়িত্বে আবদ্ধ করার পরিবর্তে, এবং পুরো সমাজের ওপর অপ্রয়োজনীয় বোঝা চাপানোর পরিবর্তে, অধিক যুক্তিসঙ্গত হলো—যারা এই ধরনের হুমকি ও ভয়ের কারণ সৃষ্টি করে, তাদেরই এমনভাবে সীমাবদ্ধ করা যাতে তারা ভবিষ্যতে আর এই ধরনের হুমকি সৃষ্টি করতে না পারে। কারণ, পুরো সমাজের তুলনায় কিছু ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা অনেক সহজ। এইভাবে দেখলে, চুরির শাস্তি একেবারে যুক্তি ও ন্যায়সঙ্গত।
ব্যভিচার (জিনা) যা বাহ্যিকভাবে একটি ক্ষণস্থায়ী কাজ মনে হয়,কিন্তু এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। এর মাধ্যমে একদিকে জাতির নৈতিক অবক্ষয় ঘটে, অন্যদিকে মানব বংশের পরিচয়ে মারাত্মক ক্ষতি হয়।সমাজে জারজ সন্তান আর আসল সন্তান পার্থক্য থাকে না। এজন্য, যে জাতিতে ব্যভিচার সাধারণ হয়ে যায়, আল্লাহ সেই জাতিকে ধ্বংস করে দেন। এইভাবে, জিনা একটি বড় মানবিক ক্ষতির উৎস, এবং এর কুপ্রভাব শুধু একজন ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং পুরো মানব সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। এই ভিত্তিতেই ইসলামী শরিয়ত জিনার জন্য কঠোর শাস্তির বিধান দিয়েছে যা তার পরিণতির দিক থেকে অত্যন্ত যুক্তি ও ন্যায়সঙ্গত।(সুবহানাল্লাহ)
মদ্যপান (শরব খমর)—এর শাস্তিও ইসলাম কঠোরভাবে নির্ধারণ করেছে। কারণ এই কাজ মানুষের বুদ্ধিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, আর বুদ্ধি হলো মানব সমাজের মৌলিক প্রয়োজন। তাই, যে ব্যক্তি বুদ্ধিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, সে আসলে পুরো মানব সমাজের ক্ষতির কারণ সৃষ্টি করে।
হত্যা—এই কাজ পুরো সমাজকে জীবন রক্ষার বিষয়ে আতঙ্কিত করে তোলে। ফলে, পরিণতির দিক থেকে একজন ব্যক্তির হত্যা আসলে পুরো মানবতার হত্যার সমান হয়ে যায়। এরই ভিত্তিতে আল্লাহ এটার শাস্তিবিধান দিয়েছেন “কিসাস", যা পুরো মানব সমাজের জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান করে। আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَلَكُمْ فِي ٱلْقِصَاصِ حَيَوٰةٌۭ يَـٰٓأُو۟لِى ٱلْأَلْبَـٰبِ
(সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৭৯)
অনুবাদ: “আর তোমাদের জন্য কিসাসে রয়েছে জীবন, হে বুদ্ধিমানগণ!”
সারকথা হলো, ইসলামী আইনে মানুষের পাঁচটি মৌলিক উদ্দেশ্য—জীবন, ধর্ম, বংশ, বুদ্ধি ও সম্পদের যেপরিমাণ সংরক্ষণ ও মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, তা অন্য কোনো আইনে নেই।অন্য কোন ধর্মে নেই।অন্য কোন জীবনব্যবস্থায় নেই। থাকতে পারে না।
ইসলামী আইন অপরাধীদের সংশোধন করে, সমাজের চাপে আইন পরিবর্তন করে না; বরং সে সমাজকেই বাধ্য করে যেন তারা নিজেদেরকে আইনের কাঠামোয় রূপান্তরিত করে।
উদ্দেশ্যের পার্থক্য
আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো—উদ্দেশ্যের ভিন্নতা। অর্থাৎ, আইন মূলত সমাজের কার্যক্রমকে সংগঠিত করার জন্য তৈরি করা হয়। এর চেয়ে বেশি কোনো উদ্দেশ্য এতে অন্তর্ভুক্ত থাকে না। যেমন, সমাজ গঠন, নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা, দিকনির্দেশনা প্রদান এবং চিন্তাগত ব্যাখ্যা এসব আইনগত উদ্দেশ্যের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু ইসলামী শরিয়তের উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে এসব বিষয় বাই ডিফল্ট অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। একদিকে শরিয়ত লেনদেন ও সামাজিক কার্যক্রমের সংগঠনের নীতিমালা নির্ধারণ করে, অন্যদিকে একটি নৈতিক ও কল্যাণকর সমাজ গঠনের রূপরেখাও প্রদান করে।
সারকথা: ইসলামী আইন এমন এক পরিপূর্ণ, ন্যায়নিষ্ঠ ও চিরস্থায়ী ব্যবস্থা,
যা মানুষের সব দিকের কল্যাণ নিশ্চিত করে।
অন্য কোনো মানবীয় বা ধর্মীয় ব্যবস্থায় যার সমকক্ষ নেই।
মানবীয় আইনের সত্যতা নিশ্চিত নয়
ইসলামী আইনের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এর ব্যাপারে সত্য, ন্যায়ের ভারসাম্য এবং সঠিকতার নিশ্চয়তা রয়েছে। এতে কোনো ভুল, ভুল বোঝাবুঝি বা জুলুম-অত্যাচারের সম্ভাবনা নেই, কারণ এই আইনের প্রণেতা এসব ত্রুটি থেকে মুক্ত, এবং সেখানে শুধুই কল্যাণ রয়েছে।
এর বিপরীতে, মানবীয় আইনে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।কারণ এর প্রণেতা মানুষ, আর মানুষ তার চিন্তা ও কর্মে বহু সামাজিক প্রভাব যেমন: রীতি-নীতি ও পরিবেশ, প্রাকৃতিক উপাদান ইত্যাদি দ্বারা প্রভাবিত হয়।
এই কারণে, স্বাভাবিকভাবেই একটি পরিস্থিতিতে তৈরি আইন অন্য পরিস্থিতিতে প্রযোজ্য হতে পারে না, এবং একটি দলের চিন্তা-ভাবনা অনুযায়ী তৈরি সংবিধান অন্য দলের প্রয়োজনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে না। কারণ, মানুষ যতই চিন্তার উচ্চতায় পৌঁছাক না কেন, ভবিষ্যতের পরিস্থিতি ও ঘটনাবলীর নাগাল তার নেই, এবং সে সময়কে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে না—যেন সময় সব যুগে একইভাবে চলে এবং একটি আইন সব যুগের জন্য যথেষ্ট হয়।
এই কারণেই মানবীয় আইনগুলো বারবার ভাঙাগড়ার শিকার হয়, এবং পরবর্তী প্রতিটি যুগে আগের আইনকে অপ্রচলিত ও অচল ঘোষণা করে বাতিল করে দেওয়া হয়।
ইসলামী আইনে মানবিক কল্যাণের প্রতি যত্ন
ইসলামী আইনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এতে মানবিক কল্যাণকে আইনের ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। মানবিক কল্যাণ বলতে পাঁচটি বিষয়ের নিরাপত্তাকে বোঝানো হয়—জীবন, ধর্ম, বংশ, বুদ্ধি এবং সম্পদের সংরক্ষণ। এই পাঁচটি বিষয়ের সংরক্ষণ সম্পর্কিত সকল বিষয়ই মানবিক কল্যাণের অন্তর্ভুক্ত, এবং দীন ও দুনিয়ার সকল বিষয় এইগুলোর ওপর নির্ভরশীল। ব্যক্তি ও সমাজের সকল সমস্যার তত্ত্বাবধানও এগুলোকে ঘিরেই আবর্তিত হয়।
যে কোনো বিষয় এই পাঁচটির যেকোনো একটির ক্ষতি করে - তা অপরাধ এবং শাস্তিযোগ্য। তবে এতে ভিত্তি হলো শরিয়তের দৃষ্টিভঙ্গি। শরিয়ত যেটিকে মানুষের জন্য উপকারী মনে করে, সেটিই কল্যাণ; আর যেটিকে ক্ষতিকর বলে, সেটিই অনিষ্ট। শুধুমাত্র মানবীয় বোধ-বুদ্ধির ওপর নির্ভর করা যায় না, কারণ মানুষ স্বভাবতই তাড়াহুড়া এবং আবেগপ্রবণ হয়, এবং তার ইচ্ছা ও অনুভূতিতে প্রবল পার্থক্য থাকে। এজন্যই কোরআনে বলা হয়েছে:
وَلَوِ اتَّبَعَ الْحَقُّ أَهْوَاءَهُمْ لَفَسَدَتِ السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ وَمَن فِيهِنَّ
(সূরা আল-মু’মিনূন, আয়াত: ৭১)
অনুবাদ: “আর যদি সত্য তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করত, তবে আকাশ, পৃথিবী এবং তাতে যা কিছু আছে সবই বিপর্যস্ত হয়ে যেত।”
আল্লাহ তাআলা বস্তু ও কর্মের ওপর বিধান দিয়েছেন তাদের ফলাফল ও পরিণতির ভিত্তিতে। যে বিষয় ফলাফলের দিক থেকে উপকারী, তা বৈধ; আর যা ক্ষতিকর, তা নিষিদ্ধ। তদুপরি, ক্ষতি ও উপকারের মধ্যে সামাজিক দিকটি অগ্রাধিকার পায়। হতে পারে কোনো বিষয় সমাজের জন্য উপকারী, কিন্তু কিছু ব্যক্তির জন্য ক্ষতিকর। যেমন, ইসলাম যেসব শাস্তির বিধান দিয়েছে, তা অপরাধীদের জন্য কষ্টদায়ক হলেও পুরো সমাজের জন্য উপকারী। সুদ, জবরদখল, ব্যভিচার, মদ্যপান ইত্যাদি—এসব কিছু মানুষের জন্য আনন্দদায়ক হলেও মানব সমাজের জন্য ক্ষতিকর।
ইসলাম সামাজিক পরিণতির ভিত্তিতে কঠোর শাস্তির বিধান দিয়েছে
ইসলাম শাস্তির কঠোরতা নির্ধারণ করেছে তার সামাজিক পরিণতির ভিত্তিতে। যেমন, ইসলামে চুরির শাস্তি হাত কেটে দেওয়া। বাহ্যিকভাবে এটা কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু এর ফলাফল বিবেচনা করলে তা একেবারে যুক্তি ও ন্যায়সঙ্গত। কারণ, চুরি এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে যে সমাজে সম্পদ ও ধণ দৌলতের নিরাপত্তা হুমকির মুখে রয়েছে, এবং এই হুমকি যেকোনো ব্যক্তির ওপর আসতে পারে। স্পষ্টতই, সকল ব্যক্তি তাদের সম্পদের নিরাপত্তার জন্য শক্তিশালী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে না এবং এমন প্রহরী নিয়োগ করতে পারে না যারা তাদের জিনিসপত্রের সার্বক্ষণিক পাহারা দেবে।
এই কারণে, সকলকে আইনগতভাবে তাদের সম্পদের নিরাপত্তার দায়িত্বে আবদ্ধ করার পরিবর্তে, এবং পুরো সমাজের ওপর অপ্রয়োজনীয় বোঝা চাপানোর পরিবর্তে, অধিক যুক্তিসঙ্গত হলো—যারা এই ধরনের হুমকি ও ভয়ের কারণ সৃষ্টি করে, তাদেরই এমনভাবে সীমাবদ্ধ করা যাতে তারা ভবিষ্যতে আর এই ধরনের হুমকি সৃষ্টি করতে না পারে। কারণ, পুরো সমাজের তুলনায় কিছু ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা অনেক সহজ। এইভাবে দেখলে, চুরির শাস্তি একেবারে যুক্তি ও ন্যায়সঙ্গত।
ব্যভিচার (জিনা) যা বাহ্যিকভাবে একটি ক্ষণস্থায়ী কাজ মনে হয়,কিন্তু এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। এর মাধ্যমে একদিকে জাতির নৈতিক অবক্ষয় ঘটে, অন্যদিকে মানব বংশের পরিচয়ে মারাত্মক ক্ষতি হয়।সমাজে জারজ সন্তান আর আসল সন্তান পার্থক্য থাকে না। এজন্য, যে জাতিতে ব্যভিচার সাধারণ হয়ে যায়, আল্লাহ সেই জাতিকে ধ্বংস করে দেন। এইভাবে, জিনা একটি বড় মানবিক ক্ষতির উৎস, এবং এর কুপ্রভাব শুধু একজন ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং পুরো মানব সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। এই ভিত্তিতেই ইসলামী শরিয়ত জিনার জন্য কঠোর শাস্তির বিধান দিয়েছে যা তার পরিণতির দিক থেকে অত্যন্ত যুক্তি ও ন্যায়সঙ্গত।(সুবহানাল্লাহ)
মদ্যপান (শরব খমর)—এর শাস্তিও ইসলাম কঠোরভাবে নির্ধারণ করেছে। কারণ এই কাজ মানুষের বুদ্ধিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, আর বুদ্ধি হলো মানব সমাজের মৌলিক প্রয়োজন। তাই, যে ব্যক্তি বুদ্ধিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, সে আসলে পুরো মানব সমাজের ক্ষতির কারণ সৃষ্টি করে।
হত্যা—এই কাজ পুরো সমাজকে জীবন রক্ষার বিষয়ে আতঙ্কিত করে তোলে। ফলে, পরিণতির দিক থেকে একজন ব্যক্তির হত্যা আসলে পুরো মানবতার হত্যার সমান হয়ে যায়। এরই ভিত্তিতে আল্লাহ এটার শাস্তিবিধান দিয়েছেন “কিসাস", যা পুরো মানব সমাজের জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান করে। আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَلَكُمْ فِي ٱلْقِصَاصِ حَيَوٰةٌۭ يَـٰٓأُو۟لِى ٱلْأَلْبَـٰبِ
(সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৭৯)
অনুবাদ: “আর তোমাদের জন্য কিসাসে রয়েছে জীবন, হে বুদ্ধিমানগণ!”
সারকথা হলো, ইসলামী আইনে মানুষের পাঁচটি মৌলিক উদ্দেশ্য—জীবন, ধর্ম, বংশ, বুদ্ধি ও সম্পদের যেপরিমাণ সংরক্ষণ ও মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, তা অন্য কোনো আইনে নেই।অন্য কোন ধর্মে নেই।অন্য কোন জীবনব্যবস্থায় নেই। থাকতে পারে না।
ইসলামী আইন অপরাধীদের সংশোধন করে, সমাজের চাপে আইন পরিবর্তন করে না; বরং সে সমাজকেই বাধ্য করে যেন তারা নিজেদেরকে আইনের কাঠামোয় রূপান্তরিত করে।
উদ্দেশ্যের পার্থক্য
আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো—উদ্দেশ্যের ভিন্নতা। অর্থাৎ, আইন মূলত সমাজের কার্যক্রমকে সংগঠিত করার জন্য তৈরি করা হয়। এর চেয়ে বেশি কোনো উদ্দেশ্য এতে অন্তর্ভুক্ত থাকে না। যেমন, সমাজ গঠন, নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা, দিকনির্দেশনা প্রদান এবং চিন্তাগত ব্যাখ্যা এসব আইনগত উদ্দেশ্যের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু ইসলামী শরিয়তের উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে এসব বিষয় বাই ডিফল্ট অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। একদিকে শরিয়ত লেনদেন ও সামাজিক কার্যক্রমের সংগঠনের নীতিমালা নির্ধারণ করে, অন্যদিকে একটি নৈতিক ও কল্যাণকর সমাজ গঠনের রূপরেখাও প্রদান করে।
সারকথা: ইসলামী আইন এমন এক পরিপূর্ণ, ন্যায়নিষ্ঠ ও চিরস্থায়ী ব্যবস্থা,
যা মানুষের সব দিকের কল্যাণ নিশ্চিত করে।
অন্য কোনো মানবীয় বা ধর্মীয় ব্যবস্থায় যার সমকক্ষ নেই।
Comment