হেফাজতে ইসলামী বাংলাদেশের ভাস্কর্য ও মোদিবিরোধী আন্দোলন এবং তৎপরবর্তী ক্র*্যাকডাউন জাতির বড় একটি অংশকে নানান চিন্তার সম্মুখীন করেছে।
প্রশাসনিক চাপের মুখে একের পর এক শীর্ষ নেতার পদত্যাগ, বন্দী হওয়া অগ্রগামী নেতাদের ছুড়ে ফেলে নতুন কমিটি গঠন কিংবা খোদ আক্রমণকারীর ডেরায় গিয়ে আপোসের দাবীদাওয়া জানানো ইত্যাদির মাধ্যমে, ইসলামী ব্যাক্তিত্বদের সহজ শিকারে পরিণত করা এবং গ্রেফতারকৃতদের আরো চাপে ফেলা দেয়ার মত অমানবিক ও আশ্চর্যজনক সিদ্ধান্তে ইসলামপ্রেমী জনসাধারণের মাঝে হতবুদ্ধিতাও দেখা যাচ্ছে।৷
আসলে আমাদের অতিসরল উলামায়ে কেরামের অপরিণামদর্শী রাজনীতি চর্চা কোনো বিচ্ছিন্ন বাস্তবতা নয়। আমরা যদি রাজনৈতিক চর্চায় উলামায়ে কেরামের ঐতিহাসিক ভূমিকার দিকে নজর দেই সহজেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
বাংলাদেশে ইসলামকেন্দ্রীক রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা সর্বপ্রথম দেখা যায় জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর, ১৯৮১ সালে অনুষ্ঠিত রাষ্টপ্রতি নির্বাচনে উলামা ফ্রন্টের ব্যানারে হাফেজ্জী হুজুরের (রহঃ) এর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মাধ্যমে।
প্রকৃত বাস্তবতা যাই হোক, ফলাফল এই দাঁড়ায় যে, দশ কোটি মুসলমানের এই দেশে তিনি (রহঃ) এক লক্ষাধিক ভোটও পাননি। যার পরিণতিতে উনার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।
সর্বজনশ্রদ্ধেয়, সুলেখক মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ (দা বা), মাওলানা নাসিম আরফাত (দা বা) সহ আরো অনেকের লেখা পাঠ করলে অবশ্য যে কেউ ধারণা করবেন যে, সূক্ষ্ম কারচুপি ও নিকটজনদের যথাযথ আনুগত্যের অভাবে 'অল্পের' জন্য শায়খ (রহঃ) রাষ্ট্রপতি হতে পারেন নি।
.
অথচ বাস্তবতা হলো সরকারি রোষানলে মেরুদণ্ড ভাংগা, কমিউনিস্ট পার্টি জাসদের মেজর জলিল পর্যন্ত হাফেজ্জী হুজুর রহঃ এর কাছাকাছি ভোট পায়। উভয়ের কেউই ২% ভোটও পান নি।
মনে রাখতে হবে, জাসদ সরকারের নিকট সন্দেহাতীত ভাবেই হাফজ্জী হুজুরের দলের চেয়ে অধিক চক্ষুশূল ছিল।
আরও দেখুন,
১৯৮৬ সালের নির্বাচনে জামায়াত ইসলামী ৫টি আসন পেলেও দেওবন্দী চিন্তাধারার কোনো দল একটি আসন লাভেও সক্ষম হয় নি। অথচ তখন জামায়াতে ইসলামী তাদের শীর্ষ নেতা গোলাম আজমের নাগরিকত্ব ইস্যু নিয়ে যথেষ্ট ব্যাকফুটে ছিল।
এরপর,
১৯৯১ সালের নির্বাচনে ৭ টি ইসলামী দলের সমন্বয়ে গঠিত জোটের প্রার্থীদের মাত্র একটি আসনে মাওলানা ওবায়দুল হক বিজয়ী হয়।
পক্ষান্তরে জামায়াতে ইসলামী ১৮টি আসনে জয়লাভ করে।যদিও তাদের প্রাপ্য ভোট জাতীয় পার্টির চেয়েও বেশী ছিল।
১৯৯৬ সালে দেওবন্দী ধারার কোন দল একটি আসনও লাভ করে নি।
২০০১ সালে ইসলামী ঐক্যজোট বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার বাইরে কার্যত কোন কিছুই অর্জন করতে পারে নি।
এই ঐতিহাসিক উপাত্ত থেকে স্পষ্টতই প্রতিভাত হয় যে, উলামায়ে কেরামের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের মাকসাদ ইসলামের কর্তৃত্ব বা নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা কষ্টকল্পিতই বটে; বরং কিছু সংস্কার বা অধিক হারে মসজিদ-মাদ্রাসা আবাদই মৌলিক উদ্দেশ্যই বলা যায়।
বরং দুঃখজনক ব্যাপার হলো, উলামায়ে কেরাম রাজনীতি চর্চার মাধ্যমে কখনো আমেরিকাপন্থী বিএনপি, আবার কখনো ভারতপন্থী আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি ছাড়া কিছুই অর্জন করতে পারেন নি।
বারবার ইসলামের খেদমত করতে গিয়ে বিপরীত ফলাফল প্রত্যক্ষ করার একটি বড় কারণ, ন্যারেটিভ হিসেবে ইসলামের বিজয় বা খেলাফত প্রতিষ্ঠার কথা সামনে আনলেও কার্যত কিছু সংস্কারমূলক কাজই নিজেদের উদ্দেশ্য বানিয়ে রাখা।
উলামায়ে কেরাম তথা কওমী অঙ্গনের রাজনীতির ময়দানে স্থায়ী ব্যর্থতা সত্ত্বেও, একই প্রক্রিয়ায় লেগে থাকাই প্রমান করে যে, ইসলাম প্রতিষ্ঠা উনাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নয়।
তসলিমা নাসরিনের নির্বাসন, কওমী সরকারী সনদ লাভ ইত্যাদি কিছু বিচ্ছিন্ন সফলতার বাইরে বাংলাদেশে ইসলামের নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষমতা কখনোই উলামায়ে কেরাম অর্জন করেনি বা এর জন্য কোন পূর্ব প্রস্তুতি নেন নি।
তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ২০১৩ এর ৫ই মে পরবর্তী আত্নসমর্পণমূলক ও দুর্বল রাজনৈতিক পদক্ষেপ এবং সাম্প্রতিক সময়ের ভাষ্কর্য, মোদিবিরোধী আন্দোলন পরবর্তী হতবুদ্ধিতা।
যেহেতু উলামায়ে কেরামের নেতৃত্বাধীন ইসলামী দলগুলো বা হেফাযতে ইসলাম সিস্টেম পরিবর্তন বা প্রতিস্থাপনের কর্মসূচি রাখেন না, তাই এই বিষয়ে উনাদের উদ্দেশ্য ও সক্ষমতার অতিরিক্ত আশা করার কী আছে?
সারকথা, কিছু সংস্কারমূলক কাজ করাই উলামায়ে কেরামের নের্তৃতাধীন সংগঠনগুলোর মৌলিক উদ্দেশ্য। তাই যখন ইসলাম প্রতিষ্ঠায় উনাদের কর্মসূচি খুজতে যাওয়া হয় কিংবা উনাদের বিভিন্ন আন্দোলনকে ইসলাম পুনঃপ্রতিষ্ঠার অনুগামী মনে করা হয়, তখন তা আসলে বাতুলতা বৈ কিছুই নয়।
আবারও বলছি, ইসলাম প্রতিষ্ঠা বা ইসলামের বিজয়ের পথ এক রকম এবং ইসলামের কিছু সংস্কার সাধনের পথ অন্য রকম।
প্রথমটি অত্যন্ত দুঃসাধ্য, কণ্টকাকীর্ণ এবং একই সাথে সুসমন্বিত, দুঃসাহসী ও প্রজ্ঞাপূর্ণ কর্মসূচির মুখাপেক্ষী। এক্ষেত্রে প্রতিটি সুযোগ ও সময়কে কাজে লাগানোর মত সতর্ক নের্তৃত্ব প্রয়োজন, বিপরীতে কিছু সংস্কারমূলক কাজকর্মের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই হাল্কা বাকপটু হলেই নের্তৃত্বের চাহিদা পূরণ হয়ে যায়।
তবে যে বিষয়টি ভুলে যাওয়া হয় তা হচ্ছে, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলে ইসলামের প্রচার প্রসার ও সংস্কার দ্রুততম ও কার্যকর হয়।
তাই আমাদের জন্য উলামায়ে কেরামের নিকট অসম্ভব আশা-আকাঙ্ক্ষা বা সমালোচনার চেয়ে ইসলাম পুঃনপ্রতিষ্ঠার বাস্তবমুখী কর্মসূচিতে আবদ্ধ হতে উনাদের দিকনির্দেশ করা জরুরী।
শরীয়াহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা, উম্মাহ্'র প্রতিরক্ষার মতো মহান লক্ষ্যে কীভাবে আমাদের জাতির এই মহান ব্যক্তিবর্গ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন সে চেষ্টাই আমাদের করা উচিৎ।
লক্ষ্য করুন, কিভাবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এমনকি কট্টর মার্ক্সবাদীরা পর্যন্ত উম্মাহর এই গুরুত্বপূর্ণ অংশের উপর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে সুচতুর স্লোগান আর ফাঁপা প্রতিশ্রুতির আশ্রয় নিয়ে।
বিপরীতে শক্তিশালী ও সুদৃঢ় মানহাজের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও আমরা বিরক্তি, বিষোদগার আর ব্যক্তি আক্রমণের পাশাপাশি উচ্চাশার মাধ্যমে উলামায়ে কেরাম, তালেবে ইলম ও দা'ঈ ইলাল্লাহ্দের দূরে ঠেলে দেই। বরং অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকে নিজের শত্রুতে পরিণত করছি। লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ্।
জাতি হিসেবে আমরা এমনিতেই আবেগপ্রবণ। তন্মধ্যে উলামায়ে কেরাম ও তালেব ইলমদের মধ্যে তা আরও বেশী। এক দিকে রয়েছে সমাজের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে সৃষ্ট হীনমন্যতা, আবার একই সাথে রয়েছে দেওবন্দী চেতনার ধারক হওয়ার আত্নতৃপ্তিবোধ ও অতি আত্নবিশ্বাস।
বিপরীতমুখী দুই অনুভূতির মাঝে দোল খাওয়া এই মহান শ্রেনীটির মাঝে তাই আবেগের স্মরণ ঘটে অতি অল্পতেই। ফলত অসহিষ্ণু মধ্যবিত্তের চিরাচরিত স্বভাবের নিয়ত বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখতে পাই-
উম্মাহর কর্ণধারগণ আজকে কাউকে মাথার মুকুট বানিয়েছেন তো পরদিনই দ্বীনের দুশমন বানানোর প্রতিযোগিতায় প্রায়শই মশগুল হোন।
আমাদের উলামায়ে কেরাম ও তালেব ইলমদের আন্তরিকতা, আবেগ ও কিছু করার আগ্রহের অভাব নেই। কুফফারদের ক্রমাগত চক্রান্তের শিকার এই শ্রেণীটি এমনিতেই প্রতারিত ও প্রবঞ্চিত। এর উপর রয়েছে নিজেদের ভেতরকার দুঃখজনক অবক্ষয়ের নানা রকমের উপাদান! জাতির রাজনৈতিক নের্তৃত্বদানে উলামায়ে কেরামদের অপারগতার বাস্তবতা উপলব্ধি করাও আমাদের জন্য প্রাথমিক কর্তব্য।
বিশেষত, বিগত কয়েক শতকের ক্রমাগত অবনতির ফলাফল হিসেবে এই বাস্তবতা উম্মত প্রত্যক্ষ করছে যে, একই ব্যক্তির মাঝে নেতৃত্ব ও ইল্মের গভীরতার উপস্থিতি এ জামানায় প্রায় অসম্ভব বা বিরল।
এর কারন হিসেবে বলা যায়, হিজরি ১৩তম শতকের শুরু থেকে ইলমি কেন্দ্রগুলোতে- সমসাময়িক বাস্তবতা, পরিবর্তিত দুনিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞান, নতুন প্রজন্মের চাহিদার ব্যাপারে দক্ষতা অর্জন করা দূরে থাক, এবিষয়ে ফিকির করাই ছিল অবিশ্বাস্য কল্পনা।
.
ইলম চর্চার এমন এক ধারা সে সময় থেকে চলমান আছে, যার স্রোতে ভেসে আসা মস্তিষ্কে শরয়ী ইলম ও রাজনীতি চর্চা ধারন করা সম্ভব হচ্ছে না।
.
অবক্ষয়যুগের মুসলিম বিশ্বের ব্যাপারে আলোচনার এক পর্যায়ে শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী রাহঃ বলেন,
আর একথা সর্বজনবিদিত যে, আমাদের সমাজে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা যা 'দরসে নিজামী' হিসেবে সমধিক পরিচিত সেই অবক্ষয়যুগেরই ফসল।
যার ফলে দরসে নিজামির ছাত্র হিসেবে জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়ে দেয়ার পর, উম্মাহর এই ক্রান্তিলগ্নে নেতৃত্বের দায়িত্ব নেয়ার সক্ষমতা গড়ে তোলা কঠিন থেকে কঠিনতরই হয়ে উঠছে।
বস্তুত, কোনো কওমের মাঝে যত ভালো গুণ ও যোগ্যতাই থাকুক, যদি ফিকরের পরিচ্ছন্নতা ও সচেতনতা না থাকে, তাহলে যে কোনো কপটের কপটতাই তাকে সহজে বিভ্রান্ত করতে পারে। ইলমের কিছু শাখায় পারদর্শিতা বা নফল আমলের আধিক্য এ বিষয়টিকে পরিবর্তন বা প্রভাবিত কোনটাই করে না।
কেমন যেন এমন আমাদের দীনী নের্তৃত্বের এমন বাস্তবতার কথাই শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী (রহঃ) বলে গিয়েছিলেন,
শেষকথা, নিশ্চয়ই কুম্ভকর্ণের মতো দীর্ঘমেয়াদী আরামদায়ক দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকার চেয়ে নিজেকে যন্ত্রণাদায়ক বাস্তবতার সামনে দাড় করানোই অধিক লাভজনক।
প্রশাসনিক চাপের মুখে একের পর এক শীর্ষ নেতার পদত্যাগ, বন্দী হওয়া অগ্রগামী নেতাদের ছুড়ে ফেলে নতুন কমিটি গঠন কিংবা খোদ আক্রমণকারীর ডেরায় গিয়ে আপোসের দাবীদাওয়া জানানো ইত্যাদির মাধ্যমে, ইসলামী ব্যাক্তিত্বদের সহজ শিকারে পরিণত করা এবং গ্রেফতারকৃতদের আরো চাপে ফেলা দেয়ার মত অমানবিক ও আশ্চর্যজনক সিদ্ধান্তে ইসলামপ্রেমী জনসাধারণের মাঝে হতবুদ্ধিতাও দেখা যাচ্ছে।৷
আসলে আমাদের অতিসরল উলামায়ে কেরামের অপরিণামদর্শী রাজনীতি চর্চা কোনো বিচ্ছিন্ন বাস্তবতা নয়। আমরা যদি রাজনৈতিক চর্চায় উলামায়ে কেরামের ঐতিহাসিক ভূমিকার দিকে নজর দেই সহজেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
বাংলাদেশে ইসলামকেন্দ্রীক রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা সর্বপ্রথম দেখা যায় জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর, ১৯৮১ সালে অনুষ্ঠিত রাষ্টপ্রতি নির্বাচনে উলামা ফ্রন্টের ব্যানারে হাফেজ্জী হুজুরের (রহঃ) এর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মাধ্যমে।
প্রকৃত বাস্তবতা যাই হোক, ফলাফল এই দাঁড়ায় যে, দশ কোটি মুসলমানের এই দেশে তিনি (রহঃ) এক লক্ষাধিক ভোটও পাননি। যার পরিণতিতে উনার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।
সর্বজনশ্রদ্ধেয়, সুলেখক মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ (দা বা), মাওলানা নাসিম আরফাত (দা বা) সহ আরো অনেকের লেখা পাঠ করলে অবশ্য যে কেউ ধারণা করবেন যে, সূক্ষ্ম কারচুপি ও নিকটজনদের যথাযথ আনুগত্যের অভাবে 'অল্পের' জন্য শায়খ (রহঃ) রাষ্ট্রপতি হতে পারেন নি।
.
অথচ বাস্তবতা হলো সরকারি রোষানলে মেরুদণ্ড ভাংগা, কমিউনিস্ট পার্টি জাসদের মেজর জলিল পর্যন্ত হাফেজ্জী হুজুর রহঃ এর কাছাকাছি ভোট পায়। উভয়ের কেউই ২% ভোটও পান নি।
মনে রাখতে হবে, জাসদ সরকারের নিকট সন্দেহাতীত ভাবেই হাফজ্জী হুজুরের দলের চেয়ে অধিক চক্ষুশূল ছিল।
আরও দেখুন,
১৯৮৬ সালের নির্বাচনে জামায়াত ইসলামী ৫টি আসন পেলেও দেওবন্দী চিন্তাধারার কোনো দল একটি আসন লাভেও সক্ষম হয় নি। অথচ তখন জামায়াতে ইসলামী তাদের শীর্ষ নেতা গোলাম আজমের নাগরিকত্ব ইস্যু নিয়ে যথেষ্ট ব্যাকফুটে ছিল।
এরপর,
১৯৯১ সালের নির্বাচনে ৭ টি ইসলামী দলের সমন্বয়ে গঠিত জোটের প্রার্থীদের মাত্র একটি আসনে মাওলানা ওবায়দুল হক বিজয়ী হয়।
পক্ষান্তরে জামায়াতে ইসলামী ১৮টি আসনে জয়লাভ করে।যদিও তাদের প্রাপ্য ভোট জাতীয় পার্টির চেয়েও বেশী ছিল।
১৯৯৬ সালে দেওবন্দী ধারার কোন দল একটি আসনও লাভ করে নি।
২০০১ সালে ইসলামী ঐক্যজোট বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার বাইরে কার্যত কোন কিছুই অর্জন করতে পারে নি।
এই ঐতিহাসিক উপাত্ত থেকে স্পষ্টতই প্রতিভাত হয় যে, উলামায়ে কেরামের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের মাকসাদ ইসলামের কর্তৃত্ব বা নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা কষ্টকল্পিতই বটে; বরং কিছু সংস্কার বা অধিক হারে মসজিদ-মাদ্রাসা আবাদই মৌলিক উদ্দেশ্যই বলা যায়।
বরং দুঃখজনক ব্যাপার হলো, উলামায়ে কেরাম রাজনীতি চর্চার মাধ্যমে কখনো আমেরিকাপন্থী বিএনপি, আবার কখনো ভারতপন্থী আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি ছাড়া কিছুই অর্জন করতে পারেন নি।
বারবার ইসলামের খেদমত করতে গিয়ে বিপরীত ফলাফল প্রত্যক্ষ করার একটি বড় কারণ, ন্যারেটিভ হিসেবে ইসলামের বিজয় বা খেলাফত প্রতিষ্ঠার কথা সামনে আনলেও কার্যত কিছু সংস্কারমূলক কাজই নিজেদের উদ্দেশ্য বানিয়ে রাখা।
উলামায়ে কেরাম তথা কওমী অঙ্গনের রাজনীতির ময়দানে স্থায়ী ব্যর্থতা সত্ত্বেও, একই প্রক্রিয়ায় লেগে থাকাই প্রমান করে যে, ইসলাম প্রতিষ্ঠা উনাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নয়।
তসলিমা নাসরিনের নির্বাসন, কওমী সরকারী সনদ লাভ ইত্যাদি কিছু বিচ্ছিন্ন সফলতার বাইরে বাংলাদেশে ইসলামের নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষমতা কখনোই উলামায়ে কেরাম অর্জন করেনি বা এর জন্য কোন পূর্ব প্রস্তুতি নেন নি।
তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ২০১৩ এর ৫ই মে পরবর্তী আত্নসমর্পণমূলক ও দুর্বল রাজনৈতিক পদক্ষেপ এবং সাম্প্রতিক সময়ের ভাষ্কর্য, মোদিবিরোধী আন্দোলন পরবর্তী হতবুদ্ধিতা।
যেহেতু উলামায়ে কেরামের নেতৃত্বাধীন ইসলামী দলগুলো বা হেফাযতে ইসলাম সিস্টেম পরিবর্তন বা প্রতিস্থাপনের কর্মসূচি রাখেন না, তাই এই বিষয়ে উনাদের উদ্দেশ্য ও সক্ষমতার অতিরিক্ত আশা করার কী আছে?
সারকথা, কিছু সংস্কারমূলক কাজ করাই উলামায়ে কেরামের নের্তৃতাধীন সংগঠনগুলোর মৌলিক উদ্দেশ্য। তাই যখন ইসলাম প্রতিষ্ঠায় উনাদের কর্মসূচি খুজতে যাওয়া হয় কিংবা উনাদের বিভিন্ন আন্দোলনকে ইসলাম পুনঃপ্রতিষ্ঠার অনুগামী মনে করা হয়, তখন তা আসলে বাতুলতা বৈ কিছুই নয়।
আবারও বলছি, ইসলাম প্রতিষ্ঠা বা ইসলামের বিজয়ের পথ এক রকম এবং ইসলামের কিছু সংস্কার সাধনের পথ অন্য রকম।
প্রথমটি অত্যন্ত দুঃসাধ্য, কণ্টকাকীর্ণ এবং একই সাথে সুসমন্বিত, দুঃসাহসী ও প্রজ্ঞাপূর্ণ কর্মসূচির মুখাপেক্ষী। এক্ষেত্রে প্রতিটি সুযোগ ও সময়কে কাজে লাগানোর মত সতর্ক নের্তৃত্ব প্রয়োজন, বিপরীতে কিছু সংস্কারমূলক কাজকর্মের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই হাল্কা বাকপটু হলেই নের্তৃত্বের চাহিদা পূরণ হয়ে যায়।
তবে যে বিষয়টি ভুলে যাওয়া হয় তা হচ্ছে, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলে ইসলামের প্রচার প্রসার ও সংস্কার দ্রুততম ও কার্যকর হয়।
তাই আমাদের জন্য উলামায়ে কেরামের নিকট অসম্ভব আশা-আকাঙ্ক্ষা বা সমালোচনার চেয়ে ইসলাম পুঃনপ্রতিষ্ঠার বাস্তবমুখী কর্মসূচিতে আবদ্ধ হতে উনাদের দিকনির্দেশ করা জরুরী।
শরীয়াহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা, উম্মাহ্'র প্রতিরক্ষার মতো মহান লক্ষ্যে কীভাবে আমাদের জাতির এই মহান ব্যক্তিবর্গ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন সে চেষ্টাই আমাদের করা উচিৎ।
লক্ষ্য করুন, কিভাবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এমনকি কট্টর মার্ক্সবাদীরা পর্যন্ত উম্মাহর এই গুরুত্বপূর্ণ অংশের উপর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে সুচতুর স্লোগান আর ফাঁপা প্রতিশ্রুতির আশ্রয় নিয়ে।
বিপরীতে শক্তিশালী ও সুদৃঢ় মানহাজের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও আমরা বিরক্তি, বিষোদগার আর ব্যক্তি আক্রমণের পাশাপাশি উচ্চাশার মাধ্যমে উলামায়ে কেরাম, তালেবে ইলম ও দা'ঈ ইলাল্লাহ্দের দূরে ঠেলে দেই। বরং অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকে নিজের শত্রুতে পরিণত করছি। লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ্।
জাতি হিসেবে আমরা এমনিতেই আবেগপ্রবণ। তন্মধ্যে উলামায়ে কেরাম ও তালেব ইলমদের মধ্যে তা আরও বেশী। এক দিকে রয়েছে সমাজের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে সৃষ্ট হীনমন্যতা, আবার একই সাথে রয়েছে দেওবন্দী চেতনার ধারক হওয়ার আত্নতৃপ্তিবোধ ও অতি আত্নবিশ্বাস।
বিপরীতমুখী দুই অনুভূতির মাঝে দোল খাওয়া এই মহান শ্রেনীটির মাঝে তাই আবেগের স্মরণ ঘটে অতি অল্পতেই। ফলত অসহিষ্ণু মধ্যবিত্তের চিরাচরিত স্বভাবের নিয়ত বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখতে পাই-
উম্মাহর কর্ণধারগণ আজকে কাউকে মাথার মুকুট বানিয়েছেন তো পরদিনই দ্বীনের দুশমন বানানোর প্রতিযোগিতায় প্রায়শই মশগুল হোন।
আমাদের উলামায়ে কেরাম ও তালেব ইলমদের আন্তরিকতা, আবেগ ও কিছু করার আগ্রহের অভাব নেই। কুফফারদের ক্রমাগত চক্রান্তের শিকার এই শ্রেণীটি এমনিতেই প্রতারিত ও প্রবঞ্চিত। এর উপর রয়েছে নিজেদের ভেতরকার দুঃখজনক অবক্ষয়ের নানা রকমের উপাদান! জাতির রাজনৈতিক নের্তৃত্বদানে উলামায়ে কেরামদের অপারগতার বাস্তবতা উপলব্ধি করাও আমাদের জন্য প্রাথমিক কর্তব্য।
বিশেষত, বিগত কয়েক শতকের ক্রমাগত অবনতির ফলাফল হিসেবে এই বাস্তবতা উম্মত প্রত্যক্ষ করছে যে, একই ব্যক্তির মাঝে নেতৃত্ব ও ইল্মের গভীরতার উপস্থিতি এ জামানায় প্রায় অসম্ভব বা বিরল।
এর কারন হিসেবে বলা যায়, হিজরি ১৩তম শতকের শুরু থেকে ইলমি কেন্দ্রগুলোতে- সমসাময়িক বাস্তবতা, পরিবর্তিত দুনিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞান, নতুন প্রজন্মের চাহিদার ব্যাপারে দক্ষতা অর্জন করা দূরে থাক, এবিষয়ে ফিকির করাই ছিল অবিশ্বাস্য কল্পনা।
.
ইলম চর্চার এমন এক ধারা সে সময় থেকে চলমান আছে, যার স্রোতে ভেসে আসা মস্তিষ্কে শরয়ী ইলম ও রাজনীতি চর্চা ধারন করা সম্ভব হচ্ছে না।
.
অবক্ষয়যুগের মুসলিম বিশ্বের ব্যাপারে আলোচনার এক পর্যায়ে শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী রাহঃ বলেন,
"মাদ্রাসা ও শিক্ষাকেন্দ্রগুলো চরম স্থবিরতা, নির্জীবতা ও বন্ধাত্তের শিকার হয়ে পড়েছিলো।
সেখানেও ছিল (বাস্তব) জ্ঞান ও চিন্তাগত অবক্ষয়ের ছাপ। মুসলিম বিশ্বের উপর তখন জ্ঞান-বন্ধাত্ত ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্থবিরতা কেমন কঠিনভাবে চেপে বসেছিলো, যা থেকে জীবনের কোনো অংন মুক্ত ছিল না।"
(মা যা খসিরাল 'আলাম পৃষ্ঠাঃ ২৭৮ দারুল কলম)
সেখানেও ছিল (বাস্তব) জ্ঞান ও চিন্তাগত অবক্ষয়ের ছাপ। মুসলিম বিশ্বের উপর তখন জ্ঞান-বন্ধাত্ত ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্থবিরতা কেমন কঠিনভাবে চেপে বসেছিলো, যা থেকে জীবনের কোনো অংন মুক্ত ছিল না।"
(মা যা খসিরাল 'আলাম পৃষ্ঠাঃ ২৭৮ দারুল কলম)
যার ফলে দরসে নিজামির ছাত্র হিসেবে জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়ে দেয়ার পর, উম্মাহর এই ক্রান্তিলগ্নে নেতৃত্বের দায়িত্ব নেয়ার সক্ষমতা গড়ে তোলা কঠিন থেকে কঠিনতরই হয়ে উঠছে।
বস্তুত, কোনো কওমের মাঝে যত ভালো গুণ ও যোগ্যতাই থাকুক, যদি ফিকরের পরিচ্ছন্নতা ও সচেতনতা না থাকে, তাহলে যে কোনো কপটের কপটতাই তাকে সহজে বিভ্রান্ত করতে পারে। ইলমের কিছু শাখায় পারদর্শিতা বা নফল আমলের আধিক্য এ বিষয়টিকে পরিবর্তন বা প্রভাবিত কোনটাই করে না।
কেমন যেন এমন আমাদের দীনী নের্তৃত্বের এমন বাস্তবতার কথাই শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী (রহঃ) বলে গিয়েছিলেন,
"মুসলিম দেশগুলো সম্পর্কে সতর্কতার অনুরোধে যদি আমরা এই কথা বলতে না চাই যে, ‘সচেতনতা’ তাঁদের মধ্যে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত, তাঁদের অন্তত এতটুকু বলতে হবে যে, তাঁদের সচেতনতা খুবই দুর্বল এবং প্রাথমিক পর্যায়ের।
আফসোসের সঙ্গেই বলতে হয়, দোস্ত-দুশমন ও শত্রু-মিত্রের পার্থক্য তারা বুঝতে পারেনা। হিতাকাঙ্ক্ষী ও অহিতাকাঙ্ক্ষী উভয়ের প্রতি তাঁদের আচরণ প্রায় অভিন্ন।
ক্ষেত্রবিশেষে বরং সুচতুর ও ‘ক্ষতিকর’ ব্যাক্তিরাই বিপুল আস্থা ও সর্বপ্রিয়তা অর্জন করে থাকে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সতর্ক করে বলেছেন, "মুমিন একই গর্ত থেকে দুবার দংশিত হয় না।"
কিন্তু আমাদের বাসিন্দারা দু’বার নয়, বহুবার দংশিত হয়েও যেন দংশনের ঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। আবারও সহজ দংশনের শিকার হয়।
তাঁদের স্মৃতি ও স্মৃতিশক্তি এত দুর্বল যে, নেতা ও শাসকদের অতীত, এমনকি নিকট অতীতও ভুলে যায়। তাঁদের ধর্মীয়, সামজিক ও নাগরিক সচেতনতা মর্মান্তিকভাবে দুর্বল, আর রাজনৈতিক সচেতনতা তো বলতে গেলে একেবারেই শুন্য।
এই সচেতনতার অভাবেই তারা বাইরের শক্তিগুলোর এবং নিজেদের স্বার্থবাদী নেতাঁদের হাতে ‘খেলার পুতুল’ হয়ে আছে। খুব সহজেই তাঁদের দৃষ্টি ও মনোযোগ যে কোনো দিকে ঘুরিয়ে দেয়া যায় এবং এক লাঠিতে সবাইকে ইচ্ছেমত হাঁকিয়ে নেয়া যায়।"
আফসোসের সঙ্গেই বলতে হয়, দোস্ত-দুশমন ও শত্রু-মিত্রের পার্থক্য তারা বুঝতে পারেনা। হিতাকাঙ্ক্ষী ও অহিতাকাঙ্ক্ষী উভয়ের প্রতি তাঁদের আচরণ প্রায় অভিন্ন।
ক্ষেত্রবিশেষে বরং সুচতুর ও ‘ক্ষতিকর’ ব্যাক্তিরাই বিপুল আস্থা ও সর্বপ্রিয়তা অর্জন করে থাকে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সতর্ক করে বলেছেন, "মুমিন একই গর্ত থেকে দুবার দংশিত হয় না।"
কিন্তু আমাদের বাসিন্দারা দু’বার নয়, বহুবার দংশিত হয়েও যেন দংশনের ঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। আবারও সহজ দংশনের শিকার হয়।
তাঁদের স্মৃতি ও স্মৃতিশক্তি এত দুর্বল যে, নেতা ও শাসকদের অতীত, এমনকি নিকট অতীতও ভুলে যায়। তাঁদের ধর্মীয়, সামজিক ও নাগরিক সচেতনতা মর্মান্তিকভাবে দুর্বল, আর রাজনৈতিক সচেতনতা তো বলতে গেলে একেবারেই শুন্য।
এই সচেতনতার অভাবেই তারা বাইরের শক্তিগুলোর এবং নিজেদের স্বার্থবাদী নেতাঁদের হাতে ‘খেলার পুতুল’ হয়ে আছে। খুব সহজেই তাঁদের দৃষ্টি ও মনোযোগ যে কোনো দিকে ঘুরিয়ে দেয়া যায় এবং এক লাঠিতে সবাইকে ইচ্ছেমত হাঁকিয়ে নেয়া যায়।"
Comment