সংঘাতের সূত্রঃ শত্রুতার মৌলিক কারণ!!
ইসলামের শত্রুরা খুব ভালোভাবেই আমাদের দীনের শক্তি, প্রভাব ও সর্বব্যাপীতার মাত্রা উপলব্ধি করলেও, আমরা যারা ইসলামের বিজয় চাই তাদের অনেকেই কেমন যেন অতিসরল, কল্পনাবিলাসী হয়ে ভবঘুরের ন্যায় ঘুরপাক খাই।
গৎবাঁধা কিছু রেটোরিক আর চিন্তাধারার বাইরে গিয়ে মানুষকে শরিয়াহর উদ্দেশ্যের সাথে একাত্ম করতে বাস্তবসম্মত, পরিকল্পিত ও প্রয়োগিক কোনো কার্যক্রমে অগ্রসর হতে পারিনা।
এর মূল কারণ ইসলামের তত্ত্বের দাবী, প্রয়োজনীয়তা ও ওজন সম্পর্কে আমরা উদাসীন। পাশাপাশি ইসলামের শত্রুদের নানামুখী কর্মসূচীর ব্যাপারে ঢালাও দৃষ্টিভঙ্গিও আমাদের চিন্তাগত তারল্যের জন্য দায়ী।
.
এই জটিলতা থেকে মুক্ত হতে ফিকরের পরিচ্ছন্নতা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। ঢালাও চিন্তাধারার ফলে সৃষ্ট জড়তা যেমন কাম্য নয়, একই সাথে ক্রিটিকাল থিংকিংয়ের মোড়কে অলস ও নিস্ক্রিয় তাত্ত্বিকে পরিণত হওয়াও বর্জনীয়।
.
এ সংকট উত্তরণে আমাদের শায়খদের ফিকরের ফলাফলসমূহ থেকে প্রথমেই যে সূত্রটি উপস্থাপন করা হচ্ছে, 'কাফিররা শুধুমাত্র আকিদার কারণে ইসলামের শত্রুতা করে না। বরং, স্বীয় চাহিদা চরিতার্থে উদ্দেশ্যে যে স্থানে, যখন, যতটুকু বিরোধিতা করা প্রয়োজন তারা তা ই করে।'
.
মহান শায়খ আবু বকর নাজি তার কিংবদন্তীতূল্য গ্রন্থ 'ইদারাতুত তাওয়াহহুশ' এ বলেন,
"শত্রু ও তার সহগামীদের নেতৃত্ব ও নীতি সম্পর্কে যথাসম্ভব বিস্তারিত ব্যাখ্যা থাকা দরকার, যাতে তাদের রাজনীতি একজন মুজাহিদ গভীরভাবে বুঝতে পারে।
এবং এ ধারণা থেকে সরে আসতে পারে যে, শত্রু শুধু ইসলাম বিদ্বেষের কারণে বা ধর্মীয় কারণে সংঘাতে লিপ্ত হয়।
গভীর পর্যবেক্ষণের পর এটি পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, অনেক শত্রুগোষ্ঠীর কাছে ধর্মীয় দিকটি দ্বিতীয় পর্যায়ের বা একেবারেই গৌণ।"
উদাহরণ হলো উপলব্ধির চাবি। তাই একটি উদাহারণ উল্লেখ করা যাক,
১৯৬৪ সালের ২১-২২ জুলাই ঢাকায় কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি খাজা নাজিমুদ্দিনের বাড়িতে বিরোধী দলের নেতাদের একটি সভা হয়। সভায় আওয়ামী লীগ,
নেজামে ইসলামী পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও কাউন্সিল মুসলিম লীগের প্রতিনিধিরা যোগ দেন। সভায় এই পাঁচ দলের সমন্বয়ে কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি বা 'কপ' তৈরি হয়। কপের পক্ষ হতে নয় দফা ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
নয় দফার আট নম্বর দফায় ছিলঃ "কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশ অনুযায়ী সত্যিকার ইসলামী সমাজব্যবস্থা ও শরিয়তের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান। এই পরিপ্রেক্ষিতে পারিবারিক আইন সংশোধন।"
পরবর্তীতে ১৯৬১ সালে আইয়ুব খান 'পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১' জারী করলে জামায়াতে ইসলামী তা 'ইসলামবিরোধী' আখ্যা দিয়ে বিরোধিতা করলে আওয়ামী লীগও তাতে সমর্থন দেয়!
অথচ, এই শেখ মুজিবই পরবর্তীতে ধর্মনিরপেক্ষতার ছাতার নীচে আশ্রয় নেয় ভারতের আস্থাভাজন হওয়ার লক্ষ্যে এবং ক্ষমতায় পৌঁছে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানের চার মূলনীতির একটি করে।
আজীবন সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা বলে মানুষের ঐক্যবদ্ধ করা শেখ মুজিবকেই আবার দেখা গিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের আশীর্বাদধন্য হওয়ার চেষ্টায় একক পার্টির ক্ষমতায়ন বা বাকশাল প্রতিষ্ঠা করতে।
.
সচেতন পাঠকমাত্রই জেনে থাকবেন; ইসলাম, পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন তিনটি মতবাদ।
.
আবার, শাসনব্যবস্থা হিসেবে শরয়ী দলীলের ভিত্তিতে ইসলামী শুরাভিত্তিক শাসন, কৃষক-শ্রমিকের একনায়কতন্ত্র
এবং সংসদীয় গণতন্ত্র সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী তিনটি শাসনব্যবস্থা।
.
.
এমনকি, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণকারী মিছিলে গুলি চালানোর জিম্মাদার খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে সখ্যতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন বিরোধী এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোরবিরোধী মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতেমা জিন্নাহকে প্রেসিডেন্ট করতে প্রকাশ্য গোপন সকল প্রকার তৎপরতায় লিপ্ত হয় শেখ মুজিবের আওয়ামীলীগ, মাত্র ১যুগের মাথায়।
.
.
অথচ, দল-মত-নির্বিশেষে এদেশের প্রচলিত রাজনীতির ধ্বজাধারীদের অন্যতম আদর্শ শেখ মুজিবের এমন চেহারা পাল্টে ফেলা মূলতঃ গোটা বিশ্ব, বিশেষত, জাতীয় পর্যায়ের সকল রাজনীতিবিদদের প্রতিকৃতি।
হিংস্র, অর্থলোভী খ্রিস্টান পোপ ও সম্রাটদের শোষণের ফলে ইউরোপে ধর্মবিদ্বেষ, ভোগলিপ্সা ও বস্তুবাদী চাহিদা পূজার হিড়িক ওঠে। ক্রমান্বয়ে ধর্মকেন্দ্রিক তথা আদর্শিক রাজনীতির অবলুপ্তি ঘটে গোটা ইউরোপেই। যার ঢেউ এক পর্যায়ে আছড়ে পড়ে গোটা বিশ্বেই।
ধর্মীয় আধিপত্যের পতনের পর থেকেই মূলত আদর্শকে কেন্দ্র করে নয়; বরং ক্ষমতা, জনপ্রিয়তা বা ব্যাপকভাবে অর্থ উপার্জনই ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক, সামাজিক বা পারিবারিক কর্মকান্ডের মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাড়ায়।
আসলে পৃথিবীর ইতিহাসে এমনটা একেবারেই ছিলনা তা নয়। তবে ফরাসী বিপ্লব ও বলশেভিক বিপ্লবের পাশাপাশি মুসলিমদের পতনের ফলে তা সর্বব্যাপী হয়ে ওঠে। যার ফলে কোন আদর্শ নয় বরং ক্ষমতা চর্চা, জনপ্রিয়তার ক্ষুধা ও অর্থের লালসাই রাজনীতির মূলনীতি হয়ে দাঁড়ায়।
প্রশ্ন উঠতে পারে ইসলামবিরোধী কি এসকল শাসকগোষ্ঠীর মূল আদর্শ নয়?
প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, জাতীয় পর্যায়ের পুতুল সরকার, বিরোধী দল বা তাদের মিত্র সংগঠনগুলোর প্রাথমিক উদ্দেশ্য সাধারণত উল্লেখিত তিনটি বস্তুগত চাহিদা মেটানোর কোনো একটি বা প্রত্যেকটিই হয়ে থাকে।
ইসলামবিরোধী এসকল শাসকগোষ্ঠী বা রাজনৈতিক দলগুলো ইসলামের বিরোধিতায় শুধু এজন্যই করে, কারণ ইসলামের প্রকৃত ও পূর্ণাঙ্গ অনুসারীগণ এসকল জালিমদের স্বেচ্ছাচারিতার পথে বাঁধাস্বরূপ।
শুধুমাত্র মুলহিদ শাসকগোষ্ঠীই নয়, প্রত্যেক স্বৈরাচারী জালিম, সে কাফির হোক বা মুসলিম; প্রত্যেক খাহেশাতের পূজারী, তার গায়ে মুজিব কোট থাকুক বা মাথায় টুপি থাকুক; প্রত্যেক অপব্যাখ্যাকারী, সে মার্ক্সবাদী
হোক বা মাদখালি হোক- তাদের প্রত্যেকের ইসলামের পরিপূর্ণ দাওয়াত ও দায়ীদের বিরোধিতার মূল কারণই হচ্ছে প্রবৃত্তির গোলামির পথে বাঁধাগ্রস্থ হওয়া।
কাফের, মুলহিদ, জালিম স্বৈরাচারীরা, তা সে আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, তুরস্ক বা ইরানের হোক; সঠিক কথা হচ্ছে, তাদের তৎপরতার মূলে আদর্শের মৌলিক ভূমিকা নেই।
শায়খ অন্যত্র চমৎকারভাবে উল্লেখ করেছেন,
"আমাদের শত্রুদেরকে যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করে বস্তুবাদী অর্জন। কাফির ও মুরতাদরা অধিকাংশে ক্ষেত্রে সংঘাতে জড়ায় বস্তুবাদী দুনিয়াবী স্বার্থের জন্য। তবে তারা বস্তুগত দুনিয়াবী উদ্দেশ্যকে ধর্মীয় বা বানােয়াট সাংস্কৃতিক উদ্দেশ্যের আড়ালে লুকিয়ে রাখে।
তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস যুদ্ধের পেছনে একক নিয়ামক হিসেবে কাজ করে না, বরং এটি অনেকগুলাের নিয়ামকের মধ্যে একটি।
তবে কাফির, মুরতাদদের অজ্ঞ অনুসারী এবং সাধারণ লােকদের জন্য ধর্ম অনেক সময় একটি শক্তিশালী কারণ হয়ে উঠে।
কিন্তু দিনশেষে, বস্তুগত স্বার্থ এবং বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষাই তাদের যুদ্ধের চালিকাশক্তি। আবার কোনরকমে বেঁচে থাকায় তারা সন্তুষ্ট না। বরং তাদের আরাম ও বিলাসিতার গ্যারান্টিযুক্ত জীবন লাগবে।
আর শত্রুর মিত্র ও সমর্থকদের ব্যাপারটা হল , যতােক্ষণ তাদের স্বার্থ পূরণ হবে ততােক্ষণ তারা একসাথে থাকবে। এ বিষয়টি আমাদের অবশ্যই ভাল করে বুঝতে হবে ।
কাজেই, শত্রুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নীতি হলাে স্বার্থ। এ নীতি কখনােই কোনাে নৈতিকতা বা আদর্শের সামনে মাথানত করে না।
স্বার্থের সামনে অন্যান্য সকল নীতিই গৌণ। বন্ধুত্ব - শত্রুতা, শান্তি বা যুদ্ধ- সব নির্ধারিত হয় স্বার্থের ভিত্তিতে।
পশ্চিমা রাজনীতিকরা একটি স্লোগানের মাধ্যমে বিষয়টি তুলে ধরে-
"রাজনীতিতে কোন স্থায়ী বন্ধুত্ব বা স্থায়ী শত্রুতা নেই, আছে শুধু স্থায়ী স্বার্থ।”
তবে, ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ অনেক সময় বিভিন্ন কাফির ও মুরতাদ সম্প্রদায়ের একজোট হবার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, এই বাস্তবতা ভুলে যাওয়াও চলবে না। কিন্তু একইসাথে এটা বলা যায় যে, ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের জোট আদর্শিকভাবে দুর্বল। কারণ প্রত্যেক গ্রুপ তার নিজের বস্তুগত স্বার্থ দ্বারা চালিত হয়। তাই তাদের এ জোট প্রত্যেক্যের বস্তুগত স্বার্থ দ্বারা সীমাবদ্ধ।
একারণে সর্বনিম্ন কী পরিমাণ স্বার্থ থাকলে কোন সদস্য জোটে সক্রিয় থাকবে, তা আমাদেরকে খুব ভালাে ভাবে বুঝতে হবে, পরিমাপ করতে হবে। তারপর নিজেদের সামরিক ও রাজনৈতিক পরিকল্পনা করতে হবে এবং শত্রু জোটের শরিকদের মাঝে বিদ্বেষ বাড়ানাের কাজটি করতে হবে।
একারণে জোটের শরিকদের কার, কোথায়, কী পরিমাণ স্বার্থ জড়িত তা আমাদের কাছে স্পষ্ট থাকতে হবে। স্বার্থের এই মানচিত্র সামরিক মানচিত্রের মতই গুরুত্বপূর্ণ।"
অতিরিক্ত আরেকটি বিষয় আলোচিতব্য,
নিশ্চয়ই আত্মহংকার ও ব্যাক্তিস্বার্থের পূজা শুধু কাফির ও জালিমদের সীমালঙ্ঘনে প্ররোচিত করে তা নয়; বরং যে বা যারাই যে অনুপাতে অহংকার ও দুনিয়ার দিকে ঝুকে পরে; সেই অনুপাতে তারা হক গ্রহণ ও তাতে ইস্তিকামাত থাকতে অপারগ হয়!
আল্লাহ তা আলার কাছেই সকল নিরাপত্তা!
وَ جَحَدُوۡا بِہَا وَ اسۡتَیۡقَنَتۡہَاۤ اَنۡفُسُہُمۡ ظُلۡمًا وَّ عُلُوًّا ؕ فَانۡظُرۡ کَیۡفَ کَانَ عَاقِبَۃُ الۡمُفۡسِدِیۡنَ
"আর তারা অন্যায় ও উদ্ধতভাবে নিদর্শনগুলো প্রত্যাখ্যান করল, যদিও তাদের অন্তর এগুলোকে নিশ্চিত সত্য বলে গ্ৰহণ করেছিল। সুতরাং দেখুন, বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পরিণাম কেমন হয়েছিল!"
قَالُوۡۤا اَنُؤۡمِنُ لَکَ وَ اتَّبَعَکَ الۡاَرۡذَلُوۡنَ
"তারা বলল, ‘আমরা কি তোমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করব অথচ ইতরজনেরা তোমার অনুসরণ করছে?"
"আর তারা অন্যায় ও উদ্ধতভাবে নিদর্শনগুলো প্রত্যাখ্যান করল, যদিও তাদের অন্তর এগুলোকে নিশ্চিত সত্য বলে গ্ৰহণ করেছিল। সুতরাং দেখুন, বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পরিণাম কেমন হয়েছিল!"
قَالُوۡۤا اَنُؤۡمِنُ لَکَ وَ اتَّبَعَکَ الۡاَرۡذَلُوۡنَ
"তারা বলল, ‘আমরা কি তোমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করব অথচ ইতরজনেরা তোমার অনুসরণ করছে?"
Comment