"আফগানিস্তানে সংঘটিত আরব মুজাহিদিনদের সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে পরিচালিত ‘জাজি যুদ্ধ’ হচ্ছে বিশাল একটি সামগ্রিক লড়াইয়ের সমাপ্তি। এই যুদ্ধের আগে আফগানিস্তানে হাজারো যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল বর্তমান যুগের এক সুপার পাওয়ারের সাথে, এর নাম ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন।
দুনিয়ার পূর্ব দিকে ছিল সোভিয়েত রাশিয়া ও তার মিত্র শক্তি মিলে ‘ওয়ারশ জোট’। পশ্চিমে ছিল আমেরিকা ও তার মিত্র শক্তি মিলে ‘ন্যাটো জোট’।
এই লড়াই গত শতাব্দীর শেষ দিকে ১৩৯৯ হিজরী মোতাবেক ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হওয়া বিশাল একটি যুদ্ধকে চূড়ান্ত সমাপ্তিতে পৌঁছে দিয়েছিল। (যা স্নায়ুযুদ্ধ নামে অভিহিত ছিল)।
আল্লাহর ইচ্ছায় এই যুদ্ধটা ছিল স্পষ্ট বিজয় এবং বিরাট এক অলৌকিক ঘটনা। কারণ এর মাধ্যমে সেদিন এ যুগের বস্তুবাদী তাগুতি শক্তির সকল দম্ভ অহংকার খতম হয়েছিল। এটা সে সময়ে, যে সময়ে আধুনিক অস্ত্রে অকল্পনীয় উন্নতি সাধন করা হয়েছিল।
.
অন্যদিকে মুসলিমদের হাতে উল্লেখযোগ্য কোনো যুদ্ধা-স্ত্র ছিল না, তাদের শাসকরা দুনিয়ার ভোগবিলাসে মত্ত ছিল এবং আল্লাহ তাআলার শরীয়ত বাস্তবায়ন থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছিল।
এর আবশ্যকীয় ফল ছিল তারা আল্লাহর পথে জিহাদ পরিত্যাগ করেছিল; বরং যারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে ইচ্ছুক, তাদের প্রত্যেককে তারা জেলখানায় আবদ্ধ করে রেখেছিল।
সেই সময়ে রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে মজুদ ছিল বর্তমান সময়ের অত্যাধুনিক হাজারো যুদ্ধযান ও উন্নত ট্যাংক বহর। আজ থেকে প্রায় ২০ বছরের কিছু পূর্বে তাদের কাছে শব্দের গতির চেয়ে তিনগুণ দ্রুত গতিসম্পন্ন অত্যাধুনিক হাজারো বিমান ছিল। আরও ছিল অস্ত্রে সজ্জিত লক্ষ লক্ষ সেনা।
এই বিশাল রাষ্ট্রটি আফগান প্রশাসনের সাথে মিলে সেই দেশে সমাজতন্ত্র প্রচারের চেষ্টা করে। অতঃপর সেই প্রশাসনের বিরুদ্ধে তাদের অনুগত নেতা বারবাক কারমালের মাধ্যমে বিদ্রোহ ঘটিয়ে দখল করে নেয়। সর্বশেষ ১৯৭৯ সালের শেষ দিকে এই হিংস্র লাল বাহিনী কাবুলে প্রবেশ করে, যেটা ছিল ১৩৯৯ হিজরী।
এই বিশাল ঘটনাটি তখন পুরো পৃথিবীকে প্রকম্পিত করেছিল। এই ভয়াবহ খবরটি আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলেছিল। আরবসহ পুরো বিশ্বে তাদের শ্বাস নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। এই ভয়ংকর ঘটনাটি মূলত পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহ ও ন্যাটো জোটের ক্ষমতার সমাপ্তি ঘোষণা করেছিল।
রাশিয়া যখন ইউরোপের পূর্বের অংশ দখল করেছিল, তখন এই ন্যাটো জোট (এই জোটে আমেরিকা, ইউরোপসহ অন্যান্য অধিকাংশ দেশ অন্তর্ভুক্ত ছিল) ইউরোপে যুদ্ধ প্রস্তুতি ও প্রতিরক্ষা অস্ত্রের পেছনে প্রায় সাড়ে চারশ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছিল। এসবই করেছিল ইউরোপের উপর রাশিয়ার আক্রমণের ভয়ে। তারা(ন্যাটো জোট) কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সমস্ত শক্তিগুলোকে একত্রিত করেছিল, যেমনটা পূর্বে রোমানিয়াতে করেছিল।
ষাটের দশকে কোন রাষ্ট্র যদি সোভিয়েত ইউনিয়নের আনুগত্য করতে অস্বীকার করত, তাদের শাসক ও কমান্ডাররা নিজেদেরকে রাশিয়ান ট্যাংকের নিচে আবিষ্কার করত। রাশিয়ানরা বিশাল বিমান বহর, সেনাবাহিনী ও অস্ত্র বহন করে নিয়ে আসত এবং পুরা দেশের মধ্যে ছড়িয়ে দিত। একারণে সমস্ত মানুষ এই কমিউনিস্টদের অনুগত দাসে পরিণত হয়েছিল।
এই লাল দানব হিংস্র রাশিয়ান ভাল্লুক হঠাৎ করেই ১৩৯৯ হিজরীতে তার বিমান ও ট্যাংক বহর নিয়ে কাবুল দখল করে বসে। তারা এসেছিল তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান ও তুর্কেমেনিস্তান দিয়ে। এর ফলে রাজধানীসহ সমস্ত জনগণ ক্রুসেডার রাশিয়ার দখলদারিত্বের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।
এই পর্যায়ে এসে রাশিয়ার আ-ফগা-নিস্তানে প্রবেশের পূর্বের অবস্থা একটু বিস্তারিত আলোচনা করা আবশ্যক। কেন রাশিয়া আফগানিস্তানে প্রবেশ করেছিল? আফগানিস্তান কি তাদের মৌলিক কোন স্বার্থ ছিল? নাকি মৌলিক চাহিদার পাশাপাশি অন্য কোন স্বার্থ ছিল?
তখনকার সময়ে রক্তপিপাসু কিছু পক্ষ একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করছিল। তারা ছিল পূর্ব ও পশ্চিম, অর্থাৎ রাশিয়া ও আমেরিকা। মুসলিম বা অমুসলিম – সকল রাষ্ট্রের উপরই আক্রমণ করে রক্ত প্রবাহিত করার প্রতিযোগিতায় তারা নেমেছিল।
এসময় সোভিয়েত রাশিয়া তাদের সাথে বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রকে অন্তর্ভুক্ত করে নিতে সক্ষম হয়। এর মধ্যে আরবসহ অনেক ইসলামী রাষ্ট্র ছিল। যদি আপনি মানচিত্রের দিকে তাকান, তাহলে দুই ব্লকের মাঝে প্রতিযোগিতার স্বরূপটা বুঝতে পারবেন।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল বিশাল বিস্তৃত এক শক্তি, অনেক অঞ্চল তার অনুগত ছিল। আজারবাইজান, শীশান ও তার আশপাশ, তুর্কেমিনিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কিরগিজিস্থান – এই সবগুলো রাষ্ট্রই সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এই বিশাল দানব রাষ্ট্রটি দুর্বল একটি রাষ্ট্রে প্রবেশের ফলে মানুষ অবাক হয়ে গিয়েছিল। যারা সংখ্যায়, শক্তিতে ও যুদ্ধাস্ত্রে অনেক ছোট ছিল। ১৩৯৯ হিজরীতে আফগান প্রশাসনের সহয়তায় তারা আফগানিস্তানে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। এই ছোট রাষ্ট্রটির এবং রাশিয়ান লাল ভাল্লুক বিশাল দানবের মাঝে সকল বিষয়েই বিপুল পার্থক্য বিদ্যমান ছিল।
মানুষ কখনো কল্পনাও করেনি, এই দুর্বল রাষ্ট্রটি রাশিয়াকে পরাজিত করবে অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরাজিত করতে সক্ষম হবে। কিন্তু আল্লাহ তাআলার উপর ভরসা করার ফলে শুধু পরাজিতই করেনি; বরং তাদের নিশানা পর্যন্ত জমিনের বুক থেকে মুছে দিয়েছে। সকল প্রশংসা ও দয়া একমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্যই।"
________
ইমাম উসামা বিন মুহাম্মাদ রহিমাহুল্লাহ!
নিশ্চয়ই ইতিহাসবিস্মৃত, বাস্তবতাবিবর্জিত গাফেল আর দুনিয়ার লোভে মাতাল ছাড়া কেউই লাল সন্ত্রাসের আগ্রাসন আর বিষাক্ত মতবাদ কমিউনিজমের বিস্তারের ফলে উম্মাহর দেহে সৃষ্ট হতে যাওয়া অনিবার্য ও স্থায়ী ক্ষতের সম্ভাবনা অস্বীকার করতে পারে না।
এদেশে ৭০ এর দশকে সিরাজ শিকদার, মেজর জলিল, ইনু বা কর্নেল তাহেরদের দাপটে প্রশাসন থেকে নিয়ে মুসলিমদের অসহায়ত্বের কথা যাদের মনে আছে কিংবা সোভিয়েতপন্থী রাস্ট্রের মুসলিমদের দেয়ালের মাঝে বাংকার খুড়ে কুরআন লুকিয়ে রাখার ইতিহাস নিয়ে যে সামান্য চিন্তাও করবে, সে উপলব্ধি করতে পারবে কী ভয়াবহ পরিস্থিতিই না আমরা পার করতে যাচ্ছিলাম!!
নিঃসন্দেহে যে বা যারাই প্রতিরোধ ও প্রস্তুতি ব্যাতীত অন্য কোনো মাধ্যমে ইসলামের নিরাপত্তা ও ক্ষমতায়নের কথা বলেন তারা মুজাহিদিনের অবমাননা তো করেনই, একই সাথে উম্মাহকে অবাস্তব কল্পনার চোরাবালিতে আটকে ফেলেন।
আমাদের জন্য আবশ্যক আমানতদারিতা ও কৃতজ্ঞতাবোধের দাবী থেকে হলেও,
আমরা উম্মাহর শ্রেষ্ঠতম অংশটির অবদান জানব, তাদের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করব এবং সম্ভাব্য সকল উপায়ে তাদের উদ্দেশ্যের সাথে একাত্ম হয়ে সহযোগিতায় অগ্রসর হবো।
আল্লাহ তা আলা আমাদের তাওফিক দান করেন।
Comment