ইসলামী ও গণতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থার মধ্যকার পার্থক্যসমূহ
উস্তাদ সাদাত চারখি হাফিযাহুল্লাহ
উস্তাদ সাদাত চারখি হাফিযাহুল্লাহ
কিছু কথা
আমাদের সমাজে ইমারতে ইসলামী আফগানিস্তান তথা তালিবান মুজাহিদদের ব্যাপারে বিভিন্ন সংশয় ছড়ানো হয়েছে ও হচ্ছে। খাওয়ারিজ, মুনাফিক ও কুফফার গোষ্ঠী তাদের অপপ্রচারের সবগুলো তীর যেন মুজাহিদিনের দিকে নিক্ষেপ করেছে। ফলে অনেক সাধারণ মুসলিম বিভ্রান্তির সম্মুখীন হয়েছেন ও হচ্ছেন। এহেন পরিস্থিতিতে শত্রুদের এই সকল অপপ্রচারের জবাব দেওয়া আমরা অত্যান্ত জরুরী মনে করছি, যার ধারাবাহিকতায় আমরা এই প্রবন্ধটির অনুবাদ আপনাদের কাছে পেশ করছি।
এই প্রবন্ধটি তালিবান মুজাহিদদের অফিসিয়াল ফার্সি (আফগানিস্তানে ফার্সি ভাষার এই ধারাটি ‘দারি’ নামে পরিচিত ও কথিত) ম্যাগাজিন ‘মাজাল্লাহ হাকিকত’ (৮ম বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, রজব ও শাবান ১৪৪২ হিজরি, মার্চ ও এপ্রিল ২০২১ ইংরেজি) এর ৪৬ নাম্বার সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। এটির সম্পাদক হলেন মৌলবি নাঈমুল হক হক্কানি হাফিযাহুল্লাহ, যিনি ‘আহমাদ তানভির’ নামে ম্যাগাজিনের পাঠকদের কাছে সুপরিচিত।
মুহতারাম উস্তাদ সাদাত চারখি হাফিযাহুল্লাহ’র লিখিত مغایرت*های نظام اسلامی با نظام جمهوری و دموکراسی নামক এই প্রবন্ধটির বাংলা শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘ইসলামী ও গণতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থার মধ্যকার পার্থক্যসমূহ’।
আশা করছি গণতন্ত্রের ব্যাপারে ইমারতে ইসলামী আফগানিস্তানের অবস্থানের ব্যাপারে যাদের সংশয় ছিল, এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা তা দূরীভূত করতে পেরেছি।
সম্পাদক
২৬ যিলহাজ্জ ১৪৪২ হিজরি
০৬ আগস্ট ২০২১ ইংরেজি
২৬ যিলহাজ্জ ১৪৪২ হিজরি
০৬ আগস্ট ২০২১ ইংরেজি
অবশেষে, আমেরিকান এবং ন্যাটো দখলদার বাহিনী আমাদের প্রিয় জন্মভূমিতে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়েছে এবং বিশ্বের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ইমারাতে ইসলামিয়ার’ সাথে তাদের বাহিনী প্রত্যাহারে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
বর্তমানে একটি নতুন ইসলামী সরকার গঠনের আলোচনা পর্যালোচনা চলছে। সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আগামীর রাষ্ট্র ব্যবস্থার গঠন পদ্ধতি নিয়ে নানা আলাপ আলোচনা লিপ্ত আছে। একই সাথে যারা গত কুড়ি বছর ধরে দখলদারদের সহযোগিতা করেছে, মানুষদের কাঁধে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জোয়াল চাপিয়ে দিয়েছে এবং দ্বীনি ও জাতীয় মূল্যবোধ বিক্রি করেছে, ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ এসব ক্ষমতা লোভীরা নতুন ইসলামী রাষ্ট্রের নামে ষড়যন্ত্র করছে এবং এমন কিছু পরিকল্পনাও গ্রহণ করছে যা ইসলাম পরিপন্থী এবং ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। যাতে আফগানিস্তানের বীর মুজাহিদদের সাম্প্রতিক আত্মত্যাগের ফলে যে বিশুদ্ধ রাষ্ট্র ব্যবস্থা গঠন হতে চলেছে তাকে বানচাল করা যায় এবং একে তাগুতি আদর্শ দ্বারা কলঙ্কিত করা যায়।
তাই আমি এখানে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং প্রজাতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য নিয়ে কিছু বিষয় আলোচনা করতে চাই। এবং পরস্পর অসঙ্গতিপূর্ণ বিষয়গুলোকে নির্দিষ্ট করতে চাই, যাতে মুসলমানরা জানতে পারে যে, প্রজাতন্ত্র ও গণতন্ত্র একটি পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থার অংশ, এবং এটি একটি বিদেশী ব্যবস্থা যা আফগানিস্তানের মতো ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
আমরা যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং ইসলামী ব্যবস্থার দিকে একটু খেয়াল করি, তাহলে আমরা এই দুই ধরনের ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্যগুলো খুব সহজেই উপলব্ধি করতে পারবো। কেননা এই দুটি পদ্ধতির বুনিয়াদি বিষয়গুলো আলাদা এবং একটি আরেকটির সাথে সাংঘর্ষিক।
উদাহরণস্বরূপ:
১. ইসলামী ব্যবস্থার বুনিয়াদ হলো দ্বীন। আর দ্বীনের বুনিয়াদি বিষয়গুলো নির্ধারিত হয় বিশ্বাসের মাধ্যমে।
অথচ গণতন্ত্রের বুনিয়াদ কিছু (সাংবিধানিক) চুক্তিপত্র। আর বিশ্বাস ও চুক্তিপত্রের মাঝে আকাশপাতাল পার্থক্য।
২. ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার সম্পর্ক হচ্ছে শেকড়ের সাথে। আর প্রজাতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের ব্যবস্থার সম্পর্ক হলো ভিত্তিমূলহীন। অন্য কথায়, ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি হলো ইসলাম, আর ইসলাম হলো বান্দার সাথে স্রষ্টার এবং মানুষের সাথে আসমানওয়ালার সম্পর্ক গঠন করা। যাকে রাবেতায়ে উমুদীও বলা হয়। আর গণতন্ত্র হচ্ছে মানুষের সাথে মানুষের অর্থাৎ নাগরিকের উপর নাগরিকের কর্তৃত্বের ছিন্নমূলহীন কিছু চুক্তিপত্র। যাকে রাবেতায়ে আফাকী বলা হয়।
৩. ইসলামী ব্যবস্থায়, মানুষ পরিচালিত হয় একমাত্র তার স্রষ্টার দেয়া বিধিবিধান দ্বারা। অন্যদিকে গণতন্ত্র এবং প্রজাতন্ত্রের (গণতন্ত্র) ব্যবস্থায় মানুষ পরিচালিত হয় মানুষেরই বানানো বিধিবিধানের মাধ্যমে। অর্থাৎ মানুষের জন্য মানুষের আইন যা প্রজাতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংসদীয় আইনসভা কর্তৃপক্ষ তৈরি করে। এবং তাদের এই পার্লামেন্টের তৈরি আইনই জনগণের উপর প্রয়োগ করা হয়। অথচ ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আইন বা আহকামসমূহের উৎস হচ্ছে, কুরআন, হাদিস, ইজমা এবং কিয়াস। একই সাথে এই আইন সবার উপর সমানভাবে প্রযোজ্য। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যদিও শুরা আছে এবং পরামর্শ করার অধিকারের ভিত্তিকে তার একটি বিশেষ অবস্থানও আছে তবে তা কোন ভাবেই আইন প্রণয়নের অধিকার রাখেনা।
৪. ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার বুনিয়াদ হলো দ্বীন। আর শুধুমাত্র মুমিনগণই দ্বীনদার। কিন্তু গণতন্ত্রের বুনিয়াদ হলো নাগরিক। দ্বীন নাগরিকের তুলনায় বিশ্বাসী মুমিনকে গুরুত্ব দেয়। কিন্তু গণতন্ত্র নাগরিককে গুরুত্ব দেয় সে কাফির হোক বা মুমিন।
৫. ধর্ম এবং গণতন্ত্র দুটি পৃথক পৃথক মতাদর্শ। একটির সাথে অন্যটির কোন সম্পর্ক নেই; ইসলাম এবং গণতন্ত্রের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো; গণতন্ত্র বস্তুগত শোষণনীতি এবং একান্তই ভোগের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে। এতে অনিবার্যভাবে মানুষের অন্তরে কর্মসংস্থান গড়ে উঠার নামে শোষণের পথ তৈরি করে। যা মানুষকে তার নিজের ইচ্ছা ও খেয়াল-খুশি মত চলার দিকে পরিচালিত করে। এবং এটিই বিগত শতাব্দীর রাষ্ট্রীয় অত্যাচার যা আজ নাগরিক সমাজের ছদ্মবেশে আমাদের মাঝে আবির্ভূত হয়েছে; প্রমাণ তো এটাই যে, আমরা এখনও দুর্বল জাতির বিরুদ্ধে শক্তিশালী জাতির নিপীড়ন ও অত্যাচার প্রত্যক্ষ করছি, বর্তমান ও অতীতের মধ্যে পার্থক্য এই যে পূর্বের সেই অত্যাচারিত রূপটিই বর্তমানে সামাজিক রূপে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাতে বিজয় ও চুক্তির নীতিগুলোর দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, এই গণতন্ত্র ইসলামের শতভাগ বিরোধী একটা বিষয়।
৬. ইসলামী জীবনব্যবস্থা এবং মানুষের তৈরি জীবনব্যবস্থার মধ্যে আরেকটি পার্থক্য হলো; ইতিহাসের দিকে নজর দিলে দেখা যায়, মানুষের তৈরি সমাজ কখনই শ্রেণীভেদ থেকে মুক্ত হতে পারেনি, কিন্তু ইসলামী সমাজ এমন একটি সমাজ যেখানে কারো উপর কারো বিশেষ কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তবে বিশেষ শ্রেষ্ঠত্ব পাওয়ার একমাত্র মাপকাঠি হলো, তাকওয়া অর্জন করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন –
إِنَّ أَکْرَ
مَکُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاکُم
তোমাদের মধ্যে সেই শ্রেষ্ঠ যে, যে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় করে। (সুরা হুজুরাত ৪৯:১৩)
অতএব, ইসলামে, সবাই আইনের কাছে সমান এবং কোন শ্রেণী বিভাজন নেই, এর কারণ হল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আখলাক ও জীবন যাপন পদ্ধতি।তোমাদের মধ্যে সেই শ্রেষ্ঠ যে, যে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় করে। (সুরা হুজুরাত ৪৯:১৩)
৭. এই দুই ধরনের ব্যবস্থার মধ্যে আরেকটি পার্থক্য হল; মুসলিম সমাজে ইসলামী আইন জারি করা সকল মুসলমানের দায়িত্ব। এটা জানা উচিত যে; রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া সুন্নাহকে সামনে রেখে কোন ধরণের সংশয় ছাড়াই সাহাবী রাদিয়াল্লাহু আনহুগণ নিজেরাই একজন খলিফা নিযুক্ত করেছেন। খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণকারী এই খলিফা শরিয়তের বিধিবিধানগুলোকে কোন ধরণের পরিবর্তন ছাড়াই বাস্তবায়ন করবেন। দৈনন্দিন ঘটে যাওয়া নিত্য নতুন বিষয়গুলোতে মুসলমানদের সাথে পরামর্শ করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। এর দলিল হচ্ছে- আল্লাহ তায়ালা বলেন;
لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا ﴿٢١﴾
“যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্
৮. ইসলামী রাষ্ট্রের বুনিয়াদ হচ্ছে শরিয়তের হুকুম আহকাম। যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহির মাধ্যমে সমাজে বাস্তবায়ন করেছেন। আর প্রজাতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের বুনিয়াদ হচ্ছে মানুষের বিবেক বুদ্ধি।
৯. ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায়, শাসকদের আনুগত্যকে শরয়ী বাধ্যবাধকতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, অথচ প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিষয়টি এমন নয়। এ ব্যবস্থায় শাসকদের আনুগত্যের সাথে দ্বীনি বিশ্বাস, অবিশ্বাসের কোন সম্পর্ক নাই।
১০. ইসলামে ইসলামী রাষ্ট্র প্রধানের বিরোধিতাকে বিশ্বাসঘাতকতা এবং নিফাক হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং ধর্মীয় শাস্তির পাশাপাশি আখিরাতের শাস্তির বিষয়টিও নির্ধারিত হয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই জাতীয় যে কোনো বিরোধ ও বিদ্রোহকে শুধুমাত্র পার্থিব শাস্তি এবং প্রচলিত আইনের অধীনে বিচার করাই যথেষ্ট মনে করা হয়।
১১. ইসলামী রাষ্ট্রের আইন কানুনের ভিত্তি হচ্ছে কিতাব ও সুন্নাহ। তাই এখানে মৌলিকভাবে একটা স্বচ্ছতার দিক আছে। এছাড়া ইসলামী রাষ্ট্রের আইন কানুনগুলোতে শরয়ী ও দ্বীনি অনুমোদন রয়েছে। কিন্তু মানুষের তৈরি আইন কানুন কেবল জনসংখ্যায় অধিকাংশ হওয়াটাকেই আনুগত্যের জন্য যথেষ্ট মনে করে।
১২. যেহেতু ইসলামী ব্যবস্থার আইন কানুনগুলো কুরআনুল কারীম এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম –এর সুন্নাহর মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছে, তাই কিয়ামত পর্যন্ত এগুলোতে কোন ধরণের পরিবর্তন, পরিবর্ধন করার সুযোগ নেই। এর মাধ্যমেই সত্য-মিথ্যা নির্ধারিত হবে। বাতিলের এখানে জায়গা নেই, কেননা এটি চিরন্তন বিষয়।
কিন্তু প্রজাতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের আইন কানুনগুলো এক ধরনের সংবিধানের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়, যা সব সময়, সঠিক না ভুল, ভুল না সঠিক এই ধরনের সংশয়ের মাঝে পতিত থাকে। তাছাড়া এখানে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন বিয়োজন চলতেই থাকে। এটি স্থায়ী কোনো বিষয় নয়। এবং মানুষ (শাসক) নিজেরাই একে পরিবর্তন করে।
১৩. ইসলামী ব্যবস্থায় শরিয়তের নির্ধারিত পন্থায় শাসক নির্ধারণ করা হয়। তাই শাসক যতক্ষণ পর্যন্ত শরিয়তের উপর থাকে, জনগণ চাইলে তাকে অপসারণ বা তার ক্ষমতাকে সীমিত করতে পারে না। কারণ শরিয়তের মাধ্যমে শাসককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাই কোন মানুষ তাকে অপসারণের ক্ষমতা রাখেনা। কিন্তু প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং গণতন্ত্রের শাসকরা এমন যে জনগণ তাদের অপসারণ করতে পারে বা বিভিন্নভাবে তাদের ক্ষমতা সীমিত করতে পারে।
১৪. ইসলামী ব্যবস্থায় যতক্ষণ পর্যন্ত শাসক শরিয়তের অনুসরণ করেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তার মেয়াদকাল অনির্দিষ্ট। তাকে অপসারণ করা বৈধ নয়। হ্যাঁ তবে তিনি যদি শরিয়তের শর্ত লঙ্ঘন করেন অথবা মৃত্যু বরণ করেন, তবে তিনি আপনিতেই অপসারিত হয়ে যাবে। কিন্তু প্রজাতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসকের মেয়াদকাল নির্দিষ্ট। এটি তাদের সংবিধান অথবা সামাজিক নিয়ম দ্বারা নির্ধারিত হয়। এছাড়া স্বৈরশাসক এবং অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার তরবারি যে কোন সময় তাকে অপসারণ করতে পারে।
১৫. ইসলামী ব্যবস্থায় একজন শাসকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হল শরিয়াহহ বাস্তবায়ন এবং আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। পাশাপাশি দ্বীনি সমাজে মানুষের সন্তুষ্টিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তবে তা হতে হবে শরিয়তের মাপকাঠির আলোকে।
অথচ প্রজাতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও লক্ষ্য হল জনগণের ব্যক্তি স্বার্থ রক্ষা করার মাধ্যমে জনগণের সন্তুষ্টি লাভ করা। এভাবেই জনগণ নিজেদের চিন্তা চেতনা ফলানোর মাধ্যমে একটা গণতান্ত্রিক কাঠামো নির্মাণ করে।
১৬. ইসলামী শাসন ব্যবস্থায় শাসকের শরয়ী দায়িত্বের দিক থেকে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা ও নানা প্রকল্প গ্রহণ করার যে সুযোগ সুবিধা রয়েছে, তা গণতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার শাসকদের তুলনায় অধিকতর প্রশস্ত। তাই ইসলামী ব্যবস্থার শাসক নিজ কর্তব্যের ভিত্তিতে সমস্ত ধর্মীয় তহবিল যেমন যাকাত, খুমুস, ফাই ইত্যাদি গ্রহণ এবং ব্যয় করার অধিকার রাখে। এবং অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং সামাজিক অবকাঠামো বিনির্মাণের ক্ষেত্রে ইসলামী রাষ্ট্রের শাসকগণ অধিকতর স্বাধীন। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থার শাসকদের জন্য, এই বিষয়ে সাংবিধানিক বিধিবদ্ধ রয়েছে। সংসদ ও পার্লামেন্ট কর্তৃক পাস করা আইন তাদের জন্য যথেষ্ট প্রতিবন্ধক। এবং সংসদের বেঁধে দেয়া সীমা পার হলেই রাষ্ট্রপতিরা তাদের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
যাইহোক, উপরের ইসলামী ব্যবস্থা এবং প্রজাতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মধ্যকার মৌলিক কিছু পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে। এই পার্থক্যগুলো এটা প্রমাণ করে যে, ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ইসলামী সরকার একটি বিশেষ সরকার যেখানে সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহ তায়ালার ও তাঁর দেয়া শরিয়তের। এছাড়া শাসকদের চারিত্রিক ও আধ্যাত্মিক গুণাবলীরও রয়েছে অপরিসীম গুরুত্ব। অন্য দিকে অনৈসলামিক ব্যবস্থায় এগুলোর কোনই গুরুত্ব নেই।
অতএব, এটি কোন ভাবেই সম্ভব নয় যে, আসমানি ধর্ম, বিশেষ করে দ্বীনে ইসলাম গণতান্ত্রিক জীবন ব্যবস্থাকে অনুমোদন করতে পারে। কোন আসমানি ধর্ম এমনটি দাবিও করেনি। তবে রাষ্ট্র গঠন হতে পারে একমাত্র দ্বীনের ভিত্তিতে। বর্তমানে অনেক রাষ্ট্র ব্যবস্থাই রয়েছে। আবার আমরা অনেক রকম ইসলামী সরকার দেখতে পাই। উদাহরণস্বরূপ, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিষ্ঠিত খেলাফত থেকে খেলাফতের রাশেদা পর্যন্ত, অতঃপর ইমারাত ব্যবস্থা, তারপর বাদশাহী ব্যবস্থা।
অতএব, হে বীর জাতি! খুব ভালো করে বুঝে রাখুন যে, যদি আপনি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই কামনা করেন, তাহলে দ্বীনি বিশ্বাসের বিসর্জন দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। মনে রাখুন ইসলাম এবং গণতন্ত্র একসাথে চলা অসম্ভব।
প্রবাদ আছে যে; একহাতে দুটি তরমুজ নেয়া যায় না। অন্য কথায় ইসলামী জীবন ব্যবস্থা আর প্রজাতন্ত্র ও গণতন্ত্র ব্যবস্থা হচ্ছে, দুনিয়া ও আখিরাতের মতো। একটির সন্তুষ্টি অন্যটিকে অসন্তুষ্ট করবেই। তাই এ বিদেশী ও অনৈসলামিক ব্যবস্থা থেকে সাবধান থাকুন,এবং ইসলামী ব্যবস্থার দিকে ফিরে আসুন। যা আমাদের সকলের দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের গ্যারান্টি দেয় এবং তা আন্তরিকভাবে গ্রহণ করুন।
- সংগৃহীত
Comment