তালেবানদের যে অবিস্মরণীয় বিজয় অর্জিত হয়েছে তাতে অবাক হবার কিছুই নেই। কারণ, এ বিজয় এসেছে বহু ত্যাগ আর কোরবানীর পর। শুধু বসে থেকে, আত্মত্যাগপূর্ণ সংগ্রাম ছাড়া পৃথিবীতে কোনাে ধর্ম, কোনাে আদর্শই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি।
দ্বীন তাদের দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত হয়; যাদের কর্মপন্থায় সামগ্রিকতা ও সমন্বয়তা রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলাে, যুগ যুগ যাবৎ ইসলামী দলগুলাে দাওয়াতের সর্বোচ্চ লক্ষ্য (আল্লাহর যমীনে আল্লাহর বিধান কাযেম ও আল্লাহর বান্দাদেরকে শরীয়াহর শাসনে পরিচালিত করা) অর্জনের সঠিক ও কার্যকরী পখগুলাে ভুলে রয়েছে।
তবে বিগত দশকগুলােতে ইসলামী জাগরণ এমন কিছু আত্মােৎসর্গকারীও পেয়েছে, যারা বাতিলের সামনে মুসার লাঠির ভূমিকা পালন করছেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, এই উম্মাহরই অপর অনেক গুনীজন এদের বিরােধিতা করাকেই নিজেদের দ্বীনি দায়িত্ব মনে করছে এবং দ্বীন কায়েমের আল্লাহ প্রদত্ত তরিকা নিয়ে উম্মাহর মাঝে সমূহ সংশয় ছড়িয়ে যাচ্ছে। (আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই)।
ইনশা আল্লাহ, আজ আমি সে সকল দ্বীনি ভাই ও গুণীজনদের সমীপে এমন কিছু বিষয় তুলে ধরবাে; যা তাদের চিন্তার রুদ্ধদ্বার খুলে দিবে।
সকল দ্বিধা সংশয়ের ময়লা ঝেড়ে পবিত্র কাফেলায় শরীক হবার আলােকিত পথ উন্মােচিত করবে। কারণ, সংশয়ের গ্যাড়াকলে আবদ্ধ থেকে কালক্ষেপনের মত সময় আমাদের হাতে নেই। ক্রুসেডার বাহিনী সমগ্র শক্তি একত্রিত করে আমাদের দুয়ারে এসে উপস্থিত।
খিলাফতে ইসলামিয়ার পতনের পর হতে প্রত্যেক দশকেই অনেক ধরনের ইসলামী আন্দোলনের শ্লোগান তােলা হয়েছে।
যদিও সাময়িকভাবে সে আন্দোলনগুলাে যুগােপযােগী মনে হয়েছিল, কিন্তু বর্তমান বিশ্ব প্রমাণ করে দিয়েছে যে, তার কোনটাই সার্বজনীন এবং বাস্তবমুখী ছিল না।
সে চিন্তাগুলাে ছিল অনেকটাই কাল্পনিক ও অযৌক্তিক। সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে শক্তি অর্জনের যে কোরআনী নির্দেশনা মুসলমানদেরকে দেওয়া হয়েছে, তা বেমালুম ভুলে থাকা হয়েছে।
অধিকন্তু ‘যুগের বিবর্তন' এবং স্থান পরিবর্তন' এই দুটি বিষয় যে কোন যুদ্ধনীতির দুই বাহুমূলের ন্যায়।
কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের নেতারা এই দু'টি বিষয়ের প্রতিও তেমন দৃষ্টি দেয়নি। ফলস্বরূপ, গন্তব্যহীন দিশেহারা পথিকের নিস্ফল পথ মাড়ানাে ছাড়া আমাদের ভাগ্যে আর বেশি কিছু জোটেনি।
এর চাইতেও দুঃখজনক কথা হলাে, প্রতিটি দলই ধারণা করে বসেছিল যে, তারা অন্যদের চাইতে অগ্রগামী ও শ্রেষ্ঠ। হয়তাে প্রতিষ্ঠাকাল বিচারে (অর্থাৎ অনেক পুরনো আন্দোলন বা তানযিম হওয়ার কারণে), অথবা সদস্য সংখ্যার আধিক্যের দরুন, কিংবা স্বভাবজাত অহমিকার কারণে।
এভাবে পারস্পরিক উন্নাসিকতার কারণে শরিয়াহর ক্ষমতায়নের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছাঁর পথে নিজেদের ত্রুটিপূর্ণ জায়গাটি চিহ্নিত করতে সবাই ব্যর্থ হয়েছে।
আল্লাহর নির্দেশিত সরল-সােজা পথ বাদ দিয়ে প্রত্যেকেই নিজস্ব চিন্তার আঙ্গিকে পরিশ্রম করে যাচ্ছিল। এ পথে সমূহ দুঃখ কষ্ট-ক্লেশ মাখা গেথে নিচ্ছিল। সবাই নিজ নিজ লায়লার প্রেমে কবিতা আবৃতিতে মত্ত ছিল। দিন দিন শতধা বিভক্তির ধারা ক্রমশ বাড়ছিল।
এতসব প্রচেষ্টা মেহনত সত্বেও উম্মাহর ক্ষত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছিল। এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় , তাই ঐশী অমােঘ নীতি “সুন্নাতুল ইসতিবদাল” (আল্লাহ তা আলা কর্তৃক এক জাতিকে বাদ দিয়ে আরেক জাতিকে নিয়ে আসার সুন্নাহ) প্রকাশ গেল।
আল্লাহর ইচ্ছায় এর মাঝেই আরেকটি নতুন ইসলামী প্রজন্ম তৈরী হল। যাঁরা আল্লাহর নির্দেশ হুবহু পালনে বদ্ধপরিকর।
ফলাফলস্বরূপ, গত ১৫ই আগস্ট, এক মােবারক দিনে পুরাে বিশ্ব স্বচক্ষে তাঁদেরকে প্রত্যক্ষ করল। যদিও তাঁদের উত্থান পরিক্রমা দুই দশক যাবৎই চলছে।
আমাদের যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমর-কৌশলবিদ মু জা হি দি ন দের নেতা শায়খ আবু উবাইদা আল কুরাইশীর নিম্নোক্ত আলোচনাটি গভীর অভিনিবেশের সাথে লক্ষ্য করুনঃ-
এটি একটি স্বতঃসিদ্ধ বিষয় যে, ইসলামী খিলাফতের পুনরুদ্ধার হােক কিংবা স্বল্প পরিসরে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হােক, কোনটাই সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। শক্তি অর্জন এবং শক্তি প্রযােগ ছাড়া তার বাস্তবায়ন কখনােই সম্ভব নয়।
কিছু মানুষ শক্তির অর্থ নির্ধারণেও ভুল করে। তারা আত্মিক শক্তিকেই এক্ষেত্রে যথেষ্ট মনে করে। অথচ ইসলামী শাসন বাস্তবায়ন এবং শত্রুর আক্রমন থেকে তা সুরক্ষার জন্য কোরআন আমাদেরকে যে শক্তি অর্জনের নির্দেশ দিয়েছে, তা সামরিক ও বাহ্যিক শক্তি বৈ অন্য কিছু নয়।
আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন,
وأعدوا لهم ما استطعتم من قوة ومن رباط الخيل
“আর প্রস্তুত কর তাদের সাথে যুদ্ধের জন্য যা কিছু সংগ্রহ করতে পার নিজের শক্তি সামর্থ্যের মধ্যে থেকে এবং পালিত ঘােড়া যেকে।” (সূরা আনফাল: ৬০)
আমি মনে করি ইসলাম পুনরুত্থানের পথে সর্বোচ্চ ভুল এবং পদস্থলনের জায়গাটি হলাে এই ‘শক্তির দর্শন’।
আসলে শক্তি কী?
তা কীভাবে অর্জিত হবে?
কীভাবে তা কাজে লাগানাে যাবে?
এই বিষয়টি নিয়ে প্রত্যেক জাতির সমরবিদরা প্রচুর গবেষণা করেছে, যাতে স্বজাতিকে আরাে উর্ধ্বে ও আরাে মর্যাদাপূর্ণ স্থানে নিয়ে যেতে পারে।
আজ আমরা এ জাতীয় কিছু গবেষণার দিকে নজর দিতে চাই। বিজাতির গবেষণায় নজর দেওয়া কি ঠিক? এমন প্রশ্নের জবাবে বলবকোনাে জ্ঞান যদি ইসলামী মূলনীতির বিরােধী না হয়, তাহলে তা থেকে ফায়দা নিতে কোন মানা নেই।
কারণ, হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-
শক্তি কী?
এ ব্যাপারে আমাদের জানামতে সবচেয়ে গােছানাে আলােচনা করেছে আমেরিকান গােয়েন্দা সংস্থা ‘সি আই এ’র সবচে ঝানু গােয়েন্দাপ্রধান ড. রে ক্লাইন (Ray Cline)।
সে যখন গােয়েন্দাপ্রধান ছিল তখন আমেরিকার গােয়েন্দা তৎপরতা ছিল সম্পূর্ণ পেশাদারিত্বপূর্ণ।
বর্তমানে, তাদের পেশাদারিত্বের সিংহভাগই তাে দখল করে ফেলেছে ইলেক্ট্রিক ডিভাইস আর ইন্টারনেট। ড. রে ক্লাইন কোরিয়া যুদ্ধের সময় আমেরিকার প্রধান গােয়েন্দা বিশ্লেষক ছিল।
১৯৬১ সালে আমেরিকা কর্তৃক কিউবায় ঐতিহাসিক মিসাইল হামলার পরবর্তী সমযে গুপ্তচরবৃত্তিতে তার দক্ষতা প্রকাশ পায়। গুপ্তচরবৃত্তিতে তার দখল দেখে মার্কিন কর্তৃপক্ষ তাকে ১৯৬২ সালে গােয়েন্দা অধিদস্তুরের (D.D.I) ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নিয়ােগ দেয়।
ভারসাম্যতার বিশ্লেষণমূলক এ আলােচনাটি বিবৃত হয়েছে ড. ক্লাইলের “World's Power Assessment: a Calculus of Strategic Drift” নামক গ্রন্থে।
সে গ্রন্থে ড. ক্লাইন ‘শক্তির ওপর একটি সূত্র উল্লেখ করেছিল। সূত্রটি নিচে দেওয়া হলােঃ-
Pp = Potential Power (সম্ভাব্য শক্তি)
C = critical mass (ভূমি, ভূমির অধিবাসী যােদ্ধা ও যুদ্ধক্ষেত্র)
E= economic capability ( অর্থনৈতিক সক্ষমতা)
M =military capability (সৈন্যসংখ্যা ও সামরিক সক্ষমতা)
S= strategic purpose ( সামরিক দর্শন এবং লক্ষ্য-উদ্দেশ্য)
W= Will (যােদ্ধাদের মনবল ও জনসাধারণের মানসিক সমর্থন)।
সূত্রটির আরবী অনুবাদ হবে এমন:-
x الغاية الاستراتيجية + القوة الكامنة . رالكتلة الضرورية + قدرت اقتصادية + قدرات عسكرية الإرادة)
বৈশ্বিক অঙ্গনে প্রভাব বিস্তারের জন্য যেমন রণশক্তির ভারসাম্যতাকে মূল ভিত্তি নির্ধারণ করা হয়েছে, তেমনিভাবে কোন দল ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনরত কোন জামাতের জন্যও এই ভারসাম্যতা অর্জন অত্যাবশ্যকীয়।
এই বিশ্লেষণে প্রতিভাত হলাে যে, অর্থহীন আবেগমাখা কিছু স্লোগানের নাম রণশক্তি নয়। বরং তা একটি চাক্ষুষ বাস্তবতা; যা হবে দৃশ্যমান এবং সকলে উপলব্ধি করতে পারবে এমন।
আর তা অর্জনের পথে চেষ্টাটাও হবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নীতিমালার আলােকে। কোন খামখেয়ালী বা বিলাসী চিন্তা চেতনায় তা অর্জিত হবার নয়।
এমনিভাবে শত্রুর মােকাবেলাও হবে একটি সুরক্ষিত ভূমি থেকে, বাস্তবতা বিবর্জিত কিছু ধারণার বশবর্তী হয়ে শুধু সংঘাত বাঁধিয়ে দিলেই টিকে থাকা যাবে না।
কিছু জিহাদি দল এমনও রয়েছে, যারা মৌলিক পরিবর্তনে বিশ্বাসী। কিন্তু তারা সময় চেষ্টা ব্যয় করে থাকে সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি অর্জন এবং দলের সদস্যদের মনন গঠনে।
পক্ষান্তরে, তাদের স্ট্রাটেজিক্যাল চিন্তাগত ও আদর্শিক সুদৃঢ় কোনাে ভিত্তি নেই। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের অনুপ্রবেশ হয় ভয় ডানায় উড়াল দেওয়ার ন্যায়। পরিণতিতে তাদের চরম মূল্য দিতে হয়। তাদের সদস্যরা উপহাসের পাত্রে পরিণত হয়। লম্বাজনক পতন বুঝাতে তাদেরকে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে আসা হয়।
কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে যে, আমাদের নিজস্ব ভূমি, যােদ্ধা ও যুদ্ধক্ষেত্র আছে, ফলে আমাদের অন্যগুলাে না থাকলেও চলবে। কিন্তু বাস্তবতা হলাে, শুধু এতটুকু দিয়েই নতুন কোনাে ভূমির উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রশক্তির ব্যাপারটা এর চাইতে ভিন্ন।
কিন্তু এই প্রশ্ন তখনই গ্রহনযােগ্য, যখন সামরিক ও রাজনৈতিক সক্ষমতা পূর্ণাঙ্গরূপে বহাল থাকে। যেমনটি হয়েছে ল্যাটিন আমেরিকা, এশিয়া এবং আফ্রিকার কিছু বিদ্রোহী দলের সাথে। এমনিভাবে কিছু ইসলামী দলের উদাহরণও এখানে দেওয়া যেতে পারে। যেমন- ইয়েমেন, মালি, সােমালিয়া ও আফগানিস্তানের ইসলামী দলগুলাে।
ভারসাম্যপূর্ণ আন্দোলনের ফলে এই দলগুলাে এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে যে, সেসব দেশের যে কোনাে প্রান্তে তাদেরকে ডিঙ্গিয়ে কোনাে সিদ্ধান্ত নেওয়া অসম্ভব।
এর আলােকে আমরা বলব- আমাদের আল-কায়েদার ভাইযেরা শূন্য হাতে মাঠে নামেননি। সংশয় সৃষ্টিকারীরা যেমনটা বলে বেড়াচ্ছে।
বরং ড. কাইল রণশক্তিতে ভারসাম্যতার যে দর্শন দেখিয়েছে, তা যদি আমরা আল-কায়েদার উপর প্রয়ােগ করি তাহলে দেখা যাবে- আল-কায়েদার যে রণশক্তি রয়েছে, একটি গােপন আন্দোলনের জন্য এটি শুধু পর্যাপ্তই নয় বরং অনেক বেশি।
Critical mass তথা যােদ্ধা এবং যুদ্ধভূমির বিবেচনায় বলব, আফগানিস্তানে প্রচুর সংখ্যক মুজাহিদ রয়েছেন। দীর্ঘ সময় যাবৎ তাঁরাই সে ভূখন্ডের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। এটি এমন রাষ্ট্র যা যুগ যুগ যাবৎ একটি অভিউপযুক্ত যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
বলতে গেলে আফগান হলাে পৃথিবীর পরাশক্তিগুলাের শক্তি প্রদর্শন আর শক্তি ক্ষযের কেন্দ্র। পরাশক্তিগুলাের গােরস্থান। আর অর্থনীতির কথা হলাে, আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদদের মতে মুজাহিদদের অর্থনৈতিক অবস্থান অনেক ভালাে এবং সুরক্ষিত।
বরং ইসলামী অঞ্চলগুলােতে জাতিগত সম্প্রীতি গড়ে উঠার কারণে অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির পথে রয়েছে। আর সামরিক দিক থেকে তাঁদের অবস্থা আলহামদুলিল্লাহ! এতই সন্তোষজনক যে, যতই বাড়িয়ে বলা হােকনা কেনাে তা কমই মনে হবে। মুজাহিদদের নিজেদের বক্তব্য বাদই দিলাম, আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থাগুলাের কথাই সামনে আনা যাক।
সিএনএন এর এক সংবাদে বলা হয়েছে- মুজাহিদদের যুদ্ধকৌশল এতটাই সুনিপুণ যে, তারা পাশ্চাত্যের সর্বোচ্চ প্রশিক্ষিত যেকোনাে বাহিনীকে সহজেই কাবু করতে সক্ষম।
আর কৌশলগত ভিত্তির ব্যাপারে বলব, তানযীম আল-কায়েদা গত দশক থেকেই ঘােষণা দিয়ে আসছে। তাদেরকে হালকাভাবে দেখার কোন সুযােগ নেই।
তাঁরা খুব ভালাে ভাবেই জানেম কোন দিক থেকে আমেরিকার গর্দানে আঘাত হানতে হয়।
আর ইরাদা তখা মুজাহিদদের মনােবলের ব্যাপারে বলা যায়, পৃথিবীতে আল্লাহর পখের মুজাহিদদের মত এমন আর কাউকে আপনি পাবেন না, যারা এমন পর্বতসম দৃঢ়তা আর আকাশছোঁয়া ঈমানী শক্তি বুকে ধারণ করে। এই পর্যালােচনায় আমরা দেখতে পেলাম,
তানযিম আল-কায়েদার মুজাহিদগণ অতি অল্প সময়ে (মাত্র দুই দশকে) যে সক্ষমতা অর্জন করেছেন, অন্যান্য দল কয়েক দশকেও তার সিকি ভাগও অর্জন করতে পারেনি।
এর কারণ একটাই, আর তা হলাে রণশক্তির সেই ভারসাম্যতা, যা তাঁদেরকে যুগের ফেরাউন আমেরিকার ঘাড় মটকাতে সামর্থ্য যুগিয়েছে। তাঁরা আমেরিকার অন্দরমহলে ঢুকে তার পিঠে পেরেক ঠুকতে সক্ষম হয়েছে মাত্র কয়েক ঘন্টা সময়ের ব্যবধানে।
তাঁদের সুনিপুণ যুদ্ধকৌশল আর রণদক্ষতা কাজে লাগিয়ে। অভিযােগকারীরা কি তাদের এসব কর্মদক্ষতা দেখেছে?
প্রত্যেকেই নিরপেক্ষভাবে নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখি। আশা করি সঠিক উত্তর পেতে তেমন কষ্ট হবেনা। অভিযােগকারী ভাইয়েরা প্রকৃত অবস্থা সহজে মেনে নিবে না। তাদের সামনে নতুন নতুন আরাে অনেক অভিযােগ দাঁড়িয়ে যাবে। তারা আবার অভিযােগের ভিন্ন সুর ভুলে বলবে-
সম্ভাব্য শক্তিতে (Potential Power) কোথায় আমেরিকা আর কোথায় আল-কায়েদা! এরদ্বারা তাদের উদ্দেশ্য হলাে আল-কায়েদার রণশক্তির ভারসাম্যতার গােড়ায় কুঠারাঘাত। করা। কিন্তু এই অভিযােগও ধােপে টিকবে না, ইনশাআল্লাহ।
ইতিপূর্বে কোনো যুদ্ধরত পক্ষের রণশক্তির ওপর ডক্টর রে ক্লাইনের উদ্ধৃত একটি সূত্র উল্লেখ করা হয়েছিল। সূত্রটি নিচে দেওয়া হলােঃ-
Pp = (C+E+M) x (S+W)
রণশক্তিতে ভারসাম্যতার যে পাঁচটি পয়েন্ট আলােচনা করা হয়েছে, তাকে আমরা মৌলিক দুই প্রকারে ভাগ করতে পারি।
প্রথম প্রকার = (C+E+M) তখা যােদ্ধা ও যুদ্ধক্ষেত্র+অর্থনৈতিক সক্ষমতা+সামরিক সক্ষমতা।
দ্বিতীয় প্রকার = (S+W) তথা যুদ্ধকৌশল+ইরাদা (মুজাহিদদের সুউচ্চ মনােবল ও যুদ্ধভূমির অধিবাসীদের সহযােগিতামূলক মানসিকতা)
এই দুই প্রকার হলাে ভারসাম্যপূর্ণ রণশক্তির দুই বাহুর ন্যায়। এবার আসা যাক তুলনামূলক বিশ্লেষণে।
প্রথম বাহুতে যদিও আমেরিকা ও আল-কায়েদার মাঝে বিস্তর ফারাক রয়েছে, কিন্তু দ্বিতীয় বাহুতে মুজাহিদগণ এতটাই অগ্রগামী যে আমেরিকা কল্পনাও তার ধারেকাছে আসতে পারবে না।
এবার আমরা যখন উভয় বাহতে সমন্বয় সাধনে যাবাে, তখন দেখব-
তানযিম আল-কায়েদা ভারসাম্যতায় আমেরিকার চাইতে কয়েকধাপ এগিয়ে আছে। এই কারণেই সুপার পাওযারখ্যাত আমেরিকার মনে আল-কায়েদার ব্যাপারে এত ভীতি।
একদিন আল-কায়েদার হাতেই আমেরিকার দম্ভ বিচূর্ণ হয়ে ইসলামের বিজয় অর্জিত হবে, ইনশাআল্লাহ।
আরেকটি মজার ব্যাপার হলাে,
আমেরিকা একটি বিস্তৃত রাষ্ট্রশক্তি হবার কারণে সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও জনকল্যাণসহ বহু সেক্টর তাকে সামলে চলতে হয়। এসব বিষয়ে সমন্বয় করতে গিয়ে তাদের চেষ্টা এবং শক্তি বহু খাতে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
ফলে, তাদের বিভিন্ন অসুবিধা ও সীমাবদ্ধতার মুখােমুখি হতে হয়। পক্ষান্তরে, মুজাহিদগণের সকল প্রচেষ্টা একটি মাত্র লক্ষ্যে নিবদ্ধ।
তা হলাে ক্রুসেডার আমেরিকার গলায় পরাজযের বেড়ি পড়ানাে। এটি ছাড়া তাদের আর কোনাে ব্যস্ততা নেই। কোনাে সীমাবদ্ধতা নেই।
এই বিষয়টিই মুজাহিদদেরকে কর্মক্ষমতায় আমেরিকার অনেক উর্ধ্বে নিয়ে গেছে।"
________
শায়খ আবু উবাইদা আল কুরাইশী রহিমাহুল্লাহ,
(তিনি ছিলেন শায়খ সাইফ আল আদল হাফিজাহুল্লাহর ঘনিষ্ঠ সহচরদের অন্যতম)
দ্বীন তাদের দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত হয়; যাদের কর্মপন্থায় সামগ্রিকতা ও সমন্বয়তা রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলাে, যুগ যুগ যাবৎ ইসলামী দলগুলাে দাওয়াতের সর্বোচ্চ লক্ষ্য (আল্লাহর যমীনে আল্লাহর বিধান কাযেম ও আল্লাহর বান্দাদেরকে শরীয়াহর শাসনে পরিচালিত করা) অর্জনের সঠিক ও কার্যকরী পখগুলাে ভুলে রয়েছে।
তবে বিগত দশকগুলােতে ইসলামী জাগরণ এমন কিছু আত্মােৎসর্গকারীও পেয়েছে, যারা বাতিলের সামনে মুসার লাঠির ভূমিকা পালন করছেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, এই উম্মাহরই অপর অনেক গুনীজন এদের বিরােধিতা করাকেই নিজেদের দ্বীনি দায়িত্ব মনে করছে এবং দ্বীন কায়েমের আল্লাহ প্রদত্ত তরিকা নিয়ে উম্মাহর মাঝে সমূহ সংশয় ছড়িয়ে যাচ্ছে। (আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই)।
ইনশা আল্লাহ, আজ আমি সে সকল দ্বীনি ভাই ও গুণীজনদের সমীপে এমন কিছু বিষয় তুলে ধরবাে; যা তাদের চিন্তার রুদ্ধদ্বার খুলে দিবে।
সকল দ্বিধা সংশয়ের ময়লা ঝেড়ে পবিত্র কাফেলায় শরীক হবার আলােকিত পথ উন্মােচিত করবে। কারণ, সংশয়ের গ্যাড়াকলে আবদ্ধ থেকে কালক্ষেপনের মত সময় আমাদের হাতে নেই। ক্রুসেডার বাহিনী সমগ্র শক্তি একত্রিত করে আমাদের দুয়ারে এসে উপস্থিত।
খিলাফতে ইসলামিয়ার পতনের পর হতে প্রত্যেক দশকেই অনেক ধরনের ইসলামী আন্দোলনের শ্লোগান তােলা হয়েছে।
যদিও সাময়িকভাবে সে আন্দোলনগুলাে যুগােপযােগী মনে হয়েছিল, কিন্তু বর্তমান বিশ্ব প্রমাণ করে দিয়েছে যে, তার কোনটাই সার্বজনীন এবং বাস্তবমুখী ছিল না।
সে চিন্তাগুলাে ছিল অনেকটাই কাল্পনিক ও অযৌক্তিক। সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে শক্তি অর্জনের যে কোরআনী নির্দেশনা মুসলমানদেরকে দেওয়া হয়েছে, তা বেমালুম ভুলে থাকা হয়েছে।
অধিকন্তু ‘যুগের বিবর্তন' এবং স্থান পরিবর্তন' এই দুটি বিষয় যে কোন যুদ্ধনীতির দুই বাহুমূলের ন্যায়।
কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের নেতারা এই দু'টি বিষয়ের প্রতিও তেমন দৃষ্টি দেয়নি। ফলস্বরূপ, গন্তব্যহীন দিশেহারা পথিকের নিস্ফল পথ মাড়ানাে ছাড়া আমাদের ভাগ্যে আর বেশি কিছু জোটেনি।
এর চাইতেও দুঃখজনক কথা হলাে, প্রতিটি দলই ধারণা করে বসেছিল যে, তারা অন্যদের চাইতে অগ্রগামী ও শ্রেষ্ঠ। হয়তাে প্রতিষ্ঠাকাল বিচারে (অর্থাৎ অনেক পুরনো আন্দোলন বা তানযিম হওয়ার কারণে), অথবা সদস্য সংখ্যার আধিক্যের দরুন, কিংবা স্বভাবজাত অহমিকার কারণে।
এভাবে পারস্পরিক উন্নাসিকতার কারণে শরিয়াহর ক্ষমতায়নের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছাঁর পথে নিজেদের ত্রুটিপূর্ণ জায়গাটি চিহ্নিত করতে সবাই ব্যর্থ হয়েছে।
আল্লাহর নির্দেশিত সরল-সােজা পথ বাদ দিয়ে প্রত্যেকেই নিজস্ব চিন্তার আঙ্গিকে পরিশ্রম করে যাচ্ছিল। এ পথে সমূহ দুঃখ কষ্ট-ক্লেশ মাখা গেথে নিচ্ছিল। সবাই নিজ নিজ লায়লার প্রেমে কবিতা আবৃতিতে মত্ত ছিল। দিন দিন শতধা বিভক্তির ধারা ক্রমশ বাড়ছিল।
এতসব প্রচেষ্টা মেহনত সত্বেও উম্মাহর ক্ষত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছিল। এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় , তাই ঐশী অমােঘ নীতি “সুন্নাতুল ইসতিবদাল” (আল্লাহ তা আলা কর্তৃক এক জাতিকে বাদ দিয়ে আরেক জাতিকে নিয়ে আসার সুন্নাহ) প্রকাশ গেল।
আল্লাহর ইচ্ছায় এর মাঝেই আরেকটি নতুন ইসলামী প্রজন্ম তৈরী হল। যাঁরা আল্লাহর নির্দেশ হুবহু পালনে বদ্ধপরিকর।
ফলাফলস্বরূপ, গত ১৫ই আগস্ট, এক মােবারক দিনে পুরাে বিশ্ব স্বচক্ষে তাঁদেরকে প্রত্যক্ষ করল। যদিও তাঁদের উত্থান পরিক্রমা দুই দশক যাবৎই চলছে।
আমাদের যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমর-কৌশলবিদ মু জা হি দি ন দের নেতা শায়খ আবু উবাইদা আল কুরাইশীর নিম্নোক্ত আলোচনাটি গভীর অভিনিবেশের সাথে লক্ষ্য করুনঃ-
এটি একটি স্বতঃসিদ্ধ বিষয় যে, ইসলামী খিলাফতের পুনরুদ্ধার হােক কিংবা স্বল্প পরিসরে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হােক, কোনটাই সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। শক্তি অর্জন এবং শক্তি প্রযােগ ছাড়া তার বাস্তবায়ন কখনােই সম্ভব নয়।
কিছু মানুষ শক্তির অর্থ নির্ধারণেও ভুল করে। তারা আত্মিক শক্তিকেই এক্ষেত্রে যথেষ্ট মনে করে। অথচ ইসলামী শাসন বাস্তবায়ন এবং শত্রুর আক্রমন থেকে তা সুরক্ষার জন্য কোরআন আমাদেরকে যে শক্তি অর্জনের নির্দেশ দিয়েছে, তা সামরিক ও বাহ্যিক শক্তি বৈ অন্য কিছু নয়।
আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন,
وأعدوا لهم ما استطعتم من قوة ومن رباط الخيل
“আর প্রস্তুত কর তাদের সাথে যুদ্ধের জন্য যা কিছু সংগ্রহ করতে পার নিজের শক্তি সামর্থ্যের মধ্যে থেকে এবং পালিত ঘােড়া যেকে।” (সূরা আনফাল: ৬০)
আমি মনে করি ইসলাম পুনরুত্থানের পথে সর্বোচ্চ ভুল এবং পদস্থলনের জায়গাটি হলাে এই ‘শক্তির দর্শন’।
আসলে শক্তি কী?
তা কীভাবে অর্জিত হবে?
কীভাবে তা কাজে লাগানাে যাবে?
এই বিষয়টি নিয়ে প্রত্যেক জাতির সমরবিদরা প্রচুর গবেষণা করেছে, যাতে স্বজাতিকে আরাে উর্ধ্বে ও আরাে মর্যাদাপূর্ণ স্থানে নিয়ে যেতে পারে।
আজ আমরা এ জাতীয় কিছু গবেষণার দিকে নজর দিতে চাই। বিজাতির গবেষণায় নজর দেওয়া কি ঠিক? এমন প্রশ্নের জবাবে বলবকোনাে জ্ঞান যদি ইসলামী মূলনীতির বিরােধী না হয়, তাহলে তা থেকে ফায়দা নিতে কোন মানা নেই।
কারণ, হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-
"প্রজ্ঞা, সে তাে মু'মিনের হৃত সম্পদ, যেখানেই সে পাবে তাকে কাজে লাগাবে।"
এ ব্যাপারে আমাদের জানামতে সবচেয়ে গােছানাে আলােচনা করেছে আমেরিকান গােয়েন্দা সংস্থা ‘সি আই এ’র সবচে ঝানু গােয়েন্দাপ্রধান ড. রে ক্লাইন (Ray Cline)।
সে যখন গােয়েন্দাপ্রধান ছিল তখন আমেরিকার গােয়েন্দা তৎপরতা ছিল সম্পূর্ণ পেশাদারিত্বপূর্ণ।
বর্তমানে, তাদের পেশাদারিত্বের সিংহভাগই তাে দখল করে ফেলেছে ইলেক্ট্রিক ডিভাইস আর ইন্টারনেট। ড. রে ক্লাইন কোরিয়া যুদ্ধের সময় আমেরিকার প্রধান গােয়েন্দা বিশ্লেষক ছিল।
১৯৬১ সালে আমেরিকা কর্তৃক কিউবায় ঐতিহাসিক মিসাইল হামলার পরবর্তী সমযে গুপ্তচরবৃত্তিতে তার দক্ষতা প্রকাশ পায়। গুপ্তচরবৃত্তিতে তার দখল দেখে মার্কিন কর্তৃপক্ষ তাকে ১৯৬২ সালে গােয়েন্দা অধিদস্তুরের (D.D.I) ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নিয়ােগ দেয়।
ভারসাম্যতার বিশ্লেষণমূলক এ আলােচনাটি বিবৃত হয়েছে ড. ক্লাইলের “World's Power Assessment: a Calculus of Strategic Drift” নামক গ্রন্থে।
সে গ্রন্থে ড. ক্লাইন ‘শক্তির ওপর একটি সূত্র উল্লেখ করেছিল। সূত্রটি নিচে দেওয়া হলােঃ-
Pp = (C+E+M) x (S+W)
Pp = Potential Power (সম্ভাব্য শক্তি)
C = critical mass (ভূমি, ভূমির অধিবাসী যােদ্ধা ও যুদ্ধক্ষেত্র)
E= economic capability ( অর্থনৈতিক সক্ষমতা)
M =military capability (সৈন্যসংখ্যা ও সামরিক সক্ষমতা)
S= strategic purpose ( সামরিক দর্শন এবং লক্ষ্য-উদ্দেশ্য)
W= Will (যােদ্ধাদের মনবল ও জনসাধারণের মানসিক সমর্থন)।
সূত্রটির আরবী অনুবাদ হবে এমন:-
x الغاية الاستراتيجية + القوة الكامنة . رالكتلة الضرورية + قدرت اقتصادية + قدرات عسكرية الإرادة)
বৈশ্বিক অঙ্গনে প্রভাব বিস্তারের জন্য যেমন রণশক্তির ভারসাম্যতাকে মূল ভিত্তি নির্ধারণ করা হয়েছে, তেমনিভাবে কোন দল ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনরত কোন জামাতের জন্যও এই ভারসাম্যতা অর্জন অত্যাবশ্যকীয়।
এই বিশ্লেষণে প্রতিভাত হলাে যে, অর্থহীন আবেগমাখা কিছু স্লোগানের নাম রণশক্তি নয়। বরং তা একটি চাক্ষুষ বাস্তবতা; যা হবে দৃশ্যমান এবং সকলে উপলব্ধি করতে পারবে এমন।
আর তা অর্জনের পথে চেষ্টাটাও হবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নীতিমালার আলােকে। কোন খামখেয়ালী বা বিলাসী চিন্তা চেতনায় তা অর্জিত হবার নয়।
এমনিভাবে শত্রুর মােকাবেলাও হবে একটি সুরক্ষিত ভূমি থেকে, বাস্তবতা বিবর্জিত কিছু ধারণার বশবর্তী হয়ে শুধু সংঘাত বাঁধিয়ে দিলেই টিকে থাকা যাবে না।
কিছু জিহাদি দল এমনও রয়েছে, যারা মৌলিক পরিবর্তনে বিশ্বাসী। কিন্তু তারা সময় চেষ্টা ব্যয় করে থাকে সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি অর্জন এবং দলের সদস্যদের মনন গঠনে।
পক্ষান্তরে, তাদের স্ট্রাটেজিক্যাল চিন্তাগত ও আদর্শিক সুদৃঢ় কোনাে ভিত্তি নেই। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের অনুপ্রবেশ হয় ভয় ডানায় উড়াল দেওয়ার ন্যায়। পরিণতিতে তাদের চরম মূল্য দিতে হয়। তাদের সদস্যরা উপহাসের পাত্রে পরিণত হয়। লম্বাজনক পতন বুঝাতে তাদেরকে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে আসা হয়।
কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে যে, আমাদের নিজস্ব ভূমি, যােদ্ধা ও যুদ্ধক্ষেত্র আছে, ফলে আমাদের অন্যগুলাে না থাকলেও চলবে। কিন্তু বাস্তবতা হলাে, শুধু এতটুকু দিয়েই নতুন কোনাে ভূমির উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রশক্তির ব্যাপারটা এর চাইতে ভিন্ন।
কিন্তু এই প্রশ্ন তখনই গ্রহনযােগ্য, যখন সামরিক ও রাজনৈতিক সক্ষমতা পূর্ণাঙ্গরূপে বহাল থাকে। যেমনটি হয়েছে ল্যাটিন আমেরিকা, এশিয়া এবং আফ্রিকার কিছু বিদ্রোহী দলের সাথে। এমনিভাবে কিছু ইসলামী দলের উদাহরণও এখানে দেওয়া যেতে পারে। যেমন- ইয়েমেন, মালি, সােমালিয়া ও আফগানিস্তানের ইসলামী দলগুলাে।
ভারসাম্যপূর্ণ আন্দোলনের ফলে এই দলগুলাে এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে যে, সেসব দেশের যে কোনাে প্রান্তে তাদেরকে ডিঙ্গিয়ে কোনাে সিদ্ধান্ত নেওয়া অসম্ভব।
এর আলােকে আমরা বলব- আমাদের আল-কায়েদার ভাইযেরা শূন্য হাতে মাঠে নামেননি। সংশয় সৃষ্টিকারীরা যেমনটা বলে বেড়াচ্ছে।
বরং ড. কাইল রণশক্তিতে ভারসাম্যতার যে দর্শন দেখিয়েছে, তা যদি আমরা আল-কায়েদার উপর প্রয়ােগ করি তাহলে দেখা যাবে- আল-কায়েদার যে রণশক্তি রয়েছে, একটি গােপন আন্দোলনের জন্য এটি শুধু পর্যাপ্তই নয় বরং অনেক বেশি।
Critical mass তথা যােদ্ধা এবং যুদ্ধভূমির বিবেচনায় বলব, আফগানিস্তানে প্রচুর সংখ্যক মুজাহিদ রয়েছেন। দীর্ঘ সময় যাবৎ তাঁরাই সে ভূখন্ডের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। এটি এমন রাষ্ট্র যা যুগ যুগ যাবৎ একটি অভিউপযুক্ত যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
বলতে গেলে আফগান হলাে পৃথিবীর পরাশক্তিগুলাের শক্তি প্রদর্শন আর শক্তি ক্ষযের কেন্দ্র। পরাশক্তিগুলাের গােরস্থান। আর অর্থনীতির কথা হলাে, আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদদের মতে মুজাহিদদের অর্থনৈতিক অবস্থান অনেক ভালাে এবং সুরক্ষিত।
বরং ইসলামী অঞ্চলগুলােতে জাতিগত সম্প্রীতি গড়ে উঠার কারণে অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির পথে রয়েছে। আর সামরিক দিক থেকে তাঁদের অবস্থা আলহামদুলিল্লাহ! এতই সন্তোষজনক যে, যতই বাড়িয়ে বলা হােকনা কেনাে তা কমই মনে হবে। মুজাহিদদের নিজেদের বক্তব্য বাদই দিলাম, আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থাগুলাের কথাই সামনে আনা যাক।
সিএনএন এর এক সংবাদে বলা হয়েছে- মুজাহিদদের যুদ্ধকৌশল এতটাই সুনিপুণ যে, তারা পাশ্চাত্যের সর্বোচ্চ প্রশিক্ষিত যেকোনাে বাহিনীকে সহজেই কাবু করতে সক্ষম।
আর কৌশলগত ভিত্তির ব্যাপারে বলব, তানযীম আল-কায়েদা গত দশক থেকেই ঘােষণা দিয়ে আসছে। তাদেরকে হালকাভাবে দেখার কোন সুযােগ নেই।
তাঁরা খুব ভালাে ভাবেই জানেম কোন দিক থেকে আমেরিকার গর্দানে আঘাত হানতে হয়।
আর ইরাদা তখা মুজাহিদদের মনােবলের ব্যাপারে বলা যায়, পৃথিবীতে আল্লাহর পখের মুজাহিদদের মত এমন আর কাউকে আপনি পাবেন না, যারা এমন পর্বতসম দৃঢ়তা আর আকাশছোঁয়া ঈমানী শক্তি বুকে ধারণ করে। এই পর্যালােচনায় আমরা দেখতে পেলাম,
তানযিম আল-কায়েদার মুজাহিদগণ অতি অল্প সময়ে (মাত্র দুই দশকে) যে সক্ষমতা অর্জন করেছেন, অন্যান্য দল কয়েক দশকেও তার সিকি ভাগও অর্জন করতে পারেনি।
এর কারণ একটাই, আর তা হলাে রণশক্তির সেই ভারসাম্যতা, যা তাঁদেরকে যুগের ফেরাউন আমেরিকার ঘাড় মটকাতে সামর্থ্য যুগিয়েছে। তাঁরা আমেরিকার অন্দরমহলে ঢুকে তার পিঠে পেরেক ঠুকতে সক্ষম হয়েছে মাত্র কয়েক ঘন্টা সময়ের ব্যবধানে।
তাঁদের সুনিপুণ যুদ্ধকৌশল আর রণদক্ষতা কাজে লাগিয়ে। অভিযােগকারীরা কি তাদের এসব কর্মদক্ষতা দেখেছে?
প্রত্যেকেই নিরপেক্ষভাবে নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখি। আশা করি সঠিক উত্তর পেতে তেমন কষ্ট হবেনা। অভিযােগকারী ভাইয়েরা প্রকৃত অবস্থা সহজে মেনে নিবে না। তাদের সামনে নতুন নতুন আরাে অনেক অভিযােগ দাঁড়িয়ে যাবে। তারা আবার অভিযােগের ভিন্ন সুর ভুলে বলবে-
সম্ভাব্য শক্তিতে (Potential Power) কোথায় আমেরিকা আর কোথায় আল-কায়েদা! এরদ্বারা তাদের উদ্দেশ্য হলাে আল-কায়েদার রণশক্তির ভারসাম্যতার গােড়ায় কুঠারাঘাত। করা। কিন্তু এই অভিযােগও ধােপে টিকবে না, ইনশাআল্লাহ।
ইতিপূর্বে কোনো যুদ্ধরত পক্ষের রণশক্তির ওপর ডক্টর রে ক্লাইনের উদ্ধৃত একটি সূত্র উল্লেখ করা হয়েছিল। সূত্রটি নিচে দেওয়া হলােঃ-
Pp = (C+E+M) x (S+W)
রণশক্তিতে ভারসাম্যতার যে পাঁচটি পয়েন্ট আলােচনা করা হয়েছে, তাকে আমরা মৌলিক দুই প্রকারে ভাগ করতে পারি।
প্রথম প্রকার = (C+E+M) তখা যােদ্ধা ও যুদ্ধক্ষেত্র+অর্থনৈতিক সক্ষমতা+সামরিক সক্ষমতা।
দ্বিতীয় প্রকার = (S+W) তথা যুদ্ধকৌশল+ইরাদা (মুজাহিদদের সুউচ্চ মনােবল ও যুদ্ধভূমির অধিবাসীদের সহযােগিতামূলক মানসিকতা)
এই দুই প্রকার হলাে ভারসাম্যপূর্ণ রণশক্তির দুই বাহুর ন্যায়। এবার আসা যাক তুলনামূলক বিশ্লেষণে।
প্রথম বাহুতে যদিও আমেরিকা ও আল-কায়েদার মাঝে বিস্তর ফারাক রয়েছে, কিন্তু দ্বিতীয় বাহুতে মুজাহিদগণ এতটাই অগ্রগামী যে আমেরিকা কল্পনাও তার ধারেকাছে আসতে পারবে না।
এবার আমরা যখন উভয় বাহতে সমন্বয় সাধনে যাবাে, তখন দেখব-
তানযিম আল-কায়েদা ভারসাম্যতায় আমেরিকার চাইতে কয়েকধাপ এগিয়ে আছে। এই কারণেই সুপার পাওযারখ্যাত আমেরিকার মনে আল-কায়েদার ব্যাপারে এত ভীতি।
একদিন আল-কায়েদার হাতেই আমেরিকার দম্ভ বিচূর্ণ হয়ে ইসলামের বিজয় অর্জিত হবে, ইনশাআল্লাহ।
আরেকটি মজার ব্যাপার হলাে,
আমেরিকা একটি বিস্তৃত রাষ্ট্রশক্তি হবার কারণে সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও জনকল্যাণসহ বহু সেক্টর তাকে সামলে চলতে হয়। এসব বিষয়ে সমন্বয় করতে গিয়ে তাদের চেষ্টা এবং শক্তি বহু খাতে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
ফলে, তাদের বিভিন্ন অসুবিধা ও সীমাবদ্ধতার মুখােমুখি হতে হয়। পক্ষান্তরে, মুজাহিদগণের সকল প্রচেষ্টা একটি মাত্র লক্ষ্যে নিবদ্ধ।
তা হলাে ক্রুসেডার আমেরিকার গলায় পরাজযের বেড়ি পড়ানাে। এটি ছাড়া তাদের আর কোনাে ব্যস্ততা নেই। কোনাে সীমাবদ্ধতা নেই।
এই বিষয়টিই মুজাহিদদেরকে কর্মক্ষমতায় আমেরিকার অনেক উর্ধ্বে নিয়ে গেছে।"
________
শায়খ আবু উবাইদা আল কুরাইশী রহিমাহুল্লাহ,
(তিনি ছিলেন শায়খ সাইফ আল আদল হাফিজাহুল্লাহর ঘনিষ্ঠ সহচরদের অন্যতম)
Comment