আল্লাহর আইনের বিপরীত বিচার করা : ইসলাম কী বলে?
এ বিষয়টি নিয়ে অনেকের মাঝে বেশ ইখতিলাফ ও বিতর্ক দেখা যায়। কিছু মানুষ আছে, যারা এটাকে কোনোভাবেই কুফর মানতে চায় না। অনেকে তো সকল ক্ষেত্রেই কুফর বলে প্রচার করে। এদিকে কুরআনের স্পষ্ট আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহর দেওয়া আইন অনুসারে বিচার না করলে সে কাফির, ফাসিক ও জালিম। এগুলোরই বা রহস্য কী? একই অপরাধীর ক্ষেত্রে তিনরকম বিধান কেন? এখানে মূল আলোচনার বিষয় হলো, মানবরচিত আইনে বিচার করা কুফরে আকবার বা বড় কুফর কিনা, যা ব্যক্তিকে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের করে দেয়? এর উত্তর এক কথায় দেওয়া সম্ভব নয়। এখানে এভাবে উত্তর হবে যে, যদি রাষ্ট্রে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং সে আল্লাহর আইনকে সঠিক বলে বিশ্বাস করা সত্ত্বেও পার্থিব স্বার্থে কখনো ভিন্ন আইনে বিচার করে অথবা অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে বিচারকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে তাহলে সে কাফির নয়; বরং জালিম। এ ধরনের কুফরকে বলা হবে ‘কুফর দুনা কুফর।’ অর্থাৎ এর কারণে সে মারাত্মক গুনাহগার হলেও দ্বীন ইসলাম থেকে বের হয়ে মুরতাদ হয়ে যাবে না। আর যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে আল্লাহর আইনের পরিবর্তে মানবরচিত আইন প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং নিয়মিত সে অনুসারেই বিচার-আচার করা হয় কিংবা সে আল্লাহর আইনের বিপরীতে মানবরচিত আইনকেই সঠিক ও শ্রদ্ধাযোগ্য মনে করে অথবা মানবজীবনের সকল সমস্যার সমাধানকল্পে এ আইন অনুসারে ফয়সালা করাকে বাধ্যতামূলক বিশ্বাস করে তাহলে তার কুফর ও ইরতিদাদের বিষয়টি সুস্পষ্ট। এখানে তার কুফরির ব্যাপারে ন্যূনতম সন্দেহ করার অবকাশ নেই। এটাকে ‘কুফর দুনা কুফর’ বলে যারা বিষয়টিকে হালকা করে প্রচার করে, তারা নিশ্চিত দ্বীনের অপব্যাখ্যা করে তাগুতদের খুশি করতে চায়। আমরা এদের থেকে মুক্ত এবং তারাও আমাদের থেকে মুক্ত।
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিচার করবেনা তারা কাফির, ফাসিক ও জালিম। তিনটি উদাহরণের মাধ্যমে এ তিন শ্রেণির মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরা হলো :
১. কাফির : এর উদাহরণ হলো, যখন কোনো ব্যভিচারীর বিচার করার সময় সকল সাক্ষ্য প্রমাণাদির ভিত্তিতে সে দোষী সাব্যস্ত হয়, কিন্তু বিচারক তাকে শরিয়াসম্মত শাস্তি না দিয়ে মানবরচিত অন্য কোনো শাস্তি দেয় অথবা জেল-জরিমানা করে। সে এ কথা বলে যে, আমরা এ ধরনের অপরাধের জন্য এমন শাস্তিই দিয়ে থাকি। অর্থাৎ এ অপরাধের জন্য এটাই আমাদের শাস্তির নির্ধারিত ও চূড়ান্ত বিধান। তাহলে এতে সে আল্লাহর সীমা অতিক্রম করে ফেলায় পরিপূর্ণরূপে কাফির সাব্যস্ত হবে।
২. জালিম : এর উদাহরণও একই। তবে পার্থক্য হলো, এই বিচারক আল্লাহর বিধান মানে, আইনেও তা লেখা আছে এবং ব্যভিচারের শাস্তির ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধানকে অস্বীকারও করে না। কিন্তু সে কিছু লোককে শরিয়া নির্ধারিত শাস্তি প্রদান করে না। কারণ, তার সাথে দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের ভালো সম্পর্ক আছে। অথবা তাদের সামাজিক মর্যাদা উঁচু। অথবা তারা তাকে ঘুষ দিয়েছে। তাহলে এমন বিচারক জালিম হিসাবে বিবেচিত হবে।
৩. ফাসিক : তার উদাহরণ হলো, সে শরিয়া অনুযায়ী বিচার করে ঠিক, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে নিজের সুবিধার জন্য অথবা ভয়ের কারণে সে এমন কিছু অপকৌশল অবলম্বন করে থাকে, যাতে এ শাস্তি বাস্তবায়ন করা থেকে বিরত থাকা যায়। যেমন ব্যভিচারের ক্ষেত্রে চারজন সাক্ষী আছে। তখন বিচারক অপরাধীকে শাস্তি থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে বলল, এই সাক্ষী ভালোভাবে ঘটনা দেখেনি। অথবা অমুক সাক্ষী ন্যায়পরায়ণ নয়। এভাবে সে সাক্ষীদেরকে বিভিন্ন মিথ্যা ও ভুয়া অজুহাত দেখিয়ে সাক্ষ্য দিতে বাধাপ্রদান করল। তাহলে এমন বিচারক ফাসিক বলে বিবেচিত হবে।
আল্লামা মুহাম্মাদ বিন ইবরাহিম রহ. বলেন :
وأما الذي قيل فيه: كفر دون كفر. إذا حاكم إلى غير الله مع اعتقاد أنه عاص وأن حكم الله هو الحق فهذا الذي يصدر منه المرة نحوها أما الذي جعل قوانين بترتيب وتخضيع فهو كفر وإن قالوا أخطأنا وحكم الشرع أعدل ففرق بين المقرر والمثبت والمرجح جعلوه هو المرجع فهذا كفر ناقل عن الملة.
‘আল্লাহর আইনকে সঠিক বলে বিশ্বাস করা সত্ত্বেও আল্লাহর বিধান ছাড়া অন্য আইনে বিচার-ফয়সালা করে নিজেকে গুনাহগার ভাবলে তার ব্যাপারে যে বলা হয়েছে ‘কুফর দুনা কুফর’। আর এটা কেবল ওই ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যার থেকে তা এক-দুবার প্রকাশ পায়। কিন্তু যে ব্যক্তি যথাযথভাবে আইনকানুন তৈরি করবে এবং তা মেনে চলবে তখন তা অবশ্যই কুফর বলে বিবেচিত হবে; যদিও সে একথা বলে যে, (এর কারণে) আমি গুনাহগার হয়েছি এবং শরিয়তের ফয়সালাই অধিক নিষ্ঠাপূর্ণ। অতঃপর সে (শরিয়তের) চূড়ান্ত, প্রমাণিত ও প্রাধান্যপ্রাপ্ত আইনকে বাদ দিয়ে সেটাকে (মানবরচিত আইনকে) মূল বানিয়ে নিয়েছে। অতএব, তা এমন কুফর বলে গণ্য হবে, যা তাকে দ্বীন থেকে বহিষ্কার করে দেয়।’ (ফাতাওয়া ওয়া রাসায়িল, মুহাম্মাদ বিন ইবরাহিম : ১২/২৮০, ফতোয়া নং ৪০৬০, প্রকাশনী : মাতবাআতুল হুকুমাহ, মক্কা)
এ বিষয়ে অনেক উলামায়ে কিরাম এমনই বক্তব্য পেশ করেছেন। তাদের সকলের তাফসির বা মন্তব্য থেকে একথাই স্পষ্ট হয়েছে যে, আল্লাহর বিধান ছাড়া অন্য কোনো বিধান দ্বারা বিচারকার্য পরিচালনা করা আল্লাহর সাথে এক জঘন্য ও স্পষ্ট ঔদ্ধত্য। অথচ বর্তমানে প্রায় সকল মুসলিম ইচ্ছা বা অনিচ্ছায়, জেনে বা না জেনে মানবরচিত আইনে পরিচালিত কোর্টের সামনে বিচারের জন্য ভিড় জমায়।
উম্মাহর ফকিহগণ আল্লাহর বিধান বাদ দিয়ে অন্য বিধান দ্বারা বিচারকারীদেরকেই শুধু কাফিরই বলেননি; বরং তাদের পক্ষ অবলম্বনকারী আলিমদেরকেও কাফির বলে আখ্যায়িত করেছেন।
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন :
وَمَتَى تَرَكَ الْعَالِمُ مَا عَلِمَهُ مِنْ كِتَابِ اللَّهِ وَسُنَّةِ رَسُولِهِ وَاتَّبَعَ حُكْمَ الْحَاكِمِ الْمُخَالِفِ لِحُكْمِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ كَانَ مُرْتَدًّا كَافِرًا يَسْتَحِقُّ الْعُقُوبَةَ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ.
‘আর যখন কোনো আলিম কুরআন-সুন্নাহ হতে অর্জিত শিক্ষা অনুযায়ী আমল ত্যাগ করে এবং আল্লাহ ও রাসুলের বিরুদ্ধাচরণকারী বিচারকের অনুসরণ করে, তখন সে একজন ধর্মত্যাগী এবং কাফির হিসাবে বিবেচিত হেএ, যে দুনিয়া ও আখিরাত-উভয় জাহানে শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত।’ (মাজমুউল ফাতাওয়া, ইবনু তাইমিয়া : ৩৫/৩৭৩, প্রকাশনী : মাজমাউল মালিক ফাহাদ, মদিনা)
এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বিচার-ফয়সালা এবং বিধান। বিচার-ফয়সালা হলো বিধানেরই একটি অংশ বিশেষ। আর বিধান হলো আল্লাহর তাআলার পূর্ণ আইনব্যবস্থা। সুতরাং শুধু বিচার-ফয়সালা থেকে বিধান বাদ দেওয়া আর সম্পূর্ণ বিধানকেই পরিত্যাগ করা দুটো ভিন্ন ভিন্ন বিষয়। কাজেই যদি কোনো শাসক আল্লাহর শরিয়া অনুযায়ী বিচার না করে তখন বিধানের অন্য ধারার প্রেক্ষিতে এ প্রশ্ন চলে আসে যে, সে কি কাফের নাকি মুসলিম? সেক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে শরিয়াকে ক্ষুদ্র দৃষ্টিতে দেখা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে তা বাস্তবায়ন না করা তার বড় কুফরিকেই আবশ্যক করে। আর যদি আল্লাহর বিধান বলবৎ থাকা সত্ত্বেও সাময়িকভাবে শরিয়া বাদ দিয়ে সে বিচার করে তাহলে সেটা হবে এক ধরনের কুফর অর্থাৎ ছোট কুফুর। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। যদি সংবিধান হিসাবে শরিয়া বলবৎ থাকে তাহলে শরিয়া আইন বাস্তবায়ন না হলে এটা হবে ছোট কুফর। আর যদি সংবিধানকে শরিয়ত ছাড়া অন্য কোনো আইন বা তন্ত্র দ্বারা পরিবর্তন করা হয় তাহলে সেটা হবে বড় কুফর।
আল্লামা ইবনে কাসির রহ. তাঁর যুগেও যখন এমন বাস্তবতা অবলোকন করেছিলেন তখন ঠিকই তিনি এ বিষয়ে দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করে তাদের বড় কুফরির কথা স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন। এক্ষেত্রে মাসআলা গোপন রাখার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন :
وَكَمَا يَحْكُمُ بِهِ التَّتَارُ مِنَ السِّيَاسَاتِ الْمَلَكِيَّةِ الْمَأْخُوذَةِ عَنْ مَلِكِهِمْ جِنْكِزْخَانَ الَّذِي وَضَعَ لَهُمُ الياسق، وَهُوَ عِبَارَةٌ عَنْ كِتَابٍ مَجْمُوعٍ مِنْ أَحْكَامٍ قد اقتبسها من شَرَائِعَ شَتَّى: مِنَ الْيَهُودِيَّةِ وَالنَّصْرَانِيَّةِ وَالْمِلَّةِ الْإِسْلَامِيَّةِ وغيرها، وَفِيهَا كَثِيرٌ مِنَ الْأَحْكَامِ أَخَذَهَا مِنْ مُجَرَّدِ نظره وهواه، فصارت في بينه شرعا متبعا يقدمونه على الحكم بِكِتَابِ اللَّهِ وَسُنَّةِ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ مِنْهُمْ فَهُوَ كَافِرٌ يَجِبُ قِتَالُهُ حتى يرجع إلى حكم الله ورسوله، فَلَا يَحْكُمُ سِوَاهُ فِي قَلِيلٍ وَلَا كَثِيرٍ.
‘যেরকমভাবে (মুসলিম নামধারী) মোঙ্গলীয় শাসকরা চেঙ্গিস খানের প্রণীত সংবিধান দ্বারা বিচার-ফয়সালা করত, যা তাদের নেতা চেঙ্গিস খানের ‘ইয়াসিক’ নামক গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। ‘ইয়াসিক’ এমন একটি আইনগ্রন্থ, যা বিভিন্ন ধর্ম তথা ইহুদি, খ্রিষ্টান, ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মের সমন্বয়ে গঠিত। সেখানে তার নিজস্ব খেয়ালখুশি ও চিন্তাধারারও অনেক আইন সন্নিবেশিত ছিল। এভাবেই এটা তাদের মাঝে অনুসরণীয় একটি সংবিধানরূপে স্বীকৃতি পায়। তারা (নিজেদেরকে মুসলিম দাবি করলেও) আল্লাহর কিতাব এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহর উপর এটাকে প্রাধান্য দিত। অতএব, যে কেউ এমনটা করবে সে কাফির হয়ে যাবে। তার বিরূদ্ধে ততক্ষণ পর্যন্ত জিহাদ করতে হবে, যতক্ষণ না সে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিধানের দিকে ফিরে আসে। সুতরাং কমবেশি কোনো বিষয়েই তিনি ছাড়া কেউ ফয়সালা করতে পারবে না।’ (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৩/১১৯, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)
আল্লাহর আইনের বিপরীত আইন দিয়ে বিচার করার এ বিধান বর্তমান মুসলিম সমাজের অনেকেই জানেন না, কিছু মানুষ জানলেও মুখ খোলে না। অথচ বিষয়টি জানা সবারই প্রয়োজন। কেউ যদি মুখ না খোলে, তাহলে মানুষ কীভাবে জানবে দ্বীনের বিধান? সবাই যদি সম্মিলিতভাবে এসব বিধানের ব্যাপারে নীরব থাকে, তাহলে কিয়ামতের দিন আমাদের কেউই মুক্তি পাবে না। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنزَلَ اللَّهُ مِنَ الْكِتَابِ وَيَشْتَرُونَ بِهِ ثَمَنًا قَلِيلًا أُولَٰئِكَ مَا يَأْكُلُونَ فِي بُطُونِهِمْ إِلَّا النَّارَ وَلَا يُكَلِّمُهُمُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَا يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর অবতীর্ণ কুরআনের বিধান গোপন করে এবং এর বিনিময়ে অল্প মূল্য গ্রহণ করে, তারা নিজেদের উদরে আগুনই ভক্ষণ করে এবং আল্লাহ তাআলা না তাদের সাথে কিয়ামতের দিন কথা বলবেন আর না তাদের পবিত্র করবেন। বস্তুত তাদের জন্যে রয়েছে বেদনাদায়ক আজাব।’ (সুরা আল-বাকারা : ১৭৪)
এ বিষয়টি নিয়ে অনেকের মাঝে বেশ ইখতিলাফ ও বিতর্ক দেখা যায়। কিছু মানুষ আছে, যারা এটাকে কোনোভাবেই কুফর মানতে চায় না। অনেকে তো সকল ক্ষেত্রেই কুফর বলে প্রচার করে। এদিকে কুরআনের স্পষ্ট আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহর দেওয়া আইন অনুসারে বিচার না করলে সে কাফির, ফাসিক ও জালিম। এগুলোরই বা রহস্য কী? একই অপরাধীর ক্ষেত্রে তিনরকম বিধান কেন? এখানে মূল আলোচনার বিষয় হলো, মানবরচিত আইনে বিচার করা কুফরে আকবার বা বড় কুফর কিনা, যা ব্যক্তিকে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের করে দেয়? এর উত্তর এক কথায় দেওয়া সম্ভব নয়। এখানে এভাবে উত্তর হবে যে, যদি রাষ্ট্রে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং সে আল্লাহর আইনকে সঠিক বলে বিশ্বাস করা সত্ত্বেও পার্থিব স্বার্থে কখনো ভিন্ন আইনে বিচার করে অথবা অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে বিচারকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে তাহলে সে কাফির নয়; বরং জালিম। এ ধরনের কুফরকে বলা হবে ‘কুফর দুনা কুফর।’ অর্থাৎ এর কারণে সে মারাত্মক গুনাহগার হলেও দ্বীন ইসলাম থেকে বের হয়ে মুরতাদ হয়ে যাবে না। আর যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে আল্লাহর আইনের পরিবর্তে মানবরচিত আইন প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং নিয়মিত সে অনুসারেই বিচার-আচার করা হয় কিংবা সে আল্লাহর আইনের বিপরীতে মানবরচিত আইনকেই সঠিক ও শ্রদ্ধাযোগ্য মনে করে অথবা মানবজীবনের সকল সমস্যার সমাধানকল্পে এ আইন অনুসারে ফয়সালা করাকে বাধ্যতামূলক বিশ্বাস করে তাহলে তার কুফর ও ইরতিদাদের বিষয়টি সুস্পষ্ট। এখানে তার কুফরির ব্যাপারে ন্যূনতম সন্দেহ করার অবকাশ নেই। এটাকে ‘কুফর দুনা কুফর’ বলে যারা বিষয়টিকে হালকা করে প্রচার করে, তারা নিশ্চিত দ্বীনের অপব্যাখ্যা করে তাগুতদের খুশি করতে চায়। আমরা এদের থেকে মুক্ত এবং তারাও আমাদের থেকে মুক্ত।
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিচার করবেনা তারা কাফির, ফাসিক ও জালিম। তিনটি উদাহরণের মাধ্যমে এ তিন শ্রেণির মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরা হলো :
১. কাফির : এর উদাহরণ হলো, যখন কোনো ব্যভিচারীর বিচার করার সময় সকল সাক্ষ্য প্রমাণাদির ভিত্তিতে সে দোষী সাব্যস্ত হয়, কিন্তু বিচারক তাকে শরিয়াসম্মত শাস্তি না দিয়ে মানবরচিত অন্য কোনো শাস্তি দেয় অথবা জেল-জরিমানা করে। সে এ কথা বলে যে, আমরা এ ধরনের অপরাধের জন্য এমন শাস্তিই দিয়ে থাকি। অর্থাৎ এ অপরাধের জন্য এটাই আমাদের শাস্তির নির্ধারিত ও চূড়ান্ত বিধান। তাহলে এতে সে আল্লাহর সীমা অতিক্রম করে ফেলায় পরিপূর্ণরূপে কাফির সাব্যস্ত হবে।
২. জালিম : এর উদাহরণও একই। তবে পার্থক্য হলো, এই বিচারক আল্লাহর বিধান মানে, আইনেও তা লেখা আছে এবং ব্যভিচারের শাস্তির ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধানকে অস্বীকারও করে না। কিন্তু সে কিছু লোককে শরিয়া নির্ধারিত শাস্তি প্রদান করে না। কারণ, তার সাথে দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের ভালো সম্পর্ক আছে। অথবা তাদের সামাজিক মর্যাদা উঁচু। অথবা তারা তাকে ঘুষ দিয়েছে। তাহলে এমন বিচারক জালিম হিসাবে বিবেচিত হবে।
৩. ফাসিক : তার উদাহরণ হলো, সে শরিয়া অনুযায়ী বিচার করে ঠিক, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে নিজের সুবিধার জন্য অথবা ভয়ের কারণে সে এমন কিছু অপকৌশল অবলম্বন করে থাকে, যাতে এ শাস্তি বাস্তবায়ন করা থেকে বিরত থাকা যায়। যেমন ব্যভিচারের ক্ষেত্রে চারজন সাক্ষী আছে। তখন বিচারক অপরাধীকে শাস্তি থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে বলল, এই সাক্ষী ভালোভাবে ঘটনা দেখেনি। অথবা অমুক সাক্ষী ন্যায়পরায়ণ নয়। এভাবে সে সাক্ষীদেরকে বিভিন্ন মিথ্যা ও ভুয়া অজুহাত দেখিয়ে সাক্ষ্য দিতে বাধাপ্রদান করল। তাহলে এমন বিচারক ফাসিক বলে বিবেচিত হবে।
আল্লামা মুহাম্মাদ বিন ইবরাহিম রহ. বলেন :
وأما الذي قيل فيه: كفر دون كفر. إذا حاكم إلى غير الله مع اعتقاد أنه عاص وأن حكم الله هو الحق فهذا الذي يصدر منه المرة نحوها أما الذي جعل قوانين بترتيب وتخضيع فهو كفر وإن قالوا أخطأنا وحكم الشرع أعدل ففرق بين المقرر والمثبت والمرجح جعلوه هو المرجع فهذا كفر ناقل عن الملة.
‘আল্লাহর আইনকে সঠিক বলে বিশ্বাস করা সত্ত্বেও আল্লাহর বিধান ছাড়া অন্য আইনে বিচার-ফয়সালা করে নিজেকে গুনাহগার ভাবলে তার ব্যাপারে যে বলা হয়েছে ‘কুফর দুনা কুফর’। আর এটা কেবল ওই ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যার থেকে তা এক-দুবার প্রকাশ পায়। কিন্তু যে ব্যক্তি যথাযথভাবে আইনকানুন তৈরি করবে এবং তা মেনে চলবে তখন তা অবশ্যই কুফর বলে বিবেচিত হবে; যদিও সে একথা বলে যে, (এর কারণে) আমি গুনাহগার হয়েছি এবং শরিয়তের ফয়সালাই অধিক নিষ্ঠাপূর্ণ। অতঃপর সে (শরিয়তের) চূড়ান্ত, প্রমাণিত ও প্রাধান্যপ্রাপ্ত আইনকে বাদ দিয়ে সেটাকে (মানবরচিত আইনকে) মূল বানিয়ে নিয়েছে। অতএব, তা এমন কুফর বলে গণ্য হবে, যা তাকে দ্বীন থেকে বহিষ্কার করে দেয়।’ (ফাতাওয়া ওয়া রাসায়িল, মুহাম্মাদ বিন ইবরাহিম : ১২/২৮০, ফতোয়া নং ৪০৬০, প্রকাশনী : মাতবাআতুল হুকুমাহ, মক্কা)
এ বিষয়ে অনেক উলামায়ে কিরাম এমনই বক্তব্য পেশ করেছেন। তাদের সকলের তাফসির বা মন্তব্য থেকে একথাই স্পষ্ট হয়েছে যে, আল্লাহর বিধান ছাড়া অন্য কোনো বিধান দ্বারা বিচারকার্য পরিচালনা করা আল্লাহর সাথে এক জঘন্য ও স্পষ্ট ঔদ্ধত্য। অথচ বর্তমানে প্রায় সকল মুসলিম ইচ্ছা বা অনিচ্ছায়, জেনে বা না জেনে মানবরচিত আইনে পরিচালিত কোর্টের সামনে বিচারের জন্য ভিড় জমায়।
উম্মাহর ফকিহগণ আল্লাহর বিধান বাদ দিয়ে অন্য বিধান দ্বারা বিচারকারীদেরকেই শুধু কাফিরই বলেননি; বরং তাদের পক্ষ অবলম্বনকারী আলিমদেরকেও কাফির বলে আখ্যায়িত করেছেন।
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন :
وَمَتَى تَرَكَ الْعَالِمُ مَا عَلِمَهُ مِنْ كِتَابِ اللَّهِ وَسُنَّةِ رَسُولِهِ وَاتَّبَعَ حُكْمَ الْحَاكِمِ الْمُخَالِفِ لِحُكْمِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ كَانَ مُرْتَدًّا كَافِرًا يَسْتَحِقُّ الْعُقُوبَةَ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ.
‘আর যখন কোনো আলিম কুরআন-সুন্নাহ হতে অর্জিত শিক্ষা অনুযায়ী আমল ত্যাগ করে এবং আল্লাহ ও রাসুলের বিরুদ্ধাচরণকারী বিচারকের অনুসরণ করে, তখন সে একজন ধর্মত্যাগী এবং কাফির হিসাবে বিবেচিত হেএ, যে দুনিয়া ও আখিরাত-উভয় জাহানে শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত।’ (মাজমুউল ফাতাওয়া, ইবনু তাইমিয়া : ৩৫/৩৭৩, প্রকাশনী : মাজমাউল মালিক ফাহাদ, মদিনা)
এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বিচার-ফয়সালা এবং বিধান। বিচার-ফয়সালা হলো বিধানেরই একটি অংশ বিশেষ। আর বিধান হলো আল্লাহর তাআলার পূর্ণ আইনব্যবস্থা। সুতরাং শুধু বিচার-ফয়সালা থেকে বিধান বাদ দেওয়া আর সম্পূর্ণ বিধানকেই পরিত্যাগ করা দুটো ভিন্ন ভিন্ন বিষয়। কাজেই যদি কোনো শাসক আল্লাহর শরিয়া অনুযায়ী বিচার না করে তখন বিধানের অন্য ধারার প্রেক্ষিতে এ প্রশ্ন চলে আসে যে, সে কি কাফের নাকি মুসলিম? সেক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে শরিয়াকে ক্ষুদ্র দৃষ্টিতে দেখা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে তা বাস্তবায়ন না করা তার বড় কুফরিকেই আবশ্যক করে। আর যদি আল্লাহর বিধান বলবৎ থাকা সত্ত্বেও সাময়িকভাবে শরিয়া বাদ দিয়ে সে বিচার করে তাহলে সেটা হবে এক ধরনের কুফর অর্থাৎ ছোট কুফুর। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। যদি সংবিধান হিসাবে শরিয়া বলবৎ থাকে তাহলে শরিয়া আইন বাস্তবায়ন না হলে এটা হবে ছোট কুফর। আর যদি সংবিধানকে শরিয়ত ছাড়া অন্য কোনো আইন বা তন্ত্র দ্বারা পরিবর্তন করা হয় তাহলে সেটা হবে বড় কুফর।
আল্লামা ইবনে কাসির রহ. তাঁর যুগেও যখন এমন বাস্তবতা অবলোকন করেছিলেন তখন ঠিকই তিনি এ বিষয়ে দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করে তাদের বড় কুফরির কথা স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন। এক্ষেত্রে মাসআলা গোপন রাখার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন :
وَكَمَا يَحْكُمُ بِهِ التَّتَارُ مِنَ السِّيَاسَاتِ الْمَلَكِيَّةِ الْمَأْخُوذَةِ عَنْ مَلِكِهِمْ جِنْكِزْخَانَ الَّذِي وَضَعَ لَهُمُ الياسق، وَهُوَ عِبَارَةٌ عَنْ كِتَابٍ مَجْمُوعٍ مِنْ أَحْكَامٍ قد اقتبسها من شَرَائِعَ شَتَّى: مِنَ الْيَهُودِيَّةِ وَالنَّصْرَانِيَّةِ وَالْمِلَّةِ الْإِسْلَامِيَّةِ وغيرها، وَفِيهَا كَثِيرٌ مِنَ الْأَحْكَامِ أَخَذَهَا مِنْ مُجَرَّدِ نظره وهواه، فصارت في بينه شرعا متبعا يقدمونه على الحكم بِكِتَابِ اللَّهِ وَسُنَّةِ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ مِنْهُمْ فَهُوَ كَافِرٌ يَجِبُ قِتَالُهُ حتى يرجع إلى حكم الله ورسوله، فَلَا يَحْكُمُ سِوَاهُ فِي قَلِيلٍ وَلَا كَثِيرٍ.
‘যেরকমভাবে (মুসলিম নামধারী) মোঙ্গলীয় শাসকরা চেঙ্গিস খানের প্রণীত সংবিধান দ্বারা বিচার-ফয়সালা করত, যা তাদের নেতা চেঙ্গিস খানের ‘ইয়াসিক’ নামক গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। ‘ইয়াসিক’ এমন একটি আইনগ্রন্থ, যা বিভিন্ন ধর্ম তথা ইহুদি, খ্রিষ্টান, ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মের সমন্বয়ে গঠিত। সেখানে তার নিজস্ব খেয়ালখুশি ও চিন্তাধারারও অনেক আইন সন্নিবেশিত ছিল। এভাবেই এটা তাদের মাঝে অনুসরণীয় একটি সংবিধানরূপে স্বীকৃতি পায়। তারা (নিজেদেরকে মুসলিম দাবি করলেও) আল্লাহর কিতাব এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহর উপর এটাকে প্রাধান্য দিত। অতএব, যে কেউ এমনটা করবে সে কাফির হয়ে যাবে। তার বিরূদ্ধে ততক্ষণ পর্যন্ত জিহাদ করতে হবে, যতক্ষণ না সে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিধানের দিকে ফিরে আসে। সুতরাং কমবেশি কোনো বিষয়েই তিনি ছাড়া কেউ ফয়সালা করতে পারবে না।’ (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৩/১১৯, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)
আল্লাহর আইনের বিপরীত আইন দিয়ে বিচার করার এ বিধান বর্তমান মুসলিম সমাজের অনেকেই জানেন না, কিছু মানুষ জানলেও মুখ খোলে না। অথচ বিষয়টি জানা সবারই প্রয়োজন। কেউ যদি মুখ না খোলে, তাহলে মানুষ কীভাবে জানবে দ্বীনের বিধান? সবাই যদি সম্মিলিতভাবে এসব বিধানের ব্যাপারে নীরব থাকে, তাহলে কিয়ামতের দিন আমাদের কেউই মুক্তি পাবে না। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنزَلَ اللَّهُ مِنَ الْكِتَابِ وَيَشْتَرُونَ بِهِ ثَمَنًا قَلِيلًا أُولَٰئِكَ مَا يَأْكُلُونَ فِي بُطُونِهِمْ إِلَّا النَّارَ وَلَا يُكَلِّمُهُمُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَا يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর অবতীর্ণ কুরআনের বিধান গোপন করে এবং এর বিনিময়ে অল্প মূল্য গ্রহণ করে, তারা নিজেদের উদরে আগুনই ভক্ষণ করে এবং আল্লাহ তাআলা না তাদের সাথে কিয়ামতের দিন কথা বলবেন আর না তাদের পবিত্র করবেন। বস্তুত তাদের জন্যে রয়েছে বেদনাদায়ক আজাব।’ (সুরা আল-বাকারা : ১৭৪)
-সংগৃহীত
Comment