রমজানের প্রস্তুতি : মুমিনের পথ ও পাথেয়
রমজান অন্য সব সাধারণ মাসের মতোই একটি মাসের নাম। কিন্তু ফজিলত, বরকত ও রহমতের কারণে এর রয়েছে অনন্য মর্যাদা। বাকি এগারো মাসের তুলনায় এ মাসটি এতটাই উজ্জ্বল ও মহিমাময়, বাকি সব নক্ষত্রের মাঝে সূর্য যেমন দীপ্তময়। এমন মর্যাদা ও ফজিলতের মহান মাসটি সমাগত প্রায়। আর কিছুদিনের মধ্যেই মাসটি সৌভাগ্য ও আখিরাতের অবর্ণনীয় অফার নিয়ে আমাদের মাঝে আগমন করবে। যে মাস হলো কুরআন অবতরণের, তাকওয়া অর্জনের ও রহমত বর্ষণের।
প্রতি বছর একবারের জন্য আসে এ মাসটি। তাই আমাদের হায়াত যেই ক'বছর, রমজানও পাই সেই ক'টা। এর মাধ্যমেই আমাদের আখিরাতের শূন্য ঝুড়ি ভরে নিতে হবে, পূর্ণ করতে হবে আমাদের জান্নাতের যাওয়ার গাড়ির ট্যাংকি। সময় স্বল্প, পূঁজির প্রয়োজন বেশি; তাই মাসটিকে খুবই সতর্কতা ও সচেতনতার সহিত কাটানোর চেষ্টা করতে হবে। দুর্ভাগ্য ও উদাসীনতাবশত এ মর্যাদাকর মাসটি যেন হেলায়-খেলায় কেটে না যায়, সেজন্য আমাদের কিছু কর্মসূচি তৈরি করে মাসটিকে সে অনুসারে ব্যবহার করা উচিত।
ব্যক্তিগতভাবে নিজের ও কিছু প্রিয় ভাইদের সুন্দর একটি রমজান কাটানোর জন্য নিম্নলিখিত কাজগুলোর লিস্ট করা হয়েছে। অন্য যে কেউ-ই এটা বা এটাতে কিছু কমবেশ করে ফলো করতে পারেন।
👉০১. প্রতিদিন ন্যূনতম দুই ঘণ্টা কুরআন তিলাওয়াত। একসাথেও হতে পারে, আলাদা আলাদা সময়েও হতে পারে। তিলাওয়াত অবশ্যই সুন্দরভাবে তাজবিদের সহিত পড়া উচিত, তাড়াহুড়ো কাম্য নয়। আলিম হলে অর্থ বুঝেবুঝে পড়া চাই।
👉০২. প্রতিদিন এক ঘণ্টা কুরআন তরজমা ও তাফসির অধ্যয়ন। বাংলা থেকে হোক বা উর্দু থেকে বা আরবি থেকে হোক। সাধারণ ভাইদের তরজমা ও তাফসির বাছাইয়ের জন্য নির্ভরযোগ্য কোনো আলিমের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
👉০৩. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাআতের সহিত পড়ার ইহতিমাম করা। এমনিতেও জামাআত গুরুত্বপূর্ণ হলেও রমজানে এর প্রতি আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া। তবে ফজরের জামাআতের ব্যাপারে সতর্ক থাকা। কেননা, সুবহে সাদিকের সময় নিয়ে বড় বিতর্ক আছে। সাহরির প্রচলিত শেষ সময়ের বিশ থেকে পঁচিশ মিনিট পর জামাআত হলে সেটা নিরাপদ। এর আগে হলে সেটা সুবহে কাজিব হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এক্ষেত্রে সতর্কতা কাম্য। খাওয়া প্রচলিত শেষ সময়ের মধ্যেই শেষ করলে আর নামাজ এর আধা ঘণ্টা পরে আদায় করলে উভয় দিকই (রোজা ও নামাজ) নিরাপদ থাকে।
👉০৪. তারাবিহ নামাজ সুন্নাতে মুআক্কাদা আইন। আর জামাআতে পড়া সুন্নাতে মুআক্কাদা কিফায়া। তারাবিহ নিয়মিতভাবে ত্রিশদিনই মসজিদে গিয়ে আদায় করা। তবে দুক্ষেত্রে মসজিদে যাওয়া ঠিক হবে না। এক. যেখানে অত্যধিক দ্রুত নামাজ পড়ানো হয়। তিলাওয়াত, কাওমা, রুকু, সিজদা ইত্যাদি ঠিকমতো আদায় করা হয় না। দুই. যেখানে বিনিময় নিয়ে খতম তারাবিহ পড়ানো হয়। ভালো মাদরাসা-মসজিদে সাধারণত বিনিময় ছাড়াই পড়ানো হয়ে থাকে। নচেৎ বেশিরভাগ মসজিদে টাকার চুক্তি করে পড়ানো হয়। উভয় ক্ষেত্রে অবশ্য কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে। এ দুই ক্ষেত্রে ফরজ নামাজ মসজিদে পড়লেও তারাবিহ মসজিদে না পড়ে বাড়িতেই কিছু মানুষকে নিয়ে সুন্দর করে ধীরেসুস্থে সুরা তারাবিহ পড়বে। কাউকে না পেলে তবুও একাকিই পড়া ভালো।
👉০৫. সম্ভব হলে রমজানে কিয়ামুল লাইল, জিকির-আজকার, তিলাওয়াত, দ্বীনি কিতাব অধ্যয়ন ইত্যাদির মাধ্যমে রাত্রি জাগরণ করা। নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়া এবং এটাকে ধীরে ধীরে এমন অভ্যাসে পরিণত করা, যাতে সারা বছরই পড়া যায়। অধিকহারে ইসতিগফার ও কান্নাকাটি করা।
👉০৬. কম ঘুমানোর চেষ্টা করা। কারণ, এটা দুনিয়ার জীবনে সবচেয়ে বড় অফারের মাস। বেশি ঘুমালে অফার বেশি নেওয়া যাবে না। বঞ্চিত হতে হবে। তাই সময় যথাসম্ভব সেভ করে যত অর্জন করে নেওয়া যায়, ততই লাভ।
👉০৭. প্রতিদিন একজনকে হলেও ইফতারি করানোর চেষ্টা করা। সামান্য পানি বা খাবার দিয়ে হলেও। বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে এনেও খাওয়ানো যায়, প্যাকেটে বা পাত্রে করে বাসায়ও পাঠানো যায়। অসহায়, গরিব, মুসাফির, আলিম, আত্মীয়স্বজন, পড়শীদের থেকে রোজাদার কাউকে বেছে নেওয়া যেতে পারে।
👉০৮. রমজানে বাড়ির মা-বোন-স্ত্রীদের রান্নার ব্যস্ততা অনেক বেশি থাকে। তাই সময় করে রান্নাঘরেও কিছু কিছু সময় ব্যয় করা। এটা রাসুলুল্লাহ সা.-এর একটি সুন্নাহ। সারা বছর না পারলেও রমজানে এটা নিয়ে একটু ফিকির করা। সাহরির সময় আগে আগে উঠে বাড়ির লোকদের ও পড়শীদের জাগিয়ে দেওয়া।
👉০৯. এ মাসে সবর ও ইসারের গুণে গুণান্বিত হওয়ার চেষ্টা করা৷ কাউকে গালিগালাজ, সমালোচনা না করা। হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানি থেকে দূরে থাকা। সবার প্রতি, বিশেষত নিজের অধীনস্ত চাকর-বাকর, ছাত্র-ছাত্রী, সন্তান-সন্তুতিসহ সব ধরনের লোকদের প্রতি সদয় হওয়া। ক্ষমার অভ্যাস গড়ে তোলা। আর এসব সৎগুণ এমনভাবে অর্জন করা, যাতে করে সারা বছর; বরং সারা জীবনের জন্য তা যথেষ্ট হয়ে যায়।
👉১০. সব ধরনের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। যারা কবিরা গুনাহে অভ্যস্ত ছিল, তারা কমপক্ষে কবিরা গুনাহ ছেড়ে দেবে। আর যারা সগিরা গুনাহে অভ্যস্ত ছিল, তারা সগিরা গুনাহ ছেড়ে দেবে। যারা সব গুনাহ থেকে দূরে ছিল, তারা নফল-মুসতাহাব-সুন্নত ইত্যাদি আমলের প্রতি আরও যত্নবান হবে। এভাবে সবাইকে একটি স্তরে হলেও উন্নতি করতে হবে।
👉১১. রমজানের শেষ দশকে নিজ এলাকার মসজিদে ইতিকাফে বসা। পির, মুরশিদ, উস্তাদ বিভিন্ন মানুষের সাথে ইতিকাফে বসার অজুহাতে নিজ এলাকা ছেড়ে দূরে কোথাও সফর করা উচিত নয়। তবে ভিন্ন কোনো কারণে কেউ তাঁদের সাথে আগ থেকেই থাকলে সেক্ষেত্রে তাঁদের সাথে বসা ঠিক আছে।
👉১২. রমজানে দান-সদকা বাড়িয়ে দেওয়া। অন্য মাসে এক হাজার টাকা দান করার অভ্যাস থাকলে এ মাসে দুই হাজার বা ততোধিক দান করার চেষ্টা করা। তালিবুল ইলমদের খোঁজখবর নিয়ে তাদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা। যারা কারও কাছে চায় না, তাদের প্রতি একটু বেশি খেয়াল করা।
👉১৪. সাদাকাতুল ফিতর আদায়ে কার্পণ্যতার পরিচয় না দেওয়া। আধা সা' গমের হাদিসের ভিত্তিতে জনপ্রতি ৫০-৬০ টাকা দেওয়া সবার-ই উচিত হয় না। বরং সামর্থ্য থাকলে অধিক দামি নিসাবের ফিতরা আদায় করা। আধা সা' গম তো সবচেয়ে কমদামি ফিতরা। আপনি ধনী বা সামর্থ্যবান হলে খেজুর, কিসমিস বা পনিরের দামে ফিতরা আদায় করেন। সাড়ে তিন কেজির মূল্য হিসাব করে একটি ফিতরা দিন। এতে গরিবদের উপকার বেশি হবে। ৬০ টাকার পরিবর্তে আপনি যদি ২০০০ টাকা ফিতরা দিতে পারেন, তাহলে কার্পণ্য কেন করেন! ফিতরা ইদের রাতে বা সকালেই দেওয়া উত্তম। আগেও দেওয়া যায়। পরে দেওয়া ঠিক নয়। একান্ত কেউ আদায় না করলে ইদের নামাজের পরে হলেও আদায় করতে হবে।
👉১৫. রমজানে জাকাতের টাকা আদায় করলে বেশি ভালো। নিসাব পরিমাণ অর্থ থাকলে এ মাসেই জাকাত হিসাব করে আদায় করা যেতে পারে। বছর শেষ হওয়ার আগেও জাকাত দেওয়া যায়। তাই নিসাব পরিমাণ সম্পদের ওপর এক চান্দ্র বছর অতিক্রান্ত না হলেও রমজানে অগ্রীম জাকাত দিয়ে দিলে লাভ বেশি। এতে সাওয়াবের মাত্রা অনেকগুণে বেশি হয়। জাকাত বুঝেশুনে উপযুক্ত খাতে ব্যয় করা উচিত। যেকোনো মাদরাসায় চোখ বন্ধ করে জাকাত দেওয়া উচিত নয়। দুটি বিষয় ভালোভাবে যাচাই করে নিতে হবে। যথা : কোনোরূপ খিয়ানত না করে জাকাতের যথাযথ খাতে ব্যয় করা হয় কিনা এবং তাবিল করে জেনারেল ফান্ডে ব্যয় করলে সঠিক নিয়মে তাবিল করা হয় কিনা। প্রাজ্ঞ আলিম ও তাকওয়াবান না হলে এসব ক্ষেত্রে বেশ গড়বড় হয়ে যায়। তাই এসব ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই করে জাকাত দেওয়া উচিত।
👉১৬. অনলাইন ও গুনাহের উপকরণগুলো থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করা। অনলাইন মাধ্যম একান্ত দ্বীনি প্রয়োজনে ব্যবহার করলেও সময় নির্দিষ্ট করে সীমিত সময়ের জন্য ব্যবহার করা। সবসময় এতে এক্টিভ থাকলে এবং অন্যান্য সময়ের মতোই এতে সময় ব্যয় করলে ইবাদতের মজা পাওয়া দুষ্কর হয়ে যাবে।
👉১৮. কোনো গুনাহের অভ্যাস থাকলে এ মাসেই তা চিরস্থায়ীভাবে বন্ধ করার সংকল্প করা। যেমন : মুভি-নাটক দেখা, পর্নো দেখা, গেম-খেলায় আসক্ত থাকা, অবৈধ প্রেম-ভালোবাসা করা, অনলাইনের নানা ফিতনায় আক্রান্ত হওয়া, দৃষ্টির কুঅভ্যাস থাকা ইত্যাদি। কেননা, এ মাসে শয়তান বন্দী থাকে। তাই খুব শক্তভাবে সুদৃঢ় নিয়ত করে গুনাহ ছেড়ে লাগাতার একমাস আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করলে আশা করা যায়, আল্লাহ তা থেকে স্থায়ীভাবে মুক্তি দিয়ে দেবেন।
👉১৯. অন্যান্য কাজ থেকে অবসর হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় দ্বীনি বইপুস্তক পড়া। বই পড়ে ও আলিমদের বিভিন্ন হালকায় গিয়ে ইলম অর্জন করা। সুন্নাহসম্মত দুআ-আজকার মুখস্থ করা। প্রতিদিন কিছু কিছু করে কুরআন হিফজ করা। বাড়ির লোকদের নিয়ে কিছু সময় দ্বীনি কথাবার্তা বলা। এককথায় বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানে দ্বীনি পরিবেশ কায়েম করে ফেলা। গিবত, সমালোচনা, বিদ্বেষ থেকে নিজেও দূরে থাকা, অন্যদেরকেও এ থেকে বাধা দেওয়া।
👉২০. শবে কদর পাওয়ার উদ্দেশ্য রমজানের শেষ দশকের প্রতিটি রাতই পুরোপুরি গুরুত্ব দিয়ে ইবাদত করা। শুধু সাতাশ তারিখের অপেক্ষায় থেকে অন্যান্য রাতে গাফলতি না করা। কেননা, শবে কদর শেষ দশদিনের যেকোনো রাতেই হতে পারে। এমন মহান রাত পাওয়ার জন্য একমাস জাগতে হলে সেটাও তো কম হয়ে যায়। তাই এর জন্য দশ রাত জাগাকে কঠিন না ভাবা এবং এসব রাতে ইবাদতের পূর্ণ স্বাদ পাওয়ার চেষ্টা করা। কেননা, একটি ইবাদতে এক হাজারগুণ সাওয়াব অর্জনের রাত এটি। তাই এর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। এর জন্য ইতিকাফ সবচেয়ে উত্তম ব্যবস্থা। একান্ত না পারলে ঘরেই এ রাতগুলো ইবাদতের মাধ্যমে বিনিদ্র পার করা।
আল্লাহ তাআলা আমাদের রমজানের আজমত ও পবিত্রতা অক্ষুণ্ন রেখে আখিরাতের আ্যকাউন্ট ভারী ও সমৃদ্ধ করার তাওফিক দান করুন।
রমজান অন্য সব সাধারণ মাসের মতোই একটি মাসের নাম। কিন্তু ফজিলত, বরকত ও রহমতের কারণে এর রয়েছে অনন্য মর্যাদা। বাকি এগারো মাসের তুলনায় এ মাসটি এতটাই উজ্জ্বল ও মহিমাময়, বাকি সব নক্ষত্রের মাঝে সূর্য যেমন দীপ্তময়। এমন মর্যাদা ও ফজিলতের মহান মাসটি সমাগত প্রায়। আর কিছুদিনের মধ্যেই মাসটি সৌভাগ্য ও আখিরাতের অবর্ণনীয় অফার নিয়ে আমাদের মাঝে আগমন করবে। যে মাস হলো কুরআন অবতরণের, তাকওয়া অর্জনের ও রহমত বর্ষণের।
প্রতি বছর একবারের জন্য আসে এ মাসটি। তাই আমাদের হায়াত যেই ক'বছর, রমজানও পাই সেই ক'টা। এর মাধ্যমেই আমাদের আখিরাতের শূন্য ঝুড়ি ভরে নিতে হবে, পূর্ণ করতে হবে আমাদের জান্নাতের যাওয়ার গাড়ির ট্যাংকি। সময় স্বল্প, পূঁজির প্রয়োজন বেশি; তাই মাসটিকে খুবই সতর্কতা ও সচেতনতার সহিত কাটানোর চেষ্টা করতে হবে। দুর্ভাগ্য ও উদাসীনতাবশত এ মর্যাদাকর মাসটি যেন হেলায়-খেলায় কেটে না যায়, সেজন্য আমাদের কিছু কর্মসূচি তৈরি করে মাসটিকে সে অনুসারে ব্যবহার করা উচিত।
ব্যক্তিগতভাবে নিজের ও কিছু প্রিয় ভাইদের সুন্দর একটি রমজান কাটানোর জন্য নিম্নলিখিত কাজগুলোর লিস্ট করা হয়েছে। অন্য যে কেউ-ই এটা বা এটাতে কিছু কমবেশ করে ফলো করতে পারেন।
👉০১. প্রতিদিন ন্যূনতম দুই ঘণ্টা কুরআন তিলাওয়াত। একসাথেও হতে পারে, আলাদা আলাদা সময়েও হতে পারে। তিলাওয়াত অবশ্যই সুন্দরভাবে তাজবিদের সহিত পড়া উচিত, তাড়াহুড়ো কাম্য নয়। আলিম হলে অর্থ বুঝেবুঝে পড়া চাই।
👉০২. প্রতিদিন এক ঘণ্টা কুরআন তরজমা ও তাফসির অধ্যয়ন। বাংলা থেকে হোক বা উর্দু থেকে বা আরবি থেকে হোক। সাধারণ ভাইদের তরজমা ও তাফসির বাছাইয়ের জন্য নির্ভরযোগ্য কোনো আলিমের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
👉০৩. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাআতের সহিত পড়ার ইহতিমাম করা। এমনিতেও জামাআত গুরুত্বপূর্ণ হলেও রমজানে এর প্রতি আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া। তবে ফজরের জামাআতের ব্যাপারে সতর্ক থাকা। কেননা, সুবহে সাদিকের সময় নিয়ে বড় বিতর্ক আছে। সাহরির প্রচলিত শেষ সময়ের বিশ থেকে পঁচিশ মিনিট পর জামাআত হলে সেটা নিরাপদ। এর আগে হলে সেটা সুবহে কাজিব হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এক্ষেত্রে সতর্কতা কাম্য। খাওয়া প্রচলিত শেষ সময়ের মধ্যেই শেষ করলে আর নামাজ এর আধা ঘণ্টা পরে আদায় করলে উভয় দিকই (রোজা ও নামাজ) নিরাপদ থাকে।
👉০৪. তারাবিহ নামাজ সুন্নাতে মুআক্কাদা আইন। আর জামাআতে পড়া সুন্নাতে মুআক্কাদা কিফায়া। তারাবিহ নিয়মিতভাবে ত্রিশদিনই মসজিদে গিয়ে আদায় করা। তবে দুক্ষেত্রে মসজিদে যাওয়া ঠিক হবে না। এক. যেখানে অত্যধিক দ্রুত নামাজ পড়ানো হয়। তিলাওয়াত, কাওমা, রুকু, সিজদা ইত্যাদি ঠিকমতো আদায় করা হয় না। দুই. যেখানে বিনিময় নিয়ে খতম তারাবিহ পড়ানো হয়। ভালো মাদরাসা-মসজিদে সাধারণত বিনিময় ছাড়াই পড়ানো হয়ে থাকে। নচেৎ বেশিরভাগ মসজিদে টাকার চুক্তি করে পড়ানো হয়। উভয় ক্ষেত্রে অবশ্য কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে। এ দুই ক্ষেত্রে ফরজ নামাজ মসজিদে পড়লেও তারাবিহ মসজিদে না পড়ে বাড়িতেই কিছু মানুষকে নিয়ে সুন্দর করে ধীরেসুস্থে সুরা তারাবিহ পড়বে। কাউকে না পেলে তবুও একাকিই পড়া ভালো।
👉০৫. সম্ভব হলে রমজানে কিয়ামুল লাইল, জিকির-আজকার, তিলাওয়াত, দ্বীনি কিতাব অধ্যয়ন ইত্যাদির মাধ্যমে রাত্রি জাগরণ করা। নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়া এবং এটাকে ধীরে ধীরে এমন অভ্যাসে পরিণত করা, যাতে সারা বছরই পড়া যায়। অধিকহারে ইসতিগফার ও কান্নাকাটি করা।
👉০৬. কম ঘুমানোর চেষ্টা করা। কারণ, এটা দুনিয়ার জীবনে সবচেয়ে বড় অফারের মাস। বেশি ঘুমালে অফার বেশি নেওয়া যাবে না। বঞ্চিত হতে হবে। তাই সময় যথাসম্ভব সেভ করে যত অর্জন করে নেওয়া যায়, ততই লাভ।
👉০৭. প্রতিদিন একজনকে হলেও ইফতারি করানোর চেষ্টা করা। সামান্য পানি বা খাবার দিয়ে হলেও। বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে এনেও খাওয়ানো যায়, প্যাকেটে বা পাত্রে করে বাসায়ও পাঠানো যায়। অসহায়, গরিব, মুসাফির, আলিম, আত্মীয়স্বজন, পড়শীদের থেকে রোজাদার কাউকে বেছে নেওয়া যেতে পারে।
👉০৮. রমজানে বাড়ির মা-বোন-স্ত্রীদের রান্নার ব্যস্ততা অনেক বেশি থাকে। তাই সময় করে রান্নাঘরেও কিছু কিছু সময় ব্যয় করা। এটা রাসুলুল্লাহ সা.-এর একটি সুন্নাহ। সারা বছর না পারলেও রমজানে এটা নিয়ে একটু ফিকির করা। সাহরির সময় আগে আগে উঠে বাড়ির লোকদের ও পড়শীদের জাগিয়ে দেওয়া।
👉০৯. এ মাসে সবর ও ইসারের গুণে গুণান্বিত হওয়ার চেষ্টা করা৷ কাউকে গালিগালাজ, সমালোচনা না করা। হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানি থেকে দূরে থাকা। সবার প্রতি, বিশেষত নিজের অধীনস্ত চাকর-বাকর, ছাত্র-ছাত্রী, সন্তান-সন্তুতিসহ সব ধরনের লোকদের প্রতি সদয় হওয়া। ক্ষমার অভ্যাস গড়ে তোলা। আর এসব সৎগুণ এমনভাবে অর্জন করা, যাতে করে সারা বছর; বরং সারা জীবনের জন্য তা যথেষ্ট হয়ে যায়।
👉১০. সব ধরনের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। যারা কবিরা গুনাহে অভ্যস্ত ছিল, তারা কমপক্ষে কবিরা গুনাহ ছেড়ে দেবে। আর যারা সগিরা গুনাহে অভ্যস্ত ছিল, তারা সগিরা গুনাহ ছেড়ে দেবে। যারা সব গুনাহ থেকে দূরে ছিল, তারা নফল-মুসতাহাব-সুন্নত ইত্যাদি আমলের প্রতি আরও যত্নবান হবে। এভাবে সবাইকে একটি স্তরে হলেও উন্নতি করতে হবে।
👉১১. রমজানের শেষ দশকে নিজ এলাকার মসজিদে ইতিকাফে বসা। পির, মুরশিদ, উস্তাদ বিভিন্ন মানুষের সাথে ইতিকাফে বসার অজুহাতে নিজ এলাকা ছেড়ে দূরে কোথাও সফর করা উচিত নয়। তবে ভিন্ন কোনো কারণে কেউ তাঁদের সাথে আগ থেকেই থাকলে সেক্ষেত্রে তাঁদের সাথে বসা ঠিক আছে।
👉১২. রমজানে দান-সদকা বাড়িয়ে দেওয়া। অন্য মাসে এক হাজার টাকা দান করার অভ্যাস থাকলে এ মাসে দুই হাজার বা ততোধিক দান করার চেষ্টা করা। তালিবুল ইলমদের খোঁজখবর নিয়ে তাদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা। যারা কারও কাছে চায় না, তাদের প্রতি একটু বেশি খেয়াল করা।
👉১৪. সাদাকাতুল ফিতর আদায়ে কার্পণ্যতার পরিচয় না দেওয়া। আধা সা' গমের হাদিসের ভিত্তিতে জনপ্রতি ৫০-৬০ টাকা দেওয়া সবার-ই উচিত হয় না। বরং সামর্থ্য থাকলে অধিক দামি নিসাবের ফিতরা আদায় করা। আধা সা' গম তো সবচেয়ে কমদামি ফিতরা। আপনি ধনী বা সামর্থ্যবান হলে খেজুর, কিসমিস বা পনিরের দামে ফিতরা আদায় করেন। সাড়ে তিন কেজির মূল্য হিসাব করে একটি ফিতরা দিন। এতে গরিবদের উপকার বেশি হবে। ৬০ টাকার পরিবর্তে আপনি যদি ২০০০ টাকা ফিতরা দিতে পারেন, তাহলে কার্পণ্য কেন করেন! ফিতরা ইদের রাতে বা সকালেই দেওয়া উত্তম। আগেও দেওয়া যায়। পরে দেওয়া ঠিক নয়। একান্ত কেউ আদায় না করলে ইদের নামাজের পরে হলেও আদায় করতে হবে।
👉১৫. রমজানে জাকাতের টাকা আদায় করলে বেশি ভালো। নিসাব পরিমাণ অর্থ থাকলে এ মাসেই জাকাত হিসাব করে আদায় করা যেতে পারে। বছর শেষ হওয়ার আগেও জাকাত দেওয়া যায়। তাই নিসাব পরিমাণ সম্পদের ওপর এক চান্দ্র বছর অতিক্রান্ত না হলেও রমজানে অগ্রীম জাকাত দিয়ে দিলে লাভ বেশি। এতে সাওয়াবের মাত্রা অনেকগুণে বেশি হয়। জাকাত বুঝেশুনে উপযুক্ত খাতে ব্যয় করা উচিত। যেকোনো মাদরাসায় চোখ বন্ধ করে জাকাত দেওয়া উচিত নয়। দুটি বিষয় ভালোভাবে যাচাই করে নিতে হবে। যথা : কোনোরূপ খিয়ানত না করে জাকাতের যথাযথ খাতে ব্যয় করা হয় কিনা এবং তাবিল করে জেনারেল ফান্ডে ব্যয় করলে সঠিক নিয়মে তাবিল করা হয় কিনা। প্রাজ্ঞ আলিম ও তাকওয়াবান না হলে এসব ক্ষেত্রে বেশ গড়বড় হয়ে যায়। তাই এসব ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই করে জাকাত দেওয়া উচিত।
👉১৬. অনলাইন ও গুনাহের উপকরণগুলো থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করা। অনলাইন মাধ্যম একান্ত দ্বীনি প্রয়োজনে ব্যবহার করলেও সময় নির্দিষ্ট করে সীমিত সময়ের জন্য ব্যবহার করা। সবসময় এতে এক্টিভ থাকলে এবং অন্যান্য সময়ের মতোই এতে সময় ব্যয় করলে ইবাদতের মজা পাওয়া দুষ্কর হয়ে যাবে।
👉১৮. কোনো গুনাহের অভ্যাস থাকলে এ মাসেই তা চিরস্থায়ীভাবে বন্ধ করার সংকল্প করা। যেমন : মুভি-নাটক দেখা, পর্নো দেখা, গেম-খেলায় আসক্ত থাকা, অবৈধ প্রেম-ভালোবাসা করা, অনলাইনের নানা ফিতনায় আক্রান্ত হওয়া, দৃষ্টির কুঅভ্যাস থাকা ইত্যাদি। কেননা, এ মাসে শয়তান বন্দী থাকে। তাই খুব শক্তভাবে সুদৃঢ় নিয়ত করে গুনাহ ছেড়ে লাগাতার একমাস আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করলে আশা করা যায়, আল্লাহ তা থেকে স্থায়ীভাবে মুক্তি দিয়ে দেবেন।
👉১৯. অন্যান্য কাজ থেকে অবসর হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় দ্বীনি বইপুস্তক পড়া। বই পড়ে ও আলিমদের বিভিন্ন হালকায় গিয়ে ইলম অর্জন করা। সুন্নাহসম্মত দুআ-আজকার মুখস্থ করা। প্রতিদিন কিছু কিছু করে কুরআন হিফজ করা। বাড়ির লোকদের নিয়ে কিছু সময় দ্বীনি কথাবার্তা বলা। এককথায় বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানে দ্বীনি পরিবেশ কায়েম করে ফেলা। গিবত, সমালোচনা, বিদ্বেষ থেকে নিজেও দূরে থাকা, অন্যদেরকেও এ থেকে বাধা দেওয়া।
👉২০. শবে কদর পাওয়ার উদ্দেশ্য রমজানের শেষ দশকের প্রতিটি রাতই পুরোপুরি গুরুত্ব দিয়ে ইবাদত করা। শুধু সাতাশ তারিখের অপেক্ষায় থেকে অন্যান্য রাতে গাফলতি না করা। কেননা, শবে কদর শেষ দশদিনের যেকোনো রাতেই হতে পারে। এমন মহান রাত পাওয়ার জন্য একমাস জাগতে হলে সেটাও তো কম হয়ে যায়। তাই এর জন্য দশ রাত জাগাকে কঠিন না ভাবা এবং এসব রাতে ইবাদতের পূর্ণ স্বাদ পাওয়ার চেষ্টা করা। কেননা, একটি ইবাদতে এক হাজারগুণ সাওয়াব অর্জনের রাত এটি। তাই এর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। এর জন্য ইতিকাফ সবচেয়ে উত্তম ব্যবস্থা। একান্ত না পারলে ঘরেই এ রাতগুলো ইবাদতের মাধ্যমে বিনিদ্র পার করা।
আল্লাহ তাআলা আমাদের রমজানের আজমত ও পবিত্রতা অক্ষুণ্ন রেখে আখিরাতের আ্যকাউন্ট ভারী ও সমৃদ্ধ করার তাওফিক দান করুন।
-সংগৃহীত
Comment