অনেকে মনে করেন, শাসক মুরতাদ হয়ে গেলেই শুধু তাকে অপসারিত করার জন্য তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যায়। আর যেহেতু শাসক মুরতাদ হয়ে গেলে তার বিপক্ষে যুদ্ধ করা ওয়াজিব হয়ে যাবে তাই শত কুফর-ইরতেদাদে লিপ্ত হলেও তারা শাসকগোষ্ঠীর মুরতাদ হওয়ার বিষয়টা স্বীকার করেন না। তাদের কথাবার্তায় মনে হয়, শাসক মুরতাদ হওয়ার শুধু একটিই পদ্ধতি, তা হলো শাসক নিজেকে নাস্তিক বা মুসলিম নয় বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিবে, কিন্তু এই বন্ধুরা বুঝতে চান না, শাসকের কান্ডজ্ঞান লোপ না পেলে শাসক কোন দিনও এই ঘোষণা দিতে যাবে না। ঘোষণা না দিয়ে শত কুফরী করেও যদি মুসলিম থাকা যায়, বরং আলেমদের সমর্থণ পাওয়া যায়, সাধারণ জনগণকে ধোঁকা দেওয়া যায়, তাহলে ঘোষণা দিয়ে শুধু শুধু জনরোষের শিকার হওয়ার কি প্রয়োজন?
আশ্চর্যের বিষয় হলো, বিদ্রোহের পরিবর্তে তারা বর্তমান শাসকদের সংশোধনের জন্য দাওয়াতের পদ্ধতি গ্রহণ করার পরামর্শ দেয়, কিন্তু এই পদ্ধতির প্রবক্তা মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী রহিমাহুল্লাহ তার কিতাব ‘রিদ্দাতুন ওলা আবা বাকরীন লাহা’য় (পৃ: ৭-৮) শাসক ও এলিট শ্রেণীর অধিকাংশই যে, ঘোষণা দেওয়া ব্যতীত ভিতরে ভিতরে ব্যাপকভাবে নাস্তিক-মুরতাদ হয়ে এ গেছে, এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।তাহলে আমরা শাসকদের মুরতাদ বললে তারা আমাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষেপে যান কেন, আমাদের খারেজী-চরমপন্থী ইত্যাদি উপাধি দেন কেন?
আসলে শাসকদের মুরতাদ বা মুসলিম হওয়া নিয়ে তাদের সাথে আমাদের মূল বিরোধ নয়, বরং মূল দ্বন্দ্ব হলো, শাসকের বিপক্ষে যুদ্ধ নিয়ে, এজন্য নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, যদি কোনদিন কোন শাসক প্রকাশ্যে নাস্তিক হওয়ার ঘোষণা দিয়েও দেয়, তখনও তারা ইমাম না থাকা, শক্তি না থাকা, বড় ফিতনার ভয় ইত্যাদি বাহানায় যুদ্ধ হতে বিরত থাকতে চেষ্টা করবে। আর এভাবেই তারা উবাদা বিন সামেতের হাদিস إلا أن تروا كفرا بواحا عندكم من الله فيه برهان ‘তবে (শাসকদের থেকে) সুস্পষ্ট কুফর দেখলে যার স্বপক্ষে তোমাদের নিকট আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে দলিল রয়েছে, তখন তাদের বিপক্ষে যুদ্ধ করবে’ (সহিহ বুখারী, ৭০৫৬; সহিহ মুসলিম, ১৭০৯) এবং এ হাদিসের আলোকে মুরতাদ শাসকের বিপক্ষে বিদ্রোহের ব্যাপারে উম্মাহর ইজমায়ী সিদ্ধান্তকে কার্যত অস্বীকার করছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, হাদিসের এমন মিসদাক-ক্ষেত্র নির্ধারণ করা এবং হাদিসের উপর আমলের জন্য এমন এমন শর্ত আরোপ করা যা পূর্বেও কখনোও পাওয়া যায়নি এবং কিয়ামত পর্যন্ত পাওয়া যাবেও না, এটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? আর আমাদের মত চরমপন্থীদের দলিল হওয়া ছাড়া এ হাদিসের দ্বারা উম্মাহর কি বা ফায়েদা? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি বুঝলেন না, মুরতাদ শাসকের বিপক্ষে যুদ্ধ না করে সবর করা বা তাকে দাওয়াত দিয়ে সংশোধন করাই উত্তম, মুরতাদ শাসকের বিপক্ষে যুদ্ধ করতে গেলেই বড় ফিতনার আশংকা !!!!
যাক, এই সংশয়ের বিষয়ে প্রবন্ধের শেষে ইনশাআল্লাহ বিস্তারিত আলোচনা করবো, এখন আলোচনার বিষয়বস্তুতে ফিরে আসি, প্রকৃতপক্ষে শাসক মুরতাদ হওয়া, শাসকের বিপক্ষে অস্ত্রধারণ করার একটি ক্ষেত্র মাত্র। মুরতাদ হওয়া ছাড়াও আরো কিছু ক্ষেত্র রয়েছে, যেসব ক্ষেত্রে শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাকে অপসারিত করা ওয়াজিব হয়ে যায়। কুরআন-সুন্নাহর আলোকে উলামায়ে কেরাম এমন কিছু ক্ষেত্র বর্ণণা করেছেন এবং এর মধ্যে কিছু ক্ষেত্র তো এমন যেসব ক্ষেত্রে বিদ্রোহ করার ব্যাপারে সহিহ হাদিস রয়েছে, এবং উলামায়ে কেরাম এসব ক্ষেত্রে বিদ্রোহ ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে ইজমা নকল করেছেন। আর এসবগুলো কারণই বর্তমান শাসকদের মাঝে পুরোপুরি বিদ্যমান। তাই যদি তর্কের খাতিরে ওদের মুসলিম হিসেবে মেনেও নেই, তারপরও নিম্নোলিখিত কারণগুলোর প্রেক্ষিতে ওদের বিপক্ষে বিদ্রোহ করা ওয়াজিব হয়ে যাবে।
আমরা প্রথমে সে ক্ষেত্রগুলোর তালিকা পেশ করবো, এরপর প্রবন্ধ দীর্ঘ হওয়ার কারণে এক বা দুই পর্বে একটি একটি ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।
১ - নামায তরক করা।
২ - কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা না করা।
৩ - শাসকের পাপাচার ও জুলুম অত্যাচার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া, যার কারণে মুসলমানদের দ্বীন-দুনিয়া উভয়টি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
৪ - কাফের-মুরতাদদের সাথে জিহাদ পরিত্যাগ করা, ওদের বন্ধুরুপে গ্রহণ করা এবং ওদের সাথে মিলিত হয়ে মুসলিমদের বিপক্ষে যুদ্ধ করা।
এ পর্বে নামায পরিত্যাগকারী শাসকের বিপক্ষে বিদ্রোহ করার বিষয়ে সহিহ হাদিস ও আলেমদের বক্তব্য তুলে ধরবো ইনশাআল্লাহ। আর আগামী পর্বে এ বিষয়ে কিছু সংশয়ের উত্তর দেওয়া হবে ইনশাঅাল্লাহ। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, আমরা যে আলেমদের বক্তব্য উদ্ধৃত করবো, তারা সবাই হানাফী, মালেকী কিংবা শাফেয়ী মাযহাবের, আর এই তিন মাযহাবে নামায তরক করা কুফরী নয়। বরং শুধু হান্বলী মাযহাবেই নামায তরক করা কুফরী। এরপরও তিনো মাযহাবের আলেমগণ নামায তরককারী শাসকের বিপক্ষে যুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন। সুতরাং এর দ্বারা আমাদের দাবী ‘নামায তরক করা শাসকের বিপক্ষে বিদ্রোহের একটি স্বতন্ত্র ক্ষেত্র’ প্রমাণিত হবে ইনশাআল্লাহ।
আউফ বিন মালিক রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের মধ্যে উত্তম শাসক হলো তারা, যাদেরকে তোমরা ভালোবাসবে এবং তারাও তোমাদেরকে ভালোবাসবে, তোমরা তাদের জন্য দোয়া করবে তারাও তোমাদের জন্য দোয়া করবে। আর তোমাদের মধ্যে নিকৃষ্ট শাসক হলো তারা, যাদেরকে তোমরা অপছন্দ করবে এবং তারাও তোমাদেরকে অপছন্দ করবে, যাদেরকে তোমরা লা’নত করবে এবং তারাও তোমাদেরকে লা’নত করবে। বলা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি তরবারি দ্বারা তাদের মোকাবেলা করবো না? রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: না, যতদিন তারা তোমাদের মাঝে নামায কায়েম করে। -সহিহ মুসলিম, ১৮৫৫
উম্মে সালামা রাযিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘এমন কিছু লোককে তোমাদের আমির নিযুক্ত করা হবে যাদের কিছু কাজ তোমাদের কাছে ভালো মনে হবে আর কিছু কাজ মন্দ মনে হবে, (অর্থাৎ ভালো-মন্দ সব কাজই করবে), সুতরাং যে তাদের (মন্দ কাজগুলোকে) অপছন্দ করবে সে মুক্তি পাবে, আর যে প্রতিবাদ করবে সেও মুক্তি পাবে, কিন্তু যে সন্তুষ্টি প্রকাশ করবে, এবং সহযোগিতা করবে সে মুক্তি পাবে না। সাহাবায়ে কেরাম প্রশ্ন করলেন, আমরা কি এমন আমিরদের সাথে যুদ্ধ করবো না, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, যতদিন তারা নামায পড়বে ততদিন তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে না। -সহিহ মুসলিম, ১৮৫৪
১. মালেকী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফকিহ ও মুহাদ্দিস ইমাম ইবনে বাত্তাল রহিমাহুল্লাহ (মৃ: ৪৪৯ হি.) বুখারী শরিফের ভাষ্যগ্রন্থ ‘শরহু সহিহিল বুখারী’তে বলেন,
সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমদের মতে শাসক মুরতাদ হয়ে গেলে কিংবা নামায কায়েম করা ছেড়ে দিলেই শুধু তাদের বিপক্ষে বিদ্রোহ করা ও তাদের অপসারিত করা ওয়াজিব হয়। এছাড়া শুধু জুলুম-অত্যাচারের কারণে তাদের বিপক্ষে বিদ্রোহ করা যাবে না, ... ইবনে মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, অচিরেই এমন কিছু আমির তোমাদের দ্বায়িত্ব গ্রহণ করবে, যারা (জুলুম-অত্যাচারের মাধ্যমে) অশান্তি সৃষ্টি করবে, তবে তাদের দ্বারা যতটুকু কল্যাণ হবে তা তাদের দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতির থেকে বেশি, তাদের মধ্যে যারা আল্লাহর আনুগত্য করবে তারা প্রতিদানের হকদার হবে এবং তোমাদের উপর তাদের কৃতজ্ঞতা আদায় করা আবশ্যক হবে, আর যারা আল্লাহর নাফরমানী করবে তারা গুনাহের ভাগীদার হবে, আর এক্ষেত্রে তোমাদের কর্তব্য হবে সবর ও ধৈর্য্যধারণ। -শরহু সহিহিল বুখারী, ৫/১২৭
ইবনে বাত্তাল আরো বলেন,
এ সকল হাদিস প্রমাণ করে জালেম শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে না, বরং তার আনুগত্য করতে হবে, ততদিন পর্যন্ত যতদিন সে জুমুআ কায়েম করবে, এবং জিহাদ জারী রাখবে। -শরহু সহিহিল বুখারী, ১০/৮
২. ইবনে বাত্তাল রহিমাহুল্লাহুর বক্তব্য থেকে সুস্পষ্ট ভাবে বুঝে আসে যে ফাসেক ও জালেম শাসকের বিপক্ষে বিদ্রোহ না করার যে আদেশ হাদিসে দেওয়া হয়েছে তা ঐ শাসকের ক্ষেত্রে যে নামায কায়েম করে, জিহাদ জারী রাখে, এবং তার দ্বারা যে কল্যাণ হয় (যেমন নামায কায়েম করা, মুসলমানদের প্রতিরক্ষা ইত্যাদি) তা তার দ্বারা হওয়া ক্ষতির চেয়ে বেশি। এ বিষয়টিই ইমাম ইবনুল উযির ইয়ামানী রহিমাহুল্লাহু (মৃ: ৮৪০ হি.) তার কালজয়ী গ্রন্থ আররাওযুল বাসিমে স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তিনি বলেন,
ইবনে বাত্তালের যে কথার উপর আপত্তিকারী আপত্তি করেছে, সে কথা তো আপত্তিকারীর বিপক্ষেই যায়, কেননা ইবনে বাত্তাল ফুকাহায়ে কেরাম থেকে নকল করেছেন যে, তারা জোরপূর্বক ক্ষমতাদখলকারীর আনুগত্য ওয়াজিব হওয়ার ক্ষেত্রে জুমুআ ও ইদ কায়েম করা, জিহাদ জারী রাখা এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাজলুমের পক্ষে সুবিচার করা ইত্যাদি বিষয়ের শর্ত করেছেন। -আররাওযুল বাসিম, ২/৩৮৪
৩. কাযী ইয়ায রহিমাহুল্লাহ (মৃ: ৫৪৪ হি.) বলেন,
উলামায়ে কেরাম সবাই এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন যে, কোনো কাফেরকে খলীফা নিযুক্ত করলে সে খলীফা হবে না এবং কোনো খলীফার মাঝে যদি কুফরী প্রকাশ পায়, তাহলে সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অপসারিত হয়ে যাবে। এমনিভাবে শাসক যদি নামায প্রতিষ্ঠা করা অথবা নামাযের দিকে আহবান করা ছেড়ে দেয় (তাহলেও)। তিনি আরও বলেন, জুমহুরের মতে শাসক যদি বিদ‘আত করে (তবে তাদের হুকুম একই)। কতিপয় বসরী আলেমের মত হলো, বিদ‘আতির ইমামত সাব্যস্ত হবে এবং সেটা স্থায়ী হবে, কেননা সে তা’বিলকারী। অতএব শাসক যদি এজাতীয় কাজগুলোর কোন একটি, যেমন, কুফর, শরীয়া পরিবর্তন অথবা বিদ‘আতে লিপ্ত হয়, তবে সে পদচ্যুত হয়ে যাবে এবং তার আনুগত্যের অপরিহার্যতা শেষ হয়ে যাবে। মুসলমানদের উপর ফরজ হবে, সম্ভব হলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা, তাকে অপসারণ করা এবং একজন ন্যায়পরায়ণ খলিফা নিযুক্ত করা, যদি এটা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়। -ইকমালুল মু’লিম, ৬/২৪৬
৪. ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহও (মৃ: ৬৭৬ হি.) কাযী ইয়ায রহিমাহুল্লাহুর উপরোল্লিখিত বক্তব্য সমর্থণ করেছেন। তিনি বলেন,
কাযী ইয়ায রহিমাহুল্লাহ বলেন, উলামায়ে কেরাম সবাই এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন যে, কোনো কাফেরকে খলীফা নিযুক্ত করলে সে খলীফা হবে না এবং কোনো খলীফার মাঝে যদি কুফরী প্রকাশ পায়, তাহলে সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অপসারিত হয়ে যাবে। তিনি বলেন, এমনিভাবে শাসক যদি নামায প্রতিষ্ঠা করা অথবা নামাযের দিকে আহবান করা ছেড়ে দেয় (তাহলেও)। তিনি আরও বলেন, জুমহুরের মতে শাসক যদি বিদ‘আত করে (তবে তাদের হুকুম একই)। কতিপয় বসরী আলেমের মত হলো, বিদ‘আতির ইমামত সাব্যস্ত হবে এবং সেটা স্থায়ী হবে, কেননা সে তা’বিলকারী। কাযী ইয়ায বলেন, শাসকের উপর যদি কুফর আপতিত হয় এবং সে যদি শরীয়া পরিবর্তন করে অথবা বিদ‘আত করে, তবে সে পদচ্যুত হয়ে যাবে এবং তার আনুগত্যের অপরিহার্যতা শেষ হয়ে যাবে। মুসলমানদের উপর ফরজ হবে, সম্ভব হলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা, তাকে অপসারণ করা এবং একজন ন্যায়পরায়ণ খলিফা নিযুক্ত করা। -শরহু মুসলিম, ১২/২২৯
৫. মুহাদ্দিস আবুল আব্বাস কুরতুবী মালেকী রহিমাহুল্লাহ (মৃ: ৬৫৬ হি.) ‘তালখীসু সহিহি মুসলিম’ নামে সহিহ মুসলিমের একটি সারসংক্ষেপ তৈরী করেন, এরপর আলমুফহিম নামে সেই সংক্ষিপ্তগ্রন্থের শরাহ লিখেন, এই কিতাবে তিনি বলেন,
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, “মুসলিমের উপর শ্রবণ ও আনুগত্য ওয়াজিব”, প্রমাণ করে, মুসলমানদের জন্য ইমাম, আমির ও কাযীর আনুগত্য করা ওয়াজিব, আর এ ব্যাপারে আলেমগণের মাঝে কোন দ্বিমতও নেই, যতক্ষণ না শাসক গুনাহের আদেশ করে। যদি শাসক গুনাহের আদেশ করে তাহলে সর্বসম্মতিক্রমে সে গুনাহের কাজে তার আনুগত্য করা জায়েয হবে না। এখন সেই গুনাহটা যদি কুফর হয়, তাহলে সকল মুসলমানের উপর ফরজ হলো, তাকে অপসারণ করা। এমনিভাবে সে যদি নামায, রমযানের রোযা, হুদুদ তথা দণ্ডবিধির মতো দ্বীনের মৌলিক কোন বিধান প্রতিষ্ঠা করা ছেড়ে দেয় এবং সেগুলো পালনে বাধা দেয়, তদ্রুপ সে যদি মদপান ও যিনাকে বৈধতা দান করে এবং সেগুলো থেকে বারণ না করে, তখনও তার অপসারণ ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। -আলমুফহিম, ৪/৩৯
৬. মুফাসসির আবু আব্দুল্লাহ কুরতুবী রহিমাহুল্লাহ (মৃ: ৬৭১ হি.) বলেন,
ইমাম ফাসেক হয়ে গেলে সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমদের মতে সে অপসারিত হয়ে যাবে, এবং প্রকাশ্য ও সুবিদিত ফিসকের কারণে তাকে অপসারণ করতে হবে, ….. আর অন্যান্য আলেমদের মতে ইমাম অপসারিত হবে না, যতক্ষণ না সে কুফরে লিপ্ত হয় কিংবা নামায পরিত্যাগ করে, অথবা নামাযের দিকে আহ্বান করা ছেড়ে দেয়, কিংবা শরিয়তের কোন বিধান কায়েম করা ছেড়ে দেয়। কেননা উবাদা বিন সামেতের সূ্ত্রে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের থেকে বাইয়াত নিয়েছেন, আমরা আমিরদের সাথে ক্ষমতা নিয়ে যুদ্ধ করবো না, তবে যদি তোমরা সুস্পষ্ট কুফরী দেখতে পাও, যে ব্যাপারে তোমাদের নিকট আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট দলিল রয়েছে। আউফ বিন মালিকের সূত্রে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, যতদিন তারা তোমাদের মাঝে নামায কায়েম করবে ততদিন তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে না। ইমাম মুসলিম উল্লিখিত হাদিসদ্বয় বর্ণণা করেছেন। উম্মে সালামা রাযিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘এমন কিছু লোককে তোমাদের আমির নিযুক্ত করা হবে যাদের কিছু কাজ তোমাদের কাছে ভালো মনে হবে আর কিছু কাজ মন্দ মনে হবে, (অর্থাৎ ভালো-মন্দ সব কাজই করবে), সুতরাং যে তাদের (মন্দ কাজগুলোকে) অপছন্দ করবে সে মুক্তি পাবে, আর যে প্রতিবাদ করবে সেও মুক্তি পাবে, কিন্তু যে সন্তুষ্টি প্রকাশ করবে, এবং সহযোগিতা করবে সে মুক্তি পাবে না। সাহাবায়ে কেরাম প্রশ্ন করলেন, আমরা কি এমন আমিরদের সাথে যুদ্ধ করবো না, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, যতদিন তারা নামায পড়বে ততদিন তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে না। ... এই হাদিসটিও ইমাম মুসলিম বর্ণণা করেছেন। -তাফসীরে কুরতুবী, ১/২৭১
৭. তাফসীরে বাইযাবীর লেখক ইমাম বাইযাবী রহিমাহুল্লাহ (মৃ: ৬৮৫ হি.) ‘তুহফাতুল আবরার’ নামে ইমাম বাগাভী রচিত হাদিসের কিতাব ‘মাসাবীহুস সুন্নাহ’র একটি ব্যাখাগ্রন্থ রচনা করেছেন, এ কিতাবে উম্মে সালামা রাযিআল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত হাদিসের ব্যাখায় তিনি বলেন,
নামায হলো দ্বীনের ভিত্তি, ইসলামের পরিচায়ক ও ঈমান-কুফরের মাঝে পার্থক্য, তাই যতদিন পর্যন্ত শাসকরা নামায কায়েম করে ততদিন তাদের বিপক্ষে যুদ্ধ করতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা এক্ষেত্রে তাদের সাথে যুদ্ধ করলে ফিতনা হবে এবং লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে। -তুহফাতুল আবরার, ২/৫৪৬
7. আল্লামা ত্বীবী রহিমাহুল্লাহ (মৃ: ৭৪৩ হি.) মেশকাত শরিফের ভাষ্যগ্রন্থ ‘আলকাশিফ আন হাকায়িকিস সুনানে’ বলেন,
আহলুস সুন্নাহর উলামাগণ এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন যে, কোনো কাফেরকে খলীফা নিযুক্ত করলে সে খলীফা হবে না এবং কোনো খলীফার মাঝে যদি কুফরী প্রকাশ পায়, তাহলে সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অপসারিত হবে যাবে। এমনিভাবে শাসক যদি নামায প্রতিষ্ঠা করা অথবা নামাযের দিকে আহবান করা ছেড়ে দেয় তাহলেও। -আলকাশেফ আন হাকায়িকিস *সুনান, পৃ: ৮/২৫৬০
৯. শাফেয়ী মাযহাবের শীর্ষস্থানীয় আলেম হাফেয ইবনুল মুলাক্কিন রহিমাহুল্লাহ (মৃ: ৮০৪ হি.) সহিহ বুখারীর শরাহ ‘আততাওযীহ’তে বলেন,
যালেম শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করা এবং তাদের কথা শোনা ও আনুগত্য আবশ্যক হওয়ার প্রমাণ এ হাদীস সমূহে বিদ্যমান রয়েছে। ফুকাহায়ে কেরাম এ ব্যাপারে একমত যে, জোরপূর্বক ক্ষমতা দখলকারী শাসকের আনুগত্য ততদিন আবশ্যক, যতদিন তারা নামাযের জামাত এবং জিহাদ কায়েম রাখে। -আততাওযীহ, ৩২/২৮২
তিনি আরো বলেন
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘ইমামের আনুগত্য ওয়াজিব, যতক্ষণ না সে কোন অন্যায় কাজের আদেশ দেয়। যদি সে কোন অন্যায় কাজের আদেশ দেয় তাহলে তার কোন আনুগত্য নেই’। এ হাদীস দ্বারা খারেজীরা দলিল দিয়ে থাকে, ফলে তারা জালেম শাসক থেকে জুলুম প্রকাশ পেলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা এবং তাকে অপসারণ করা জায়েয মনে করে। তবে জুমহুরের মত হলো তা না করা, তবে হাঁ, তারা যদি ঈমান গ্রহণের পর কুফরী করে অথবা নামায কায়েম করা ছেড়ে দেয়, তখন তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে হবে। -আততাওযীহ, ১৮/৬৬
১০. হানাফী মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনুল মালাক রহিমাহুল্লাহ (মৃ: ৮৫৪ হি.) ‘মাসাবীহুস সুন্নাহ’র শরাহ ‘শরহুল মাসাবীহ’তে উম্মে সালামা রাযিআল্লাহু আনহার হাদিসের ব্যাখায় বলেন,
শাসকরা যতদিন পর্যন্ত ইমান ও কুফরের মাঝে পার্থক্যকারী নামায কায়েম করে ততদিন তাদের বিপক্ষে যুদ্ধ করতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন। কেননা এক্ষেত্রে তাদের সাথে যুদ্ধ করলে ফিতনা হবে এবং লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে। এই হাদিস প্রমাণ করে ফিসকের কারণে ইমাম অপসারিত হবে না। -শরহুল মাসাবীহ, ৪/২৪৬
১১. মোল্লা আলী ক্বারী রহ. উম্মে সালামা রাযিআল্লাহু আনহার হাদিসের ব্যাখায় (মৃ: ১০১৪ হি.) বলেন,
রাবী বলেন, আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সে সময় আমরা কি তাদেরকে সরিয়ে ফেলব না, তাদের সাথে কৃত অঙ্গীকার ছুড়ে ফেলব না, এবং তাদের সাথে লড়াই করব না? তিনি বললেন না, অর্থাৎ যতক্ষণ তারা তোমাদের মাঝে নামায কায়েম করে ততক্ষণ তা করো না। কেননা এটি মুসলিম উম্মাহর ঐক্য বজায় থাকার প্রমাণ বহন করে। আল্লামা ত্বীবী বলেন, উক্ত হাদীসে এ কথার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে যে, নামাযের বিষয়টি অনেক গুরুতর এবং শাসক নামায না পড়লে তার আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে ফেলা আবশ্যক হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে বিষয়টি কুফরি প্রকাশ পাওয়ার মতো। যেমনটি উবাদা বিন ছামেতের ‘তবে যদি তোমরা কুফরি দেখ’ শীর্ষক হাদীসে গত হয়েছে। -মিরকাতুল মাফাতীহ, ৬/২৩৯৬
১২. হিন্দুস্তানের অন্যতম আলেম শায়েখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রহিমাহুল্লাহ (মৃ: ১০৫২ হি.) মিশকাত শরিফের ভাষ্যগ্রন্থ ‘লামাআতুত তানকীহ’তে উম্মে সালামা রাযিআল্লাহু আনহার হাদিসের ব্যাখায় বলেন,
সাহাবায়ে কেরাম প্রশ্ন করলেন, আমরা কি তাদের সাথে যুদ্ধ করবো না? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, যতদিন তারা নামায কায়েম করবে ততদিন তাদের সাথে যুদ্ধ করবে না। এ হাদিস প্রমাণ করে, নামায ছেড়ে দেওয়ার কারণে শাসকদের সাথে যুদ্ধ ও তাদের আনুগত্য পরিহার করা ওয়াজিব হয়ে যায়, কেননা নামায হলো দ্বীনের ভিত্তি এবং ঈমান-কুফরের মাঝে পার্থক্যকারী বিষয়। কিন্তু অন্যান্য গুনাহের বিষয়টা নামাযের মত নয়। (তাই অন্যান্য গুনাহের কারণে ইমামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে না। হাদিস থেকে নামাযের গুরুত্ব ও নামাযের পরিত্যাগের ভয়াবহ পরিণতি বুঝে আছে। -লামাআতুত তানকীহ, ৬/৪৫৪
১৩. ইমাম নববীর অমরগ্রন্থ ‘রিয়াযুস সালিহিন’ আমরা সবাই চিনি। মুহাক্কিক আলেমদের নিকট এ কিতাবের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য শরাহ হলো আল্লামা ইবনে আল্লান দিমাশকী শাফেয়ী রহ. (মৃত্যু ১০৫৭ হি.) রচিত ‘দালিলুল ফালিহীন’, এ কিতাবে উম্মে সালামা রাযিআল্লাহু আনহার হাদিসের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন-
হে আল্লাহর রাসূল তারা এত খারাপ হওয়া সত্ত্বেও কি আমরা তাদের আনুগত্য করবো, না কি তাদের আনুগত্য পরিহার করে তাদের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হবো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, যতদিন তারা তোমাদের মাঝে নামায কায়েম করে তোমরা তাদের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ো না। এ হাদীস থেকে নামাযের গুরুত্ব বোঝা যায়। এথেকে এও বোঝা যায় যে, নামায প্রতিষ্ঠা ছেড়ে দেওয়া কুফরে বাওয়াহের মতই। কেননা উবাদা রাযি. এর হাদীসে এসেছে ‘ততক্ষণ কিতাল করবে না, যতক্ষণ না কুফরে বাওয়াহ দেখতে পাবে’। আমর বিল মারুফের অধ্যায়ে এই হাদিসটি গত হয়েছে এবং সেখানে উম্মে সালামা রাযিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হাদিসটিও অতিবাহিত হয়েছে, ‘সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আমরা কি তাদের সাথে যুদ্ধ করবো না? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, যতদিন তারা নামায কায়েম করবে ততদিন তাদের সাথে যুদ্ধ করবে না’ সহিহ মুসলিম। এই হাদিস দ্বারা বুঝে আসে, আমাদের আলোচ্য হাদিসে منابذة (দ্বন্দ্ব) দ্বারা যুদ্ধ উদ্দেশ্য। কেননা হাদিসের ব্যাখা হাদিস দ্বারা করাই উত্তম। -দালিলুল ফালিহীন, ৫/১২৪
আশ্চর্যের বিষয় হলো, বিদ্রোহের পরিবর্তে তারা বর্তমান শাসকদের সংশোধনের জন্য দাওয়াতের পদ্ধতি গ্রহণ করার পরামর্শ দেয়, কিন্তু এই পদ্ধতির প্রবক্তা মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী রহিমাহুল্লাহ তার কিতাব ‘রিদ্দাতুন ওলা আবা বাকরীন লাহা’য় (পৃ: ৭-৮) শাসক ও এলিট শ্রেণীর অধিকাংশই যে, ঘোষণা দেওয়া ব্যতীত ভিতরে ভিতরে ব্যাপকভাবে নাস্তিক-মুরতাদ হয়ে এ গেছে, এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।তাহলে আমরা শাসকদের মুরতাদ বললে তারা আমাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষেপে যান কেন, আমাদের খারেজী-চরমপন্থী ইত্যাদি উপাধি দেন কেন?
আসলে শাসকদের মুরতাদ বা মুসলিম হওয়া নিয়ে তাদের সাথে আমাদের মূল বিরোধ নয়, বরং মূল দ্বন্দ্ব হলো, শাসকের বিপক্ষে যুদ্ধ নিয়ে, এজন্য নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, যদি কোনদিন কোন শাসক প্রকাশ্যে নাস্তিক হওয়ার ঘোষণা দিয়েও দেয়, তখনও তারা ইমাম না থাকা, শক্তি না থাকা, বড় ফিতনার ভয় ইত্যাদি বাহানায় যুদ্ধ হতে বিরত থাকতে চেষ্টা করবে। আর এভাবেই তারা উবাদা বিন সামেতের হাদিস إلا أن تروا كفرا بواحا عندكم من الله فيه برهان ‘তবে (শাসকদের থেকে) সুস্পষ্ট কুফর দেখলে যার স্বপক্ষে তোমাদের নিকট আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে দলিল রয়েছে, তখন তাদের বিপক্ষে যুদ্ধ করবে’ (সহিহ বুখারী, ৭০৫৬; সহিহ মুসলিম, ১৭০৯) এবং এ হাদিসের আলোকে মুরতাদ শাসকের বিপক্ষে বিদ্রোহের ব্যাপারে উম্মাহর ইজমায়ী সিদ্ধান্তকে কার্যত অস্বীকার করছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, হাদিসের এমন মিসদাক-ক্ষেত্র নির্ধারণ করা এবং হাদিসের উপর আমলের জন্য এমন এমন শর্ত আরোপ করা যা পূর্বেও কখনোও পাওয়া যায়নি এবং কিয়ামত পর্যন্ত পাওয়া যাবেও না, এটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? আর আমাদের মত চরমপন্থীদের দলিল হওয়া ছাড়া এ হাদিসের দ্বারা উম্মাহর কি বা ফায়েদা? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি বুঝলেন না, মুরতাদ শাসকের বিপক্ষে যুদ্ধ না করে সবর করা বা তাকে দাওয়াত দিয়ে সংশোধন করাই উত্তম, মুরতাদ শাসকের বিপক্ষে যুদ্ধ করতে গেলেই বড় ফিতনার আশংকা !!!!
যাক, এই সংশয়ের বিষয়ে প্রবন্ধের শেষে ইনশাআল্লাহ বিস্তারিত আলোচনা করবো, এখন আলোচনার বিষয়বস্তুতে ফিরে আসি, প্রকৃতপক্ষে শাসক মুরতাদ হওয়া, শাসকের বিপক্ষে অস্ত্রধারণ করার একটি ক্ষেত্র মাত্র। মুরতাদ হওয়া ছাড়াও আরো কিছু ক্ষেত্র রয়েছে, যেসব ক্ষেত্রে শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাকে অপসারিত করা ওয়াজিব হয়ে যায়। কুরআন-সুন্নাহর আলোকে উলামায়ে কেরাম এমন কিছু ক্ষেত্র বর্ণণা করেছেন এবং এর মধ্যে কিছু ক্ষেত্র তো এমন যেসব ক্ষেত্রে বিদ্রোহ করার ব্যাপারে সহিহ হাদিস রয়েছে, এবং উলামায়ে কেরাম এসব ক্ষেত্রে বিদ্রোহ ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে ইজমা নকল করেছেন। আর এসবগুলো কারণই বর্তমান শাসকদের মাঝে পুরোপুরি বিদ্যমান। তাই যদি তর্কের খাতিরে ওদের মুসলিম হিসেবে মেনেও নেই, তারপরও নিম্নোলিখিত কারণগুলোর প্রেক্ষিতে ওদের বিপক্ষে বিদ্রোহ করা ওয়াজিব হয়ে যাবে।
আমরা প্রথমে সে ক্ষেত্রগুলোর তালিকা পেশ করবো, এরপর প্রবন্ধ দীর্ঘ হওয়ার কারণে এক বা দুই পর্বে একটি একটি ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।
যেসব ক্ষেত্রে মুরতাদ না হলেও শাসকের বিপক্ষে যুদ্ধ করা যায়:
১ - নামায তরক করা।
২ - কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা না করা।
৩ - শাসকের পাপাচার ও জুলুম অত্যাচার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া, যার কারণে মুসলমানদের দ্বীন-দুনিয়া উভয়টি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
৪ - কাফের-মুরতাদদের সাথে জিহাদ পরিত্যাগ করা, ওদের বন্ধুরুপে গ্রহণ করা এবং ওদের সাথে মিলিত হয়ে মুসলিমদের বিপক্ষে যুদ্ধ করা।
এ পর্বে নামায পরিত্যাগকারী শাসকের বিপক্ষে বিদ্রোহ করার বিষয়ে সহিহ হাদিস ও আলেমদের বক্তব্য তুলে ধরবো ইনশাআল্লাহ। আর আগামী পর্বে এ বিষয়ে কিছু সংশয়ের উত্তর দেওয়া হবে ইনশাঅাল্লাহ। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, আমরা যে আলেমদের বক্তব্য উদ্ধৃত করবো, তারা সবাই হানাফী, মালেকী কিংবা শাফেয়ী মাযহাবের, আর এই তিন মাযহাবে নামায তরক করা কুফরী নয়। বরং শুধু হান্বলী মাযহাবেই নামায তরক করা কুফরী। এরপরও তিনো মাযহাবের আলেমগণ নামায তরককারী শাসকের বিপক্ষে যুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন। সুতরাং এর দ্বারা আমাদের দাবী ‘নামায তরক করা শাসকের বিপক্ষে বিদ্রোহের একটি স্বতন্ত্র ক্ষেত্র’ প্রমাণিত হবে ইনশাআল্লাহ।
عن عوف بن مالك، عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: «خيار أئمتكم الذين تحبونهم ويحبونكم، ويصلون عليكم وتصلون عليهم، وشرار أئمتكم الذين تبغضونهم ويبغضونكم، وتلعنونهم ويلعنونكم»، قيل: يا رسول الله، أفلا ننابذهم بالسيف؟ فقال: «لا، ما أقاموا فيكم الصلاة». رواه مسلم: (1855)
আউফ বিন মালিক রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের মধ্যে উত্তম শাসক হলো তারা, যাদেরকে তোমরা ভালোবাসবে এবং তারাও তোমাদেরকে ভালোবাসবে, তোমরা তাদের জন্য দোয়া করবে তারাও তোমাদের জন্য দোয়া করবে। আর তোমাদের মধ্যে নিকৃষ্ট শাসক হলো তারা, যাদেরকে তোমরা অপছন্দ করবে এবং তারাও তোমাদেরকে অপছন্দ করবে, যাদেরকে তোমরা লা’নত করবে এবং তারাও তোমাদেরকে লা’নত করবে। বলা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি তরবারি দ্বারা তাদের মোকাবেলা করবো না? রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: না, যতদিন তারা তোমাদের মাঝে নামায কায়েম করে। -সহিহ মুসলিম, ১৮৫৫
عن أم سلمة، أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: «إنه يستعمل عليكم أمراء، فتعرفون وتنكرون، فمن كره فقد برئ، ومن أنكر فقد سلم، ولكن من رضي وتابع»، قالوا: يا رسول الله، ألا نقاتلهم؟ قال: «لا، ما صلوا» رواه مسلم: (1854)
উম্মে সালামা রাযিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘এমন কিছু লোককে তোমাদের আমির নিযুক্ত করা হবে যাদের কিছু কাজ তোমাদের কাছে ভালো মনে হবে আর কিছু কাজ মন্দ মনে হবে, (অর্থাৎ ভালো-মন্দ সব কাজই করবে), সুতরাং যে তাদের (মন্দ কাজগুলোকে) অপছন্দ করবে সে মুক্তি পাবে, আর যে প্রতিবাদ করবে সেও মুক্তি পাবে, কিন্তু যে সন্তুষ্টি প্রকাশ করবে, এবং সহযোগিতা করবে সে মুক্তি পাবে না। সাহাবায়ে কেরাম প্রশ্ন করলেন, আমরা কি এমন আমিরদের সাথে যুদ্ধ করবো না, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, যতদিন তারা নামায পড়বে ততদিন তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে না। -সহিহ মুসলিম, ১৮৫৪
১. মালেকী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফকিহ ও মুহাদ্দিস ইমাম ইবনে বাত্তাল রহিমাহুল্লাহ (মৃ: ৪৪৯ হি.) বুখারী শরিফের ভাষ্যগ্রন্থ ‘শরহু সহিহিল বুখারী’তে বলেন,
والذى عليه جمهور الأمة أنه لا يجب القيام عليهم ولا خلعهم إلا بكفرهم بعد الإيمان وتركهم إقامة الصلوات، وأما دون ذلك من الجور فلا يجوز الخروج عليهم . ..وروى الآجرى، عن البغوى، عن القواريرى: حدثنا حكيم بن حزام وكان من عباد الله الصالحين حدثنا عبد الملك بن عمير، عن الربيع بن عميلة، عن ابن مسعود عن النبى صلى الله عليه وسلم قال: سيليكم أمراء يفسدون، وما يصلح الله بهم أكثر، فمن عمل منهم بطاعة الله فله الأجر وعليكم الشكر، ومن عمل منهم بمعصية الله فعليه الوزر وعليكم الصبر. (شرح صحيح البخاري لابن بطال: 5/127 ط. مكتبة الرشد: 1423(
সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমদের মতে শাসক মুরতাদ হয়ে গেলে কিংবা নামায কায়েম করা ছেড়ে দিলেই শুধু তাদের বিপক্ষে বিদ্রোহ করা ও তাদের অপসারিত করা ওয়াজিব হয়। এছাড়া শুধু জুলুম-অত্যাচারের কারণে তাদের বিপক্ষে বিদ্রোহ করা যাবে না, ... ইবনে মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, অচিরেই এমন কিছু আমির তোমাদের দ্বায়িত্ব গ্রহণ করবে, যারা (জুলুম-অত্যাচারের মাধ্যমে) অশান্তি সৃষ্টি করবে, তবে তাদের দ্বারা যতটুকু কল্যাণ হবে তা তাদের দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতির থেকে বেশি, তাদের মধ্যে যারা আল্লাহর আনুগত্য করবে তারা প্রতিদানের হকদার হবে এবং তোমাদের উপর তাদের কৃতজ্ঞতা আদায় করা আবশ্যক হবে, আর যারা আল্লাহর নাফরমানী করবে তারা গুনাহের ভাগীদার হবে, আর এক্ষেত্রে তোমাদের কর্তব্য হবে সবর ও ধৈর্য্যধারণ। -শরহু সহিহিল বুখারী, ৫/১২৭
ইবনে বাত্তাল আরো বলেন,
فى هذه الأحاديث حجة فى ترك الخروج على أئمة الجور، ولزوم السمع والطاعة لهم والفقهاء مجمعون على أن الإمام المتغلب طاعته لازمة، ما أقام الجمعات والجهاد. (شرح صحيح البخاري لابن بطال: 10/8 ط. مكتبة الرشد: 1423)
এ সকল হাদিস প্রমাণ করে জালেম শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে না, বরং তার আনুগত্য করতে হবে, ততদিন পর্যন্ত যতদিন সে জুমুআ কায়েম করবে, এবং জিহাদ জারী রাখবে। -শরহু সহিহিল বুখারী, ১০/৮
২. ইবনে বাত্তাল রহিমাহুল্লাহুর বক্তব্য থেকে সুস্পষ্ট ভাবে বুঝে আসে যে ফাসেক ও জালেম শাসকের বিপক্ষে বিদ্রোহ না করার যে আদেশ হাদিসে দেওয়া হয়েছে তা ঐ শাসকের ক্ষেত্রে যে নামায কায়েম করে, জিহাদ জারী রাখে, এবং তার দ্বারা যে কল্যাণ হয় (যেমন নামায কায়েম করা, মুসলমানদের প্রতিরক্ষা ইত্যাদি) তা তার দ্বারা হওয়া ক্ষতির চেয়ে বেশি। এ বিষয়টিই ইমাম ইবনুল উযির ইয়ামানী রহিমাহুল্লাহু (মৃ: ৮৪০ হি.) তার কালজয়ী গ্রন্থ আররাওযুল বাসিমে স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তিনি বলেন,
ومن ذلك كلام ابن بطّال الذي أورده المعترض، وقد مرّ، وهو على المعترض لا له، فإنّه روى عن الفقهاء أنّهم اشترطوا في طاعة المتغلّب إقامة الجمعات والأعياد، والجهاد، وإنصاف المظلوم غالباً. (الروض الباسم في الذب عن سنة أبي القاسم: 2/384 ط. دار عالم الفوائد)
ইবনে বাত্তালের যে কথার উপর আপত্তিকারী আপত্তি করেছে, সে কথা তো আপত্তিকারীর বিপক্ষেই যায়, কেননা ইবনে বাত্তাল ফুকাহায়ে কেরাম থেকে নকল করেছেন যে, তারা জোরপূর্বক ক্ষমতাদখলকারীর আনুগত্য ওয়াজিব হওয়ার ক্ষেত্রে জুমুআ ও ইদ কায়েম করা, জিহাদ জারী রাখা এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাজলুমের পক্ষে সুবিচার করা ইত্যাদি বিষয়ের শর্ত করেছেন। -আররাওযুল বাসিম, ২/৩৮৪
৩. কাযী ইয়ায রহিমাহুল্লাহ (মৃ: ৫৪৪ হি.) বলেন,
لا خلاف بين المسلمين أنه لا تنعقد الإمامة للكافر، ولا تستديم له إذا طرأ عليه، وكذلك إذا ترك إقامة الصلوات والدعاء إليها، وكذلك عند جمهورهم البدعة. وذهب بعض البصريين إلى أنها تنعقد لها وتستديم على التأويل، فإذا طرأ مثل هذا على وال من كفر أو تغيير شرع أو تأويل بدعة، خرج عن حكم الولاية وسقطت طاعته، ووجب على الناس القيام عليه وخلعه، ونصب إمام عدل أو وال مكانه إن أمكنهم ذلك. (إكمال المعلم: 6/246 ط. دار الوفاء: 1419 ه.)
উলামায়ে কেরাম সবাই এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন যে, কোনো কাফেরকে খলীফা নিযুক্ত করলে সে খলীফা হবে না এবং কোনো খলীফার মাঝে যদি কুফরী প্রকাশ পায়, তাহলে সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অপসারিত হয়ে যাবে। এমনিভাবে শাসক যদি নামায প্রতিষ্ঠা করা অথবা নামাযের দিকে আহবান করা ছেড়ে দেয় (তাহলেও)। তিনি আরও বলেন, জুমহুরের মতে শাসক যদি বিদ‘আত করে (তবে তাদের হুকুম একই)। কতিপয় বসরী আলেমের মত হলো, বিদ‘আতির ইমামত সাব্যস্ত হবে এবং সেটা স্থায়ী হবে, কেননা সে তা’বিলকারী। অতএব শাসক যদি এজাতীয় কাজগুলোর কোন একটি, যেমন, কুফর, শরীয়া পরিবর্তন অথবা বিদ‘আতে লিপ্ত হয়, তবে সে পদচ্যুত হয়ে যাবে এবং তার আনুগত্যের অপরিহার্যতা শেষ হয়ে যাবে। মুসলমানদের উপর ফরজ হবে, সম্ভব হলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা, তাকে অপসারণ করা এবং একজন ন্যায়পরায়ণ খলিফা নিযুক্ত করা, যদি এটা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়। -ইকমালুল মু’লিম, ৬/২৪৬
৪. ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহও (মৃ: ৬৭৬ হি.) কাযী ইয়ায রহিমাহুল্লাহুর উপরোল্লিখিত বক্তব্য সমর্থণ করেছেন। তিনি বলেন,
قال القاضي عياض: أجمع العلماء على أن الإمامة لا تنعقد لكافر، وعلى أنه لو طرأ عليه الكفر انعزل. قال: وكذا لو ترك إقامة الصلوات والدعاء إليها. قال: وكذلك عند جمهورهم البدعة. قال: وقال بعض البصريين: تنعقد له وتستدام له، لأنه متأول. قال القاضي: فلو طرأ عليه كفر وتغيير للشرع أو بدعة خرج عن حكم الولاية وسقطت طاعته، ووجب على المسلمين القيام عليه وخلعه ونصب إمام عادل إن أمكنهم ذلك. (شرح مسلم للنووي: 12/229 ط. دار إحياء التراث العربي: 1392)
কাযী ইয়ায রহিমাহুল্লাহ বলেন, উলামায়ে কেরাম সবাই এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন যে, কোনো কাফেরকে খলীফা নিযুক্ত করলে সে খলীফা হবে না এবং কোনো খলীফার মাঝে যদি কুফরী প্রকাশ পায়, তাহলে সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অপসারিত হয়ে যাবে। তিনি বলেন, এমনিভাবে শাসক যদি নামায প্রতিষ্ঠা করা অথবা নামাযের দিকে আহবান করা ছেড়ে দেয় (তাহলেও)। তিনি আরও বলেন, জুমহুরের মতে শাসক যদি বিদ‘আত করে (তবে তাদের হুকুম একই)। কতিপয় বসরী আলেমের মত হলো, বিদ‘আতির ইমামত সাব্যস্ত হবে এবং সেটা স্থায়ী হবে, কেননা সে তা’বিলকারী। কাযী ইয়ায বলেন, শাসকের উপর যদি কুফর আপতিত হয় এবং সে যদি শরীয়া পরিবর্তন করে অথবা বিদ‘আত করে, তবে সে পদচ্যুত হয়ে যাবে এবং তার আনুগত্যের অপরিহার্যতা শেষ হয়ে যাবে। মুসলমানদের উপর ফরজ হবে, সম্ভব হলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা, তাকে অপসারণ করা এবং একজন ন্যায়পরায়ণ খলিফা নিযুক্ত করা। -শরহু মুসলিম, ১২/২২৯
৫. মুহাদ্দিস আবুল আব্বাস কুরতুবী মালেকী রহিমাহুল্লাহ (মৃ: ৬৫৬ হি.) ‘তালখীসু সহিহি মুসলিম’ নামে সহিহ মুসলিমের একটি সারসংক্ষেপ তৈরী করেন, এরপর আলমুফহিম নামে সেই সংক্ষিপ্তগ্রন্থের শরাহ লিখেন, এই কিতাবে তিনি বলেন,
قوله على المرء المسلم السَّمع والطاعة ظاهر في وجوب السمع والطّاعة للأئمة والأمراء والقضاة، ولا خلاف فيه إذا لم يأمر بمعصية، فإن أمر بمعصية فلا تجوز طاعته في تلك المعصية قولًا واحدًا، ثم إن كانت تلك المعصية كفرًا وَجَبَ خَلعُه على المسلمين كلهم، وكذلك لو ترك إقامة قاعدة من قواعد الدين كإقام الصلاة وصوم رمضان وإقامة الحدود ومَنَع من ذلك، وكذلك لو أباح شرب الخمر والزنا ولم يمنع منها لا يختلف في وجوب خَلعِهِ. (المفهم لما أشكل من تلخيص صحيح مسلم: 4/39 ط. دار ابن كثير: 1497)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, “মুসলিমের উপর শ্রবণ ও আনুগত্য ওয়াজিব”, প্রমাণ করে, মুসলমানদের জন্য ইমাম, আমির ও কাযীর আনুগত্য করা ওয়াজিব, আর এ ব্যাপারে আলেমগণের মাঝে কোন দ্বিমতও নেই, যতক্ষণ না শাসক গুনাহের আদেশ করে। যদি শাসক গুনাহের আদেশ করে তাহলে সর্বসম্মতিক্রমে সে গুনাহের কাজে তার আনুগত্য করা জায়েয হবে না। এখন সেই গুনাহটা যদি কুফর হয়, তাহলে সকল মুসলমানের উপর ফরজ হলো, তাকে অপসারণ করা। এমনিভাবে সে যদি নামায, রমযানের রোযা, হুদুদ তথা দণ্ডবিধির মতো দ্বীনের মৌলিক কোন বিধান প্রতিষ্ঠা করা ছেড়ে দেয় এবং সেগুলো পালনে বাধা দেয়, তদ্রুপ সে যদি মদপান ও যিনাকে বৈধতা দান করে এবং সেগুলো থেকে বারণ না করে, তখনও তার অপসারণ ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। -আলমুফহিম, ৪/৩৯
৬. মুফাসসির আবু আব্দুল্লাহ কুরতুবী রহিমাহুল্লাহ (মৃ: ৬৭১ হি.) বলেন,
الإمام إذا نصب ثم فسق بعد انبرام العقد فقال الجمهور: إنه تنفسخ إمامته ويخلع بالفسق الظاهر المعلوم
وقال آخرون: لا ينخلع إلا بالكفر أو بترك إقامة الصلاة أو الترك إلى دعائها أو شي من الشريعة، لقوله عليه السلام في حديث عبادة: (وألا ننازع الأمر أهله قال: إلا أن تروا كفرا بواحا عندكم من الله فيه برهان وفي حديث عوف بن مالك: (لا ما أقاموا فيكم الصلاة) الحديث. أخرجهما مسلم. وعن أم سلمة عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: (إنه يستعمل عليكم أمراء فتعرفون وتنكرون فمن كره فقد برئ ومن أنكر فقد سلم ولكن من رضي وتابع- قالوا: يا رسول الله ألا نقاتلهم؟ قال: لا ما صلوا أي من كره بقلبه وأنكر بقلبه. أخرجه أيضا مسلم. (الجامع لأحكام القرآن: 1/271 ط. دار الكتب المصرية: 1384)
وقال آخرون: لا ينخلع إلا بالكفر أو بترك إقامة الصلاة أو الترك إلى دعائها أو شي من الشريعة، لقوله عليه السلام في حديث عبادة: (وألا ننازع الأمر أهله قال: إلا أن تروا كفرا بواحا عندكم من الله فيه برهان وفي حديث عوف بن مالك: (لا ما أقاموا فيكم الصلاة) الحديث. أخرجهما مسلم. وعن أم سلمة عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: (إنه يستعمل عليكم أمراء فتعرفون وتنكرون فمن كره فقد برئ ومن أنكر فقد سلم ولكن من رضي وتابع- قالوا: يا رسول الله ألا نقاتلهم؟ قال: لا ما صلوا أي من كره بقلبه وأنكر بقلبه. أخرجه أيضا مسلم. (الجامع لأحكام القرآن: 1/271 ط. دار الكتب المصرية: 1384)
ইমাম ফাসেক হয়ে গেলে সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমদের মতে সে অপসারিত হয়ে যাবে, এবং প্রকাশ্য ও সুবিদিত ফিসকের কারণে তাকে অপসারণ করতে হবে, ….. আর অন্যান্য আলেমদের মতে ইমাম অপসারিত হবে না, যতক্ষণ না সে কুফরে লিপ্ত হয় কিংবা নামায পরিত্যাগ করে, অথবা নামাযের দিকে আহ্বান করা ছেড়ে দেয়, কিংবা শরিয়তের কোন বিধান কায়েম করা ছেড়ে দেয়। কেননা উবাদা বিন সামেতের সূ্ত্রে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের থেকে বাইয়াত নিয়েছেন, আমরা আমিরদের সাথে ক্ষমতা নিয়ে যুদ্ধ করবো না, তবে যদি তোমরা সুস্পষ্ট কুফরী দেখতে পাও, যে ব্যাপারে তোমাদের নিকট আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট দলিল রয়েছে। আউফ বিন মালিকের সূত্রে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, যতদিন তারা তোমাদের মাঝে নামায কায়েম করবে ততদিন তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে না। ইমাম মুসলিম উল্লিখিত হাদিসদ্বয় বর্ণণা করেছেন। উম্মে সালামা রাযিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘এমন কিছু লোককে তোমাদের আমির নিযুক্ত করা হবে যাদের কিছু কাজ তোমাদের কাছে ভালো মনে হবে আর কিছু কাজ মন্দ মনে হবে, (অর্থাৎ ভালো-মন্দ সব কাজই করবে), সুতরাং যে তাদের (মন্দ কাজগুলোকে) অপছন্দ করবে সে মুক্তি পাবে, আর যে প্রতিবাদ করবে সেও মুক্তি পাবে, কিন্তু যে সন্তুষ্টি প্রকাশ করবে, এবং সহযোগিতা করবে সে মুক্তি পাবে না। সাহাবায়ে কেরাম প্রশ্ন করলেন, আমরা কি এমন আমিরদের সাথে যুদ্ধ করবো না, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, যতদিন তারা নামায পড়বে ততদিন তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে না। ... এই হাদিসটিও ইমাম মুসলিম বর্ণণা করেছেন। -তাফসীরে কুরতুবী, ১/২৭১
৭. তাফসীরে বাইযাবীর লেখক ইমাম বাইযাবী রহিমাহুল্লাহ (মৃ: ৬৮৫ হি.) ‘তুহফাতুল আবরার’ নামে ইমাম বাগাভী রচিত হাদিসের কিতাব ‘মাসাবীহুস সুন্নাহ’র একটি ব্যাখাগ্রন্থ রচনা করেছেন, এ কিতাবে উম্মে সালামা রাযিআল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত হাদিসের ব্যাখায় তিনি বলেন,
وإنما مُنع عن مقاتلتهم ما داموا يقيمون الصلاة التي هي عماد الدين، وعنوان الإسلام، والفاروق بين الكفر والإيمان، حذرا من هيج الفتن واختلاف الكلمة، وغير ذلك مما يكون أشد نكاية من احتمال نكرهم والمصابرة على ما ينكرون منهم. (تحفة الأبرار شرح مصابيح السنة: ط. 2/546 وزارة الأوقاف والشؤون الإسلامية بالكويت: 1433 هـ)
নামায হলো দ্বীনের ভিত্তি, ইসলামের পরিচায়ক ও ঈমান-কুফরের মাঝে পার্থক্য, তাই যতদিন পর্যন্ত শাসকরা নামায কায়েম করে ততদিন তাদের বিপক্ষে যুদ্ধ করতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা এক্ষেত্রে তাদের সাথে যুদ্ধ করলে ফিতনা হবে এবং লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে। -তুহফাতুল আবরার, ২/৫৪৬
7. আল্লামা ত্বীবী রহিমাহুল্লাহ (মৃ: ৭৪৩ হি.) মেশকাত শরিফের ভাষ্যগ্রন্থ ‘আলকাশিফ আন হাকায়িকিস সুনানে’ বলেন,
وأجمعوا على أن الإمامةَ لا تنعقدُ لكافر ولو طرأ عليه الكفرُ انعزل، وكذا لو ترك إقامةَ الصلوات والدعاء إليها. (الكاشف عن حقائق السنن: ص: 2560 مكتبة نزار مصطفى الباز. المكة المكرمة)
আহলুস সুন্নাহর উলামাগণ এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন যে, কোনো কাফেরকে খলীফা নিযুক্ত করলে সে খলীফা হবে না এবং কোনো খলীফার মাঝে যদি কুফরী প্রকাশ পায়, তাহলে সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অপসারিত হবে যাবে। এমনিভাবে শাসক যদি নামায প্রতিষ্ঠা করা অথবা নামাযের দিকে আহবান করা ছেড়ে দেয় তাহলেও। -আলকাশেফ আন হাকায়িকিস *সুনান, পৃ: ৮/২৫৬০
৯. শাফেয়ী মাযহাবের শীর্ষস্থানীয় আলেম হাফেয ইবনুল মুলাক্কিন রহিমাহুল্লাহ (মৃ: ৮০৪ হি.) সহিহ বুখারীর শরাহ ‘আততাওযীহ’তে বলেন,
وفي هذِه الأحاديث حُجَّةٌ في ترك الخروج على أئمة الجَوْر ولزومِ السمع والطاعة لهم، والفقهاء يجمعون على أن الإمام المتغلِّبَ طاعتُه لازمةٌ ما أقامَ الجماعاتِ والجهادَ. (التوضيح لشرح الجامع الصحيح: 32/282 ط. دار النوادر: 1429 ه.)
যালেম শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করা এবং তাদের কথা শোনা ও আনুগত্য আবশ্যক হওয়ার প্রমাণ এ হাদীস সমূহে বিদ্যমান রয়েছে। ফুকাহায়ে কেরাম এ ব্যাপারে একমত যে, জোরপূর্বক ক্ষমতা দখলকারী শাসকের আনুগত্য ততদিন আবশ্যক, যতদিন তারা নামাযের জামাত এবং জিহাদ কায়েম রাখে। -আততাওযীহ, ৩২/২৮২
তিনি আরো বলেন
عن ابن عمر رضي الله عنهما عن النبي صلى الله عليه وسلم، قال: «السمع والطاعة حق، ما لم يؤمر بالمعصية، فإذا أمر بمعصية فلا سمع ولا طاعة». احتجَّ بهذا الحديث الخوارجُ، فرأوا الخروجَ على أئمة الجَوْر والقيامَ عليهم عندَ ظُهُور جَوْرِهِم، والذي عليه جُمهوُر الأئمة المنعُ، إلا بكفرهم بعد إيمانهم أو تركِهم إقامةَ الصلواتِ. (التوضيح لشرح الجامع الصحيح: 18/66)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘ইমামের আনুগত্য ওয়াজিব, যতক্ষণ না সে কোন অন্যায় কাজের আদেশ দেয়। যদি সে কোন অন্যায় কাজের আদেশ দেয় তাহলে তার কোন আনুগত্য নেই’। এ হাদীস দ্বারা খারেজীরা দলিল দিয়ে থাকে, ফলে তারা জালেম শাসক থেকে জুলুম প্রকাশ পেলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা এবং তাকে অপসারণ করা জায়েয মনে করে। তবে জুমহুরের মত হলো তা না করা, তবে হাঁ, তারা যদি ঈমান গ্রহণের পর কুফরী করে অথবা নামায কায়েম করা ছেড়ে দেয়, তখন তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে হবে। -আততাওযীহ, ১৮/৬৬
১০. হানাফী মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনুল মালাক রহিমাহুল্লাহ (মৃ: ৮৫৪ হি.) ‘মাসাবীহুস সুন্নাহ’র শরাহ ‘শরহুল মাসাবীহ’তে উম্মে সালামা রাযিআল্লাহু আনহার হাদিসের ব্যাখায় বলেন,
قال: لا، ما أقاموا فيكم الصلاة، لا ما أقاموا فيكم الصلاة" منعه صلى الله عليه وسلم عن ذلك ما داموا مُقِيمي الصلاة الفارقةِ بين الإيمان والكفر، يحذر هيجان الفتنة التي هي أشد من المصابرة على ما ينكر منهم، وفيه دليل على عدم انعزال الإمام بالفسق. (شرح المصابيح لابن ملك: 4/246 ط. إدارة الثقافة الإسلامية: 1433 هـ)
শাসকরা যতদিন পর্যন্ত ইমান ও কুফরের মাঝে পার্থক্যকারী নামায কায়েম করে ততদিন তাদের বিপক্ষে যুদ্ধ করতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন। কেননা এক্ষেত্রে তাদের সাথে যুদ্ধ করলে ফিতনা হবে এবং লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে। এই হাদিস প্রমাণ করে ফিসকের কারণে ইমাম অপসারিত হবে না। -শরহুল মাসাবীহ, ৪/২৪৬
১১. মোল্লা আলী ক্বারী রহ. উম্মে সালামা রাযিআল্লাহু আনহার হাদিসের ব্যাখায় (মৃ: ১০১৪ হি.) বলেন,
(قال: قلنا: يا رسول الله أفلا ننابذهم) أي أفلا نعزلهم ولا نطرح عهدهم ولا نحاربهم (عند ذلك) أي إذا حصل ما ذكر (قال: لا) أي لا تنابذوهم (ما أقاموا فيكم الصلاة) أي مدة إقامتهم الصلاة فيما بينكم ; لأنها علامة اجتماع الكلمة في الأمة، قال الطيبي: فيه إشعار بتعظيم أمر الصلاة وأن تركها موجب لنزع اليد عن الطاعة كالكفر على ما سبق في حديث عبادة: إلا أن تروا كفرا بواحا. (مرقاة المفاتيح: 6/2396 ط. دار الفكر: 1423)
রাবী বলেন, আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সে সময় আমরা কি তাদেরকে সরিয়ে ফেলব না, তাদের সাথে কৃত অঙ্গীকার ছুড়ে ফেলব না, এবং তাদের সাথে লড়াই করব না? তিনি বললেন না, অর্থাৎ যতক্ষণ তারা তোমাদের মাঝে নামায কায়েম করে ততক্ষণ তা করো না। কেননা এটি মুসলিম উম্মাহর ঐক্য বজায় থাকার প্রমাণ বহন করে। আল্লামা ত্বীবী বলেন, উক্ত হাদীসে এ কথার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে যে, নামাযের বিষয়টি অনেক গুরুতর এবং শাসক নামায না পড়লে তার আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে ফেলা আবশ্যক হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে বিষয়টি কুফরি প্রকাশ পাওয়ার মতো। যেমনটি উবাদা বিন ছামেতের ‘তবে যদি তোমরা কুফরি দেখ’ শীর্ষক হাদীসে গত হয়েছে। -মিরকাতুল মাফাতীহ, ৬/২৩৯৬
১২. হিন্দুস্তানের অন্যতম আলেম শায়েখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রহিমাহুল্লাহ (মৃ: ১০৫২ হি.) মিশকাত শরিফের ভাষ্যগ্রন্থ ‘লামাআতুত তানকীহ’তে উম্মে সালামা রাযিআল্লাহু আনহার হাদিসের ব্যাখায় বলেন,
وقوله: (أفلا ننابذهم) بالسيف، وفي المشارق: أي: ندافعهم ونباعدهم بالقتال، انتهى. وفي (مجمع البحار): نبذته: إذا رميته وأبعدته، أي: نقاتلهم. وقوله: (لا) أي: لا تنابذوهم ما أقاموا الصلاة، وفيه أن ترك الصلاة موجب لمنابذتهم، ونزع اليد من طاعتهم؛ لأن الصلاة عماد الدين، والفارق بين الكفر والإيمان بخلاف سائر المعاصي، وفيه تشديد وتهديد عظيم على ترك الصلاة. (لمعات التنقيح: 6/454 ط. دار النوادر: 1435 هـ)
সাহাবায়ে কেরাম প্রশ্ন করলেন, আমরা কি তাদের সাথে যুদ্ধ করবো না? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, যতদিন তারা নামায কায়েম করবে ততদিন তাদের সাথে যুদ্ধ করবে না। এ হাদিস প্রমাণ করে, নামায ছেড়ে দেওয়ার কারণে শাসকদের সাথে যুদ্ধ ও তাদের আনুগত্য পরিহার করা ওয়াজিব হয়ে যায়, কেননা নামায হলো দ্বীনের ভিত্তি এবং ঈমান-কুফরের মাঝে পার্থক্যকারী বিষয়। কিন্তু অন্যান্য গুনাহের বিষয়টা নামাযের মত নয়। (তাই অন্যান্য গুনাহের কারণে ইমামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে না। হাদিস থেকে নামাযের গুরুত্ব ও নামাযের পরিত্যাগের ভয়াবহ পরিণতি বুঝে আছে। -লামাআতুত তানকীহ, ৬/৪৫৪
১৩. ইমাম নববীর অমরগ্রন্থ ‘রিয়াযুস সালিহিন’ আমরা সবাই চিনি। মুহাক্কিক আলেমদের নিকট এ কিতাবের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য শরাহ হলো আল্লামা ইবনে আল্লান দিমাশকী শাফেয়ী রহ. (মৃত্যু ১০৫৭ হি.) রচিত ‘দালিলুল ফালিহীন’, এ কিতাবে উম্মে সালামা রাযিআল্লাহু আনহার হাদিসের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন-
(قال: قلنا: يا رسول الله، أفلا ننابدهم) أي أنطيعهم على سوء وصفهم المذكور، فلا ننابذهم، أي نخالفهم بترك الطاعة لهم (قال: لا) أي: لا تنابذوهم (ما) مصدرية ظرفية (أقاموا فيكم الصلاة) أي مدة إقامتهم لها فيكم، وفيه دليل تعظيم الصلاة. ويؤخذ منه: أن ترك إقامة الصلاة كالكفر البواح لقوله في حديث عبادة: «لا إلا أن تروا كفرا بواحا». وقد تقدم في باب الأمر بالمعروف، وكذا تقدم فيه من حديث أم سلمة: «قالوا: يا رسول الله، ألا نقاتلهم؟ قال: لا، ما أقاموا فيكم الصلاة». رواه مسلم، وبه يتبين تفسير ننابذهم في حديث الباب، لأن تفسير السنة بالسنة أولى، وفي المصباح: نابذته الحرب: كاشفته إياها وجاهرته بها. (دليل الفالحين :5/124 ط. دار المعرفة: 1425 هـ)
হে আল্লাহর রাসূল তারা এত খারাপ হওয়া সত্ত্বেও কি আমরা তাদের আনুগত্য করবো, না কি তাদের আনুগত্য পরিহার করে তাদের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হবো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, যতদিন তারা তোমাদের মাঝে নামায কায়েম করে তোমরা তাদের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ো না। এ হাদীস থেকে নামাযের গুরুত্ব বোঝা যায়। এথেকে এও বোঝা যায় যে, নামায প্রতিষ্ঠা ছেড়ে দেওয়া কুফরে বাওয়াহের মতই। কেননা উবাদা রাযি. এর হাদীসে এসেছে ‘ততক্ষণ কিতাল করবে না, যতক্ষণ না কুফরে বাওয়াহ দেখতে পাবে’। আমর বিল মারুফের অধ্যায়ে এই হাদিসটি গত হয়েছে এবং সেখানে উম্মে সালামা রাযিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হাদিসটিও অতিবাহিত হয়েছে, ‘সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আমরা কি তাদের সাথে যুদ্ধ করবো না? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, যতদিন তারা নামায কায়েম করবে ততদিন তাদের সাথে যুদ্ধ করবে না’ সহিহ মুসলিম। এই হাদিস দ্বারা বুঝে আসে, আমাদের আলোচ্য হাদিসে منابذة (দ্বন্দ্ব) দ্বারা যুদ্ধ উদ্দেশ্য। কেননা হাদিসের ব্যাখা হাদিস দ্বারা করাই উত্তম। -দালিলুল ফালিহীন, ৫/১২৪
চলবে ইনশাআল্লাহ
Comment