ইলম অর্জনের পদ্ধতি : কিছু প্রয়োজনীয় কথা
আবদুল্লাহ আবু মুহাম্মাদ
ইসলামে দ্বীনী ইলম অর্জনের অবকাশ সবার জন্য উন্মুক্ত। যে কোনো বংশের লোক, যে কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ, যে কোনো অঞ্চলের অধিবাসী কুরআন-সুন্নাহর ইলম অর্জন করতে পারেন; বরং ইসলামে তা কাম্য। কুরআন-সুন্নাহয় এ বিষয়ে উৎসাহিত করা হয়েছে।
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللهُ لَهُ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ
যে কেউ ইলমের খোঁজে কোনো পথে চলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন। -মুসনাদে আহমদ ১৪/৬৬
ইমাম তিরমিযী রাহ. এ হাদীসের উপর শিরোনাম দিয়েছেন باب ما جاء في فضل الفقه অর্থাৎ ‘ফিকহের (দ্বীনের সহীহ সমঝ) মর্যাদা সংক্রান্ত বর্ণনা’।
দ্বীনী ইলম অর্জনের এই সাধারণ সুযোগ ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্য উপলব্ধি করা যাবে যদি এ বিষয়ে অন্যান্য সম্প্রদায়ের ধর্ম-গ্রন্থ ও ধর্মীয় বিধিবিধান সম্পর্কে জানা শোনা থাকে। ইসলামের আরেক সৌন্দর্য হচ্ছে দ্বীনী ইলমের চর্চা ও গবেষণার ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা রোধ। ইসলাম একদিকে যেমন ইলম অর্জনের সুযোগ সবার জন্য উন্মুক্ত করেছে অন্যদিকে সঠিক উপায়ে ইলম অর্জন না করে দ্বীনী বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়াকে চরম অপরাধ সাব্যস্ত করেছে। সুতরাং ইসলামে ইলমের ক্ষেত্রে যেমন ব্রাহ্মন্যবাদ বা শ্রেণিবিশেষের ইজারাদারি নেই তেমনি অরাজকতা বা অযোগ্য লোকের অনুপ্রবেশেরও সুযোগ নেই। এই দুই প্রান্তিকতার মাঝে যে ভারসাম্যপূর্ণ নীতি সেটিই ইসলামী নীতি- ইলম অর্জনের সুযোগ সবার জন্য অবারিত আর সঠিক উপায়ে ইলম অর্জন ছাড়া ইলমী সিদ্ধান্ত দেওয়া নিষিদ্ধ।
ইলম অর্জনের সঠিক পদ্ধতি
দ্বীনী ইলম অর্জনের সঠিক পদ্ধতি হচ্ছে, আলিমগণের নিকট থেকে ইলম অর্জন করা।
হযরত আবু উমামা রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের বললেন-
خُذُوا الْعِلْمَ قَبْلَ أَنْ يَذْهَبَ
‘ইলম অর্জন কর তা বিদায় নেওয়ার আগে’। সাহাবীগণ আরয করলেন-
وَكَيْفَ يَذْهَبُ الْعِلْمُ يَا نَبِيَّ اللَّهِ، وَفِينَا كِتَابُ اللَّهِ؟
আল্লাহর নবী! ইলম কীভাবে বিদায় নেবে, আমাদের মাঝে তো রয়েছে আল্লাহর কিতাব?
বর্ণনাকারী বলেন, এ কথায় তিনি রুষ্ট হলেন। এরপর বললেন-
ثَكِلَتْكُمْ أُمَّهَاتُكُمْ أَوَلَمْ تَكُنِ التَّوْرَاةُ وَالْإِنْجِيلُ فِي بَنِي إِسْرَائِيلَ، فَلَمْ يُغْنِيَا عَنْهُمْ شَيْئًا؟ إِنَّ ذَهَابَ الْعِلْمِ أَنْ يَذْهَبَ حَمَلَتُهُ، إِنَّ ذَهَابَ الْعِلْمِ أَنْ يَذْهَبَ حَمَلَتُهُ
তোমাদের মরণ হোক! বনী ইসরাইলের মাঝে কি তাওরাত ও ইঞ্জীল ছিল না, কিন্তু এতে তো তাদের কোনোই উপকার হল না! ইলমের প্রস্থানের অর্থ তার বাহকগণের প্রস্থান। -মুসনাদে আহমদ ৫/২৬৬; আদদারেমী ১/৮৬, হাদীস ২৪৫
হাদীসের শুরুতে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন ‘ইলম গ্রহণ কর তা বিদায় নেওয়ার আগে’। এরপর ‘ইলম বিদায় নেওয়ার’ অর্থ ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ইলম বিদায় নেওয়ার অর্থ আলিমগণের বিদায় নেওয়া। তাহলে এ হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইলমের বাহক তথা আলিমগণের নিকট থেকে ইলম গ্রহণ করতে বলেছেন।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ শিক্ষার প্রতিধ্বনি আমরা শুনতে পাই তাঁর সাহাবীগণের কণ্ঠে।
হযরত আবুদ দারদা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
مَا لِي أَرَى عُلَمَاءَكُمْ يَذْهَبُونَ وَجُهَّالَكُمْ لَا يَتَعَلَّمُونَ؟ تعلَّموا قَبْلَ أَنْ يُرْفَعَ الْعِلْمُ، فَإِنَّ رَفْعَ الْعِلْمِ ذَهَابُ الْعُلَمَاءِ
হায়! তোমাদের আলিমগণ বিদায় নিচ্ছেন কিন্তু তোমাদের বে-ইলম শ্রেণি ইলম অর্জন করছে না। ইলম উঠিয়ে নেওয়ার আগেই ইলম হাসিল কর। ইলম উঠিয়ে নেওয়ার অর্থ আলিমদের প্রস্থান। -আদ দারেমী ২৫১
শুধু একটি উদাহরণ দেওয়া হল। হাদীসের কিতাবে এরকম আরো অনেক উদাহরণ রয়েছে।
এটি হচ্ছে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপরোক্ত হাদীসের একটি শিক্ষা। ঐ হাদীস থেকে দ্বিতীয় যে বিষয়টি জানা যাচ্ছে, তা হচ্ছে, শুধু গ্রন্থ নির্ভুল ইলমের জামিন নয় এবং শুধু গ্রন্থ-নির্ভরতা ইলম অর্জনের সঠিক উপায় নয়। এমনকি তা আসমানী কিতাব হলেও না। এ ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক জ্বলন্ত বাস্তবতার- তাওরাত ও ইঞ্জিলের উদাহরণ দান করেছেন। বনু ইসরাইলের মাঝে তো তাওরাত ও ইঞ্জিল ছিল। কিন্তু যোগ্য বাহকগণের বিদায় নেওয়ার পর তাদের সুযোগ্য উত্তরসূরীর অভাবে শুধু তাওরাত-ইঞ্জিলের আসমানী ইলম থেকেই ঐ জাতি বঞ্চিত হয়নি খোদ তাওরাত-ইঞ্জিলের মূল পাঠই হারিয়ে গেছে এবং এর মর্ম ও শিক্ষাও চরম বিকৃতির শিকার হয়েছে। এমনই হয়। কিতাবের যথার্থ শিক্ষা গ্রহণে যদি মানব-মস্তিষ্ক ব্যর্থ হয় এবং কিতাবের আলোয় তার হৃদয় ও কর্ম সংশোধিত না হয় তখন ঐ পাঠক নিজের চিন্তা ও রুচির আলোকে কিতাব ‘সংশোধনে’ প্রয়াসী হয়ে ওঠে। এভাবে এবং আরো বিভিন্নভাবে তাহরীফ ও বিকৃতির সূত্রপাত ঘটে। আর এতো বলাই বাহুল্য যে, কিতাবের সঠিক মর্ম ও শিক্ষা অনুধাবন ও গ্রহণের জন্য এমন প্রাজ্ঞ ও আদর্শ শিক্ষকের প্রয়োজন যিনি হবেন সব অর্থে ঐ কিতাবের বাহক। নতুবা কিতাব জ্ঞান ও আলোর সূত্র হওয়া সত্তে¡ও গ্রহণের উপায় সঠিক না হওয়ার কারণে কিতাবের পাঠক কিতাবের আলো থেকে বঞ্চিত থাকবে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, শুধু ব্যক্তিগত অধ্যয়ন ইলম অর্জনের সঠিক পদ্ধতি নয়। এ প্রসঙ্গে আরেকটি হাদীস লক্ষ করুন।
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
মানুষের উপর এমন এক যুগের আগমন ঘটবে যখন অনেক হবে পাঠকের সংখ্যা আর হ্রাস পাবে ফকীহের সংখ্যা আর ইলম তুলে নেওয়া হবে ও রক্তপাত ছড়িয়ে পড়বে। -আলমুজামুল আওসাত তবারানী, হাদীস ৩২৭৭; আলমুসতাদরাক হাকীম ৪/৪৫৭, হাদীস ৮৪১২
এ হাদীসে দুটো শব্দ আছে : القراء (আলকুররা) এটি قارئ(কারিউন) শব্দের বহুবচন। কারিউন মানে পাঠক। الفقهاء (আলফুকাহা) এটি فقيه (ফকীহুন) শব্দের বহুবচন। فقيه অর্থ বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ। তাহলে এ হাদীসে বলা হয়েছে, ‘অনেক হবে পাঠকের সংখ্যা আর হ্রাস পাবে বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞের সংখ্যা।’ এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, পাঠমাত্রই বিজ্ঞতা নয় এবং পাঠকমাত্রই বিজ্ঞ নয়। এ এমন এক বাস্তবতা যা উপলব্ধি করা খুবই প্রয়োজন। বিষয়টি সব যুগেই প্রাসঙ্গিক ছিল। এখন তা আরো প্রাসঙ্গিক।
এ হাদীসে পাঠকের সংখ্যা অনেক হওয়ার সাথে আরো বলা হয়েছে, ‘ইলম তুলে নেওয়া হবে’। ইলম তুলে নেওয়ার অর্থ ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে। ঐ অর্থ অনুসারে এ হাদীস থেকে জানা যাচ্ছে যে, পাঠকমাত্রই ইলমের বাহক নয়।
এ হাদীসে আরো বলা হয়েছে, ‘রক্তপাত ছড়িয়ে পড়বে’। বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ আলিমের তিরোধানের সাথে এ প্রসঙ্গটির সম্পর্ক যে কত গভীর তা জ্ঞানীমাত্রই উপলব্ধি করবেন।
এ হাদীসে যে শিক্ষা এসেছে তার প্রতিধ্বনি শুনুন সালাফের কণ্ঠে :
ইমাম শাফেয়ী রাহ. বলেছেন-
مَنْ تَفَقَّهَ مِنْ الْكُتُبِ ضَيَّعَ الْأَحْكَامَ
যে (শুধু) বইপত্র থেকে ফিকহ অর্জন করে সে (শরীয়তের) বিধিবিধান ধ্বংস করে।- আলমাজমু’ শরহুল মুহায্যাব ১/৩৮
এ কথা বলার অধিকার তো তাঁর মতো ব্যক্তিদেরই রয়েছে। ইমাম শাফেয়ী রাহ.-এর ইন্তিকাল ২০৪ হিজরীতে। কত আগে, সেই হিজরী তৃতীয় শতকের শুরুতে তিনি এই জ্ঞানগত অনাচার সম্পর্কে বলেছেন এবং এর সূত্র নির্দেশ করেছেন।
সালাফের এক জ্ঞানী ব্যক্তির বাস্তবসম্মত উক্তি- من اعظم البلية تشيخ الصحيفة
‘শুধু বই-পত্র উস্তাযে পরিণত হওয়া এক মহাবিপদ।’
কিছু সাধারণ মানুষ নিজেদের একজনকে নেতা বানিয়ে দ্বীনী-ব্যাখ্যা ও বিধিবিধানের মজলিস কায়েম করা ভুল
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
إِنَّ اللَّهَ لاَ يَقْبِضُ العِلْمَ انْتِزَاعًا يَنْتَزِعُهُ مِنَ العِبَادِ، وَلَكِنْ يَقْبِضُ العِلْمَ بِقَبْضِ العُلَمَاءِ، حَتَّى إِذَا لَمْ يُبْقِ عَالِمًا اتَّخَذَ النَّاسُ رُءُوسًا جُهَّالًا، فَسُئِلُوا فَأَفْتَوْا بِغَيْرِ عِلْمٍ، فَضَلُّوا وَأَضَلُّوا
আল্লাহ তাআলা এলমকে এমন ভাবে তুলে নিবেন না যে বান্দাদের (অন্তর) থেকে তা তুলে নিলেন; বরং ইলমকে তুলে নিবেন আলিমদের তুলে নেওয়ার মাধ্যমে। অবশেষে যখন আলিম থাকবে না তখন লোকেরা বেইলম লোকদের নেতা বানাবে আর তারা ইলম ছাড়া ফতোয়া দিবে। ফলে নিজেরা গোমরাহ হবে, অন্যদের গোমরাহ করবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১০০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩
আজকাল কিছু সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত ও নানা পেশায় নিয়োজিত লোকদের মাঝে এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তারা নিজেরা নিজেরা দ্বীনী বিধান নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করেছেন এবং খেয়াল খুশি মতো নতুন নতুন সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। একশ্রেণির তরুণের মধ্যেও এ প্রবণতা আছে। বলাবাহুল্য, এ কর্মপন্থাও উপরোক্ত হাদীসে উল্লেখিত ঐ নিন্দিত কর্মপন্থার মধ্যে পড়ে। এ জাতীয় ‘গবেষণা’র বা আলোচনার পরিণাম ইলম নয়, গোমরাহী। এভাবে দ্বীনী-ইলম অর্জন করা যায় না।
ইমাম আবু হানীফা রাহ.কে জানানো হল যে,
في مسجد كذا حلقة يتناظرون في الفقه
‘অমুক মসজিদে কিছু লোক একত্র হয়ে ফিকহ বিষয়ে আলোচনা করে।’
তিনি জিজ্ঞাসা করলেন- ألهمْ رأس ؟
তাদের কোনো মাথা (শিক্ষক) আছে কি?
বলা হল - لا
জ্বী না।
তিনি বললেন,
لا يفقهونَ أبداً
‘এরা কখনো ফিকহ অর্জনে সমর্থ হবে না।’
এখানে ‘শিক্ষক’ মানে সত্যিই যিনি শিক্ষক হওয়ার উপযুক্ত।
দ্বীনের ব্যাখ্যা ও বিধান জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত লোকের নিকট থেকে গ্রহণ করা ভুল
জনৈক সাহাবী আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যখন আমানত বিনষ্ট করা হবে তখন কিয়ামতের অপেক্ষা কর। প্রশ্নকারী জিজ্ঞাসা করলেন, আমানত কীভাবে বিনষ্ট করা হয়? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
إِذَا وُسِّدَ الأَمْرُ إِلَى غَيْرِ أَهْلِهِ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ
যখন অযোগ্য লোকের উপর কর্মের ভার অর্পণ করা হবে তখন কেয়ামতের অপেক্ষা কর। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯
এক বিষয়ের পণ্ডিত অন্য বিষয়ে অযোগ্য। একজন চিকিৎসক চিকিৎসা-বিদ্যায় যোগ্য হলেও প্রকৌশল শাস্ত্রে অযোগ্য। একজন প্রকৌশলী প্রকৌশল-বিষয়ে যোগ্য হলেও চিকিৎসা-শাস্ত্রে অযোগ্য। সুতরাং বিশেষ কোনো শাস্ত্রে পারদর্শী ব্যক্তির কাছে অন্য শাস্ত্রের সমাধান চাওয়া অযোগ্য লোকের উপর কর্মের ভার অর্পণ করার মধ্যেই পড়ে। এতো হল ভার অর্পণ করা। ভার গ্রহণ করা সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা দেখুন : সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম-এ হাদীস আছে যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কারো নিকট থেকে বাইআত নিতেন তখন এই অঙ্গিকারও নিতেন যে, الاننازع الامر أهله আমরা দায়িত্বশীল (ও যোগ্য) লোকের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিবাদ করব না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৭০৫৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৭০৯/৪১
দ্বীনের বিষয়ের সিদ্ধান্ত দ্বীনী বিষয়ে পারদর্শী ব্যক্তিদের উপর না ছেড়ে সাধারণ লোকদের অনুপ্রবেশ এই নিন্দিত বিবাদের শামিল।
উল্লেখ্য যে, এখানে দ্বীনী বিষয়ে ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্ত দেয়ার কথা বলা হচ্ছে, দ্বীনের সর্বজনবিদিত বিষয়াদি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করা এবং যা সবারই জানা আছে এমন সহজ-সরল বিষয়গুলো কর্মে ও আমলে আনার জন্য আলোচনার কথা বলা হচ্ছে না। এটা কুরআন-সুন্নাহর ভাষায় ‘তাযকীর’ অর্থাৎ স্মরণ করানো, ‘ইফতা’ বা ফতোয়া দান নয়।
দ্বীনী বিষয়ে ফতোয়া বা সিদ্ধান্ত যেমন জাগতিক বিষয়ের লোকদের নিকট থেকে নেওয়া ভুল তেমনি দ্বীনী ক্ষেত্রেও এক শাস্ত্রের বিষয় অন্য শাস্ত্রের লোকের নিকট থেকে নেওয়া ভুল। অনেকে ওয়ায়েজ বা আলোচকমাত্রকেই আলিম ও ফকীহ মনে করেন। অথচ দু’টো সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। হাঁ, কারো মধ্যে দু’টো বৈশিষ্ট্যই থাকতে পারে। তিনি ওয়ায়েজ বা আলোচকও আবার বিজ্ঞ আলিম ও ফকীহও। কিন্তু ওয়ায়েজ বা আলোচকমাত্রকেই আলিম ও ফকীহ মনে করা ঠিক নয়।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন-
إِنَّكُمْ فِي زَمَانٍ: كَثِيرٌ فُقَهَاؤُهُ، قَلِيلٌ خُطَبَاؤُهُ، قَلِيلٌ سُؤَّالُهُ، كَثِيرٌ مُعْطُوهُ، الْعَمَلُ فِيهِ قَائِدٌ لِلْهَوَى. وَسَيَأْتِي مِنْ بَعْدِكُمْ زَمَانٌ: قَلِيلٌ فُقَهَاؤُهُ، كَثِيرٌ خُطَبَاؤُهُ، كَثِيرٌ سُؤَّالُهُ، قَلِيلٌ مُعْطُوهُ، الْهَوَى فِيهِ قَائِدٌ لِلْعَمَلِ، اعْلَمُوا أَنَّ حُسْنَ الْهَدْيِ، فِي آخِرِ الزَّمَانِ، خَيْرٌ مِنْ بَعْضِ الْعَمَلِ
তোমরা এমন যুগে রয়েছ, যে যুগে আলিম বেশি, বক্তা ও আলোচক কম। যাঞ্চাকারী কম, দানকারী বেশি। এ যুগে কর্ম হচ্ছে প্রবৃত্তির পরিচালক। কিন্তু তোমাদের পরে অচিরেই এমন এক যুগ আসছে যখন ফকীহ হবে কম আর বক্তা হবে বেশি। অনেক হবে যাঞ্চাকারী, কম হবে দানকারী। ঐ সময় প্রবৃত্তি হবে কর্মের নিয়ন্ত্রক।... -আল আদাবুল মুফরাদ, বুখারী হাদীস ৭৮৯;
সুতরাং দ্বীনী ক্ষেত্রেও কোন বিষয় কার নিকট থেকে গ্রহণ করার সে সম্পর্কে সচেতন হওয়া কাম্য। মনে রাখতে হবে, ওয়ায়েজ বা আলোচক মাত্রই বিজ্ঞ-আলিম ও ফকীহ হওয়া অনিবার্য নয়। সুতরাং কোনো কুশলী আলোচকের সুন্দর উপস্থাপনার কারণে আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে উদাসীন হওয়ার সুযোগ নেই।
এ লেখার শিরোনাম অনেক দীর্ঘ আলোচনার দাবি রাখে। আপাতত দু’চারটি কথা কল্যাণকামিতার প্রেরণা থেকে লেখা হল। আরো জানার ও বোঝার প্রয়োজন হলে কোনো বিজ্ঞ আলিমের সাহচর্য গ্রহণ করা উচিত।
আবদুল্লাহ আবু মুহাম্মাদ
ইসলামে দ্বীনী ইলম অর্জনের অবকাশ সবার জন্য উন্মুক্ত। যে কোনো বংশের লোক, যে কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ, যে কোনো অঞ্চলের অধিবাসী কুরআন-সুন্নাহর ইলম অর্জন করতে পারেন; বরং ইসলামে তা কাম্য। কুরআন-সুন্নাহয় এ বিষয়ে উৎসাহিত করা হয়েছে।
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللهُ لَهُ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ
যে কেউ ইলমের খোঁজে কোনো পথে চলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন। -মুসনাদে আহমদ ১৪/৬৬
ইমাম তিরমিযী রাহ. এ হাদীসের উপর শিরোনাম দিয়েছেন باب ما جاء في فضل الفقه অর্থাৎ ‘ফিকহের (দ্বীনের সহীহ সমঝ) মর্যাদা সংক্রান্ত বর্ণনা’।
দ্বীনী ইলম অর্জনের এই সাধারণ সুযোগ ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্য উপলব্ধি করা যাবে যদি এ বিষয়ে অন্যান্য সম্প্রদায়ের ধর্ম-গ্রন্থ ও ধর্মীয় বিধিবিধান সম্পর্কে জানা শোনা থাকে। ইসলামের আরেক সৌন্দর্য হচ্ছে দ্বীনী ইলমের চর্চা ও গবেষণার ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা রোধ। ইসলাম একদিকে যেমন ইলম অর্জনের সুযোগ সবার জন্য উন্মুক্ত করেছে অন্যদিকে সঠিক উপায়ে ইলম অর্জন না করে দ্বীনী বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়াকে চরম অপরাধ সাব্যস্ত করেছে। সুতরাং ইসলামে ইলমের ক্ষেত্রে যেমন ব্রাহ্মন্যবাদ বা শ্রেণিবিশেষের ইজারাদারি নেই তেমনি অরাজকতা বা অযোগ্য লোকের অনুপ্রবেশেরও সুযোগ নেই। এই দুই প্রান্তিকতার মাঝে যে ভারসাম্যপূর্ণ নীতি সেটিই ইসলামী নীতি- ইলম অর্জনের সুযোগ সবার জন্য অবারিত আর সঠিক উপায়ে ইলম অর্জন ছাড়া ইলমী সিদ্ধান্ত দেওয়া নিষিদ্ধ।
ইলম অর্জনের সঠিক পদ্ধতি
দ্বীনী ইলম অর্জনের সঠিক পদ্ধতি হচ্ছে, আলিমগণের নিকট থেকে ইলম অর্জন করা।
হযরত আবু উমামা রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের বললেন-
خُذُوا الْعِلْمَ قَبْلَ أَنْ يَذْهَبَ
‘ইলম অর্জন কর তা বিদায় নেওয়ার আগে’। সাহাবীগণ আরয করলেন-
وَكَيْفَ يَذْهَبُ الْعِلْمُ يَا نَبِيَّ اللَّهِ، وَفِينَا كِتَابُ اللَّهِ؟
আল্লাহর নবী! ইলম কীভাবে বিদায় নেবে, আমাদের মাঝে তো রয়েছে আল্লাহর কিতাব?
বর্ণনাকারী বলেন, এ কথায় তিনি রুষ্ট হলেন। এরপর বললেন-
ثَكِلَتْكُمْ أُمَّهَاتُكُمْ أَوَلَمْ تَكُنِ التَّوْرَاةُ وَالْإِنْجِيلُ فِي بَنِي إِسْرَائِيلَ، فَلَمْ يُغْنِيَا عَنْهُمْ شَيْئًا؟ إِنَّ ذَهَابَ الْعِلْمِ أَنْ يَذْهَبَ حَمَلَتُهُ، إِنَّ ذَهَابَ الْعِلْمِ أَنْ يَذْهَبَ حَمَلَتُهُ
তোমাদের মরণ হোক! বনী ইসরাইলের মাঝে কি তাওরাত ও ইঞ্জীল ছিল না, কিন্তু এতে তো তাদের কোনোই উপকার হল না! ইলমের প্রস্থানের অর্থ তার বাহকগণের প্রস্থান। -মুসনাদে আহমদ ৫/২৬৬; আদদারেমী ১/৮৬, হাদীস ২৪৫
হাদীসের শুরুতে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন ‘ইলম গ্রহণ কর তা বিদায় নেওয়ার আগে’। এরপর ‘ইলম বিদায় নেওয়ার’ অর্থ ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ইলম বিদায় নেওয়ার অর্থ আলিমগণের বিদায় নেওয়া। তাহলে এ হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইলমের বাহক তথা আলিমগণের নিকট থেকে ইলম গ্রহণ করতে বলেছেন।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ শিক্ষার প্রতিধ্বনি আমরা শুনতে পাই তাঁর সাহাবীগণের কণ্ঠে।
হযরত আবুদ দারদা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
مَا لِي أَرَى عُلَمَاءَكُمْ يَذْهَبُونَ وَجُهَّالَكُمْ لَا يَتَعَلَّمُونَ؟ تعلَّموا قَبْلَ أَنْ يُرْفَعَ الْعِلْمُ، فَإِنَّ رَفْعَ الْعِلْمِ ذَهَابُ الْعُلَمَاءِ
হায়! তোমাদের আলিমগণ বিদায় নিচ্ছেন কিন্তু তোমাদের বে-ইলম শ্রেণি ইলম অর্জন করছে না। ইলম উঠিয়ে নেওয়ার আগেই ইলম হাসিল কর। ইলম উঠিয়ে নেওয়ার অর্থ আলিমদের প্রস্থান। -আদ দারেমী ২৫১
শুধু একটি উদাহরণ দেওয়া হল। হাদীসের কিতাবে এরকম আরো অনেক উদাহরণ রয়েছে।
এটি হচ্ছে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপরোক্ত হাদীসের একটি শিক্ষা। ঐ হাদীস থেকে দ্বিতীয় যে বিষয়টি জানা যাচ্ছে, তা হচ্ছে, শুধু গ্রন্থ নির্ভুল ইলমের জামিন নয় এবং শুধু গ্রন্থ-নির্ভরতা ইলম অর্জনের সঠিক উপায় নয়। এমনকি তা আসমানী কিতাব হলেও না। এ ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক জ্বলন্ত বাস্তবতার- তাওরাত ও ইঞ্জিলের উদাহরণ দান করেছেন। বনু ইসরাইলের মাঝে তো তাওরাত ও ইঞ্জিল ছিল। কিন্তু যোগ্য বাহকগণের বিদায় নেওয়ার পর তাদের সুযোগ্য উত্তরসূরীর অভাবে শুধু তাওরাত-ইঞ্জিলের আসমানী ইলম থেকেই ঐ জাতি বঞ্চিত হয়নি খোদ তাওরাত-ইঞ্জিলের মূল পাঠই হারিয়ে গেছে এবং এর মর্ম ও শিক্ষাও চরম বিকৃতির শিকার হয়েছে। এমনই হয়। কিতাবের যথার্থ শিক্ষা গ্রহণে যদি মানব-মস্তিষ্ক ব্যর্থ হয় এবং কিতাবের আলোয় তার হৃদয় ও কর্ম সংশোধিত না হয় তখন ঐ পাঠক নিজের চিন্তা ও রুচির আলোকে কিতাব ‘সংশোধনে’ প্রয়াসী হয়ে ওঠে। এভাবে এবং আরো বিভিন্নভাবে তাহরীফ ও বিকৃতির সূত্রপাত ঘটে। আর এতো বলাই বাহুল্য যে, কিতাবের সঠিক মর্ম ও শিক্ষা অনুধাবন ও গ্রহণের জন্য এমন প্রাজ্ঞ ও আদর্শ শিক্ষকের প্রয়োজন যিনি হবেন সব অর্থে ঐ কিতাবের বাহক। নতুবা কিতাব জ্ঞান ও আলোর সূত্র হওয়া সত্তে¡ও গ্রহণের উপায় সঠিক না হওয়ার কারণে কিতাবের পাঠক কিতাবের আলো থেকে বঞ্চিত থাকবে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, শুধু ব্যক্তিগত অধ্যয়ন ইলম অর্জনের সঠিক পদ্ধতি নয়। এ প্রসঙ্গে আরেকটি হাদীস লক্ষ করুন।
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
মানুষের উপর এমন এক যুগের আগমন ঘটবে যখন অনেক হবে পাঠকের সংখ্যা আর হ্রাস পাবে ফকীহের সংখ্যা আর ইলম তুলে নেওয়া হবে ও রক্তপাত ছড়িয়ে পড়বে। -আলমুজামুল আওসাত তবারানী, হাদীস ৩২৭৭; আলমুসতাদরাক হাকীম ৪/৪৫৭, হাদীস ৮৪১২
এ হাদীসে দুটো শব্দ আছে : القراء (আলকুররা) এটি قارئ(কারিউন) শব্দের বহুবচন। কারিউন মানে পাঠক। الفقهاء (আলফুকাহা) এটি فقيه (ফকীহুন) শব্দের বহুবচন। فقيه অর্থ বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ। তাহলে এ হাদীসে বলা হয়েছে, ‘অনেক হবে পাঠকের সংখ্যা আর হ্রাস পাবে বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞের সংখ্যা।’ এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, পাঠমাত্রই বিজ্ঞতা নয় এবং পাঠকমাত্রই বিজ্ঞ নয়। এ এমন এক বাস্তবতা যা উপলব্ধি করা খুবই প্রয়োজন। বিষয়টি সব যুগেই প্রাসঙ্গিক ছিল। এখন তা আরো প্রাসঙ্গিক।
এ হাদীসে পাঠকের সংখ্যা অনেক হওয়ার সাথে আরো বলা হয়েছে, ‘ইলম তুলে নেওয়া হবে’। ইলম তুলে নেওয়ার অর্থ ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে। ঐ অর্থ অনুসারে এ হাদীস থেকে জানা যাচ্ছে যে, পাঠকমাত্রই ইলমের বাহক নয়।
এ হাদীসে আরো বলা হয়েছে, ‘রক্তপাত ছড়িয়ে পড়বে’। বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ আলিমের তিরোধানের সাথে এ প্রসঙ্গটির সম্পর্ক যে কত গভীর তা জ্ঞানীমাত্রই উপলব্ধি করবেন।
এ হাদীসে যে শিক্ষা এসেছে তার প্রতিধ্বনি শুনুন সালাফের কণ্ঠে :
ইমাম শাফেয়ী রাহ. বলেছেন-
مَنْ تَفَقَّهَ مِنْ الْكُتُبِ ضَيَّعَ الْأَحْكَامَ
যে (শুধু) বইপত্র থেকে ফিকহ অর্জন করে সে (শরীয়তের) বিধিবিধান ধ্বংস করে।- আলমাজমু’ শরহুল মুহায্যাব ১/৩৮
এ কথা বলার অধিকার তো তাঁর মতো ব্যক্তিদেরই রয়েছে। ইমাম শাফেয়ী রাহ.-এর ইন্তিকাল ২০৪ হিজরীতে। কত আগে, সেই হিজরী তৃতীয় শতকের শুরুতে তিনি এই জ্ঞানগত অনাচার সম্পর্কে বলেছেন এবং এর সূত্র নির্দেশ করেছেন।
সালাফের এক জ্ঞানী ব্যক্তির বাস্তবসম্মত উক্তি- من اعظم البلية تشيخ الصحيفة
‘শুধু বই-পত্র উস্তাযে পরিণত হওয়া এক মহাবিপদ।’
কিছু সাধারণ মানুষ নিজেদের একজনকে নেতা বানিয়ে দ্বীনী-ব্যাখ্যা ও বিধিবিধানের মজলিস কায়েম করা ভুল
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
إِنَّ اللَّهَ لاَ يَقْبِضُ العِلْمَ انْتِزَاعًا يَنْتَزِعُهُ مِنَ العِبَادِ، وَلَكِنْ يَقْبِضُ العِلْمَ بِقَبْضِ العُلَمَاءِ، حَتَّى إِذَا لَمْ يُبْقِ عَالِمًا اتَّخَذَ النَّاسُ رُءُوسًا جُهَّالًا، فَسُئِلُوا فَأَفْتَوْا بِغَيْرِ عِلْمٍ، فَضَلُّوا وَأَضَلُّوا
আল্লাহ তাআলা এলমকে এমন ভাবে তুলে নিবেন না যে বান্দাদের (অন্তর) থেকে তা তুলে নিলেন; বরং ইলমকে তুলে নিবেন আলিমদের তুলে নেওয়ার মাধ্যমে। অবশেষে যখন আলিম থাকবে না তখন লোকেরা বেইলম লোকদের নেতা বানাবে আর তারা ইলম ছাড়া ফতোয়া দিবে। ফলে নিজেরা গোমরাহ হবে, অন্যদের গোমরাহ করবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১০০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩
আজকাল কিছু সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত ও নানা পেশায় নিয়োজিত লোকদের মাঝে এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তারা নিজেরা নিজেরা দ্বীনী বিধান নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করেছেন এবং খেয়াল খুশি মতো নতুন নতুন সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। একশ্রেণির তরুণের মধ্যেও এ প্রবণতা আছে। বলাবাহুল্য, এ কর্মপন্থাও উপরোক্ত হাদীসে উল্লেখিত ঐ নিন্দিত কর্মপন্থার মধ্যে পড়ে। এ জাতীয় ‘গবেষণা’র বা আলোচনার পরিণাম ইলম নয়, গোমরাহী। এভাবে দ্বীনী-ইলম অর্জন করা যায় না।
ইমাম আবু হানীফা রাহ.কে জানানো হল যে,
في مسجد كذا حلقة يتناظرون في الفقه
‘অমুক মসজিদে কিছু লোক একত্র হয়ে ফিকহ বিষয়ে আলোচনা করে।’
তিনি জিজ্ঞাসা করলেন- ألهمْ رأس ؟
তাদের কোনো মাথা (শিক্ষক) আছে কি?
বলা হল - لا
জ্বী না।
তিনি বললেন,
لا يفقهونَ أبداً
‘এরা কখনো ফিকহ অর্জনে সমর্থ হবে না।’
এখানে ‘শিক্ষক’ মানে সত্যিই যিনি শিক্ষক হওয়ার উপযুক্ত।
দ্বীনের ব্যাখ্যা ও বিধান জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত লোকের নিকট থেকে গ্রহণ করা ভুল
জনৈক সাহাবী আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যখন আমানত বিনষ্ট করা হবে তখন কিয়ামতের অপেক্ষা কর। প্রশ্নকারী জিজ্ঞাসা করলেন, আমানত কীভাবে বিনষ্ট করা হয়? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
إِذَا وُسِّدَ الأَمْرُ إِلَى غَيْرِ أَهْلِهِ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ
যখন অযোগ্য লোকের উপর কর্মের ভার অর্পণ করা হবে তখন কেয়ামতের অপেক্ষা কর। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯
এক বিষয়ের পণ্ডিত অন্য বিষয়ে অযোগ্য। একজন চিকিৎসক চিকিৎসা-বিদ্যায় যোগ্য হলেও প্রকৌশল শাস্ত্রে অযোগ্য। একজন প্রকৌশলী প্রকৌশল-বিষয়ে যোগ্য হলেও চিকিৎসা-শাস্ত্রে অযোগ্য। সুতরাং বিশেষ কোনো শাস্ত্রে পারদর্শী ব্যক্তির কাছে অন্য শাস্ত্রের সমাধান চাওয়া অযোগ্য লোকের উপর কর্মের ভার অর্পণ করার মধ্যেই পড়ে। এতো হল ভার অর্পণ করা। ভার গ্রহণ করা সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা দেখুন : সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম-এ হাদীস আছে যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কারো নিকট থেকে বাইআত নিতেন তখন এই অঙ্গিকারও নিতেন যে, الاننازع الامر أهله আমরা দায়িত্বশীল (ও যোগ্য) লোকের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিবাদ করব না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৭০৫৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৭০৯/৪১
দ্বীনের বিষয়ের সিদ্ধান্ত দ্বীনী বিষয়ে পারদর্শী ব্যক্তিদের উপর না ছেড়ে সাধারণ লোকদের অনুপ্রবেশ এই নিন্দিত বিবাদের শামিল।
উল্লেখ্য যে, এখানে দ্বীনী বিষয়ে ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্ত দেয়ার কথা বলা হচ্ছে, দ্বীনের সর্বজনবিদিত বিষয়াদি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করা এবং যা সবারই জানা আছে এমন সহজ-সরল বিষয়গুলো কর্মে ও আমলে আনার জন্য আলোচনার কথা বলা হচ্ছে না। এটা কুরআন-সুন্নাহর ভাষায় ‘তাযকীর’ অর্থাৎ স্মরণ করানো, ‘ইফতা’ বা ফতোয়া দান নয়।
দ্বীনী বিষয়ে ফতোয়া বা সিদ্ধান্ত যেমন জাগতিক বিষয়ের লোকদের নিকট থেকে নেওয়া ভুল তেমনি দ্বীনী ক্ষেত্রেও এক শাস্ত্রের বিষয় অন্য শাস্ত্রের লোকের নিকট থেকে নেওয়া ভুল। অনেকে ওয়ায়েজ বা আলোচকমাত্রকেই আলিম ও ফকীহ মনে করেন। অথচ দু’টো সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। হাঁ, কারো মধ্যে দু’টো বৈশিষ্ট্যই থাকতে পারে। তিনি ওয়ায়েজ বা আলোচকও আবার বিজ্ঞ আলিম ও ফকীহও। কিন্তু ওয়ায়েজ বা আলোচকমাত্রকেই আলিম ও ফকীহ মনে করা ঠিক নয়।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন-
إِنَّكُمْ فِي زَمَانٍ: كَثِيرٌ فُقَهَاؤُهُ، قَلِيلٌ خُطَبَاؤُهُ، قَلِيلٌ سُؤَّالُهُ، كَثِيرٌ مُعْطُوهُ، الْعَمَلُ فِيهِ قَائِدٌ لِلْهَوَى. وَسَيَأْتِي مِنْ بَعْدِكُمْ زَمَانٌ: قَلِيلٌ فُقَهَاؤُهُ، كَثِيرٌ خُطَبَاؤُهُ، كَثِيرٌ سُؤَّالُهُ، قَلِيلٌ مُعْطُوهُ، الْهَوَى فِيهِ قَائِدٌ لِلْعَمَلِ، اعْلَمُوا أَنَّ حُسْنَ الْهَدْيِ، فِي آخِرِ الزَّمَانِ، خَيْرٌ مِنْ بَعْضِ الْعَمَلِ
তোমরা এমন যুগে রয়েছ, যে যুগে আলিম বেশি, বক্তা ও আলোচক কম। যাঞ্চাকারী কম, দানকারী বেশি। এ যুগে কর্ম হচ্ছে প্রবৃত্তির পরিচালক। কিন্তু তোমাদের পরে অচিরেই এমন এক যুগ আসছে যখন ফকীহ হবে কম আর বক্তা হবে বেশি। অনেক হবে যাঞ্চাকারী, কম হবে দানকারী। ঐ সময় প্রবৃত্তি হবে কর্মের নিয়ন্ত্রক।... -আল আদাবুল মুফরাদ, বুখারী হাদীস ৭৮৯;
সুতরাং দ্বীনী ক্ষেত্রেও কোন বিষয় কার নিকট থেকে গ্রহণ করার সে সম্পর্কে সচেতন হওয়া কাম্য। মনে রাখতে হবে, ওয়ায়েজ বা আলোচক মাত্রই বিজ্ঞ-আলিম ও ফকীহ হওয়া অনিবার্য নয়। সুতরাং কোনো কুশলী আলোচকের সুন্দর উপস্থাপনার কারণে আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে উদাসীন হওয়ার সুযোগ নেই।
এ লেখার শিরোনাম অনেক দীর্ঘ আলোচনার দাবি রাখে। আপাতত দু’চারটি কথা কল্যাণকামিতার প্রেরণা থেকে লেখা হল। আরো জানার ও বোঝার প্রয়োজন হলে কোনো বিজ্ঞ আলিমের সাহচর্য গ্রহণ করা উচিত।
Comment