Announcement

Collapse
No announcement yet.

যে সকল কারণে মুসলিম শাসকের বিপক্ষে বিদ্রোহ করা ওয়াজিব হয়ে যায় (পর্ব-২)

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • যে সকল কারণে মুসলিম শাসকের বিপক্ষে বিদ্রোহ করা ওয়াজিব হয়ে যায় (পর্ব-২)

    গত পর্বে আমরা নামায তরককারী শাসকের বিপক্ষে বিদ্রোহ ওয়াজিহ হওয়ার ব্যাপারে সহিহ হাদিস ও নির্ভরযোগ্য আলেমদের বক্তব্য তুলে ধরেছি, এ পর্বে কিছু সংশয়ের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। তো সংশয়টা হলো, উবাদা বিন সামেতের হাদিসে তো শাসকের পক্ষ থেকে কুফরী প্রকাশ পাওয়া ব্যতীত বিদ্রোহ করতে নিষেধ করা হয়েছে, আর নামায ছেড়ে দেওয়া হানাফী, মালেকী ও শাফেয়ী মাযহাব অনুযায়ী তো কুফরী নয়, তাহলে কিভাবে নামায তরকের কারণে শাসকের বিপক্ষে বিদ্রোহ করা হবে?

    এর উত্তর হলো,
    নামায পরিত্যাগ করা কুফর না হলেও কুফরের আলামত বা নিদর্শন। কুফরের বিষয়টি যেহেতু একটু জটিল, আর শরিয়তের মূলনীতি হলো, শরিয়ত তার বিধিবিধানের ভিত্তি সুক্ষ্ম ও জটিল বিষয়ের উপর না রেখে সুস্পষ্ট ও সহজে বোধগম্য বিষয়ের উপর রাখে, তাই শরিয়ত নামায তরক করাকে শাসকের কুফরের আলামত ধরে নিয়ে শাসকের বিপক্ষে বিদ্রোহের আদেশ দিয়েছে। উপরে আমরা উম্মে সালামা রাযিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হাদিসের ব্যাখায় ইমাম বাইযাবী, ইবনে মালাক ও শায়েখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভীর যে বক্তব্যগুলো উদ্ধৃত করেছি, তা থেকে এ বিষয়টি খুব সহজেই বুঝে আসে, কেননা তারা সকলেই নামায তরক করাকে কুফরীর আলামত হিসেবে গণ্য করেছেন।

    রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি এর পবিত্র সীরাতেও আমরা এর নযীর দেখতে পাই, আনাস রাযিআল্লাহু আনহু বলেন,
    كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يغير إذا طلع الفجر، وكان يستمع الأذان، فإن سمع أذانا أمسك وإلا أغار. (صحيح البخاري: 610 صحيح مسلم: (382)

    রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (শত্রুর উপর) ভোরবেলা অতর্কিতে আক্রমণ করতেন। (তবে) তিনি (আক্রমণের পূর্বে) আযান শোনার জন্য মনোযোগ সহকারে অপেক্ষা করতেন, যদি আযান শুনতে পেতেন, তাহলে আক্রমণ হতে বিরত থাকতেন, নতুবা আক্রমণ করতেন। সহিহ বুখারী, ৬১০ সহিহ মুসলিম, ৩৮২

    হাদিসের ব্যাখায় হাফেয ইবনে হাযার রহিমাহুল্লাহ (মৃ: ৮৫২ হি.) বলেন,
    قال الخطابي: فيه أن الأذان شعار الإسلام، وأنه لا يجوز تركه، ولو أن أهل بلد اجتمعوا على تركه كان للسلطان قتالهم عليه. (فتح الباري: 2/90 ط. دار الفكر)

    খাত্তাবী রহ, বলেন, এই হাদিস প্রমাণ করে, আযান ইসলামের শিয়ার বা নিদর্শন। সুতরাং যদি কোন ভূখন্ডের অধিবাসীরা সকলে মিলে আযান ছেড়ে দেয় তাহলে মুসলিম শাসকের জন্য তাদের সাথে যুদ্ধ করা বৈধ হয়ে যাবে। -ফাতহুল বারী, ২/৯০

    তো আমরা দেখতে পাচ্ছি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধ করা না করার ভিত্তি ইসলামের আলামত অর্থাৎ আযান শোনা বা না শোনার উপর রাখছেন, অথচ এখানে এই সম্ভাবনা রয়েছে যে, যারা আযান দিচ্ছে না তারা নওমুসলিম হওয়ার কারণে আযান শিখতে পারেননি। যেমনিভাবে এই সম্ভাবনাও রয়েছে যে, তারা মুসলিম না হয়ে শুধুমাত্র মুসলমানদের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য আযান দিচ্ছে। এই বিষয়টিই হাফেয ইবনে হাযার তুলে ধরেছেন, তিনি হাদিসের ব্যাখায় বলেন,
    وفيه دلالة على الحكم بالدليل لكونه كف عن القتال بمجرد سماع الأذان. (فتح الباري: 6/112 ط. دار الفكر)

    হাদিসে দলিল ও আলামত দ্বারা হুকুম সাব্যস্ত করার প্রমাণ রয়েছে, কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধুমাত্র আযান শোনার দ্বারাই যু্দ্ধ হতে বিরত থেকেছেন। -ফাতহুল বারী, ৬/১১২

    এর আরেকটি দৃষ্টান্ত হলো, সফরে নামায কসর করার বিধান। মূলত সফরের কষ্টের কারণে সফরে নামায কসর করার বিধান দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কষ্টের বিষয়টি যেহেতু দূর্বোধ্য ও আপেক্ষিক, কারো কাছে একটি বিষয় কষ্টকর হলেও অন্যের জন্য তা একেবারেই সহজ, তাই শরিয়ত কসরের ভিত্তি কষ্টের উপর না রেখে নির্দিষ্ট দূরত্বের সফরের উপর রেখেছে, যা একটি সুস্পষ্ট ও সহজে বোধগম্য বিষয়, তাই এখন শরয়ী সফর (প্রায় সাতাত্তর কিলোমিটার) করলেই মানুষ কসর করতে পারবে, যদিও এই সফর অত্যাধুনিক ও আরামদায়ক বাহনে কোন কষ্ট ছাড়াই হয়। -দেখুন, মাবসুতে সারাখসী, ১৭/১৫৬ দারুল মা’রেফা, ১৪১৪ হি.; কাশফুল আসরার, ইমাম আব্দুল আযীয বুখারী ৩/৪৬৮ দারুল কুতুব, ১৪১৮ হি.। শরিয়তে এর অসংখ্য নযির রয়েছে, উদাহরণস্বরুপ কিছু নযির উল্লেখ করলাম, আরো নযির জানার জন্য দেখুন, হেদায়া, ১/১৯-২০, দারু ইহইয়াউত তুরাস, এবং হেদায়ার শরাহ ইনায়া ১/৬৪ দারুল ফিকর; আলমুহিতুল বুরহানী, ১/৭৪ দারুর কুতুব, ১৪২৪ হি. এবং বাজলুল মাজহুদ, ২/১৩২ মারকাযুশ শায়েখ আবুল হাসান, ১৪২৭ হি.; ফাতহুল কাদির, ১/১০৭, দারুল ফিকর; আলইখতিয়ার, ৪/১২৯ মাতবাআতুল হালাবী, ১৩৫৬ হি.; তাবয়ীনুল হাকায়িক, ৩/৩৩; তুহফাতুল ফুকাহা, ২/৩৩২, দারুল কুতুব, ১৪১৪; আলওয়াশবাহ ওয়ান নাযায়ের, পৃ: ২৫৫ মাজমাউল আনহুর, ১/৬০ দারু ইহইয়াউত তুরাস এবং রদ্দুল মুহতার, ১/৩৩১ দারুল ফিকর, ১৪১২ হি.)

    এ হলো, উম্মে সালামা রাযিআল্লাহু আনহার হাদিসের ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য, কিন্তু থানভী রহিমাহুল্লাহ এই হাদিসের এমন ব্যাখা করেছেন, যার দ্বারা হাদিসের কোন ফায়দাই বাকী থাকে না, তিনি বলেন,
    حديث ثاني ميں ترك صلاة اُس زمانه ميں كفر هي كي علامت تھي، پس اس كا حاصل كفر ہی ہوا (امداد الفتاوى: 5/127 ط. مكتبہ دار العلوم كراچي: 1431 ھ)

    ‘হাদিসে নামায পরিত্যাগকারী শাসকের বিপক্ষে যুদ্ধ করতে বলা হয়েছে, কেননা রাসূলের যমানায় নামায তরক করা কুফরের আলামত ছিল। সুতরাং ‘যতদিন পর্যন্ত শাসক নামায পড়বে ততদিন তার বিপক্ষে বিদ্রোহ করবে না’ এর অর্থ এটাই যে যতদিন সে মুসলমান থাকবে ততদিন তার বিপক্ষে যুদ্ধ করবে না। -ইমদাদুল ফাতওয়া, ৫/১২৭

    এরপর তিনি সেই যমানায় নামায তরক করা যে কুফরের আলামত ছিল এর স্বপক্ষে নিচের হাদিসগুলো উদ্ধৃত করেন,
    جابر بن عبد الله يقول: سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: «بين الرجل وبين الشرك والكفر ترك الصلاة». رواه مسلم: (82)

    عن عبد الله بن بريدة، عن أبيه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «إن العهد الذي بيننا وبينهم الصلاة، فمن تركها فقد كفر». رواه الترمذي: (2621) وقال: هذا حديث حسن صحيح.

    عن عبد الله بن شقيق العقيلي، قال: كان أصحاب محمد صلى الله عليه وسلم لا يرون شيئا من الأعمال تركه كفر غير الصلاة. رواه الترمذي: (2622)

    জাবের রাযিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মানুষের মাঝে এবং কুফর ও শিরকের মাঝে প্রতিবন্ধক হলো নামায তরক করা। -সহিহ মুসলিম, ৮২

    আবু মুসা আশআরী রাযিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমাদের মাঝে ও কাফেরদের মাঝে পার্থক্য হলো, নামায। সুতরাং যে নামায ছেড়ে দিবে সে কাফের হয়ে যাবে। জামে তিরমিযি, ২৬২১ ইমাম তিরমিযি হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন।

    আব্দুল বিন শাকিক বলখী রহিমাহুল্লাহ বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীরা নামায ব্যতীত অন্য কোন আমল তরক করাকে কুফরী মনে করতো না। -জামে তিরমিযি, ২৬২২

    কিন্তু থানভী রহিমাহুল্লাহুর এই বক্তব্যের উপর আমাদের পাঁচটি আপত্তি রয়েছে,

    ১. নামায তরক করা শুধু রাসূলের যমানায় কুফরের আলামত হবে কেন, রাসূলের হাদিস কি শুধু তার যমানার জন্যই, না কিয়ামত পর্যন্ত আগত মুসলিম উম্মাহর জন্য? উপরে ইমাম বাইযাবী, ইবনে মালাক ও শায়েখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভীর যে বক্তব্যগুলো উদ্ধৃত করা হয়েছে তাতে আমরা দেখেছি, তারা সকলেই নামাযকে ঈমান ও কুফরের মাঝে পার্থক্যকারী ও নামায তরক করাকে কুফরীর আলামত হিসেবে গণ্য করেছেন, তাদের এই বক্তব্যের ভিত্তি যে, থানভী রহিমাহুল্লাহুর উল্লেখ করা হাদিসগুলো তা সহজেই বোধগম্য।

    ২. উপরে আমরা যে আলেমদের বক্তব্য নকল করেছি থানভী রহিমাহুল্লাহুর বক্তব্য তাদের বক্তব্যের বিপরীত, বরং যেহেতু ইমাম কুরতুবী ও অনেকেই নামায তরককারী শাসকের বিপক্ষে বিদ্রোহ ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে ইজমা নকল করেছেন এবং থানভী রহিমাহুল্লাহুর পূর্বে কোন আলেম ‘নামায তরককারী শাসকের বিপক্ষেও যুদ্ধ করা যাবে না’ একথা বলেননি, তাই বলা যায় থানভী রহিমাহুল্লাহুর বক্তব্য শরিয়তের দলিল ও সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমদের বক্তব্যের পরিপন্থী একটি শায ও বিচ্ছিন্ন মত।

    ৩. থানভী রহিমাহুল্লাহ হাদিসের যে ব্যাখ্যা করেছেন, তা তার পূর্বের একাধিক আলেম স্পষ্টরুপে প্রত্যাখ্যান করেছেন, ইমাম আবুল আব্বাস কুরতুবী বলেন,

    وقوله: «لا، ما أقاموا فيكم الصلاة» ظاهره: ما حافظوا على الصلوات المعهودة بحدودها وأحكامها وداموا على ذلك وأظهروه، وقيل: معناه: ما داموا على كلمة الإسلام، ... والأوَّل أظهر. (المفهم لما أشكل من تلخيص صحيح مسلم: 4/66 ط. دار ابن كثير: 1417 هـ)

    রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, যতদিন তারা নামায কায়েম করে, ততদিন তাদের বিপক্ষে যুদ্ধ করো না, এর স্বাভাবিক অর্থ হলো, যতদিন তারা নির্ধারিত নামাযগুলোর ব্যাপারে যত্নবান হয়, নিয়মিত প্রকাশ্যে নামায আদায় করবে, ততদিন তাদের বিপক্ষে বিদ্রোহ করা যাবে না। কেউ কেউ বলেছেন, হাদিসের অর্থ হলো, যতদিন তারা ইসলামের উপর থাকবেন ততদিন তাদের বিপক্ষে বিদ্রোহ করা যাবে না। .... কিন্তু হাদিসের প্রথম অর্থটিই বেশি স্পষ্ট। -আলমুফহিম, ৪/৬৬

    ইমাম ইবনে রসলান শাফেয়ী রহিমাহুল্লাহ (মৃ: ৮৪৪ হি.) ও সুনানে আবু দাউদের শরাহ ‘শরহু সুনানি আবী দাউদে’ হুবহু একই কথা বলেছেন, তার ইবারত দেখুন,
    (قيل: يا رسول الله، أفلا نقتلهم؟) لفظ مسلم: قالوا: يا رسول الله، ألا نقاتلهم؟ وكذا (قال) سليمان (ابن داود: أفلا نقاتلهم؟) على فعل ذلك (قال: لا ما صلوا) الصلوات الخمس. أي: ما أقاموا فيكم الصلاة المعهودة بحدودها وأحكامها وأظهروا فعلها. وقيل: معناه: ما داموا على كلمة الإسلام، …والأول أظهر. (شرح سنن أبي داود لابن رسلان: 18/377 ط: دار الفلاح: 1437 هـ)

    রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, যতদিন তারা নামায কায়েম করে, ততদিন তাদের বিপক্ষে যুদ্ধ করো না, এর স্বাভাবিক অর্থ হলো, যতদিন তারা নির্ধারিত নামাযগুলোর ব্যাপারে যত্নবান হয়, নিয়মিত প্রকাশ্যে নামায আদায় করবে, ততদিন তাদের বিপক্ষে বিদ্রোহ করা যাবে না। কেউ কেউ বলেছেন, হাদিসের অর্থ হলো, যতদিন তারা ইসলামের উপর থাকবেন ততদিন তাদের বিপক্ষে বিদ্রোহ করা যাবে না। ... কিন্তু হাদিসের প্রথম অর্থটিই বেশি স্পষ্ট। -শরহু সুনানি আবী দাউদ, ১৮/৩৭৭


    ৪. থানভী রহিমাহুল্লাহ হাদিসের যে ব্যাখা করেছেন, এর দ্বারা হাদিস থেকে নতুন কোন ফায়েদা পাওয়া যায় না, বরং এই হাদিস ও উবাদা বিন সামেতের হাদিস একই অর্থবোধক হয়ে যায়। পক্ষান্তরে আমরা হাদিসের যে ব্যাখা করেছি, সে অনুযায়ী দুটি হাদিসই নতুন নতুন ফায়দা দেয়। অর্থাৎ কুফর ও নামায তরক উভয় কারণেই শাসকের বিপক্ষে বিদ্রোহের আদেশ বুঝে আসে। আর উসূলে ফিকহের মূলনীতি হলো, التأسيس أولى من التأكيد لأن الإفادة خير من الإعادة অর্থাৎ দুটি নসের এমন ব্যাখা করা যে, সে দুটি একই অর্থে হয়ে যায় এবং একটি অপরটির তাকীদ হয়, এরচেয়ে এটাই উত্তম যে, নসদুটির এমন ব্যাখা করা হবে যার দ্বারা উভয়টি ভিন্ন ভিন্ন অর্থ দেয় এবং তা থেকে নতুন নতুন ফায়েদা পাওয়া যায়।
    (দেখুন, কাশফুল আসরার, ইমাম আব্দুল আযীয বুখারী, ৩/১৪৮ দারুল কুতুব; তাইসীরুত তাহরীর, আমীর বাদশা, পৃ: ৩৫৯ দারুল বায; আলকুল্লিয়্যাত, আবুল বাকা কাফাভী হানাফী, পৃ: ১০৬৫ মুয়াসসাসাতুল রিসালাহ, ১৪১৯ হি.; শরহুল কাওয়ায়িদিল ফিকহিয়্যাহ, আহমদ যারকা, পৃ: ৩১৫ দারুল কলম, ১৪০৯ হি.; আলইহকাম ফি উসূলিল আহকাম, ইমাম আবুল হাসান আমিদী, ৩/২৫-২৬, দারুল কিতাবিল আরবী, ১৪২৬ হি.; আলবাহরুল মুহিত, ইমাম বদরুদ্দীন যারকাশী, ১/১১৪ দারুল কুতুব, ১৪২১ হি.; ফাতহুল কাদীর, ৮/১৭৫ দারুল ফিকর)

    ৫. সবচেয়ে বড় কথা হলো, থানভী রহিমাহুল্লাহ হাদিসের এই অর্থ করেছেন, পূর্বে উল্লিখিত উবাদা বিন সামেত থেকে বর্ণিত, ‘তবে যদি তোমরা স্পষ্ট কুফর দেখতে পাও’ শীর্ষক হাদিসের কারণে, কেননা এ হাদিসের বাহ্যিক বিবরণ থেকে বুঝে আসে, কুফর ছাড়া কোন ক্ষেত্রেই শাসকের বিপক্ষে যুদ্ধ করা যায় না। কিন্তু খোদ থানভী রহিমাহুল্লাহুই আলোচনার ধারাবাহিকতায় একটু পরে গিয়ে বলেছেন, ‘ইসলামের পরিপন্থী কানুন তৈরী করে মানুষকে গুনাহে বাধ্য করা কুফরের হুকুমে, তাই কোন শাসক এরকম কানুন তৈরী করলে তার বিপক্ষে বিদ্রোহ করা যাবে’। (এ বিষয়ে তার পূর্ণ ইবারত সহ বিস্তারিত আলোচনা আমরা দ্বিতীয় পর্বে করবো ইনশাআল্লাহ) এবং টীকায় এ মতের স্বপক্ষে দলিল হিসেবে তিনি বলেন,
    چنانچه فقهاء كا أذان وختان كے (جو كه سنن ميں سے هيں) ترك عام كو استخفاف دين يا موجب محاربۀ تاركين فرمانا صريح دليل هے ايسے عموم كے بحكم كفر هونے كي- ملاحظه هو در مختار و رد المحتار باب الأذان ومسائل شتى حكم الختان - 12- أشرف علي-

    ‘আযান ও খতনা সুন্নতে মুয়াক্কাদা হওয়া সত্ত্বেও ফুকাহায়ে কেরাম আযান ও খতনা ব্যাপকভাবে ছেড়ে দেওয়াকে দ্বীনকে গুরুত্বহীন মনে করার দলিল গণ্য করেছেন এবং যারা এবিষয়গুলো ব্যাপকভাবে ছেড়ে দিবে তাদের বিপক্ষে যুদ্ধ করা ওয়াজিব বলেছেন, এটা প্রমাণ করে যে কানুনের মাধ্যমে মানুষকে ব্যাপকভাবে গুনাহে বাধ্য করা কুফরীর হুকুমে’। -ইমদাদুল ফাতাওয়া, -৫/১৩০

    তো প্রশ্ন হলো, যদি ব্যাপকভাবে আযান বা খতনা ছেড়ে দেওয়া এবং ইসলামের পরিপন্থী আইন করে মানুষকে গুনাহে বাধ্য করা কুফরীর হুকুমে হতে পারে, তাহলে নামায তরক করা কেন কুফরীর হুকুমে হতে পারবে না, অথচ পূর্বে উদ্ধৃত আলেমদের বক্তব্যে আমরা দেখেছি, আল্লামা ত্বীবী, মোল্লা আলী কারী ও ইবনে আল্লান রহিমাহুমাল্লহ সবাই নামায তরককে كالكفر অর্থাৎ কুফরের মত বা কুফরের হুকুমে ধরেছেন।


    আল্লামা তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুমও থানভী রহিমাহুল্লাহুর মতটিই গ্রহণ করেছেন, তিনি এর স্বপক্ষে কাযী ইয়াযের নিম্মোক্ত বক্তব্য পেশ করেছেন,
    معنى: «ما صلوا» ما داموا على الإسلام، فالصلاة إشارة إلى ذلك. (تكملة فتح الملهم: 3/293 ط. دار إحياء التراث العربي)

    রাসূলের বাণী, ‘যতদিন তারা নামায পড়ে’ অর্থাৎ যতদিন তারা ইসলামের উপর বাকী থাকে, নামাযের কথা বলে এদিকেই ইশারা করা হয়েছে’। -তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম, ৩/২৯৩

    কিন্তু পূর্বে আমরা দেখেছি, কাযী ইয়ায রহিমাহুল্লাহ বলেছেন,
    لا خلاف بين المسلمين أنه لا تنعقد الإمامة للكافر، ولا تستديم له إذا طرأ عليه، وكذلك إذا ترك إقامة الصلوات والدعاء إليها، وكذلك عند جمهورهم البدعة. وذهب بعض البصريين إلى أنها تنعقد لها وتستديم على التأويل، فإذا طرأ مثل هذا على وال من كفر أو تغيير شرع أو تأويل بدعة، خرج عن حكم الولاية وسقطت طاعته، ووجب على الناس القيام عليه وخلعه، ونصب إمام عدل أو وال مكانه إن أمكنهم ذلك. (إكمال المعلم: 6/246 ط. دار الوفاء: 1419 ه.)

    উলামায়ে কেরাম সবাই এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন যে, কোনো কাফেরকে খলীফা নিযুক্ত করলে সে খলীফা হবে না এবং কোনো খলীফার মাঝে যদি কুফরী প্রকাশ পায়, তাহলে সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অপসারিত হয়ে যাবে। তিনি বলেন, এমনিভাবে শাসক যদি নামায প্রতিষ্ঠা করা অথবা নামাযের দিকে আহবান করা ছেড়ে দেয় (তাহলেও)। তিনি আরও বলেন, জুমহুরের মতে শাসক যদি বিদ‘আত করে (তবে তাদের হুকুম একই)। কতিপয় বসরী আলেমের মত হলো, বিদ‘আতির ইমামত সাব্যস্ত হবে এবং সেটা স্থায়ী হবে, কেননা সে তা’বিলকারী। অতএব শাসক যদি এজাতীয় কাজগুলোর কোন একটি, যেমন, কুফর, শরীয়া পরিবর্তন অথবা বিদ‘আতে লিপ্ত হয়, তবে সে পদচ্যুত হয়ে যাবে এবং তার আনুগত্যের অপরিহার্যতা শেষ হয়ে যাবে। মুসলমানদের উপর ফরজ হবে, সম্ভব হলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা, তাকে অপসারণ করা এবং একজন ন্যায়পরায়ণ খলিফা নিযুক্ত করা, যদি এটা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়। -ইকমালুল মু’লিম, ৬/২৪৬

    তো এখানে আমরা দেখছি, কাযী ইয়ায রহিমাহুল্লাহ সু্স্পষ্টরুপে বলছেন, শাসকের থেকে কুফর, নামায তরক, শরিয়ত পরিবর্তন ইত্যাদি কাজ প্রকাশ পেলে তার বিপক্ষে বিদ্রোহ করা ওয়াজিব হয়ে যাবে। আর ইলমের সর্বস্বীকৃত মূলনীতি হলো, কোন বক্তব্য অপর (চাই তা কুরআন-সুন্নাহর বাণী হোক বা কোন আলেমের বক্তব্য) বক্তব্যের বিরোধী হয়ে গেলে যেটা মুহকাম বা দ্ব্যার্থহীন সেটা অনুযায়ী আমল করা হবে, আর যে বক্তব্য মুতাশাবিহ বা দ্ব্যার্থবোধক সেটাকে মুহকামের সাথে মিলিয়ে এমনভাবে ব্যাখা করা হবে যেন দুই বক্ত্যেবের মাঝে কোন বিরোধ না থাকে, পরিভাষায় একে رَدُّ المُتَشابِه إلى المُحْكَم (মুতাশাবিহকে মুহকামের দিকে ফিরানো, মুহকাম অনুযায়ী ব্যাখা করা) বলা হয়।
    -(দেখুন, সুরা আলে ইমরান, আয়াত, ৭; আহকামুল কুরআন, ইমাম জাসসাস, ২/২৮২ দারু ইহইয়াউত তুরাস ১৪০৫ হি.; তাফসীরে ইবনে কাসীর, ২/৩৬৫ দারু তাইয়েবাহ, ১৪১৯ হি.; বাদায়েউস সানায়ে’ ১/২১ দারুল কুতুব, ১৪০৬ হি.; বাহরুল রায়েক, ১/২৫৯ দারুল কিতাবিল ইসলামী; ই’লামুল মুওয়াক্কিয়ীন, ৪/৫৮ দারু ইবনুল জাওযী, ১৪২৩ হি.; ফাতহুল বারী, ইবনে রজব, ৭/২৪০ মাকতাবাতুল গুরাবা আলআছারিয়্যাহ, ১৪১৭ হি.) সুতরাং এই উসুলের আলোকে আমরা বলতে পারি, কাযী ইয়ায রহিমাহুল্লাহ যে নামায তরক করাকে কুফরের দিকে ইশারা করেছেন এর অর্থ হলো, নামায তরক করা কুফরের আলামত, তাই যেভাবে কুফরী পাওয়া গেলে শাসকের বিপক্ষে বিদ্রোহ করা ওয়াজিব হয়ে যায়, তেমনিভাবে নামায তরক করলেও শাসকের বিপক্ষে বিদ্রোহ করা ওয়াজিব হয়ে যায়।

    আর যদি কাযী ইয়ায রহিমাহুল্লাহুর বক্তব্যের যে অর্থ তাকী উসমানী সাহেব বুঝেছেন, সেটাই সঠিক বলে ধরে নিই, তাহলেও এটা নামায পরিত্যাগকারী শাসকের বিপক্ষে বিদ্রোহ না করার তেমন কোন দলিল হতে পারে না। কেননা আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি, ইমাম আবুল আব্বাস কুরতুবী ও ইবনে রাসলান রহিমাহুমাল্লাহ হাদিসের এই অর্থকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং হাদিসের স্বাভাবিক অর্থকেই প্রাধাণ্য দিয়েছেন। তাদের বক্তব্য আবারও একটু দেখে নিন,


    وقوله: «لا، ما أقاموا فيكم الصلاة» ظاهره: ما حافظوا على الصلوات المعهودة بحدودها وأحكامها وداموا على ذلك وأظهروه، وقيل: معناه: ما داموا على كلمة الإسلام، ... والأوَّل أظهر. (المفهم لما أشكل من تلخيص صحيح مسلم: 4/66 ط. دار ابن كثير: 1417 هـ وشرح سنن أبي داود لابن رسلان: 18/377 ط: دار الفلاح: 1437 هـ)

    রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, যতদিন তারা নামায কায়েম করে, ততদিন তাদের বিপক্ষে যুদ্ধ করো না, এর স্বাভাবিক অর্থ হলো, যতদিন তারা নির্ধারিত নামাযগুলোর ব্যাপারে যত্নবান হয়, নিয়মিত প্রকাশ্যে নামায আদায় করে, ততদিন তাদের বিপক্ষে বিদ্রোহ করা যাবে না। কেউ কেউ বলেছেন, হাদিসের অর্থ হলো, যতদিন তারা ইসলামের উপর থাকবেন ততদিন তাদের বিপক্ষে বিদ্রোহ করা যাবে না। ... কিন্তু হাদিসের প্রথম অর্থটিই বেশি স্পষ্ট। -আলমুফহিম, ৪/৬৬; শরহু সুনানি আবী দাউদ, ১৮/৩৭৭

    চলবে ইনশাআল্লাহ


    প্রথম পর্বের লিংক
    https://dawahilallah.com/showthread....76;-&%232535;)
    الجهاد محك الإيمان

    জিহাদ ইমানের কষ্টিপাথর

  • #2
    জাযাকাল্লাহ আখি।খুবই উপকারি।আল্লাহ আপনার মেহনাত কবুল করুক আমিন
    আসুক না যত বাধাঁ যত ঝর সাইক্লোন কিতালের পথে মোরা চলবোই

    Comment


    • #3
      আল্লাহ বারাকাহ দান করুন।
      ভাই ;আপনি যেহেতু ধারাবাহিক আলোচনা করছেন;ইতিহাস পর্বে যখন যাবেন তখন তাতারী শাসকদের পাশাপাশি ফাতেমী হওয়ার দাবীদার কুলাঙ্গার উবাইদী শাসকদের ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের ফতোয়া ও আকওয়াল আলোচনা করলে ভাল হবে।কারণ;তাতারীদের তুলনায় উবাইদীদের প্রসঙ্গটা অনেক কম আলোচিত হয়েছে।
      একইভাবে তাতারীদের ব্যাপারে সাধারণ আলোচনা হলেও তাদের সুনির্দিষ্ট শাসকদের ব্যাপারে ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ ও ইবনে কাসীর রহঃ ছাড়াও অন্যান্য উলামা কতৃক ইরতিদাদের ফতোয়া (উদাহরণস্বরূপ তৈমুর লঙ্গের ব্যাপারে ফতোয়ায়ে বাজজাজিয়ার মুসান্নিফ কতৃক ইরতেদাদের ফতোয়া) সম্ভব হলে ইতিহাস -তারিখের কিতাবগুলো ঘাটাঘাটি করে জমা করে দিতে পারেন।

      Comment


      • #4
        Originally posted by ubada ibnus samit View Post
        আল্লাহ বারাকাহ দান করুন।
        ভাই ; আপনি যেহেতু ধারাবাহিক আলোচনা করছেন; ইতিহাস পর্বে যখন যাবেন তখন তাতারী শাসকদের পাশাপাশি ফাতেমী হওয়ার দাবীদার কুলাঙ্গার উবাইদী শাসকদের ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের ফতোয়া ও আকওয়াল আলোচনা করলে ভাল হবে। কারণ;তাতারীদের তুলনায় উবাইদীদের প্রসঙ্গটা অনেক কম আলোচিত হয়েছে।
        একইভাবে তাতারীদের ব্যাপারে সাধারণ আলোচনা হলেও তাদের সুনির্দিষ্ট শাসকদের ব্যাপারে ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ ও ইবনে কাসীর রহঃ ছাড়াও অন্যান্য উলামা কতৃক ইরতিদাদের ফতোয়া (উদাহরণস্বরূপ তৈমুর লঙ্গের ব্যাপারে ফতোয়ায়ে বাজজাজিয়ার মুসান্নিফ কতৃক ইরতেদাদের ফতোয়া) সম্ভব হলে ইতিহাস -তারিখের কিতাবগুলো ঘাটাঘাটি করে জমা করে দিতে পারেন।
        ভাই, আমার মূল আলোচনা হলো, মুসলিম শাসকদের বিপক্ষে যুদ্ধ করার বিধান নিয়ে, আর এর উদ্দেশ্য হলো, ঐ ভাইদের সংশয় দূর করা যারা জিহাদে আগ্রহী, কিন্তু শাসকদের মুরতাদ হওয়ার ব্যাপারে তাদের সংশয় রয়েছে। অর্থাৎ আমার উদ্দেশ্য হলো, এ বিষয়টি স্পষ্ট করা যে, যদি বর্তমান শাসকদের তর্কের খাতিরে মুসলিম মেনেও নেই, তবুও কি কি কারণে ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ওয়াজিব। এ বিষয়ের সাথে মিল রেখে উবাইদী ও তাতারীদের কিছু আলোচনা আসতে পারে, তবে ওদের ইরতেদাদের ব্যাপারে আলেমদের ফতোয়া এ প্রবন্ধে আসবে না। বরং এ প্রবন্ধে আসবে, ঐ আলিমদের ফতোয়া যারা নামায না পড়া, ইসলাম অনুযায়ী শাসন না করা, কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব, জিহাদ পরিত্যাগ, ইত্যাদি কারণে কোন শাসকের বিপক্ষে বিদ্রোহ করার ফতোয়া দিয়েছেন।

        আর আপনি যে বিষয়টি চাচ্ছেন, তা মূলত হাকিমিয়্যাহ সাথে সম্পৃক্ত। হাকিমিয়্যাহর কাজ অনেক ব্যাপৃত, সব আলেমই এ বিষয়ে কাজ করতে পারেন, আপনিও করতে পারেন। হোক তা বাজজাজিয়ার মুসান্নিফের মত কয়েকজন আলেমের ফতোয়া সংগ্রহই। আমার হাতে এখন কয়েকটি কাজ আছে, তাই এ মুহূর্তে হাকিমিয়্যাহর ব্যাপারে কাজের সুযোগ আমার নেই, তবে শাসকের সাথে যুদ্ধের ক্ষেত্রে ‘বড় ফিতনার ভয়’ এই সংশয় নিরসনের ক্ষেত্রে হাকিমিয়্যাহর ব্যাপারে কিছু আলোচনা আসতে পারে ।
        الجهاد محك الإيمان

        জিহাদ ইমানের কষ্টিপাথর

        Comment


        • #5
          জাযাকুমুল্লাহ।
          হ্যা,ভাই।বুঝতে পেরেছি।
          সুন্দর একটা বিষয়ের কাজ হাতে নিয়েছেন- এ বিষয়ের উপর আগে তেমন কাজ চোখে পড়েনি।
          আল্লাহ বারাকাহ দান করুন

          Comment


          • #6
            মাশাল্লাহ মুতারাম ভাই খুব উপকারাী চালিয়ে যান ইনশাআল্লাহ
            পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় থাকব ইনশাআল্লাহ
            জিহাদই হলো মুমিন ও মুনাফিকের মাঝে
            পার্থক্যকারী একটি ইবাদাহ

            Comment

            Working...
            X