জিলহজ্ব মাসের প্রথম দশ দিনের গুরুত্ব ও ফযীলত
************************************************** ***
জিলহজ্ব মাস হচ্ছে: আরবী মাসসমূহের মাঝে বারতম মাস। আশহুরুল হুরুম তথা সম্মানিত মাসসমূহের মাঝেও একটি মাস হলো জিলহজ্ব। এ মাসের অনেক বৈশিষ্ট রয়েছে। যেমন, এ মাসে আল্লাহর কিছু বান্দা পবিত্র হজ আদায় করবেন। আবার কিছু বান্দা কুরবানী করবেন। অন্যদিকে আল্লাহর কিছু বান্দা এ দুটোর কোনটাই পালন করবেন না। তাহলে তাদের কি উপায়? তারা কি এ মাসের বারাকাহ থেকে বঞ্চিত থাকবেন? নাহ..তা কি করে হয়! আল্লাহ তা‘আলা কিছু বান্দাকে তাঁর অনুগ্রহে বিভিন্ন নেক কাজ করার তাওফীক দান করে সৌভাগ্যশালী বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে নিবেন, আর অন্যান্য বান্দাদেরকে বঞ্চিত করবেন...! এটা হতেই পারে না!! তাই আল্লাহ তা‘আলা অন্যান্য বান্দারা যাতে এই মহান নেয়ামত থেকে বঞ্চিত না হন, সেজন্য কিছু আমলের ব্যবস্থা করেছেন। আসুন জেনে নেয়া যাক, সেগুলো কি কি?
*জিলহজ্বের প্রথম দশদিন বছরের শ্রেষ্ট দশদিন*
মহান আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেছেন-
وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَعْلُومَاتٍ
অনুবাদ: “তারা যেন নির্দিষ্ট দিন সমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করে।”(সূরা হজ্জ: ২৮)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনে কাসীর রহ. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণনা করেন: عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ: الْأَيْامُ الْمَعْلُومَاتُ: أَيْامُ الْعَشْرِঅর্থাৎ“(নির্দিষ্ট দিনসমূহ হল) যিলহজ্ব মাসের প্রথম দশ দিন।” হযরত আবু মূসা আশয়ারী রাযি., মুজাহিদ রহ, আতা রহ., সাঈদ ইবনে যুবাইর রহ., হাসান রহ., কাতাদাহ রহ. প্রমুখও এমনই মতামত ব্যক্ত করেছেন। (তাফসীরে ইবনে কাসীর ৩/২৮৯)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা আরো ইরশাদ করেছেন-
(وَالْفَجْرِ ﴿الفجر: ١﴾ وَلَيَالٍ عَشْرٍ ﴿الفجر: ٢
অনুবাদ: “ভোর বেলার কসম, আর কসম দশ রাত্রির।”(সূরা ফজর: ১-২)
এই দশ রাত্রির ব্যাখ্যায়ও হাফেয ইবনে কাসীর রহ. বলেছেন:
وَاللَّيَالِي الْعَشْرُ: الْمُرَادُ بِهَا عَشَرُ ذِي الْحِجَّةِ. كَمَا قَالَهُ ابْنُ عَبَّاسٍ، وَابْنُ الزُّبَيْرِ، وَمُجَاهِدٌ، وَغَيْرُ وَاحِدٍ مِنَ السَّلَفِ وَالْخَلَفِ
এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, যিলহজ্ব মাসের প্রথম দশ দিন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি., আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাযি. ও মুজাহিদ রহ.সহ অধিকাংশ সাহাবী, তাবেয়ী ও মুফাসসিরের মতে এটাই উদ্দেশ্য।
হাফেয ইবনে কাসীর রাহ. বলেন, এটিই বিশুদ্ধ মত। (তাফসীরে ইবনে কাসীর ৪/৫৩৫-৫৩৬)
*যিলহজ্বের প্রথম দশ দিনের আমল সর্বোৎকৃষ্ট আমল*
হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ مَا الْعَمَلُ فِي أَيَّامٍ أَفْضَلَ مِنْهَا فِي هَذِهِ قَالُوا وَلَا الْجِهَادُ قَالَ وَلَا الْجِهَادُ إِلَّا رَجُلٌ خَرَجَ يُخَاطِرُ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ فَلَمْ يَرْجِعْ بِشَيْءٍ
অনুবাদ: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যিলহজ্ব মাসের প্রথম দশ দিনের আমল, অন্যান্য দিনের আমলের তুলনায় উত্তম। তারা জিজ্ঞাসা করলেন, জিহাদও কি (উত্তম) নয়? নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: জিহাদও নয়। তবে সে ব্যক্তির কথা স্বতন্ত্র, যে নিজের জান ও মালের ঝুঁকি নিয়েও জিহাদ করে এবং কিছুই নিয়ে ফিরে আসে না।”(সহীহ বুখারী হাদীস, হাদীস নং-৯৬৯)
عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم: "ما مِنْ أَيْامٍ أَعْظَمَ عِنْدَ اللَّهِ وَلَا أَحَبَّ إِلَيْهِ العملُ فِيهِنَّ، مِنْ هَذِهِ الْأَيْامِ الْعَشْرِ، فَأَكْثِرُوا فِيهِمْ مِنَ التَّهْلِيلِ وَالتَّكْبِيرِ وَالتَّحْمِيدِ
অনুবাদ: হযররত ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ তাআলার নিকট যিলহজ্বের প্রথম দশদিনের আমলের চেয়ে অধিক মহৎ এবং অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। সুতরাং তোমরা সেই দিবসগুলোতে অধিক পরিমাণে তাসবীহ (সুবহানাল্লাহ) তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ) তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) ও তাকবীর (আল্লাহু আকবার) পাঠ কর।”( মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং-১৯৬৮)
উপরেল্লিখিত হাদীসদ্বয় দ্বারা এ কথা স্পষ্ট বোঝা গেল যে, এই দশ দিনে যে কোন নেক আমল করা অন্যান্য সময়ে করা আমলের তুলনায় সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোত্তম।
*যিলহজ্বের প্রথম দশ দিনের আমল*
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ “ مَا مِنْ أَيَّامٍ أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ أَنْ يُتَعَبَّدَ لَهُ فِيهَا مِنْ عَشْرِ ذِي الْحِجَّةِ يَعْدِلُ صِيَامُ كُلِّ يَوْمٍ مِنْهَا بِصِيَامِ سَنَةٍ وَقِيَامُ كُلِّ لَيْلَةٍ مِنْهَا بِقِيَامِ لَيْلَةِ الْقَدْرِ ” | رواه ترميذي
অনুবাদ: হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “জিলহজ্বের প্রথম দশ দিনের ইবাদত আল্লাহর নিকট অন্যান্য দিনের ইবাদতের তুলনায় বেশী প্রিয়, প্রত্যেক দিনের রোযা এক বছরের রোযার ন্যায়, আর প্রত্যেক রাতের ইবাদত লাইলাতুল কদরের ইবাদতের ন্যায়। (জামে তিরমিযী, হাদীস নং : ৭৫৮)
عَنْ هُنَيْدَةَ بْنِ خَالِدٍ عَنِ امْرَأَتِهِ عَنْ بَعْضِ أَزْوَاجِ النَّبِىِّ –صلى الله عليه وسلم- قَالَتْ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ –صلى الله عليه وسلم- يَصُومُ تِسْعَ ذِى الْحِجَّةِ وَيَوْمَ عَاشُورَاءَ وَثَلاَثَةَ أَيَّامٍ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ أَوَّلَ اثْنَيْنِ مِنَ الشَّهْرِ وَالْخَمِيسَ
অনুবাদ: হুনায়দা ইবনে খালিদ তাঁর স্ত্রী হতে এবং তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন এক স্ত্রী হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যিলহজ্বের প্রথম নয়দিন ও আশুরার রোযা রাখতেন। আর তিনি প্রতি মাসে তিনদিন, মাসের প্রথম সোম ও বৃহস্পতিবারসহ রোযা রাখতেন।(সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং : ২৪৩৭)
فِي صَحِيحِ مُسْلِمٍ عَنِ أَبِي قَتَادَةَ ...ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- « صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللَّهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِى قَبْلَهُ وَالسَّنَةَ الَّتِى بَعْدَهُ »
অনুবাদ: হযরত আবু কাতাদাহ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আরাফার দিনের রোযা- আমি আল্লাহর নিকট আশা করি তা পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী বছরের গুনাহসমূহ মুছে দিবে।”(সহীহ মুসলিম, হাদীস নং : ১১৬২)
عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ أَنَّ النَّبِىَّ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ « إِذَا رَأَيْتُمْ هِلاَلَ ذِى الْحِجَّةِ وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّىَ فَلْيُمْسِكْ عَنْ شَعْرِهِ وَأَظْفَارِهِ »
অনুবাদ: হযরত উম্মে সালামা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- “তোমরা যদি যিলহজ্ব মাসের চাঁদ দেখতে পাও আর তোমাদের কেউ কুরবানী করার ইচ্ছা করে তবে সে যেন স্বীয় চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং : ১৯৭৭)
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو... أُمِرْتُ بِيَوْمِ الْأَضْحَى جَعَلَهُ اللَّهُ عِيدًا لِهَذِهِ الْأُمَّةِ فَقَالَ الرَّجُلُ أَرَأَيْتَ إِنْ لَمْ أَجِدْ إِلَّا مَنِيحَةَ ابْنِي أَفَأُضَحِّي بِهَا قَالَ لَا وَلَكِنْ تَأْخُذُ مِنْ شَعْرِكَ وَتُقَلِّمُ أَظْفَارَكَ وَتَقُصُّ شَارِبَكَ وَتَحْلِقُ عَانَتَكَ فَذَلِكَ تَمَامُ أُضْحِيَّتِكَ عِنْدَ اللَّهِ
অনুবাদ: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- “আমি কুরবানীর দিন সম্পর্কে আদিষ্ট হয়েছি (অর্থাৎ এ দিবসে কুরবানী করার আদেশ করা হয়েছে।) আল্লাহ তাআলা তা এ উম্মতের জন্য ঈদ হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। এক ব্যক্তি আরজ করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি আমার কাছে শুধু একটি মানীহা থাকে অর্থাৎ যা শুধু দুধপানের জন্য দেওয়া হয়েছে? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না; বরং সেদিন তুমি তোমার চুল কাটবে (মুন্ডাবে বা ছোট করবে), নখ কাটবে, মোচ এবং নাভীর নিচের পশম পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর কাছে তোমার পূর্ণ কুরবানী বলে গণ্য হবে।”(মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং : ৬৫৭৫)
উপরে উল্লেখিত হাদীগুলোর আলোকে আমরা নিম্নোক্ত আমলগুলোর কথা জানতে পারলাম। যথা:
১। ঈদের দিন ছাড়া বাকি নয় দিন রোযা রাখা।
২। বিশেষভাবে নয় তারিখের রোযা রাখা।
৩। চুল, নখ, মোচ ইত্যাদি না কাটা। এটি মুস্তাহাব। যে ব্যক্তি কুরবানী করতে সক্ষম নয় সেও এ আমল পালন করবে। অর্থাৎ নিজের চুল, নখ, গোঁফ ইত্যাদি কাটবে না; বরং তা কুরবানীর দিন কাটবে।
৪। অধিক পরিমাণে তাসবীহ (সুবহানাল্লাহ) তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ) তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) ও তাকবীর (আল্লাহু আকবার) পাঠ করা।
১। ঈদের দিন ছাড়া বাকি নয় দিন রোযা রাখা।
২। বিশেষভাবে নয় তারিখের রোযা রাখা।
৩। চুল, নখ, মোচ ইত্যাদি না কাটা। এটি মুস্তাহাব। যে ব্যক্তি কুরবানী করতে সক্ষম নয় সেও এ আমল পালন করবে। অর্থাৎ নিজের চুল, নখ, গোঁফ ইত্যাদি কাটবে না; বরং তা কুরবানীর দিন কাটবে।
৪। অধিক পরিমাণে তাসবীহ (সুবহানাল্লাহ) তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ) তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) ও তাকবীর (আল্লাহু আকবার) পাঠ করা।
শেষকথা:
মানুষের জীবন কিছু সময়ের সমষ্টির নাম। সে সময়ের প্রতিটি অংশই মূল্যবান। কোনো অংশই অবহেলা করার মতো নয়। সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর দ্বারাই সফলতা অর্জন করা সম্ভব হয়। এটা যেমন পার্থিব জীবনের ক্ষেত্রে সত্য, তেমনি সত্য আখিরাতের জীবনের ক্ষেত্রেও। সুতরাং বুঝা গেল- আমাদের জীবনের প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত অনেক মূল্যবান। সেগুলোকে অবহেলা করে নষ্ট করার মত নয় কখনোই। মহান আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে বুঝার তাওফিক দান করুন এবং এ সময়গুলোর যথাযথ মূল্যায়ন করার তাওফিক দান করুন। আল্লাহুম্মা আমীন
পুনশ্চ: সঙ্গত কারণেই এখানে হজ্জ, কুরবানী ও আইয়্যামে তাশরীকের আমলের কথা উল্লেখ করা হয়নি।
দ্বিতীয়ত: সময় স্বল্পতার কারণে প্রতিটি বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনাও আনা সম্ভব হয়নি বা ইচ্ছাও করেনি। বরং সংক্ষিপ্ততার প্রতি লক্ষ্য রেখেছি।
তৃতীয়ত: আমার এ লেখার উদ্দেশ্য কেবল কিছু আমলের কথা ভাইদেরকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া। যদি কোন একজন ভাইও আমল করেন, তাহলে আমার এ লেখা স্বার্থক মনে করব। আর আমার এ লেখায় কোন ভুল-ভ্রান্তি কারো নিকট পরিলক্ষিত হলে অবগত করানোর বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি। ইনশা আল্লাহ, আপনার নিকট কৃতজ্ঞ থাকব।
সবার নিকট খাছ দু‘আর দরখাস্ত।
ওয়াসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।
**************************************************
Comment